লেখকঃ উস্তাদ আলী হাম্মুদা, মোহাম্মাদ ফারিস| সম্পাদনা ও সংযোজনঃ মুওয়াহহিদ মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ
প্রত্যেক বছর অস্বাস্থকর খাদ্যাভ্যাস ত্যাগ এবং পরিপাকতন্ত্রকে বিশ্রামের সুযােগ দেয়ার মাধ্যমে পবিত্র রামাদান আমাদের সুস্বাস্থ্য লাভের সুযােগ করে দেয়। এই পবিত্র মাসে সাওম পালন, রাত্রিকালীন সালাত এবং পবিত্র কুরআন পড়ার মাধ্যমে আমরা পাই সামগ্রিক সুস্বাস্থ্য ও আত্মার পরিতৃপ্তি।
তবে এখন যেহেতু বরকতময় রামাদান পার হয়ে গেছে এবং ঈদ-উল-ফিতরের অনুষ্ঠানাদিও শেষ হয়েছে, নিচের নয়টি টিপস আপনাকে সাহায্য করবে অভাবনীয় স্বাস্থসুফল পেতে এবং ভালাে অভ্যাস মেনে চলতে যা আপনি রামাদানে, কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে অর্জন করেছেন।
(১) সপ্তাহে দুইদিন সাওম পালন করুন
রামাদানের পর চেষ্টা করুন সপ্তাহে দুইদিন সাওম পালন করতে। বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেখা গেছে যে, ‘ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং’ অর্থাৎ মাঝে বিরতি দিয়ে দীর্ঘক্ষণ না খেয়ে থাকা শরীর এবং মনের জন্য উপকারি। পরীক্ষায় দেখা গেছে, এ ধরনের ফাস্টিং শরীরের পরিশােধন প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে। অর্থাৎ, মৃত এবং ক্ষতিগ্রস্থ কোষ থেকে শরীরে যে বর্জ্য জমা হয় তা দ্রুত পরিষ্কার করে। বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন, শরীর যদি এই বর্জ্যগুলাে নিয়মিত বের করে দিতে না পারে তবে, নানা ধরনের দীর্ঘমেয়াদী অসুখ বিসুখ হয়। বিশেষ করে যেসব রােগ বয়সবৃদ্ধির সাথে সম্পর্কিত। যেমনঃ ক্যান্সার, ডায়বেটিস ও হৃদরােগ।
এছাড়াও সাওম থেকে অনেক শারীরিক এবং মানসিক সুফল পাওয়া যায়। যেমন স্মৃতিশক্তির উন্নতি, ভালাে ঘুম, মনােযােগ এবং শক্তি বৃদ্ধি পাওয়া। পাশাপাশি মাঝে মাঝে সাওম পালনের ফলে স্নায়ুকোষের কার্যকারিতা ও বিকাশ ত্বরান্বিত
রাসূল-এর সুন্নাহ মেনে চলার জন্য সােমবার এবং বৃহস্পতিবার সাওম পালন করতে চেষ্টা করুন।
আবু হুরায়রা (রা:) থেকে বর্ণিত, রাসূল বলেছেন, “সােমবার এবং বৃহস্পতিবার আমলনামাগুলাে পেশ করা হয়, আর আমি এটা পছন্দ করি যে যখন আমার আমলনামা পেশ করা হবেতখনআমিসাওমরত অবস্থায় থাকবাে এবং অবশ্যই চেষ্টা করুন, শাওয়ালের ছয়টি সাওম পালনকরতে। যার আখিরাতে অনেক ফজিলত রয়েছে।” [1]
আবু আইয়ুব আল-আনসারী (রা:) থেকে বর্ণিত, রাসূল বলেছেন, “যে ব্যক্তি পুরাে রামাদান এবং তারপর শাওয়ালের ৬ দিন সাওম পালন করল, সে যেন পুরাে এক বছর সাওম পালন করল।” [2]
(২) দিনে দুই থেকে তিনবার খাবার খান
প্রতিদিন অল্প অল্প করে ছয়বার খাবার পরিবর্তে, দুই থেকে তিনবার খাবার অভ্যাস করুন (যেমনটা রামাদানে করা হয়। প্রচলিত ধারণার বিপরীতে, দু খাবারের মাঝখানে ক্ষুধার অনুভূতি আসলে শরীরের জন্য অনেক উপকারী। প্লাস ওয়ানে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, ক্ষুধার অনুভূতি আলঝেইমারস রােগকে প্রতিরােধ করে। এছাড়া এই ক্ষুধার অনুভূতির আধ্যাত্মিক সুফলও রয়েছে।
ইবরাহিম ইবনু আদহাম বলেনঃ “যে নিজের পেটকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে সেই নিজের দ্বীনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। আর যে নিজের ক্ষুধাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে, সে বজায় রাখতে পারে উত্তম আখলাক। যার পেট ভর্তি থাকে সে হল, আল্লাহর অবাধ্যতার সর্বাধিক নিকটবর্তী। অপরদিকে যে ক্ষুধার্ত, সে আল্লাহর অবাধ্যতা থেকে সর্বাধিক দূরবর্তী।”
(৩) শুকনো ফল খান
দীর্ঘ সময় কাজের ফাঁকে চকলেট কিংবা মচমচে কিছু খেতে কার না মন চায়! কিন্তু এর পরিবর্তে শুকনাে ফল খেলে কেমন হয়??
