Home Blog Page 57

ডাউনলোড করুন লাব্বায়াক গ্রুপের সকল নাশীদ

Labbayk is a nasheed group based in London, UK.  The nasheeds composed have no musical instruments and no musical instruments were utilised in composing the vocal harmonies. The group is represented by Safar Media based in Gloucestershire, UK. 

আপনি নাশিদ গুলো বিভিন্ন ইসলামী অনুষ্ঠান অথবা বিয়েতে প্লে করতে পারেন।

Caution: Please do not make a habit of listening Nasheed all the time. It should not take up your time and affects your duties and mustahabb actions, such as affecting reading of Qur’aan and calling others to Allaah.

The Greatest Gift – 2012

The Greatest Gift - CD Cover and CD
[starlist]

[/starlist]

 সকল ফাইল এক সাথে ডাউনলোড করুন 

QuranerAlo Server | Mediafire

[divider]

Rhymes of Praise – 2011

ROP CD Cover

[starlist]

[/starlist]

 সকল ফাইল এক সাথে ডাউনলোড করুন 

QuranerAlo Server | Mediafire

[divider]

O My Lord – 2010

[starlist]

[/starlist]

 সকল ফাইল এক সাথে ডাউনলোড করুন 

QuranerAlo Server | Mediafire

এ্যালবাম গুলো কিনতে চাইলে এই লিংক থেকে কিনতে পারবেন।

আরও ইংলিশ/আরবি নাশীদ ডাউনলোড করতে এইখানে ক্লিক করুন।

দাওয়ার কাজ চালিয়ে যেতে হবে

1519895_580969861982593_99911990_o
বড় করে দেখতে ছবির উপর ক্লিক করুন

হতাশ হওয়া যাবে না, এবং দাওয়ার কাজ চালিয়ে যেতে হবে…

ইসলামী দাওাহ বিষয়ে আরও প্রবন্ধ পড়তে এই লিংকে ক্লিক করুন – http://www.quraneralo.org/category/topic/dawat/

বুধবার দুপুরে ছায়াশূন্য থাকবে কাবা শরীফ

kaaba_sun

মহাকাশ বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, ২৮ মে ২০১৪ দুপুর নাগাদ মক্কার পবিত্র কাবা শরীফের সঙ্গে সরাসরি একই লাইনে অবস্থান করবে সূর্য। সূর্যের কেন্দ্রবিন্দুটি এই কাবার ঠিক ওপরে উঠে আসবে। জেদ্দা অ্যাস্ট্রোনোমিক্যাল সোসাইটি এক বিবৃতিতে এই কথা জানিয়েছে।

তারা জানিয়েছেন, মক্কানগরীতে বুধবার ভোর ৫টা ৩৮ মিনিটে সূর্যোদয় হবে। উত্তরপূর্ব দিকটি থেকে সূর্য ধীরে ধীরে উপরে উঠতে শুরু করবে এবং দূপুর ১২টা ১৫ মিনিটে তা ঠিক কাবা শরীফের মাথার ওপর উঠে আসবে। আর সে কারণে সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য হলেও পবিত্র এই মসজিদ ঘরের কোনো দিকে কোনো ছায়া থাকবে না। সূর্যের এই অবস্থানকে ‘ছায়াশূন্য’ (জিরো শ্যাডো) অবস্থা বলেই চিহ্নিত করেন মহাকাশ বিজ্ঞানীরা। আর বছরে অন্তত দুইবার পবিত্র মক্কা নগরীর ক্ষেত্রে এই ঘটনাটি ঘটে।

গবেষকরা জানান, পবিত্র কাবা ঘরটি বিষুব রেখা ও কর্কটক্রান্তির মাঝখানে অবস্থিত হওয়ার কারণেই এমনটা ঘটে। ২৮ মে ছাড়াও প্রতিবছর ১৬ জুলাই তারিখেও একই ঘটনা ঘটে বলে জানান তারা।

পৃথিবীর অক্ষরেখায় সূর্য ২৩.৫ ডিগ্রি কৌণিক অবস্থান নিয়ে বিষুব রেখার উত্তর ও দক্ষিণ দিকে ঘুরতে থাকে। এভাবে একবার উত্তর গোলার্ধে একবার দক্ষিণ গোলার্ধে যায়। আর এই আসা যাওয়ার পথে বছরে দুইবার সরাসরি উপরে অবস্থান নিয়ে পবিত্র কাবা শরীফকে ছায়াশূন্য করে দেয়। ওইদিন ঠিক মধ্যআকাশে থাকা অবস্থায় সূর্যের দিকে খালি চোখে তাকাতে নিষেধ করেছেন বিজ্ঞানীরা ।

উৎসঃ আরব নিউজ 

উদ্যমহীনতা কারণ ও এর প্রতিকার

লেখকঃ শেইখ সালিহ আল-মুনাজ্জিদ

প্রশ্ন:

জনৈক ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করতেন। কিন্তু কিছুদিন পর তিনি নিরুদ্যম হয়ে পড়েন। এখন তিনি আগের মত কুরআন তেলাওয়াত করেন না। দ্বীনদারির ক্ষেত্রে উদ্যমহীনতা দূর করার উত্তম উপায় কী?

উত্তর: 

আল্‌হামদু লিল্লাহ।

উদ্যমহীনতা সৃষ্টির বেশ কিছু কারণ রয়েছে। প্রতিকার জানার আগে নিরুদ্যম হয়ে পড়ার কারণগুলো জেনে নেয়া জরুরী। কারণগুলো জানা গেলে প্রতিরোধ করার উপায়ও জানা যাবে।

উদ্যমহীনতার কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে- আল্লাহর সাথে সম্পর্কের দুর্বলতা, আনুগত্য ও ইবাদত পালনে অলসতা, দুর্বল আকাঙ্ক্ষার ব্যক্তিদের সাথে চলাফেরা, দুনিয়া ও দুনিয়ার ভোগ নিয়ে মেতে থাকা, দুনিয়ার শেষ পরিণতি নিয়ে না ভাবা এবং যার ফলে আল্লাহর সাথে সাক্ষাতের প্রস্তুতির মধ্যেও দুর্বলতা এসে পড়ে।

কোন মুসলিম উদ্যমহীনতার রোগে দ্বারা আক্রান্ত হলে সেটা প্রতিরোধ করার বেশ কিছু পন্থা রয়েছে-

(১) স্বীয় প্রতিপালকের সাথে সম্পর্ক মজবুত করা। এটি অর্জিত হবে কুরআনে কারীম বুঝে বুঝে, চিন্তাভাবনার সাথে অধ্যয়ন করার মাধ্যমে। আল্লাহর কিতাবের মাহাত্ম্য দিয়ে আল্লাহর মাহাত্ম্য অনুধাবন করার মাধ্যমে, আল্লাহ তাআলার মহান নাম ও গুণাবলী নিয়ে চিন্তাভাবনা করার মাধ্যমে।

(২) পরিমাণে কম হলেও নিয়মিত ও বিরতিহীনভাবে নফল আমল আদায় করা। কোন মুসলিম উদ্যমহীনতায় আক্রান্ত হওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ হলো- খুব আবেগপ্রবণ হয়ে প্রথম ধাপে অতি বেশি নেক আমল করা। এটি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদর্শ নয় এবং উম্মতের প্রতি তাঁর ওসিয়ত নয়। আয়েশা (রাঃ) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আমলকে বিশেষিত করতে গিয়ে বলেন: “তাঁর আমল ছিল নিয়মিত”। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে আমাদেরকে জানিয়েছেন যে, “আল্লাহর নিকট সবচেয়ে প্রিয় আমল হল- নিয়মিত আমল; যদিও সেটা পরিমাণে কম হোক না কেন”। অতএব, কোন মুসলিম যদি উদ্যমহীনতা থেকে নিষ্কৃতি পেতে চায় তাহলে সে যেন নিয়মিতভাবে অল্প অল্প আমল করার চেষ্টা করে। অনিয়মিত বেশি আমলের চেয়ে নিয়মিত কম আমল ভাল।

(৩) নেককার ও উদ্যমীদের সাহচর্যে থাকার চেষ্টা করা। উচ্চাকাঙ্ক্ষী ব্যক্তি আপনার মাঝেও উদ্যম সৃষ্টি করবে। অলস ব্যক্তি উচ্চাকাঙ্ক্ষী ব্যক্তির সাহচর্যে থাকতে রাজি হয় না। অতএব, আপনি উচ্চাকাঙ্ক্ষী বন্ধুবান্ধবের সাহচর্যে থাকার চেষ্টা করুন। যাদের মধ্যে মুখস্থ করা, ইলম অর্জন করা, দাওয়াতি কাজ করা ইত্যাদি করার মত উচ্চাকাঙ্ক্ষা আছে। এ ধরনের লোক আপনাকে ইবাদতের প্রতি, ভাল কাজের প্রতি উদ্বুদ্ধ করবে।

(৪) জীবনে যারা উচ্চাকাঙ্ক্ষী ছিলেন এমন ব্যক্তিবর্গের জীবনীগ্রন্থ অধ্যয়ন করা। যাতে আল্লাহর রাস্তায় চলার ক্ষেত্রে আপনার সামনে কিছু উত্তম আদর্শ থাকে। এ ধরনের বইয়ের মধ্যে রয়েছে- উলুউল হিম্মাহ; লেখক: শাইখ মুহাম্মদ বিন ঈসমাইল আল-মুকাদ্দাম এবং সালাহুল উম্মাহ ফি উলুইল হিম্মাহ; লেখক: শাইখ সৈয়দ আফানি।

(৫) আমরা আপনাকে দোয়া করার পরামর্শ দিচ্ছি; বিশেষতঃ শেষ রাতে। যে ব্যক্তি সঠিকভাবে নেক আমল করতে পারার জন্য তাঁর রবের আশ্রয় ও সাহায্য প্রার্থনা করে সে বিফল হয় না।

আমরা দোয়া করছি- আল্লাহ আপনাকে তাঁর সন্তোষজনক আমল করতে পারার তাওফিক দিন। আপনাকে উত্তম কথা, কাজ ও আচরণের তাওফিক দিন।

আর আল্লাহই ভাল জানেন।

দুনিয়ার আকর্ষণ

902330_559405987472314_1467921728_o

সংকলনঃ শাদমান

…পার্থিব জীবন তো ব্যক্তিগত জিনিষপত্রের ছলনা ব্যতীত কিছুই নয়।” [কুরআন ৫৭:২০]

২০। তোমরা [ সকলে ] জেনে রাখ, এই পৃথিবীর জীবন হচ্ছে খেলাধূলা ও আনন্দ ফুর্তির ৫৩০২, আড়ম্বর, পারস্পরিক অহংকার [ প্রদর্শন ] এবং ধন-সম্পদ ও সন্তান -সন্ততিতে প্রাচুর্য লাভের প্রতিযোগীতা ব্যতীত আর কিছু নয়। এর উপমা ৫৩০৩ হচ্ছে বৃষ্টি, এবং যার দ্বারা উৎপন্ন শষ্য সম্ভার যা কৃষকদিগের [ হৃদয়ে ] আনন্দ দান করে ৫৩০৪। শীঘ্রই তা শুকিয়ে তুমি তা পীতবর্ণ ধারণ করতে দেখবে, অবশেষে তা শুকিয়ে চুর্ণ-বিচুর্ণ হয়ে যায়। [ পাপীদের জন্য ] পরকালে রয়েছে কঠিন শাস্তি এবং [ পূণ্যাত্মাদের জন্য] রয়েছে আল্লাহ্‌র নিকট থেকে ক্ষমা এবং [ তাঁর ] সন্তুষ্টি। পার্থিব জীবন তো ব্যক্তিগত জিনিষপত্রের ছলনা ব্যতীত কিছুই নয়। ৫৩০৫

