লেখক: ড. খালিদ আবু শাদি | অনুবাদক: হাসান মাসরুর
১. আজকের আলোচ্য বিষয়ের ফায়দা
-
প্রতিবেশীর প্রতি অনুগ্রহে রয়েছে পরিপূর্ণ ইমান:
আবু শুরাইহ (রা:) থেকে বর্ণিত, নবিজি (সা:) বলেন: ‘আল্লাহর শপথ, সে ইমান আনেনি। আল্লাহর শপথ, সে ইমান আনেনি। আল্লাহর শপথ, সে ইমান আনেনি।’ বলা হলো, ‘কে, হে আল্লাহর রাসুল!’ তিনি বললেন, ‘যার অত্যাচার থেকে তার প্রতিবেশী নিরাপদ নয়।’ [সহিহুল বুখারি : ৬০১৬]
সহিহ বুখারির অপর হাদিসে বর্ণিত হয়েছে: ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও আখিরাত দিবসের প্রতি বিশ্বাস রাখে, সে যেন নিজের প্রতিবেশীকে কষ্ট না দেয়।‘ [সহিহুল বুখারি: ৬০১৮]
-
জান্নাতে প্রবেশ:
আবু হুরাইরা (রা:) থেকে বর্ণিত, নবিজি (সা:) বলেন: ‘যার প্রতিবেশী তার অনিষ্টতা থেকে নিরাপদ নয়, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’ [সহিহু মুসলিম: ৪৬]
প্রতিবেশীকে কষ্ট প্রদান জাহান্নামে প্রবেশের কারণ: ‘নবিজি (সা:)-কে বলা হলো, “আল্লাহর রাসুল, অমুক মহিলা রাতে সালাত আদায় করে, দিনে রোজা রাখে, নেক আমল করে এবং সদাকা করে; কিন্তু সে জবান দিয়ে প্রতিবেশীকে কষ্ট দেয়!” রাসুল (সা:) বললেন, “তার মাঝে কোনো কল্যাণ নেই। সে জাহান্নামিদের অন্তর্ভুক্ত।” সাহাবিগণ বললেন, “আর অমুক মহিলা ফরজ সালাত আদায় করে এবং সম্পদের সদাকা দেয় এবং কাউকে কষ্ট দেয় না ।” তখন রাসুল (সা:) বললেন, “সে জান্নাতিদের অন্তর্ভুক্ত।‘ [আল-আদাবুল মুফরাদ: ১১৯]
ইমাম আহমাদ (রা:) এভাবে উল্লেখ করেছেন, ‘সে তার জবানের মাধ্যমে প্রতিবেশীকে কষ্ট দেয় না৷’
-
শ্রেষ্ঠত্বের ব্যাপারে নবিজি (সা:)-এর সাক্ষ্য:
নবিজি (সা:) বলেন: ‘আল্লাহর নিকট সর্বোত্তম সঙ্গী সে, যে তার সঙ্গীর কাছে সর্বোত্তম । আল্লাহর নিকট সেই প্রতিবেশী সর্বোত্তম, যে তার প্রতিবেশীর কাছে সর্বোত্তম।‘ [সুনানুত তিরমিজি: ১৯৪৪]
২. কুরআনের আলো
আল্লাহ তাআলা সম্পর্কের হক আলোচনায় বলেন: “তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো, তাঁর সাথে কোনো কিছু শরিক করো না; পিতামাতার সাথে সদ্ব্যবহার করো এবং আত্মীয়, এতিম, মিসকিন, কাছের প্রতিবেশী, দূরের প্রতিবেশী, ঘনিষ্ঠ সহচর, পথিকজন ও তোমাদের দাসদাসীর সাথেও (সদ্ব্যবহার করো)। আল্লাহ কখনো দাম্ভিক ও বড়াইকারীকে পছন্দ করেন না।” [সুরা আন-নিসা ৪ : ৩৬]
আল্লাহ তাআলা এখানে বলেছেন, কাছের প্রতিবেশী।’ এরা হলেন সে প্রতিবেশী, যাদের সাথে আপনার আত্মীয়তার সম্পর্ক আছে। কেউ কেউ বলেন, ‘সে হলো ওই ব্যক্তি, যার সান্নিধ্য কাছাকাছি ।’ আবার কেউ বলেন, ‘এখানে উদ্দেশ্য হলো স্ত্রী।’