শুকনাে খেজুর এবং ত্বীনফলে রয়েছে প্রচুর আয়রন, ফাইবার এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যা বয়সের সাথে বৃদ্ধি পাওয়া ক্ষতিকারক ফ্রি রেডিকেল থেকে আমাদের রক্ষা করে। যদি আপনি মিষ্টি পছন্দ করেন আর খাবার পর মিষ্টি কিছু খেলেই নয় তবে, ভারী ও পুষ্টিহীন চকলেট কেক এর পরিবর্তে তিনটি খেজুর খান।
আল্লাহর রাসূল (ﷺ) বলেছেন, “আজওয়া(খেজুর) হলাে জান্নাতের ফল এবং এতে বিষক্রিয়ার প্রতিকার রয়েছে।” [3]
(৪) ৮০/২০ এর নিয়ম
৮০/২০ এর নিয়ম মেনে চলুন এবং কেবলমাত্র ৮০% পেট ভরা পর্যন্ত খানা এজন্য ধীরে ধীরে খান, ফলে পেট কতটুকু ভর্তি হল, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে পারবেন। অবশ্যই, চলতে চলতে খাওয়া অথবা কাজ করতে করতে খাওয়া, অতিরিক্ত খাওয়ার কারণ, যা আপনার শরীরের হজমক্রিয়াকে ব্যাহত করে।
রামাদানে সাওম পালনের মাধ্যমে আপনি ভালভাবে বুঝতে পারবেন, কখন আপনার ক্ষুধা লাগছে আর কখন আপনার পেট ভরেছে। সুতরাং পুনরায় বেহিসাবি খাওয়ার অভ্যাসে ফেরত যাবেন না। আর অবশ্যই, অতিরিক্ত খাওয়ার ব্যাপারে সতর্ক থাকবেন।
রাসূল বলেছেন, “যারা এই দুনিয়াতে সবচেয়ে বেশি খায়, তারা হাশরের দিন সবচেয়ে বেশি ক্ষুধার্ত থাকবে।” [4]
(৫) মেনে চলুন এক-তৃতীয়াংশের নিয়ম
খাবারে কী খাবেন সে ব্যাপারে সতর্ক পরিকল্পনার জন্য রামাদান ছিল একটি চমৎকার সুযােগ। রামাদানে আমরা চেষ্টা করেছি এমন কিছু খেতে – যা খেলে ইফতারের পর ক্লান্তি ভর করে না এবং তারাবির সালাত আদায় সহজ হয়। রামাদান শেষ হয়ে যাওয়ার পরও আমাদের উচিত একইভাবে খাওয়া, যাতে দুপুরে খাবার পর ক্লান্তি না আসে। এজন্য এক-তৃতীয়াংশের নিয়ম মেনে চলুন, যা আপনার শক্তি বৃদ্ধি করবে। আর, ভারী খাবার খাওয়ার কারণে মাথা ভার হবে না।
রাসূল (ﷺ) বলেছেন, “মানুষ এমন কোন পাত্র পূর্ণ করেনি যা পেটের চাইতে মন্দ। সামান্য খাবারই যথেষ্ট আদম সন্তানের জন্য, তার পিঠ কে সােজা রাখবে। কিন্তু তারপরেও যদি তােমরা বেশি খেতে চাও তবে পেটের এক-তৃতীয়াংশ খাবারের জন্য, এক তৃতীয়াংশ পানির জন্য, আর এক-তৃতীয়াংশ শূন্য রাখবে।” [5]
(৬) পরিপাকতন্তের সুস্বাস্থ্য বজায় রাখতে প্রােবায়ােটিক সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করুন