৫৩০২। দেখুন অনুরূপ আয়াত [ ৬ : ৩২ ] এবং টিকা ৮৫৫। এই আয়াতে সাধারণ মানুষের পার্থিব জীবনের উদ্দেশ্যকে আরও বিশদভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। পার্থিব জীবনে মানুষ “ক্রীড়া কৌতুক ” অর্থাৎ আনন্দ, ফুর্তিতে মেতে থাকে এবং পরলোকের চিন্তা ও মৃত্যুর ভাবনা সে একবারও ভাবে না। শুধু তাই-ই নয়, জীবনের বিভিন্ন সফলতাকে সে আত্মগরিমা ও অহংকারের বস্তুতে পরিণত করে। ক্ষমতার দম্ভ, সম্পদের অহংকার, সন্তানদের সফলতার কৃতিত্ব, প্রভৃতি সৌন্দর্যের অহংবোধ ইত্যাদি জীবনের বিভিন্ন বৈচিত্র তারা পরস্পর পরস্পরের নিকট অহংকারের ও গর্বের বিষয় ও প্রদর্শনের বস্তুরূপে উপস্থাপন করতে ভালোবাসে। এর ফলে মানুষ পৃথিবীর জীবনের সমস্তটাই ব্যয় করে থাকে সম্পদের সংগ্রহে এবং সঞ্চয়ে ; ক্ষমতা ও প্রভাব প্রতিপত্তি লাভের পিছনে। এ ব্যাপারে একজন অন্যজনকে প্রতিদ্বন্দীরূপে কল্পনা করে। মানুষের এই স্বাভাবিক প্রবণতা সর্বযুগেই বিদ্যমান ছিলো এবং ভবিষ্যতেও থাকবে।

৫৩০৩। দেখুন আয়াত [ ৩৯ : ২১ ] ও টিকা ৪২৭৩ ; যেখানে অনুরূপ উপমার উপস্থাপন করা হয়েছে। সেই একই উপমা এখানে উত্থাপন করা হয়েছে তবে এর মাধ্যমে যে উপদেশ প্রদান করা হয়েছে তা পূর্বের আয়াতের উপদেশ থেকে সামান্য আলাদা। আল্লাহ্‌র অনুগ্রহ পাপী, পূণ্যাত্মা সকলের জন্য সমান যেমন আল্লাহ্‌ প্রদত্ত বৃষ্টিধারা, তা সমভাবে বর্ষিত হয়। ধনীর প্রাসাদে ও গরীবের কুড়েতে ; পূণ্যাত্মা ও পাপীর শষ্যক্ষেত্রেও সমভাবে বর্ষণ করে থাকে। কিন্তু মানুষ কি ভাবে আল্লাহ্‌র নেয়ামত বৃষ্টিকে গ্রহণ করে ? ভালো কৃষক তার জমিকে উর্বরতা ও ফসলের বৃদ্ধির কাজে বৃষ্টির পানিকে ব্যবহার করে ফলে প্রচুর শষ্য ঘরে তুলতে সক্ষম হয়। অপরপক্ষে যে কৃষক বৃষ্টির পানিতে আগাছা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে – আগাছার সবুজ তাকে যতই মোহিত করুক না কেন – শেষ পর্যন্ত তা শুকিয়ে খড়ে পরিণত হবে এবং কৃষকের ঘরে কোন শষ্যই আসবে না। এই উপমার সাহায্যে মানুষের চেতনাতে আঘাত হানা হয়েছে যে যারা পার্থিব জীবনের চাকচিক্য, সম্পদ,ক্ষমতা ইত্যাদি ক্ষণস্থায়ী বস্তু নিয়ে ব্যস্ত থাকে, তারা আধ্যাত্মিক জীবনের কোনও ফসলই ঘরে তুলতে সক্ষম হবে না। আল্লাহ্‌র অনুগ্রহ তাদের জীবনে ঐ আগাছার বৃদ্ধির ন্যায় শুধুমাত্র গর্ব, অহংকারের ন্যায় পাপেরই জন্ম দেবে। প্রকৃত মুত্তাকীর গুণাবলী অর্জনে সহায়ক হবে না। ঐ আগাছার ন্যায় এক সময়ে তা শুকিয়ে পীতবর্ণ খড়ে পরিণত হবে – কোনও শষ্য উৎপন্ন করবে না। অর্থাৎ পরলোকের জীবনের জন্য কোনও আধ্যাত্মিক সমৃদ্ধি অর্জন করবে না।

৫৩০৪। ‘Kuffar’ – আবৃত করা। এখানে অনুবাদ করা হয়েছে কৃষক, যেহেতু সে মাটি দ্বারা বীজকে ঢেকে দেয়। কিন্তু সাধারণ ভাবে শব্দটি দ্বারা সত্যকে প্রত্যাখানকারী বোঝানো হয়। এখানে উপমার মাধ্যমে এরূপ লোককেই বোঝানো হয়েছে।

৫৩০৫। দেখুন অনুরূপ আয়াত [ ৩ : ১৮৫ ] ও টিকা ৪৯২ ] এই পার্থিব জীবনে মানুষ যা পাওয়ার জন্য দিন রাত্রি সাধনা করে যা নিয়ে সে দম্ভ ও অহংকার করে তা শয়তানের প্রতারণা ব্যতীত আর কিছু নয়। কারণ এসব বস্তু ক্ষণস্থায়ী। এদের স্থায়ীত্ব শুধুমাত্র পার্থিব জীবনেই। প্রকৃত স্থায়ী সম্পদ যা পরলোকেও বহন করে নেয়া যাবে তা হচ্ছে আল্লাহ্‌ নির্দ্দেশিত সৎ জীবন যাপন থেকে উদ্ভুদ গুণাবলী যা আত্মাকে করে সমৃদ্ধ ও আলোকিত।

(আবদুল্লাহ্‌ ইউসুফ আলীর ইংরেজী তাফসীর অনুসরনে অনুবাদ)

 

আল্লাহর তরবারী খালিদ বিন ওয়ালিদ (রা)

লেখকঃ মুহাম্মাদ তামীমুল ইসলাম

ভূমিকা:

খালিদ বিন ওয়ালীদ (রাঃ) ছিলেন মুসলিম ইতিহাসে ইতিহাস সৃষ্টিকারী এক মহান সেনাপতি। যিনি রণক্ষেত্রে নিজের শক্তি ও মেধার দ্বারা বাতিলের শক্তি মূলোৎপাটন করে তাওহীদের ঝান্ডাকে বুলন্দ করেছিলেন। মিসরের খ্যাতনামা সাহিত্যিক ও ঐতিহাসিক আববাস মাহমুদ আল-আক্কাদ ‘আবকারিয়াতু খালিদ’ নামক গ্রন্থে তাঁর সামরিক ব্যক্তিত্বের পর্যালোচনা করে বলেন, ‘সামরিক নেতৃত্বের সব গুণাবলীই খালিদ (রাঃ)-এর মধ্যে ছিল। বাহাদুরী, সাহসিকতা, উপস্থিত বুদ্ধি, তীক্ষ্ম মেধাসম্পন্ন, অত্যধিক ক্ষিপ্রতা এবং শত্রুর উপর অকল্পনীয় আঘাত হানার ব্যাপারে তিনি ছিলেন অদ্বিতীয় (তালিবুল হাশেমী, বিশ্বনবীর সাহাবী, অনুবাদ : আব্দুল কাদের (ঢাকা : আধুনিক প্রকাশনী, ২য় সংস্করণ; ১৯৯৪ খ্রিঃ, ১/১৮৮ পৃঃ)। নিমেণ এ কুশাগ্রবুদ্ধি মহান সেনাপতির সংগ্রামী জীবনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হ’ল।

নাম ও জন্ম:

মূল নাম খালিদ, উপনাম আবু সুলায়মান ও আবুল ওয়ালীদ। লক্বব সাইফুল্লাহ (আল্লাহর তরবারী)। মূতার যুদ্ধে অসমান্য অবদানের জন্য তিনি ‘সাইফুল্লাহ’ উপাধিতে ভূষিত হন। খালিদের জন্ম তারিখ সম্পর্কে সঠিক কোন তথ্য পাওয়া যায় না। তবে এতটুকু জানা যায় যে, নবুয়তের ১৫ অথবা ১৬ বছর পূর্বে তাঁর জন্ম হয়। আর রাসূল (সা:)-এর নবুয়ত প্রাপ্তির সময় তাঁর ২৪ অথবা ২৫ বছর বয়স হয়েছিল।

বংশ পরিচয়:

পিতা ওয়ালিদ ইবনু মুগীরা। মাতা লুবাবা আস-সুগরা। যিনি উম্মুল মু’মিনীন হযরত ময়মুনা বিনতুল হারিছের বোন (আছহাবে রাসূল ২/৬৩ পৃঃ)। এ দৃষ্টিকোণ থেকে রাসূলুল্লাহ (সা:) তাঁর খালু। তিনি মক্কার বিখ্যাত কুরাইশ বংশে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বংশ তালিকা হচ্ছে-খালিদ ইবনু ওয়ালীদ ইবনে মুগীরা ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে উমর ইবনে মাখযুম আল-কুরাশী আল-মাখযুমী (আল-ইছাবাহ ফী তাময়ীযিছ ছাহাবা, ২/৯৮ পৃঃ)।

ইসলাম গ্রহণ:

রাসূলুল্লাহ (সা:) খালিদ ইবনু ওয়ালিদের ইসলাম গ্রহণের জন্য দো‘আ করতেন। তিনি বলতেন, ‘হে আল্লাহ খালিদ ইবনু ওয়ালিদ, সালামা ইবনু হিশাম এবং দুর্বল মুসলমানদেরকে কাফিরদের হাত থেকে মুক্তি দান করুন’। এ দো‘আর বরকতে আল্লাহ্র রহমতে ৭ম হিজরী সনে খালিদ ইবনু ওয়ালীদ ইসলাম গ্রহণ করেন (তাফসীর ইবনু কাছীর ১৬৩ পৃঃ)। তবে তাঁর ইসলাম গ্রহণের সময় সম্পর্কে মতভেদ পরিলক্ষিত হয়। আসমাউর রিজালের বিভিন্ন গ্রন্থে বলা হয়েছে, তিনি ৮ম হিজরীতে জন্মগ্রহণ করেছেন। আমর ইবনুল ‘আছ (রাঃ) নাজ্জাশীর দরবারে ইসলাম গ্রহণ করেছেন তা সবার জানা কথা। এটা অষ্টম হিজরীর ঘটনা। অপর বর্ণনায় পাওয়া যায়, আমর হাবশা থেকে ফেরার পথে খালিদ এবং উছমান ইবন ত্বালহার সাথে সাক্ষাত হয় এবং তারা তিনজন একত্রে ইসলামের গ্রহণ করে। এতে বোঝা যায় এরা সপ্তম হিজরীর প্রথম দিকে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। আল্লাহ সবকিছু ভাল জানেন (আর-রাহীকুল মাখতূম ৩৫৭ পৃঃ)। হযরত খালিদ ইবনু ওয়ালিদ বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর হাতে বায়‘আত গ্রহণকালে বলেছিলাম আল্লাহ্র পথে বাঁধা সৃষ্টি করে জীবনে যত পাপ করেছি হে আল্লাহ্র রাসূল (রাঃ) তা ক্ষমার জন্য দো‘আ করুন। তখন রাসুলুল্লাহ (সা:) তাকে বলেছিলেন, ‘ইসলাম অতীতের সকল গুনাহসমূহকে মুছে দেয়’। আমি বললাম ইয়া রাসূলুল্লাহ (সা:)! আমি এ কথার উপর বায়‘আত করলাম (রিজালুন হাওলার রাসূল, ২৮৪ পৃঃ)।

ইসলামের দাওয়াত সম্প্রসারণে খালিদ:

হিজরী নবম সনে রাসূল (ছাঃ) খালিদকে তাওহীদের দাওয়াত প্রচারের উদ্দেশ্যে বনী জুজাইম গোত্রে প্রেরণ করেন। খালিদের দাওয়াতের ফলে বনী জুজাইম গোত্র ইসলাম ধর্মে দিক্ষিত হয়। কিন্তু অজ্ঞতাবশতঃ তারা তাদের অভিব্যক্তি ব্যক্ত করতে না পারায় খালিদ তাদের ভুল বোঝেন। তিনি তাদেরকে হত্যার আদেশ দেন। ফলে সে গোত্রের বহুলোককে হত্যা করা হয়। রাসূল (ছাঃ) বিষয়টি অবহত হ’লে তিনি ভীষণ দুঃখিত হন। তিনি হাত উঠিয়ে দো‘আ করেন, ‘হে আল্লাহ খালিদ যা করেছে এ ব্যাপারে আমি দায়মুক্ত। অতঃপর তিনি আলী (রাঃ)-কে সেখানে পাঠান এবং তাদের ক্ষতিপূরণ দেন। এমনকি তাদের নিহত প্রাণীগুলোরও ক্ষতিপূরণ দেন।‘ [বুখারী, কিতাবুল মাগাযী, পৃঃ ৪৫০]

১০ম হিজরী সনে রাসূলুল্লাহ (সা:) খালিদ (রাঃ)-কে নাজরানের বনু আব্দিল মাদ্দাদের গোত্রে পাঠান। যেহেতু খালিদ বনু জুজাইমের ক্ষেত্রে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে কঠিন ভুল করেছিলেন সেজন্য রাসূল (সা:) এ যাত্রার পূর্বে তাকে বিশেষভাবে নছীহত করে বলেন, ‘কেবল ইসলামের দাওয়াতই দিবে, কোন অবস্থাতেই তলোয়ার উঠাবে না। তিনি এ নছীহত পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পালন করেন। তার দাওয়াতে মাদ্দান গোত্র ইসলাম কবুল করে ধন্য হয়। এ সকল নওমুসলিমদের তিনি দ্বীনী তা‘লীম ও তারবিয়াত শিক্ষা দেন এবং তাদেরকে রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর দরবারে নিয়ে আসেন। একই বছরে ইয়ামানবাসীর নিকটে দাওয়াত প্রচারে খালিদ ও আলী (রাঃ)-কে পাঠান। তাঁদের দাওয়াতে সাড়া দিয়ে ইয়ামানবাসী ইসলাম গ্রহণ করে (আসহাবে রাসূল, ২/৬৬ পৃঃ)।

মূর্তি ভাঙ্গলেন খালিদ:

জাহেলী যুগে আরববাসীদের মূর্তিপূজার একটি অন্যতম কেন্দ্র ছিল উজ্জা। রাসূল (সা:) খালিদকে ঐ কেন্দ্রীয় মূর্তিটি ধ্বংসের জন্য পাঠালেন। তিনি সেখানে গিয়ে নিমেণর পংক্তিটি আবৃতি করতে করতে তাকে মাটির সাথে গুড়িয়ে দেন, ‘ওহে উজ্জা তুই অপবিত্র, আমরা তোকে অস্বীকার করি। আমি দেখেছি আল্লাহ তোকে অপমান করেছেন’।

সাইফুল্লাহ তথা আল্লাহ্র তরবারী উপাধি লাভ:

মূতার যুদ্ধে তিনজন সেনাপতিকে হারিয়ে মুসলিম বাহিনী যখন কিংকর্তব্যবিমূঢ় তখন তারা খালিদ ইবন ওয়ালীদকে সিপাহসালার মনোনীত করেন। অতঃপর প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত হয়ে খালিদ অসীম বীরত্ব ও অপূর্ব দক্ষতা প্রদর্শন করে বিজয় পতাকা উড্ডীন করেন। মুহাম্মাদ (সা:) তাঁর এই তেজস্বীতা ও বীরত্বের স্বীকৃতি স্বরূপ তাকে সাইফুল্লাহ তথা আল্লাহ্র তরবারী উপাধিতে ভূষিত করেন।

রণাঙ্গনে খালিদ:

খালিদ ইবনু ওয়ালীদ (রাঃ) ইসলাম গ্রহণের মাত্র দুমাস পরেই সর্বপ্রথম মূতার যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। ৬২৯ খৃষ্টাব্দের ২২ শে মার্চ মূতার যুদ্ধ সংগঠিত হয়। এ যুদ্ধ পরিচালনার জন্য যায়েদ ইবনু হারিছা (রাঃ)-কে প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত করেন। তিনি নির্দেশ দেন যায়েদ নিহত হ’লে জাফর আর জাফর নিহত হ’লে আব্দুল্লাহ ইবনু রাওয়াহা (রাঃ) সেনাপতির দায়িত্ব পালন করবে। যখন উভয়পক্ষের মাঝে তুমুল যুদ্ধ শুরু হ’ল তখন তিন সেনা কমান্ডারই অতুলনীয় বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করতে করতে অবশেষে শাহাদত বরণ করেন। অতঃপর জনতার মতামতের ভিত্তিতে খালিদ ইবনু ওয়ালিদ (রাঃ) সেনা কমান্ডার নিযু্ক্ত হন। অতঃপর তিনি অসীম বীরত্ব দেখিয়ে শত্রু পক্ষকে ছিন্নভিন্ন ও ছত্রভঙ্গ করে দেন। তিন তিনজন সুযোগ্য সেনা নায়ককে হারিয়েও মুসলমানরা অবশেষে বিজয় লাভ করেছিল (আর-রাহীকুল মাখতুম ৪০১-৪০২ পৃঃ)। ছহীহ বুখারীতে স্বয়ং খালিদ ইবনু ওয়ালিদ থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, “মূতার যুদ্ধে আমার হাতে নয়টি তলোয়ার ভেঙ্গেছে। এরপর আমার একটি ইয়ামানী তলোয়ার অবশিষ্ট ছিল।” [ছহীহ বুখারী, মূতার যুদ্ধ অধ্যায় ২/৭১১ পৃঃ]

১০ম হিজরী সনে মক্কা বিজয়ের মূহূর্তে ছাহাবাগণ যখন মক্কায় প্রবেশ করছিলেন তখন রাসূল (সা:) খালিদকে নির্দেশ দিলেন যে, তিনি যেন মক্কার ঢালু এলাকায় প্রবেশ করেন। নবী (সা:) খালিদকে বলেন, যদি কুরাইশরা কেউ তোমার পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় তাহ’লে তুমি তাকে ক্বতল করবে। এরপর মক্কায় গিয়ে আমার সাথে দেখা করবে। খালিদ (রাঃ) রাসূল (সা:)-এর এ নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেন। অতঃপর তিনি ও তাঁর সঙ্গীদের পথে যেসব পৌত্তলিক বাঁধা হয়ে এসেছিল তাদেরকে মুকাবেলা করে হত্যা করেন। অতঃপর খান্দামা নামক স্থানে খালিদ ও তাঁর সঙ্গীদের সাথে উচ্ছৃঙ্খল কতিপয় কুরাইশ পক্ষ মুখোমুখি হয়। কিছুক্ষণ সংঘর্ষ চলে। এতে বারো জন কুরাইশ নিহত হয়। এ ঘটনায় কুরাইশদের মনে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। মুসলমানদের সাথে যুদ্ধ করতে সংকল্পবদ্ধ হাম্মাম ভয়ে ভীতু হয়ে ছুটে গিয়ে ঘরে প্রবেশ করে। এভাবে খালিদ (রাঃ) মক্কার দক্ষিণাংশের সমস্ত বিপর্যয় অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে মুকাবেলা করে রাসূল (সা:)-এর সাথে মিলিত হন (আর-রাহীকুল মাখতুম ৪১৯ পৃঃ)।

ভন্ডনবীদের দমনে খালিদ:

রাসূল (সা:)-এর ইন্তেকালের পর সমস্ত আরবে বিদ্রোহের দানা বাঁধতে থাকে। একদিকে ইসলাম ত্যাগকারী ও যাকাত অস্বীকারকারী, অপর দিকে ভন্ডনবীদের উৎপাত মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। এই ফেৎনাবাজদের শিরদাড়া গুড়িয়ে দেওয়ার জন্য ইস্পাত কঠিন শপথ নিয়ে আবূ বকর (রাঃ) তাদের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েন। কিন্তু বিশিষ্ট ছাহাবীদের অনুরোধে তিনি তা করেননি বরং মদীনাতেই রয়ে গেলেন। তিনি গোটা সেনাবাহিনীকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করে ১টি ভাগের দায়িত্ব দিলেন খালিদকে। খালিদকে মদীনা থেকে বিদায় দেওয়ার সময় তাকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, তোমার সম্পর্কে আমি রাসূল (সা:)-কে বলতে শুনেছি, ‘খালিদ আল্লাহ্র একটি তরবারী-যা আল্লাহ কাফের ও মুনাফিকদের বিরুদ্ধে কোষমুক্ত করেছেন। খালিদ আল্লাহ্র কতইনা ভাল বান্দা’ (রিজালুন হাওলার রাসূল ২৯৩ পৃঃ)। তিনি তাঁর বাহিনী নিয়ে মদীনা ত্যাগ করেন। সর্বপ্রথম তিনি ভন্ডনবী তুলায়হার বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন। তুমুল যুদ্ধ চলছে। প্রতিটি সংঘর্ষে তুলায়হা পরাজয় বরণ করছে। এমন সময় তুলায়হা একদিন তার আপনজনদের জিজ্ঞাসা করল আমাদের এত বিপুল সৈন্য থাকতেও আমাদের এমন শোচনীয় পরাজয় কেন? তার সঙ্গীরা তাকে বলল, আমাদের প্রত্যেকেই চায় তাঁর সাথী আগে মারা যাক আর তারা প্রত্যেকেই চায় যে সে তাঁর সঙ্গীর আগে মৃত্যুবরণ করুক (হায়াতুছ ছাহাবা ৩/৬৯৩ পৃঃ)। অতঃপর খালিদ তুলায়হার সঙ্গী-সাথীদের হত্যা করেন এবং ৩০ জনকে বন্দী করেন।

তারপর তিনি মুসায়লামাতুল কাযযাবের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন। মুসায়লামা হামযা (রাঃ)-এর হত্যাকারী ওয়াহশী (রাঃ)-এর হাতে নিহত হয়ে চির বিদায় নেয় (আসহাবে রাসূলের জীবনকথা ২/৬৭ পৃঃ)। ‘তারীখুল খুলাফা’ গ্রন্থকার বলেন, ভন্ড নবীদের ফিৎনা নির্মূল করার পর হযরত খালিদ (রাঃ) যাকাতদানে অস্বীকৃতি জ্ঞাপনকারী ও মুরতাদদের দিকে ধাবিত হন এবং তাদের উপর কঠিনতর আঘাত হানেন। তাদের কিছু মারা যায় এবং কিছু ধৃত হয়। আর অবশিষ্টরা তওবা করে ইসলামে ফিরে আসে’ (তারীখুল খুলাফা, ৭২ পৃঃ)।

অপরাজিত এক বীর সিপাহসালার খালিদ:

অভ্যন্তরীণ গোলযোগ দমনের পর খালিদ ইরাক অভিমুখে রওয়ানা দেন। আনবার, আইনুত তামুর, দুমা, হীরা ও সোনা প্রভৃতি অঞ্চল অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে বিজয় লাভ করেন। খালিদ বিন ওয়ালিদ (রাঃ) সর্বশেষ যুদ্ধ করেন ইরাকের ফোরাত নদীর তীরে। ফোরাতের এক তীরে মুসলিম বাহিনী অপর তীরে ইরাকী বাহিনী। ইরাকীদের প্রস্তাবমতে তাদেরকে নদী পার হবার সুযোগ দিলে তারা নদী পার হয়। মুসলিম বাহিনী শত্রু বাহিনীকে তিন দিক ঘিরে ফেলে। তাদের পিছনে বিক্ষুব্ধ তরঙ্গমালা বিশাল নদী। সামনে মুসলিম সৈন্যদের তরবারীর ভেদ। পিছনে সুবিশাল সমুদ্র। পালানোর কোন পথ নেই। সামনে অতিক্রম করলে তরবারীর আঘাত আর পিছনে ফিরে গেলে ডুবে মরা ছাড়া তাদের আর কোন উপায় ছিল না। অতঃপর মুসলিম বাহিনী শত্রু পক্ষকে কঠিনভাবে আক্রমণ করে। ফলে মুসলমানগণ বিজয় লাভ করেন। পরিশেষে যুদ্ধ বিজয়ের পর খালিদ গোপনে হজ্জ করতে যান (আছহাবে রাসূলের জীবনকথা, ৬৮ পৃঃ)।