আর আল্লাহ তাআলা আয়াতে দূরের প্রতিবেশী’ দ্বারা বুঝিয়েছেন সে প্রতিবেশীকে, পরিভাষায় যাকে প্রতিবেশী মনে করা হয় এবং আপনার ও তার বাড়ির মাঝে খালি জায়গাও রয়েছে। আবার কেউ কেউ বলেন, ‘সে হলো ওই প্রতিবেশী, যার ও আপনার মাঝে কোনো আত্মীয়তা নেই।’ আবার কারও মত হলো, ‘সে হলো অমুসলিম ।’
৩. রাসুল (সা:) আমাদের আদর্শ
- আবু হুরাইরা (রা:) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: ‘একদা এক ব্যক্তি নবিজি -এর নিকট এসে তার প্রতিবেশীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করলে তিনি বললেন, “যাও ! ধৈর্য ধরো।” অতঃপর সে দুই বা তিনবার এভাবে এসে অভিযোগ করলে তিনি বললেন, “তুমি গিয়ে তোমার জিনিসপত্র রাস্তায় ফেলে রাখো।” অতঃপর সে তার জিনিসপত্র রাস্তায় ফেলে রাখলে লোকেরা তাকে এ ব্যাপারে প্রশ্ন করতে লাগল এবং সে তাদেরকে তার প্রতিবেশীর খবর জানাতে থাকল। লোকেরা তাকে অভিশাপ দিতে লাগল, আল্লাহ তার এরূপ এরূপ করুন । তখন প্রতিবেশী তার নিকট এসে বলল, “তুমি ফিরে যাও। ভবিষ্যতে তুমি আমার পক্ষ হতে এরূপ কিছুর পুনরাবৃত্তি দেখবে না।‘ [সুনানু আবি দাউদ: ৫১৫৩]
- নবিজি (সা:) নারীদেরকে উপদেশ দিয়ে বলেন:‘হে মুসলিম নারীগণ, কোনো প্রতিবেশিনী যেন অপর প্রতিবেশিনীর হাদিয়াকে তুচ্ছ মনে না করে; যদিও তা ছাগলের সামান্য গোশতযুক্ত হাড় হোক।‘ [সহিহুল বুখারি: ২৫৬৬, সহিহু মুসলিম: ১০৩০ ]
এখানে গোশতযুক্ত হাড় দ্বারা ছাগলের ক্ষুরা উদ্দেশ্য করা হয়েছে। হাদিসের অর্থ হলো, যদি কোনো প্রতিবেশী মহিলা অপর কোনো মহিলাকে কোনো জিনিস হাদিয়া দেয়, তাহলে তা তুচ্ছ জ্ঞান করবে না; যদিও হাদিয়া দেওয়া এই জিনিসটি থেকে অনেক সময় উপকৃত হওয়া যায় না। মোটকথা হাদিসটি থেকে দুটি ফায়দা গ্রহণ করা যায়:
১. কোনো মহিলা যদি তার প্রতিবেশী মহিলাকে কিছু হাদিয়া দেয়, তাহলে তা তুচ্ছ মনে করবে না; যদিও তা সামান্য জিনিস হোক।
২. যে মহিলার কাছে কোনো জিনিস হাদিয়া পাঠানো হয়েছে, সে হাদিয়ার জিনিসটিকে তুচ্ছ মনে করবে না; যদিও তা কম হয় বা হালকা জিনিস হয় ৷
এখানে নারীদেরকে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে কয়েকটি কারণে। এখানে কিছু কারণ উল্লেখ করা হলো:
১. নারীরা অধিক পরিমাণে হাদিয়ার জিনিস নিয়ে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে থাকে ৷
২. পুরুষদের তুলনায় প্রতিবেশীদের সাথে নারীদের বেশি সম্পর্ক থাকে । কারণ, নারীরা বাড়িতে সব সময় অবস্থান করে ৷
৩. বাড়িতে ভালোবাসা বা শত্রুতার মূলভিত্তি হলো নারী।
৪. অমূল্য বাণী
- হাসান বসরি (রা:) বলেন, ‘কষ্ট প্রদান থেকে বিরত থাকা ব্যক্তি উত্তমপ্রতিবেশী নয়; বরং উত্তম প্রতিবেশী হলো যে কষ্টে সবর করে।’