রামাদানে দীর্ঘ সময় না খেয়ে থাকার পর এবং ঈদ উদযাপনের অংশ হিসেবে অতিরিক্ত মিষ্টি খাওয়ার ফলে পরিপাকতন্ত্রের উপর দিয়ে বেশ ধকল যায়। আপনার প্রতিদিনকার খাদ্যতালিকায় প্রােবায়ােটিক সাপ্লিমেন্ট যােগ করুন। এর ফলে অন্ত্রে উপকারী ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। পরীক্ষায় দেখা গেছে, প্রােবায়ােটিক ঠাণ্ডা এবং অন্যান্য সংক্রমণ প্রতিরােধ করে। এছাড়া এটি নারীদের স্বাস্থ্য ও মেটাবলিজমের উন্নতি সাধন করে। প্রােবায়ােটিক সাপ্লিমেন্ট খাওয়ার পূর্বে আপনার চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করে খেলে ভাল হবে। টক দই, আচার ইত্যাদি খাবারও খেতে পারেন।
(৭) মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নিন
মানসিক স্বাস্থ্যকে অবহেলা করবেন না; সব সময় একে শক্তিশালী করতে চেষ্টা করুন। রামাদান শেষ হওয়ার পরে যে বিষয়গুলাে আমরা মিস করি তার মধ্যে একটি হল, ভালাে থাকার ও সন্তুষ্ট হওয়ার অনুভূতি। এই অনুভূতি আমরা পাই দিন-রাত নিয়ম করে দুআ, রাতের সালাত ও পবিত্র কুরআন তিলাওয়াতের মাধ্যমে। গবেষকরা দেখেছেন, যারা দুশ্চিন্তা, ভীতি ও আসক্তির মত সমস্যায় আক্রান্ত, তাদের জন্য মেডিটেশন, ওষুধ হিসেবে কাজ করে। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে, এক মাস আধ্যাত্মিকতার সাথে মনকে পরিষ্কার করার কারণে মনের ক্ষয়পূরণ হয় ও তা শান্ত হয়।
মানসিক সুস্বাস্থ্য লাভের একটা উপায় হলাে ফজরের ১০ থেকে ২০ মিনিট আগে ঘুম থেকে উঠে তাহাজ্জুদের সালাত আদায় করা এবং দুআ করা।
আবু হুরায়রা(রা:) থেকে বর্ণিত রাসূল (ﷺ) বলেছেন, “আমাদের রব প্রত্যেক রাতে দুনিয়ার আসমানে অবতরণ করেন যখন রাতের এক তৃতীয়াংশ বাকি থাকে। তিনি বলেন কে আমাকে আহ্বান করবে আমি তার ডাকে সাড়া দিবাে; কে আমার নিকট প্রার্থনা করবে আমি তাকে প্রদান করবাে; কে আমার নিকট ক্ষমা চাইবে আমি তাকে ক্ষমা করব।” [6]
এছাড়াও কুরআন তিলাওয়াত এবং আল্লাহর যিকর করাকে আপনার দৈনন্দিন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ বানিয়ে নিন।
(৮) সাদাকা অব্যাহত রাখুন
নিয়মিত সাদাকা করার পুরস্কার হিসেবে আপনি মানসিক প্রশান্তি লাভ করবেন। যদি কোন দরিদ্র পরিবারকে রামাদানে সাহায্য করে থাকেন তবে, রামাদানের পরও এই সাহায্য অব্যাহত রাখুন। এই যে সাদাকা, তা হতে পারে টাকা দিয়ে, দক্ষতা দিয়ে কিংবা সময় দিয়ে- এর অনেক পুরস্কার রয়েছে, কেবল আখিরাতেই নয় বরং এই দুনিয়াতেও। দেখা যায় ছােট থেকে বড় যেকোনাে সাদাকা, যেমন সমাজের ভালাে কোন কাজে স্বেচ্ছাকর্মী হিসেবে কাজ করা আপনাকে করে প্রসন্ন ও সন্তুষ্টচিত্ত।
“যারা আল্লাহর রাস্তায় নিজেদের ধন সম্পদ ব্যয় করে, তাদের উদাহরণ একটি বীজের মত, যা থেকে সাতটি শীষ জন্মায়। প্রত্যেকটি শীষে একশ করে দানা থাকে। আল্লাহ অতি দানশীল, সর্বজ্ঞ।” [7]
(৯) ধূমপান পরিহার করুন এবং ব্যায়ামকে প্রাধান্য দিন