ইরাক জয়ের পরপরই খালিদ (রাঃ) খলীফার নির্দেশে বসরায় যান ও পূর্বে অবস্থানরত মুসলিম বাহিনীর সাথে যোগদান করেন। খালিদ সেখানে পৌঁছেই বসরায় আক্রমণ করেন। তার আক্রমণে হতভম্ব হয়ে বসরাবাসী ৬৩৮ খৃষ্টাব্দে তাদের শান্তি চুক্তি করে। এরপর খালিদ সিরিয়ার দিকে অগ্রসর হন। সিরিয়ায় অভিযানের প্রথমেই খালিদ দামেশক অবরোধ করেন। সেখানে খালিদ (রাঃ) প্রায় ছয়মাস অবরোধ করে রাখেন। কিন্তু দুর্গ প্রাচীর অতিক্রম করতে পারেন নি। এ সময় এক পাদ্রীর পুত্র সন্তান জন্মের কারণে আনন্দে নগরীর অধিবাসীরা মদপানে মত্ত ছিল। তাই সময় বুঝে একদিন রাতে খালিদ তাঁর কয়েকজন সঙ্গী নিয়ে দুর্গ প্রাচীর অতিক্রম করে ভিতরে প্রবেশ করেন ও দ্বাররক্ষীদের হত্যা করেন। ফলে নগরের প্রধান ফটক মুসলমানদের নিকট উন্মুক্ত হয়। অকস্মাৎ আক্রমণে ভীত হয়ে তারা তরিৎ সিদ্ধান্ত নিয়ে মুসলমানদের সাথে সন্ধি করে। এ অভিযানে আবু ওবায়দা, আমর ইবনুল ‘আছ ও সুরাহবিল (রাঃ) খালিদকে বিশেষভাবে সহযোগিতা করেন।

দামেশক বিজয়ের পর খালিদ (রাঃ) জর্দান অভিমুখে রওয়ানা দেন এবং জর্দানের নিকটবর্তী ফিহল নামক স্থানে তাঁবু স্থাপন করেন। রোমানরা সেখানে অযৌক্তিক প্রস্তাব সম্বলিত সন্ধি প্রস্তাব দেয়। মুসলমানরা তা প্রত্যাখ্যান করেন। ফলে উভয় পক্ষের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়। এ যুদ্ধে রোমানগণ শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। দামেশক জর্দান ও হিমসের ন্যায় তিনটি গুরুত্বপূর্ণ নগরের পতনে রোমান সম্রাট ভীষণ ক্ষিপ্ত হয়ে ২,৪০,০০০ জনের এক বিরাট বাহিনী প্রেরণ করেন।

খালিদ ইবনু ওয়ালীদ যুদ্ধের ময়দানে উপস্থিত হয়ে দেখতে পান বিভিন্ন কমান্ডার পৃথকভাবে সৈন্য পরিচালনা করছেন। তখন খালিদ (রাঃ) যোদ্ধাদের উদ্দেশ্যে এক গুরুগম্ভীর ভাষণ প্রদান করেন। হামদ ও ছানার পর তিনি বলেন, ‘আজকে এ দিন আল্লাহ্র নিকট অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন। তোমরা গর্ব অহংকার থেকে বিরত থাক। তোমরা খালেছভাবে যুদ্ধ কর। তোমাদের কাজের জন্য প্রভুর সন্তুষ্টি কামনা কর। এসো আমরা নেতৃত্ব ভাগাভাগি করি। কেউ আজ কেউ আগামী ও কেউ পরশু আমীর হই। আর আজকের দিন আমার উপর ছেড়ে দাও’। অতঃপর তাঁর এই তেজোদীপ্ত বক্তব্য সকলে সমর্থন দিল। প্রধান সেনাপতি পদে অধিষ্ঠিত হয়ে খালিদ (রাঃ) মুসলিম সেনাদলকে এমনভাবে বিন্যস্ত করলেন যে আরবরা কোনদিন এমন বিন্যস্তকরণ চোখে দেখেনি (আছহাবে রাসূলদের জীবনকথা ২/৬৯)। অতঃপর তুমুল যুদ্ধ শুরু হল। রোমানরা এমনভাবে আক্রমণ করল যে আরবরা এরকম বিপদে ইতিপূর্বে কখনও নিমজ্জিত হয়নি। মুসলিম বাহিনীর মাঝখানের দায়িত্বে ছিলেন কাকা ও ইকরামা (রাঃ)। খালিদ তাদেরকে ও সমস্ত মুসলিম বাহিনীকে আক্রমণের নির্দেশ দিলেন। ফলে যুদ্ধ সর্বোচ্চ রূপ ধারণ করল। হযরত খালিদও তীব্র আক্রমণ চালালেন। তিনি যে দিক গেলেন সে দিকের রোমান বাহিনী ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। তাদের শোচনীয় পরাজয় হল। ঐতিহাসিক তাবারীর মতে, এ যুদ্ধে লক্ষাধিক রোমান সৈন্য নিহত হয়।

এরপর মুসলমানরা বায়তুল মুকাদ্দাস অবরোধ করে। এ অবরোধে মুসলিম বাহিনীর সেনাপ্রধানদের মধ্যে খালিদও ছিলেন একজন। বায়তুল মুকাদ্দাসের অধিবাসীরা বাঁচার কোন পথ না পেয়ে স্বয়ং উমার (রাঃ)-এর নিকট সন্ধিচুক্তি করার প্রস্তাব দেন। তাদের অনুরোধে উমার (রাঃ) সন্ধিপত্রে স্বাক্ষর করেন। এভাবেই প্রত্যেক যুদ্ধে খালিদ ইবনে ওয়ালীদের সুতীক্ষ্ম ও সাহসিকতাপূর্ণ নেতৃত্ব প্রদান করে ইসলামের বিজয় পতাকা বিশ্বের ময়দানে উড্ডীন করেন।

প্রধান সেনাপতির পদ থেকে অপসারণ:

খলীফা উমার (রাঃ) খালিদ (রাঃ)-কে ৬৩৮ খৃষ্টাব্দে প্রধান সেনাপতির পদ থেকে অব্যাহতি দেন। অতঃপর খলীফা ওমর (রাঃ) সর্বত্র ঘোষণা দেন যে, ‘আমি খালিদকে আস্থাহীনতা, ক্রোধবশতঃ বা এ জাতীয় কোন কারণে অপসরণ করিনি। শুধুমাত্র এ কারণে পদচ্যুত করেছি যে, মুসলমানরা জেনে নিক যে, খালিদের শক্তির ওপর ইসলামের বিজয়সমূহ নির্ভরশীল নয়। বরং ইসলামের বিজয় আল্লাহর মদদ ও সাহায্যের উপর নির্ভরশীল (ইবনুল আছীর, তারিখে কামিল, ২/৪১৮ পৃঃ)।

অপসারণের কারণ:

তার অপসারেণের করণ সম্পর্কে ইতিহাসে দু’টি অভিমত পাওয়া যায়। প্রথমত, মুসলিম অমুসলিম সকলেই ধারণা করত যে, খালিদ বিন ওয়ালিদের কারণে প্রত্যেক যুদ্ধে বিজয় হচ্ছে। খলিফা এ কুধারণা দূর করার জন্য তাকে অব্যাহতি দেন (আছহাবে রাসূল ২/৭৩ পৃঃ)।

দ্বিতীয়ত, তাঁর অব্যাহতির ঘটনা কেউ কেউ এভাবে বর্ণনা করেছেন যে, খালিদ (রাঃ)-এর ব্যয় কখনো কখনো সীমা অতিক্রম করত। মাঝে মাঝে তিনি বিপুল পরিমাণে সম্পদ দান করতেন। তিনি কবি আশ‘আছ ইবনে ক্বায়েসকে ১০ হাজার দিরহাম দান করে দেন। খলিফা বিষয়টি অবগত হয়ে আবূ উবায়দাকে জিজ্ঞেস করতে বলেন, তিনি কোন খাত থেকে এ অর্থ ব্যয় করেছেন? তিনি উত্তরে বলেন নিজের অর্থ থেকে। তারপর তিনি খলীফার নির্দেশ পড়ে শোনান। অতঃপর খালিদ (রাঃ) বলেন, আমি খলীফার ফরমান শুনলাম ও মানলাম। কারো মতে এ ঘটনা ইয়ারমুকের যুদ্ধ চলাকালে ঘটে (আছহাবে রাসূলের জীবনকথা, ২/৭২ পৃঃ)।

রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন:

খলীফার উক্ত অব্যাহতি আদেশ তিনি অবনত মস্তকে মেনে নেন এবং সাধারণ সৈনিক বেশে বাকি যুদ্ধে শরীক থাকেন। তারপর খলীফা তাকে সিরিয়ার রাহা, হিরাত, আমদ এবং লারতার অঞ্চলসমূহের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন (আছহাবে রাসূলের জীবনকথা, ২/৭২ পৃঃ)। অতঃপর তিনি খলীফা প্রদত্ত দায়িত্ব গ্রহণ করে দ্রুত সিরিয়ায় গমন করেন। তিনি ইয়াযীদকে লেবানন, আমর (রাঃ)-কে জেরুজালেম, সুরাহবিলকে জর্দান অভিমুখে পেরণ করেন এবং তিনি দ্রুত গতিতে বলবেক, এডেসা, আলেপ্পো, কিন্নিসিরিন প্রভৃতি স্থান দখন করে সমগ্র সিরিয়া অঞ্চলে মুসলিম শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। আর এভাবে তিনি একজন সুদক্ষ সেনানায়ক থেকে একজন সুযোগ্য রাষ্ট্রীয় শাসকে পরিণত হন।

সেখানে কিছুদিন দায়িত্ব পালনের পর স্বেচ্ছায় অবসর নেন। ইসলাম গ্রহণের পর হযরত খালিদ মাত্র ১৪ বছর জীবিত ছিলেন। এ অল্প সময়েই তিনি মোট ১২৫ মতান্তরে ৩০০ টি ছোট-বড় যুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেন। তবে মজার বিষয় হল তিনি কোন যুদ্ধেই পরাজিত হননি (ইবনুল আছীর, তারীখে কামিল, ৪১৮ পৃঃ)।

ইলমে হাদীছে তাঁর অবদান:

ইসলাম গ্রহণের পর থেকে প্রায় মৃত্যু অবধি খালিদ বিন ওয়ালিদ (রাঃ) যুদ্ধের ময়দানে অবস্থান করেছেন। মহানবী (ছাঃ)-এর সান্নিধ্যে থাকার খুবই কম সুযোগ পেয়েছেন। যেমন তিনি বলেন, জিহাদের ব্যস্ততা আমাকে কুরআনের বিরাট একটি অংশ শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করেছে (আল-ইছাবা, ৪১৫ পৃঃ)। তারপরেও তিনি এ শিক্ষা থেকে একেবারে বঞ্চিত থেকেছেন তা নয়। বরং তিনি রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে যতটুকু সময় কাঁটাতে পেরেছেন তার সদ্ব্যবহার করেছেন। তিনি মোট ১৮ মতান্তরে ১৭টি হাদীছ বর্ণনা করেন। তন্মধ্যে মুত্তাফাক্ব আলাইহ হাদীছ ২টি এবং বুখারী এককভাবে একটি হাদীছ বর্ণনা করেছেন। তিনি ফৎওয়া বিভাগে সাধারণত বসতেন না। তাই তার ফৎওয়ার সংখ্যা দুটির বেশি পাওয়া যায় না।

ইন্তেকাল:

খালিদ ইবনে ওয়ালিদ (রাঃ) ৬৩৯ খ্রিঃ মোতাবেক হিজরী ২১ মতান্তরে ২২ সালে কিছুদিন অসুস্থ হন এবং ৬০ বছর বয়সে মদীনাতে মৃত্যুবরণ করেন। কিন্তু কোন কোন ঐতিহাসিকের মতে, তিনি ‘হিমছ’-এ মৃত্যুবরণ করেন। তবে এ মত ঠিক নয় বলে ধারণা করা হয়। কারণ খলীফা উমর (রাঃ) তাঁর যানাযায় উপস্থিত হন বলে ধারণা করা হয় (উসদুল গাবা ১/৯৫)। খালিদের মৃত্যুতে উমার (রাঃ) আফসোস করে বলেছিলেন, ‘নারীরা খালিদের মত সন্তান প্রসবে অক্ষম হয়ে গেছে।’ এমন কি তাঁর মৃত্যুতে খলীফা নিজে কেঁদেছিলেন (রিজালুন হাওলার রাসূল, ৩০৫ পৃঃ)।

উপসংহার:

খালিদ (রাঃ) ইসলামের ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ বীরের আসনে সমাসীন। সামরিক ক্ষেত্রে এবং রণাঙ্গনে তাঁর যে অবদান তা বিশ্বের ইতিহাসে বিরল ঘটনা। পাশাপাশি এ কথাও স্পষ্টত প্রতিভাত হয় যে, তিনি একজন যোগ্য শাসকও ছিলেন। পরিশেষে ‘খালিদ সাইফুল্লাহ’ নামক গ্রন্থের একটি উদ্ধৃতি দিয়েই শেষ করছি। সেখানে বলা হয়েছে ‘আল্লাহ তা‘আলা খালিদ বিন ওয়ালীদ (রাঃ)-এর উপর রহমত ও বরকত অবতীর্ণ করেছেন। তিনি ইসলাম প্রতিষ্ঠায় যে ত্যাগ স্বীকার করেছেন তা ভুলবার নয়। সুতরাং আমাদের প্রত্যেকের উচিৎ, আমরা যেন তার জীবনীর বিভিন্ন ঘটনাবলীকে নিয়ে চিন্তা করি এবং নিজেদের মধ্যে তাঁর গুণাবলীর সমাবেশ ঘটানোর চেষ্টা করি। কারণ মুসলিম জাতির তাঁর গুণাবলী অবলম্বনের মধ্যেই যথার্থ সার্থকতা নিহিত’। আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন।

আমীন!!

বিবাহের কতিপয় সুন্নাত সমূহ

যে সকল ভাইয়েরা/বোনেরা বিবাহ উপযুক্ত বা যাহারা বিবাহ নিয়ে ভাবছেন তাদের অথবা যারা অভিবাবক আছেন তারা জেনে নিন:

বিবাহের কতিপয় সুন্নত সমূহঃ

(১) মাসনূন বিবাহ সাদা সিধে ও অনাড়ম্বর হবে, যা অপচয়, অপব্যয়, বেপর্দা ও বিজাতীয় সংস্কৃতি মুক্ত হবে এবং তাতে যৌতুকের শর্ত বা সামর্থের অধিক মহরানার শর্ত থাকবেনা।” [তাবারানী আউসাত, হাদিস নং- ৩৬১২]
(২) সৎ ও খোদাভীরু পাত্র-পাত্রীর সন্ধান করে বিবাহের পূর্বে পয়গাম পাঠানো। কোন বাহানা বা সুযোগে পাত্রী দেখা সম্ভব হলে, দেখে নেয়া মুস্তাহাব। কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে ঘটা করে পাত্রী দেখানোর যে প্রথা আমাদের সমাজে প্রচলিত তা সুন্নতের পরিপন্থী ও পরিত্যাজ্য।” [বুখারী হাদিস নং-৫০৯০, ইমদাদুল ফাতাওয়া-৪: ২০০]
(৩)শাউয়াল মাসে এবং জুমুয়ার দিনে মসজিদে বিবাহ সম্পাদন করা। উল্লেখ্য, সকল মাসের যে কোন দিন বিবাহ করা যায়িজ আছে।” [মুসলিম ১৪২৩/ বায়হাকী ১৪৬৯৯]
(৪) বিবাহের খবর ব্যাপকভাবে প্রচার করে বিবাহ করা এবং বিবাহের পরে আকদ অনুষ্ঠানে উপস্থিত লোকদের মাঝে খেজুর বন্টন করা।” [বুখারী/৫১৪৭]
(৫)সামর্থানুযায়ী মোহর ধার্য করা।” [আবু দাউদ/২১০৬]
(৬) বাসর রাতে স্ত্রীর কপালের উপরের চুল হাতে নিয়ে এই দোয়া পড়াঃ “আল্লাহুম্মা ইন্নি আস আলুকা খয়রাহা ওয়া খয়রা মা জাবালতুহা আলাইহি ওয়াওযুবিকা মিন শার্রিহা মিন শার্রিমা জাবালতাহা আলাইহি” [আবু দাউদ/২১৬০]
(৭) স্ত্রীর সঙ্গে প্রথমে অন্তরঙ্গতা সৃষ্টি করবে, তার পর যখনই সহবাস এর ইচ্ছা হয়, তখন প্রথমে নিম্নোক্ত দু’আ পড়ে নিবেঃ “বিসমিল্লাহি আল্লাহুম্মা জান্নিবনা শাইতনা ওয়া জান্নিবিশশাইতনা মা রকাজকতনা” [মুসলিম/১৪৩৪]
(উপরোক্ত দোয়া না পড়লে শয়তানের তাছীরে বাচ্চার উপর কু-প্রভাব পড়ে। অতঃপর সন্তান বড় হলে, তার মধ্যে ধীরে ধীরে তা প্রকাশ পেতে থাকে এবং বাচ্চা নাফরমান ও অবাধ্য হয়। সুতরাং পিতা মাতাকে খুবই শতর্ক থাকা জরুরী)
(৮)বাসর রাতের পর স্বীয় আত্মীয় স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, শুভাকাংখী এবং গরীব মিসকীনদের তাউফীক অনুযায়ী ওলীমা খাওয়ানোর আয়োজন করা।” [মুসলিম/১৪২৭]
(৯)কোন পক্ষ যেওরের শর্ত করা নিষেধ এবং ছেলের পক্ষ থেকে যৌতুক চাওয়া হারাম।” [আহসানুল ফাতাওয়া ৫/১৩[
(১০)কনের ইযন এর জন্য স্বাক্ষীর কোন প্রয়োজন নাই। সুতরাং ছেলের পক্ষের লোক ইযন শুনতে যাওয়া অনর্থক এবং বেপর্দা। সুতরাং তা নিষেধ। মেয়ের কোন মাহরুম বিবাহের এবং উকীল হওয়ার অনুমতি নিবে।” [মুসলিম/১৪২১]
(১১)শর্ত আরোপ করে বর যাত্রীর নামে বরের সাথে অধিক সংখ্যাক লোকজন নিয়ে যাওয়া এবং কনের বাড়ীতে মেহমান হয়ে কনের পিতার উপর বোঝা সৃষ্টি করা আজকের সমাজের একটি জঘন্য কু-প্রথা, যা সম্পূর্ন রুপে পরিত্যাগ করা আবশ্যক।” [মুসনাদে আহমাদ/২০৭২২, বু খারী/২৬৯৭]
(১২)ওলীমায় অতিরিক্ত ব্যয় করা কিংবা খুব উচু মানের খানার ব্যবস্থা করা জরুরী নয়। বরং সামর্থানুযায়ী খরচ করাই সুন্নত আদায়ের জন্য যথেষ্ট। যে ওলীমায় শুধু ধনী ও দুনিয়াদার লোকদের দাওয়াত দেওয়া হয়, দ্বীনদার ও গরীব গরীব-মিসকিনদের দাওয়াত দেওয়া হয়না, সে ওলীমাকে হাদিসে নিকৃষ্টতম ওলীমা বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। সুতরাং এ ধরনের ওলীমা আয়োজন থেকে বিরত থাকা উচিত।” [আবু দাউদ /৩৭৫৪]

আল্লাহ আমাদের সবাইকে সুন্নত মোতাবেক বিবাহ করার তৌফিক দান করুন।

আমীন!!

Join Pure Matrimony!

শুধুমাত্র বাস্তব জীবনে ইসলাম চর্চাকারী অবিবাহিত মুসলিম ছেলেমেয়েদেরকে আল্লাহ্‌ভীরু জীবন সঙ্গী/সঙ্গিনী খুঁজে পেতে সহায়তা করাই “পিওর ম্যাট্রিমনি” ওয়েবসাইটের লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য। বিস্তারিত জানতে ভিজিট করুন  – https://quraneralo.net/purematrimony/

Facebook: http://www.facebook.com/purematrimonybd

জ্ঞানার্জন সম্পর্কে বিদ্বানদের উক্তি

১: লোকমান (আঃ) তার সন্তানকে বলেন, হে বৎস! তুমি এ জন্য জ্ঞানার্জন করো না যে তুমি জ্ঞানীদের সাথে অহংকার করবে কিংবা মূর্খদের উপর নিজেকে জাহির করবে অথবা বিভিন্ন মজলিসে নিজেকে বিশেষভাবে উপস্থাপন করবে। তুমি জ্ঞানকে উদাসীনতায় পরিত্যাগ করো না বা মূর্খতার মাঝে নিক্ষেপ করো না। হে বৎস! তুমি আপন চোখ দিয়ে দ্বীনী মজলিস বাছাই করে নাও। যখন কোন দলকে আল্লাহর স্মরণ করতে দেখবে তখন তাদের সাথে যোগ দিবে। তুমি যদি আলোচ্য বিষয়ে জ্ঞান রাখ তাহলেও তা তোমার জ্ঞানবৃদ্ধিতে সহায়তা করবে। আর যদি তা তোমার অজানা থাকে তবে তোমার নতুন কিছু জানা হবে। হতে পারে আল্লাহ তাদের উপর রহমত নাযিল করবেন যার একটি অংশ তুমিও প্রাপ্ত হবে। আর যে দল আল্লাহকে স্মরণ করে না তাদের সাথে বসবে না। কেননা যদি আলোচ্য বিষয়টি সম্পর্কে তোমার জ্ঞান থাকে তাহলে তা তোমাকে কোন ফায়দা দেবে না। পক্ষান্তরে যদি তা তোমার অজানা থাকে তাহলে তারা তোমাকে পথভ্রষ্ট ও অক্ষম করে ফেলবে। হতে পারে আল্লাহ তাদের উপর শাস্তি অবতীর্ণ করবেন যা তোমাকেও স্পর্শ করবে (আহমাদ হা/১৬৫১, দারেমী হা/৩৭৭, সনদ হাসান)।

: আলী (রাঃ) বলেন, জ্ঞান অর্থ-সম্পদের চেয়ে উত্তম। কেননা জ্ঞান তোমাকেই পাহারা দেয় কিন্তু অর্থকে পাহারা দিতে হয়। অথচ জ্ঞান হলো শাসক, আর অর্থ হলো শাসিত। অর্থ ব্যয় করলে নিঃশেষ হয়ে যায় কিন্তু জ্ঞান বিতরণ করলে আরো বৃদ্ধি পায় (গায্যালী, ইহয়াউল উলূম, ১/১৭-১৮)।

[dropcap]৩:[/dropcap] মু‘আয বিন জাবাল (রাঃ) বলেন, তোমরা জ্ঞানার্জন কর। কেননা আল্লাহর উদ্দেশ্যে জ্ঞানার্জনের অর্থ তাঁকে ভয় করা। জ্ঞানের আকাংখা করা ইবাদত। জ্ঞান চর্চা করা হলো তাসবীহ। জ্ঞানের অনুসন্ধান করা জিহাদ। অজ্ঞ ব্যক্তিকে জ্ঞান দেওয়া ছাদাকা। উপযুক্ত ক্ষেত্রে তা ব্যয় করা আল্লাহর নৈকট্য হাছিলের কারণ। আর তা হালাল-হারাম জানার মানদন্ড, একাকিত্বের বন্ধু, নিঃসঙ্গতার সঙ্গী, সুখ-দুঃখের ধ্রুবক, চরিত্রের সৌন্দর্য, অপরিচিতের সাথে পরিচিত হওয়ার মাধ্যম। আল্লাহ জ্ঞানের দ্বারা মানুষকে এমন মর্যাদাবান করেন যা স্থায়ীভাবে তাকে অনুসরণীয় করে রাখে (আল-আজুরী, আখলাকুল ওলামা, পৃঃ ৩৪-৩৫)।