- ইবনুল আরাবি (রা:) ‘জামিউ আহকামিল কুরআন’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন, ‘প্রতিবেশীর সম্মান রক্ষা ইসলামের জমানার ন্যায় জাহিলি যুগেও খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় ছিল। এটি যৌক্তিক, শরিয়াহসম্মত, মানবিক ও ধর্ম-বিশ্বাসের অন্তর্ভুক্ত। নবিজি (সা:) বলেন: ‘জিবরাইল (রা:) আমাকে প্রতিবেশীর ব্যাপারে উপদেশ দিতে থাকলেন। এমনকি আমার কাছে মনে হলো যে, অচিরেই প্রতিবেশীকে উত্তরাধিকারীর অন্তর্ভুক্ত করে দেবেন।’ [সহিহুল বুখারি: ৬০১৪, সহিহু মুসলিম: ২৬২৪]
৫. একটি চমৎকার কাহিনি
- আরবরা উত্তম প্রতিবেশীর দৃষ্টান্ত দিতে গিয়ে আবু দাউদের প্রতিবেশীর দৃষ্টান্ত দিত। এই প্রতিবেশীর নাম ছিল কাব বিন মামাহ। তারা উত্তম প্রতিবেশীকে তার সাথে তুলনা করে বলত, আবু দাউদের প্রতিবেশীর মতো প্রতিবেশী। কারণ, যখন কেউ কাবের প্রতিবেশিত্ব গ্রহণ করে মৃত্যুবরণ করত, তখন তিনি তার পরিবারকে রক্তপণের মূল্য পরিশোধ করে দিতেন। আর যদি প্রতিবেশীর কোনো উট বা ভেড়া মরে যেত, তাহলে তিনি তা কিনে দিতেন। ফলে তার কাছে এসে কবি আবু দাউদ প্রতিবেশিত্ব গ্রহণ করলেন। কাব তার সাথেও একই আচরণ করেন। ফলে আরবরা উত্তম প্রতিবেশীকে তার সাথে তুলনা করত। তারা বলত, আবু দাউদের প্রতিবেশীর মতো প্রতিবেশী।
৬. রমাদানে প্রতিবেশীর সাথে উত্তম আচরণ
- ইফতারের জন্য তাকে দাওয়াত করা ৷
- রমাদানের আগমনে তাকে অভিনন্দন জানানো ।
- তার সাথে মিলে তারাবিহের সালাত আদায় করা ।
- ফজরের সালাতের জন্য তার সাথে সাক্ষাৎ করা ।
এখানকার প্রতিটি কাজই আপনার জন্য একেকটি সুযোগ। যেন পানি তার নালায় ফিরে আসে এবং রমাদানে প্রতিবেশীদের হৃদয় বিগলিত হয়। ভালোবাসায় তাদের অন্তর পরিপূর্ণ হয়। সুতরাং কেন আপনি এমন সুযোগকে গনিমত মনে করবেন না?!
৭. প্রতিবেশীর সাথে উত্তম আচরণের সূর্য ডুবে গেছে
প্রতিবেশীকে কষ্ট প্রদানের বিষয়টি ছড়িয়ে পড়েছে। আর তা এভাবে:
• সামান্য অজুহাতে প্রতিবেশীর সাথে ঝগড়া-বিবাদে জড়ানো।
- স্বার্থপরতা, আত্মম্ভরিতা এবং সামাজিক স্বার্থের ওপর ব্যক্তিগত স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়া।
- প্রতিবেশীর আনন্দে শরিক না হওয়া এবং তার বেদনায় সান্ত্বনা প্রদান থেকে বিরত থাকা।
- তার বাড়ির সামনে গাড়ি থামিয়ে রাখা; যেন তার বাড়িতে প্রবেশ বা বের হওয়ার ক্ষেত্রে তার জন্য সংকীর্ণতা তৈরি হয়।
- প্রতিবেশীর বাড়ির সামনে পানি ফেলা; যেন তার ঘরে প্রবেশ বা বের হওয়া কঠিন হয়ে যায়।
- প্রতিবেশীকে সংকীর্ণতায় ফেলে রাখা তাদের বাড়ির সামনে দেয়াল ইত্যাদি প্রতিবন্ধকের মাধ্যমে।