যারা ধুমপান ত্যাগ করতে চান, তাদের জন্য রামাদান একটি আদর্শ সময়। শুরুতে ক্রমান্বয়ে ধূমপান কমান এবং পরিশেষে এই অভ্যাসকে সম্পূর্ণরূপে দমন করুন। রামাদানের পর, খাবারের পর একটি সিগারেট খাওয়ার প্রলােভনকে প্রশ্রয় দিবেন না। এই আসক্তি-সৃষ্টিকারী এবং ক্ষতিকর অভ্যাসের পরিবর্তে এমন কিছু করুন যা স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী, যেমন ব্যায়াম।
ভালাে খাদ্যাভ্যাস এবং ব্যায়ামের অভ্যাস ধরে রাখার জন্য নিজেকে সব সময় উৎসাহ ও বাহবা দিন। এজন্য ব্যায়ামের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট সময়সূচি মেনে চলুন।
রামাদানের পরেও সুস্থ থাকার উপায় ব্যায়াম করার সময় আপনার শরীর এনডরফিন, সেরােটোনিন ও ডােপামিন নিঃসরণ করে। ফলে আপনার মেজাজ ভালাে থাকে এবং আপনি সুস্থ, কর্মক্ষম ও শক্তিশালী বােধ করেন।
রাসূল (ﷺ) বলেছেন, “দুটো নিয়ামত সম্পর্কে অনেক মানুষ ধোঁকায় থাকে। সেগুলাে হলাে সুস্থতা ও অবসর।” [8]
পরিশেষে মনে রাখবেন, জীবনের সকল ক্ষেত্রে প্রােডাক্টিভিটি বাড়ানাের জন্য সুস্বাস্থ্যের দরকার। আপনার স্বাস্থ্যকে অগ্রাধিকার দিন, একে নিয়ামত হিসেবে বিবেচনা করুন। এর ফলে আপনি অভাবনীয় সুফল দেখতে পাবেন, ইন শা আল্লাহ। আল্লাহ
আমাদের সবাইকে প্রােডাক্টিভ মুসলিম হওয়ার তাউফিক দান করুন, রামাদানে এবং রামাদানের পরেও আমরা যেন আমাদের জীবনটাকে ইসলামের আলােয় প্রােডাক্টিভভাবে অতিবাহিত করে আমাদের স্থায়ী গন্তব্য জান্নাতে আমাদের স্থান পাকাপােক্ত করতে পারি। ওয়ামা তাউফিকি ইল্লা বিল্লাহ। আমিন!!
উৎসঃ প্রোডাক্টিভ রামাদান, পৃষ্ঠা: ১৮৮ – ১৯৩
[1] তিরমিবি, হাসি-ক্রম: ৭৪৭
[2] মুসলিম, হাদিস-ক্ৰম; ১১৬৪, আবু দাউদ, হাদিস-ক্রম : ২৪৩৩
[3] রিমিযি, হাদিস-ক্রম: ২০৬৬
[4] আল জামিউস সাগির, হাদিস-ক্রম ; ২১১
[5] ইবনু মাজাহ, হাদিস-ক্রম: ৩৩৪১; তিরমিযি, হাদিস-ক্রম: ২৩৮০
[6] বুখারি, হাদিস-ক্রম : ১১৪৫; মুসলিম, হাদিস-ক্রম : ৭৫৮
[7] সূরা বাকারাহ, আয়াত-ক্ৰম : ২৬১
[8] বুখারি, হাদিস-ক্রম: ৬৪১২
'আপনিও হোন ইসলামের প্রচারক'
প্রবন্ধের লেখা অপরিবর্তন রেখে এবং উৎস উল্লেখ্য করে আপনি Facebook, Whatsapp, Telegram, ব্লগ, আপনার বন্ধুদের Email Address সহ অন্য Social Networking ওয়েবসাইটে শেয়ার করতে পারেন, মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিন। ইসলামি দা’ওয়াহ্র ৮০ টিরও বেশী উপায়! বিস্তারিত জানতে এইখানে ক্লিক করুন "কেউ হেদায়েতের দিকে আহবান করলে যতজন তার অনুসরণ করবে প্রত্যেকের সমান সওয়াবের অধিকারী সে হবে, তবে যারা অনুসরণ করেছে তাদের সওয়াবে কোন কমতি হবেনা" [সহীহ্ মুসলিম: ২৬৭৪]