[dropcap]৪:[/dropcap] আবু দারদা (রাঃ) বলেন, জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে উপার্জিত হয় যেমন ধৈর্য ধৈর্যধারণের মাধ্যমে অর্জিত হয়। যে ব্যক্তি কল্যাণের খোঁজে ব্যতিব্যস্ত হয় সে কল্যাণ লাভ করে। যে অকল্যাণ থেকে বাঁচার চেষ্টা করে সে অকল্যাণ থেকে রক্ষা পায় (কিতাবুল ইলম, ইবনে খায়ছামাহ, পৃঃ ২৮)।

তিনি বলেন, কোন মানুষ জ্ঞানী হয়ে জন্ম নেয় না। তাকে জ্ঞান অর্জন করতে হয় (কিতাবুল ইলম, ইবনে খায়ছামাহ, পৃঃ ২৮)।

[dropcap]৫:[/dropcap] হাসান বসরী (রহঃ) বলেন, অজ্ঞ আমলকারী পথহারা পথিকের ন্যায়। সে কল্যাণের চেয়ে অকল্যাণই বেশী করে। অতএব তুমি জ্ঞানার্জন কর এমনভাবে যাতে তা ইবাদতকে ক্ষতিগ্রস্থ না করে, আবার ইবাদত কর এমনভাবে যেন তা জ্ঞানার্জনকে ক্ষতিগ্রস্ত না করে। একদল লোক এমনভাবে ইবাদতে ডুবে থাকে যে তারা জ্ঞানার্জনের সুযোগ পায় না, অথচ তারা উম্মতে মুহাম্মাদীর উপর তরবারী চালিয়ে দেয়। যদি জ্ঞান থাকত তাহলে তারা এরূপ কর্মে লিপ্ত হতে পারত না।
মুজাহিদ বিন জুবায়ের বলেন, লজ্জা ও ভয় হলো জ্ঞানার্জনের প্রতিবন্ধকতা (ইবনে হাজার, ফাতহুল বারী , ১/২২৮ পৃঃ)।

[dropcap]৬:[/dropcap] সুফিয়ান ছাওরী (রহঃ) বলেন, যে বিষয় আমি জেনেছি তা যদি আমল করি তবেই আমি মানুষের মধ্যে সর্বাধিক জ্ঞানী, আর যদি প্রাপ্ত জ্ঞান অনুযায়ী আমল না করি তবে দুনিয়ার বুকে আমার চেয়ে অজ্ঞ আর কেউ নেই।

[dropcap]৭:[/dropcap] ইবনে মাসঊদ (রাঃ) বলেন, মুনাফিক জ্ঞানের পরিচয় দেয় মুখে আর মু’মিনের জ্ঞানবত্তা প্রকাশ হয় তার আমলের মাধ্যমে।
তিনি আরও বলেন, যদি জ্ঞানের অধিকারীগণ জ্ঞানকে সংরক্ষণ করতেন এবং যথার্থ স্থানে তাকে রাখতেন তবে তাঁরা দুনিয়াবাসীর উপর জয়লাভ করতেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে, তাঁরা জ্ঞানকে দুনিয়াদারদের কাছে সমর্পণ করেছেন দুনিয়াবী স্বার্থ হাছিলের অভিপ্রায়ে। ফলে তাঁরা অপদস্ত হয়েছেন।

হিল্লা বিয়ে ইসলাম বিরোধী ও নারীর প্রতি বৈষম্য

লেখকঃ মুফতি কাযী ইব্রাহিম

হিল্লা বিয়ে কি?

আভিধানিকভাবে হিল্লা বলতে উপায়, গতি, ব্যবস্থা, আশ্রয় ও অবলম্বন বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়। যেমন- তোমার কি কোন হিল্লা (গতি বা উপায়) হয়েছে? বা মেয়েটির কোন হিল্লা বা আশ্রয় হয়েছে? কিন্তু প্রচলিত পরিভাষায় হিল্লা বলতে, কোন স্বামীর তিন তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীকে এ শর্তে বিয়ে করা যে, বিয়ের পর সহবাস শেষে স্ত্রীকে তালাক দেবে, যেন সে পূর্বের স্বামীর জন্য হালাল হয়, সে তাকে পুনরায় বিয়ে করতে পারে।

এই হিল্লা বিয়ে শুধু বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আর ভারতে নয়, পৃথিবীর সব মুসলিম অধ্যুষিত দেশেই কম-বেশী প্রচলিত আছে। আরবে এই হিল্লা বিয়েকে হাল্লালা বলে। হিল্লা শব্দটি আরবী (حلة) ‌‍‘হালা’ থেকে এসেছে। এর অর্থ বৈধতা/বৈধকরণ। যদিও আরবী হালাল শব্দের অর্থ হলো ইসলামে অনুমোদনপ্রাপ্ত। কিন্তু হিল্লা বিয়ে মোটেই হালাল নয়।

হিল্লা বিবাহ হারাম এবং ই নয় বরং হিল্লা স্বামীর সাথে বিয়ে ও সহবাস হারাম। সে যাই হোক এখন প্রশ্ন হলো, তালাকের পরে আপন স্ত্রী যদি পর নারী হয়েই যায় তবে তাকে আবার বিয়ে করা বৈধ হওয়া উচিৎ। কেননা আপন ভগ্নী, খালা-ফুফু ইত্যাদি ছাড়া অন্য কাউকে বিবাহ করা জায়েজ। সে তো তখন ঐ গোত্রেই পরে।

প্রসঙ্গ বাংলাদেশ 

হিল্লা বিয়ে জানেন না এমন বাংলাদেশী হয়ত একজনও খুঁজে পাওয়া যাবে না। বাংলায় এটা কোনকালেই ছিল না কিন্তু এখন গত পনেরো বিশ বছর ধরে এটা খবরের কাগজে প্রায়ই ওঠে। গ্রাম-গঞ্জের কাঠমোল্লা ও মাতুব্বররা মিলে ফতোয়ার তাৎক্ষণিক আদালতে বিভিন্ন মামলার শারিয়া-মাফিক বিচার করে রায় ঘোষণা করেন। রাষ্ট্রীয় বৈধতা না থাকলেও সে-রায় প্রচণ্ড সামাজিক শক্তিতে অপরাধীর ওপরে প্রয়োগ করা হয়। হিল্লা হল এরই একধরনের শারিয়া-মামলা যাতে কোন হিল্লা বিয়ের-কারণে শারিয়া-আদালত কোন দম্পতির বিয়ে বাতিল ঘোষণা করেন। তারপর তাদের আবার বিয়ে দেবার শর্ত হিসেবে স্ত্রীকে অন্য লোকের সাথে বিয়ে ও সহবাসে বাধ্য করেন। দ্বিতীয় স্বামী স্বেচ্ছায় তালাক দিলে তবে সে আবার আগের স্বামীকে বিয়ে করতে পারে। এটা ঘটে প্রধানত স্বামী রাগের মাথায় স্ত্রীকে একসাথে তিনবার তালাক বলে ফেলেছে বলে, তার কথা শোনার সাক্ষী কখনো থাকে, কখনো থাকে না।

এক শ্রেণীর মূর্খ ও বক ধার্মিক লোকেরা, শিক্ষিত ও ব্যক্তিত্বশালী আলেমদের কাছে না গিয়ে অল্প শিক্ষিত মোল্লাদের পরামর্শে তালাক প্রাপ্তা মহিলাকে তার আগের স্বামীর কাছে ফিরিয়ে দেওয়া বা হালাল করে দেয়ার জন্য হিল্লা বিয়ের আয়োজন করে এবং এটিকে ইসলামের বিধান বলে চালিয়ে দেয়। যার ফলে বিতর্কিত এবং কলুষিত হচ্ছে ইসলামের সুন্দর বিধান ও মহান আদর্শ। আর ইসলামের শত্রুরা এটাকে তাদের মোক্ষম হাতিয়ার হিসেবে পেয়ে কুরআন ও ইসলামের কুৎসা রটনার ক্ষেত্রে তাদের কোন প্রচেষ্টার ত্রুটি রাখছে না। অথচ তারা হাদিস সম্পর্কে কোন জ্ঞানই রাখে না।

স্বামী কর্মক্ষেত্র থেকে বাড়ীতে ফিরেছে। এসে দেখলো এখনও রান্না শেষ হয়নি। বাস মাথায় উঠে গেল প্রচন্ড রাগ। স্ত্রীর সাথে শুরু করে দিল ঝগড়া। পেটে ক্ষুধা এবং মাথায় রাগ। এক পর্যাযে বলে ফেললো তালাক। বাস আর যাবে কোথায়? মসজিদের কাঠমোল্লা দিয়ে দিল তালাকের ফতোয়া। স্ত্রী চলে গেল বাবার বাড়ী। কিন্তু যখন স্বামীর মাথা ঠান্ডা হলো যখন নিজের ভুল বুঝতে পারলো। এবার স্ত্রীকে আনার জন্য উদগ্রীব। কিন্তু বাঁধ বসালো কাঠমোল্লা আর মাতুব্বর। স্ত্রীকে আনতে হলে হিল্লা বিয়ে দিতে হবে। কিন্তু কাঠমোল্লারা একটু চিন্তা-ভাবনা করে না যে, যেখানে রাগ হলো স্বামীর, দোষ করলো স্বামী এবং অপরাধী হলো স্বামী। সেখানে স্ত্রী কেন অপরাধী হবে? স্ত্রী কেন স্বামীর পাপের বোঝা বহন করবে?

কুরআন কি বলে?

কিছু কাঠমোল্লারা না বুঝলেও আল্লাহ পাক ঠিকই বোঝেন। তাই মহান আল্লাহ পাক এরশাদ করেন: “একে অপরের কৃতকর্মের জন্য দায়ী হইবে না” [সূরা নজম ৩৮]। এ কথা সবাই স্বীকার করবেন যে, অপরাধ হোক বা না-হোক, সেটা করেছে স্বামী। অথচ হঠাৎ তালাক দিলে নিরপরাধ স্ত্রীর জীবন ধ্বংস হয়ে যায়। সে হারায় তার স্বামী-সংসার ও সন্তান। কিন্তু একজনের অপরাধে অন্যের শাস্তি হওয়া চরম অন্যায়। সে জন্যই কুরআন কি চমৎকার বলেছে:“তাহাদের কর্ম সম্পর্কে তোমাদেরকে জিজ্ঞাসা করা হবে না” [সূরা বাকারা-১৪১]

তালাক এবং তাৎক্ষণিক-দ্বিতীয় বিয়ে (হিল্লা বিয়ে) সম্পূর্ণ কুরআন বিরোধী। কুরআন মোতাবেক কোন নারীকে বিয়েতে বাধ্য করার অধিকার কারো নেই। সেই সময়ে নারীকে এ অসাধারণ অধিকার দিয়েছে কুরআন। হিল্লা বিবাহ স্ত্রীকে দিয়ে জোরপূর্বক এক ধরণের বেশ্যাবৃত্তি, যা সম্পূর্ণ হারাম। এই হারাম কাজে যারা জড়িত থাকবে হোক সে মসজিদের ইমাম, অবশ্যই সে জাহান্নামী হবে।

নাবী কারীম (সাঃ) কি বলেছেন?