- তার দরজার সামনে ময়লা-আবর্জনা ফেলে রাখা। ইবনে উমর (রা:) থেকেবর্ণিত, তিনি বলেন, ‘এমন একটি কাল আমরা অতিবাহিত করেছি, যখন কারও নিকট তার মুসলিম ভাইয়ের চেয়ে তার দিনার ও দিরহামের উপযুক্ত প্রাপক আর কেউ ছিল না। আর এখন এমন যুগ এসেছে, যখন দিনার ও দিরহামই আমাদের কারও নিকট তার মুসলিম ভাইয়ের চেয়ে অধিক প্রিয় । আমি নবিজি (সা:)-কে বলতে শুনেছি: ‘অনেক প্রতিবেশী কিয়ামতের দিন তার প্রতিবেশীকে অভিযুক্ত করে বলবে, “হে আমার প্রতিপালক, এই ব্যক্তি আমার জন্য তার দ্বার রুদ্ধ করে রেখেছিল এবং আমাকে তার সদাচরণ থেকে বঞ্চিত করেছিল।‘ [আল-আদাবুল মুফরাদ: ১১১]
৮. দুআ
নবিজির (সা:) এই দুআ করতেন: ‘হে আল্লাহ, আমি আপনার নিকট স্থায়ী আবাসস্থলে দুষ্ট প্রতিবেশী থেকে আশ্রয় চাই । কেননা, মরুভূমির প্রতিবেশী তো প্রস্থান করবে।‘ [মুসতাদরাকুল হাকিম: ১৯৫১]
৯. স্বার্থপর হবেন না
- কথাগুলো আপনার মসজিদের মুসল্লি ও আপনার সহপাঠী-সহকর্মীদের মাঝে আলোচনা করুন।
- এই বইটি নিজে পাঠ করে অন্যদেরকেও পড়তে দিন; যেন তারা এর থেকে উপকৃত হতে পারে।
- মসজিদের ইমামকেও বইটি হাদিয়া দিতে পারেন; যেন তিনি জুমআর খুতবা বা তারাবিহ-পরবর্তী আলোচনায় এর থেকে ফায়দা গ্রহণ করতে পারেন।
১০. যথেষ্ট কথা হয়েছে, এখন আমল দেখার বিষয়
- প্রতিবেশীর জন্য সংকীর্ণতা তৈরি করবে, এমন কোনো জিনিসের মাধ্যমে তাকে কষ্ট দেবেন না ।
- আপনার খাবারে প্রতিবেশীকে শরিক করে তার প্রতি খেয়াল রাখুন এবং নবিজি -এর এই হাদিসের প্রতি খেয়াল রাখুন: ‘হে আবু জার, যখন তুমি তরকারি রান্না করবে, তখন তাতে পানি বেশি দিয়ো এবং তোমার প্রতিবেশীকে কিছু প্রদান কোরো।‘ [সহিহু মুসলিম: ২৬২৫]
- তাকে নিজের সাথে ইফতারের দাওয়াত করুন এবং তারাবিহের সালাতে নিজের প্রিয় শাইখের কাছে নিয়ে যান ৷
- প্রতিবেশীর বাচ্চাদের মন ও তাদের অভিভাবকের মন আকৃষ্ট করতে তাদেরকে হাদিয়া দিন।
উৎস: রমাদান-আত্মশুদ্ধির বিপ্লব, পৃষ্ঠা: ৩৬ – ৪৪
'আপনিও হোন ইসলামের প্রচারক'
প্রবন্ধের লেখা অপরিবর্তন রেখে এবং উৎস উল্লেখ্য করে আপনি Facebook, Whatsapp, Telegram, ব্লগ, আপনার বন্ধুদের Email Address সহ অন্য Social Networking ওয়েবসাইটে শেয়ার করতে পারেন, মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিন। ইসলামি দা’ওয়াহ্র ৮০ টিরও বেশী উপায়! বিস্তারিত জানতে এইখানে ক্লিক করুন "কেউ হেদায়েতের দিকে আহবান করলে যতজন তার অনুসরণ করবে প্রত্যেকের সমান সওয়াবের অধিকারী সে হবে, তবে যারা অনুসরণ করেছে তাদের সওয়াবে কোন কমতি হবেনা" [সহীহ্ মুসলিম: ২৬৭৪]