এবার আসুন নবী করিম (সাঃ) হিল্লা বিয়ে সম্পর্কে কি বলেন। ইসলামের ইতিহাসে হিল্লা বিবাহের কোন ঠাই নাই। নবীজি (সাঃ) হিল্লা বিবাহকে শুধু ঘৃনাই করতেন না, হিল্লাকারীদের উপর লানত করতেন। জামে আত তিরমিজী ইবনে মাসউদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত হাদিস। অর্থাৎ ইবনে মাসউদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: “রাসূলুল্লাহ (সাঃ) হিল্লাকারী এবং যার জন্য হিল্লা করা হয় উভয়কে লানত করেছেন।” ইমাম তিরমিজী বলেন (র), এই হাদিসটি হাসান সহিহ। [জামে আত তিরমিজী, ২য় খন্ড, হাদিস নং ১১২০, হুসাইন আল মাদানী প্রকাশনী]

ইবনে মাজাহ শরীফেও হযরত আলী (রা:) হতে বর্ণিত আছে: “রাসূলুল্লাহ (সাঃ) হিল্লাকারী এবং যার জন্য হিল্লা করা হয় উভয়কে লানত ((অভিসম্পাত) করেছেন।” [সুনানে ইবনে মাজাহ, ২য় খন্ড, ১৯৩৫ নং হাদিস, ইসলামিক ফাউন্ডেশন]

 উল্লেখ্য যে, হিল্লাকারী হলো দ্বিতীয় স্বামী এবং যার জন্য হিল্লা করা হয় সে হলো প্রথম স্বামী। হিল্লা সম্পর্কে সাহাবী উকবা বিন আমের (রাঃ) থেকে বর্ণিত হাদিস: “উকবা ইবনে আমের (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, “রাসূলুল্লুাহ (সাঃ) বলেছেন আমি কি তোমাদেরকে ভাড়া করা পাঠা সম্পর্কে বলবো? তারা বললোঃ অবশ্যই হে আল্লাহর রাসূল, তিনি বললেন, হিল্লাকারী। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, আল্লাহ হিল্লাকারী ও যার জন্য হিল্লা করা হয় উভয়কে অভিসম্পাত করেছেন।” [সুনানে ইবনে মাজাহ, ২য় খন্ড, ১৯৩৬ নং হাদিস, ইসলামিক ফাউন্ডেশন]

হাদিস দুটিতে লক্ষ্য করুন। প্রথম হাদিসে স্বামী এবং হিল্লাকারী পুরুষকে লানত করা হয়েছে। অর্থাৎ অভিশাপ দেওয়া হয়েছে, তারা আল্লাহর রহমত হতে বঞ্চিত। দ্বিতীয় হাদিসে হিল্লাকারী পুরুষকে ভাড়া করা পাঠার সাথে তুলনা করা হয়েছে। কোন ব্যক্তি যদি বলে আমি অমুকের স্ত্রীকে হিল্লা বিয়ে করে আবার তালাক দিব যাতে সে তার স্ত্রীকে পুনরায় গ্রহণ করতে পারে। হাদিস অনুযায়ী সে ব্যক্তি হলো ভাড়া করা পাঠা। আর এ পাঠার দলে যারা থাকে তারাও পাঠার দল। অতএব যে সমস্ত কাঠমোল্লা বা মাতুব্বর হিল্লাকে বৈধ মনে করবে তারাও পাঠা। আমার জানা মতে এই পাঠাকে একমাত্র কালি পূজায় বলি দেওয়া হয়। দেখুন হযরত উমর (রা) কি বলেন।

“হযরত আসরাম (র) কাবিসাবিল জাবের (রা) হতে বর্ণনা করেন, একদিন হযরত উমর (রা) তাঁর খেলাফতকালে মসজিদের মিম্বরে উঠে বললেন, আমার নিকট যদি এমন মামলা আসে যাতে হিল্লাকারী (২য় স্বামী) এবং যার জন্য হিল্লা করা হয় (১ম স্বামী) এমন কাউকে আনা হয়, আমি দুজনকেই পাথর মেরে হত্যা করবো।” যারা পাপ করে তারা পাপী এবং যারা সেই পাপের সহযোগিতা করে তারাও পাপী। অতএব সাবধান যারা হিল্লা বিবাহকে সহযোগিতা করবে তারাও পাপের অংশীদার।

যেভাবে শুরু হলো হিল্লা বিয়ের প্রথা:

এখন আসি কিভাবে হিল্লা বিয়ের প্রথা শুরু হলো। নবী (সাঃ) এর ওফাতের পর মানুষ ধীরে ধীরে ধর্ম থেকে দূরে সরে আসার কারণে এই মুসলিম সমাজে তালাকের প্রবণতা বেড়ে যায়। ফলে এর সমাধানের জন্য এক শ্রেণীর মোল্লাদের দ্বারা হিল্লা বিয়ের মত কু-প্রথা সমাজে চালু হয়ে পড়ে। আর এর জন্য নিন্মের কুরআনের আয়াতকে অপব্যবহার করা হয়। মূলত যে সমস্ত আলেম বা কাঠমোল্লা হিল্লা বিয়ে জায়েজ করতে চায় তারা কুরআন-হাদিস সম্পর্কে অজ্ঞ এবং অপব্যাখ্যা করে। আর তারা তাদের স্বার্থে সূরা বাকারার ২৩০ নং আয়াতকে দলিল হিসাবে তুলে ধরে। “তারপর যদি সে স্ত্রীকে তালাক দেয়, তবে সে স্ত্রী যে পর্যন্ত তাকে ছাড়া অপর কোন স্বামীর সাথে বিয়ে করে না নেবে, তার জন্য হালাল নয়। অতঃপর যদি দ্বিতীয় স্বামী তালাক দিয়ে দেয়, তাহলে তাদের উভয়ের জন্যই পরষ্পরকে পুনরায় বিয়ে করাতে কোন পাপ নেই, যদি আল্লাহ হুকুম বজায় রাখার ইচ্ছা থাকে। আর এই হলো আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত সীমা; যারা উপলব্ধি করে তাদের জন্য এসব বর্ণনা করা হয়।” [সূরা বাকারা-২৩০]

প্রকৃত বিশ্লেষণ 

কাঠামোল্লারা উপরের আয়াতের দোহাই দিয়ে হিল্লা বিবাহ জায়েজ করতে চায়। কিন্তু তারা গবেষণা করে না যে এই আয়াতটি কাদের জন্য প্রযোজ্য। তারা এটাও লক্ষ্য করে না যে, পরবর্তী ২৩২ নং আয়াতে আল্লাহ কি বলেছেন। এবার সূরা বাবাকার ২৩২ নং আয়াত লক্ষ্য করি। মহান আল্লাহ এরশাদ করেন: “তোমরা যখন স্ত্রীদেরকে তালাক দাও এবং তারা তাদের ইদ্দতকাল পূর্ণ করে তবে স্ত্রীগণ নিজেদের স্বামীদেরকে পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে বিয়ে করতে চাইলে তাদের বাঁধা দিও না। এ উপদেশ তাকেই দেয়া হচ্ছে, যে আল্লাহ ও কেয়ামত দিনের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করেছে। এর মধ্যে তোমাদের জন্য রয়েছে একান্ত পরিশুদ্ধতা ও অনেক পবিত্রতা। আর আল্লাহ জানেন, তোমরা জান না।” [সুরা বাকারা-২৩২]

উল্লেখিত আয়াতে দেখা যাচ্ছে যে, স্ত্রীকে তালাক দেওয়ার পর যদি নির্ধারিত ইদ্দত শেষও হয়ে যায়, তখন স্বামীর সাথে পারস্পারিক সম্মতিক্রমে বিয়ে করা যাবে। এখানে মনে হতে পারে যে, সূরা বাকারার ২৩০নং আয়াত ২৩২ নং আয়াতের সাথে বিরোধপূর্ণ, কিন্তু বাস্তবে তা নয়। উক্ত দুটি আয়াত ব্যাখ্যাগত দিক দিয়ে বিরোধপুর্ণ নয়। এ দুটি আয়াত বোঝার জন্য এখন হাদিস শরীফ অনুসন্ধন করতে হবে। দেখতে হবে নবীজি (সাঃ) কি করেছেন। তার আগে আমি সূরা বাকারার ২৩২ নং আয়াতে শানে নুজুল উল্লেখ করতে চাই। অর্থাৎ কোন প্রেক্ষাপটে সূরা বাকারার ২৩২ নং আয়াত নাজিল হযেছে। তাফসীরে ইবনে কাসীর-এ সূরা বাকারার ২৩২ নং আয়াতের শানে নুজুল সম্পর্কে উল্লেখ আছে-

“আয়াতটি হযরত মা’কাল বিন ইয়াসার (রা:) এবং তাঁর বোনের সম্বন্ধে অবর্তীর্ণ হয়। হযরত মা’কাল বিন ইয়াসার (রা:) বলেন, ‘আমার নিকট আমার বোনের বিয়ের প্রস্তাব আসলে আমি তার বিয়ে দেই। তার স্বামী কিছুদিন পর তাকে তালাক দেয়। ইদ্দত অতিক্রান্ত হওয়ার পর পুনরায় সে আমার নিকট বিয়ের প্রস্তাব করে। আমি তা প্রত্যাখ্যান করি। আমি শপথ করি যে, তার সাথে আমার বোনে বিবাহ দিব না। তখন এই আয়াতটি (সূরা বাকারার ২৩২ নং আয়াত) অবতীর্ণ হয়। এটা শুনে হযরত মা’কাল (রা:) বলেন, শপথ করা সত্বেও আমি আল্লাহর নির্দেশ শুনেছি এবং মেনে নিয়েছি। অতঃপর তিনি তাঁর বোনকে ডেকে পাঠিয়ে পুনরায় তার সাথে তাঁর বোনের বিয়ে দিয়ে দেন এবং নিজের কসমের কাফ্ফারা আদায় করেন। তাঁর বোনের নাম ছিল জামীল বিনতে ইয়াসার (রা:) এবং তাঁর স্বামীর নাম ছিল আবুল বাদাহ (রা:)।”

আয়াতের শানে নুজুলে দেখা যাচ্ছে কোন হিল্লা বিয়ে ছাড়াই হযরত মা’কাল বিন ইয়াসার (রা:) তার বোনকে পূর্বের স্বামীর সাথে বিবাহ দিলেন। ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক প্রকাশিত বুখারী শরীফ ৭ম খন্ড, ৪১৭৩ নং হাদিসেও উক্ত ঘটনা বর্ণিত আছে। তাই জোর দিয়ে বলা যায় সূরা বাকারার ২৩০ নং আয়াত দিয়ে হিল্লা বিবাহের যে অপব্যাখ্যা দেয়া হয় তা সম্পূর্ণ বানোয়াট। সূরা বাকারার ২৩০ নং আয়াতের ব্যাখ্যা ভিন্ন হবে যা, পরে আলোচনা করছি। আসলে ঐ সব মোল্লারা এই আয়াতের শানে নজুল জানে না বা নিজেদের স্বার্থ রক্ষার জন্য এই আয়াতের অপব্যাখ্যা করে থাকে। এবার আমি ২৩২ নং আয়াতের স্বপক্ষে কিছু হাদিস শরীফ পেশ করছি।

আবু দাউদ শরীফের কিতাবুত তালাক অধ্যায়ে ইবনে আব্বাস (রা:) হতে বর্ণিত: “তিনি বলেন, রুকানার পিতা আবদ ইয়াযীদ উম্মে রুকানাকে তালাক প্রদান করেন এবং যুযায়না গোত্রের জনৈক স্ত্রীলোককে বিবাহ করেন। সেই মহিলা নবী করীম (সা:) এর খিদমতে উপস্থিত হয়ে বলে, সে সহবাসে অক্ষম, যেমন আমার মাথার চুল অন্য চুলের কোন উপকারে আসে না। কাজেই আপনি তার ও আমার মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটিয়ে দিন। এতশ্রবণে নবী করীম (সা:) রাগান্বিত হন এবং তিনি রুকানা ও তার ভাইদিগকে আহবান করেন। এরপর তিনি সেখানে উপস্থিত করে সাথীদের সম্বোধন করে বলেন, তোমারা লক্ষ্য করে দেখ যে, এদের মধ্যে অমুক অমুকের বিশেষ অঙ্গ প্রত্যঙ্গ তাদের পিতা আবদ ইয়াযীদের অঙ্গ প্রত্যঙ্গের সঙ্গে কি মিল খাচ্ছে না? তখন তারা বলেন, হ্যাঁ। নবী করীম (সাঃ) আবদ ইয়াযীদকে বলেন, তুমি তাকে তালাক দিয়ে দাও। তিনি তাকে তালাক দিলেন। এরপর তিনি তাকে নির্দেশ দেন যে, তুমি উম্মে রুকানাকে (পূর্ব স্ত্রী) পুনরায় গ্রহণ কর। তখন তিনি বলেন, আমি তো তাকে তিন তালাক প্রদান করেছি, ইয়া রাসূল্লাহ! তখন তিনি বলেন, আমি তোমার তালাক প্রদানের কথা অবগত আছি। তুমি তাকে পুনরায় গ্রহণ কর। এরপর তিনি কুরআনের আয়াত তিলাওয়াত করেন, ‘হে নবী! যখন তোমাদের স্ত্রীদের তালাক প্রদান করবে, তখন তাদেরকে ইদ্দত পালনের জন্য তালাক দিবে।”ইমাম আবু দাউদ (রা:) বলেন, আবদ ইয়াযীদ তার স্ত্রীকে তালাক প্রদান করলে নবী করিম (সা:) তাকে পুনরায় গ্রহণের জন্য নির্দেশ প্রদান করেন।” [আবু দাউদ শরীফ, ৩য় খন্ড, ২১৯৩নং হাদিস, ইসলামিক ফাউন্ডেশন]

উক্ত হাদিস শরীফে দেখা যাচ্ছে যে, উম্মে রুকানাকে নবী করীম (সাঃ)হিল্লা বিবাহ ছাড়াই তার স্বামী আবদ ইয়াযীদ এর সাথে পুনরায় বিবাহ দিলেন। অতএব নবীজি হিল্লা বিবাহকে হারাম জানতেন তা প্রমানিত হলো।

 ইবনে আব্বাস (রা) ও উমার (রা) হতে বর্ণিত: “নবী করীম (সাঃ) হযরত হাফসা (রা) কে তালাক প্রদান করেন। এরপর তিনি তাঁকে পুনরায় স্বীয় স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেন।” [আবু দাউদ শরীফ, ৩য় খন্ড, ২২৭৭ নং হাদিস এবং সুনানে নাসাই শরীফ, ৩য় খন্ড, ৩৫৬১নং হাদিস, ইসলামিক ফাউন্ডেশন]

এ হাদিসেও হিল্লা বিবাহের কোন অস্তিত্ব নেই। হিল্লা বিবাহ ছাড়াই নবীজি (সাঃ) হযরত হাফসা (রাঃ) কে পুনরায় বিবাহ করলেন। তাই হিল্লা বিবাহ অবৈধ, ইহাতে কোন সন্দেহ নেই। যেহেতু সূরা বাকারার ২৩২ নং আয়াত সম্পর্কে হাদিস শরীফে প্রমান পাওয়া যায় যে, হিল্লা বিয়ে ছাড়াই তালাকের পর পুনরায় স্ত্রীকে গ্রহণ করা যায়, সেহেতু ২৩০ নং আয়াতের ব্যাখ্যা ভুল। সূরা বাকারার ২৩০ নং আয়াত ঐ সমস্ত নারীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, যারা তালাক প্রাপ্ত হয়ে যাবার পর স্বেচ্ছায় দ্বিতীয় স্বামী গ্রহণ করে এবং পরবর্তীতে আবার পুর্বের স্বামীর নিকট ফিরে যেতে চায়।

 শেষ কথা

উল্লেখিত হাদিসসমূহ হতে আমরা সূরা বাকারার ২৩০ নং আয়াতে ব্যাখ্যা বুঝতে পারলাম। অর্থাৎ প্রথম স্বামী স্ত্রীকে তালাক দিলে ঐ স্ত্রী যদি স্বেচ্ছায় দ্বিতীয় বিবাহ করে, তবে ঐ স্ত্রী পূর্বের স্বামীর নিকট ফিরে যেতে পারবে না, যতক্ষন না দ্বিতীয় স্বামী স্বেচ্ছায় ঐ স্ত্রীকে তালাক না দেয়।

আর সূরা বাকারার ২৩২ নং আয়াতের ব্যাখ্যা হলো, যদি স্ত্রী প্রথম স্বামীর নিকট হতে তালাক প্রাপ্ত হওয়ার অন্য কোথাও বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ না হয়, তবে সে পূর্বের স্বামীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারবে উভয়ের সম্মতিতে। এতে কোন ধমীয় বা আইনি বাঁধা থাকবে না। হিল্লা বিয়ে নামে যা প্রচলিত আছে, তা হারাম এবং অনৈসলামিক কর্মকান্ড। তাই সূরা বাকারার ২৩০ ও ২৩২ নং আয়াত দুটি ব্যাখ্যাগত দিক দিয়ে অনুরসণ যোগ্য।

আমাদের দেশে সেই পাকিস্তানী আমল থেকে ১৯৬১ সালে মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ দ্বারা তালাকে বিদা নিষিদ্ধ এবং হিল্লা বিয়ের প্রথা নিষিদ্ধ করা হয়। আশা করি বিশ্বের অন্যান্য মুসলিম দেশেও এই আইন কার্যকর হবে এবং হিল্লা বিয়ের মত অনৈসলামিক প্রথা চিরতরে ইসলামী সমাজ থেকে বন্ধ করা যাবে। এ ব্যাপারে আমাদের সকলকে সচেতন হতে হবে যেন ধর্মের নামে হিল্লা বিয়ে দিয়ে কোন মা-বোনের ইজ্জত নিয়ে ছিনিমিনি খেলা না হয়। যদি কোথাও এরকম কোন দুঃখজনক পরিস্থিতি দেখা দেয় তবে সেই বিপদের হাত থেকে অসহায় নারীকে উদ্ধার করা ওয়াজিব। জেনে শুনে যারা অসহায়কে সাহায্য করে না তাদের উপর আল্লাহর রহমত আসে না। এ ব্যাপারে কারো সহযোগিতা না পেলে সরাসরি স্থানীয় প্রশাসন, থানা অথবা গণমাধ্যমকর্মীর সাহায্য নিন। একজন অসহায় নারীকে বিপদ হতে উদ্ধারের জন্য আল্লাহ পাক আপনাকে বড় ধরণের কোন পুরস্কার দিবেন। আল্লাহ আমাদের সকলকে ইসলামের সঠিক বুঝ দান করুন এবং হিল্লা বিবাহে প্রতিরোধ গড়ে তোলার তাওফিক দিন। আমিন

বইঃ তাহক্বীক্ব বুলুগুল মারাম – ফ্রী ডাউনলোড

Bulugu Maram

সংক্ষিপ্ত বর্ণনাঃ  হাদীসের সংকলন গ্রন্থগুলোর মধ্যে ইবনে হাজার আসকালানী (রহ) রচিত বুলুগুল মারাম মিন আদিল্লাতিল আহকাম প্রসিদ্ধ। এটি এমন একটি গ্রন্থ যা মধ্যপ্রাচ্য ছাড়াও প্রায় সারা বিশ্বের ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচির অন্তভূক্ত।

আমাদের দেশেও বহুকাল হতে মাদরাসায় দারসে নিযামী মাদরাসায় এটি পাঠদান করা হচ্ছে। তথাপি এ গ্রন্থটি এতোই গুরুত্বপূর্ণ যে বহু ইসলামী স্কলার, মুহাদ্দিস এটিকে নিয়ে গবেষণা করেছেন।

তন্মধ্যে আল্লামা সানআনী, নাসিরুদ্দীন আলবানী, বিন বায,সালিহ আল উসায়মীন, সালিহ আল ফাওযান, শাইখ সুমাইর আয যুহাইরী, সফিউর রহমান মুবারকপুরী প্রমুখ। এর মধ্যে শাইখ সালিত আল ফাওযান বুলুগুল মারাম বিশ্লেষণ করেছেন ১০ খন্ডে। এ গ্রন্থটিতে প্রায় প্রতিটি গ্রন্থ থেকে উপকারী টীকা গ্রহণ করেছি। পাশাপাশি দুর্বল হাদীসগুলোর গুণাগুণ বিশ্লেষণে আরও বহু প্রসিদ্ধ গ্রন্থ ও প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিসগণের প্রসিদ্ধগন্থেরও সহযোগীতা নেয়া হয়েছে।

তাহক্বীক বুলুগুল মারামের বিশেষ বৈশিষ্ট্যসমূহ:

১. শাইখ সুমাইর আয যুহাইরী সম্পাদিত বুলুগুল মারামের নম্বর অনুসরণ করা হয়েছে। তবে মূলত: শাইখ সালিত আল ফাওযান এর মিনহাতুল আল্লাম ফী শারহে বুলুগিল মারাম এর ১০ খন্ড থেকে হাদীসের বিষয়বস্তুর উপর তৈরী করা শিরোনাম সংযোজন করা হয়েছে। যার মাধ্যমে খুব সহজেই পাঠকগণ বুঝতে পারবেন যে পরবর্তী হাদীসে কী সম্পর্কে আলোচনা আসছে। আর এটিই এ গ্রন্থের একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য।

২. প্রতিটি হাদীসের তাখরীজ করা হয়েছে, যার মধ্যে বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী, আবূ দাউদ, নাসায়ী, ইবনু মাজাহ, দারেমী, মুওয়াত্তা মালিক, মুসনাদ আহমাদসহ অন্যান্য গ্রন্থের হাদীস নম্বর উল্লেখ করা হয়েছে। এ নম্বরগুলো মূলত: একই বিষয়ের হাদীসগুলোর মধ্যে যেগুলো পূর্ণাঙ্গ, আংশিক কিংবা বিষয়ের সাথে সংশ্লিষ্টতা রয়েছে এমন হাদীসের নম্বর।

৩. বুলুগুল মারামের দুর্বল ও সমস্যা সম্বলিত হাদীসগুলোকে আলাদা বক্সে দেখানো হয়েছে। হাদীস ও এর সনদ সম্পর্কে মুহাদ্দিসগণের উক্তি, হাদীস নম্বর অথবা খন্ড ও পৃষ্ঠা নম্বরসহ উল্লেখ করা হয়েছে। দুর্বল হাদীসগুলোকে দুর্বল রাবী চিহ্নিত করে তার সম্পর্কে মুহাদ্দিসগণের সমালোচনা তুলে ধরা হয়েছে। সনদ বিষয়ে মুহাদ্দিসগণের ভিন্নমতও তুলে ধরা হয়েছে।

৪. হাদীস বর্ণনাকারীদের সংক্ষিপ্ত পরিচিত তুলে ধরা হয়েছে।

৫. সহায়ক গ্রন্থের প্রায় শতাধিক গ্রন্থের প্রকাশকাল, প্রকাশনা সহ আনুষঙ্গিক তথ্য সন্নিবেশ করা হয়েছে।

৬. আরবী বর্ণমালা অনুযায়ী বুলুগুল মারামে ব্যবহৃত শব্দগুলো নিয়ে “বুলুগুল মারামের বাছাইকৃত শব্দকোষ’-এ প্রায় ১৩৫০টি শব্দের অর্থ উল্লেখ করা হয়েছে।

তাহক্বীক্ব বুলুগুল মারাম – QuranerAlo Server
তাহক্বীক্ব বুলুগুল মারাম – QuranerAlo Server

তাহক্বীক্ব বুলুগুল মারাম – Mediafire
তাহক্বীক্ব বুলুগুল মারাম – Mediafire

সালাত ও পবিত্রতা – শর্ত, ফরজ ও ওয়াজিবসমূহ

solat1

 শায়খ আল্লামা আব্দুল আযীয ইবন আব্দুল্লাহ ইবন বায (রহিমাহুল্লাহ)

অনুবাদ : মোহাম্মদ রকীবুদ্দীন আহমাদ হুসাইন |  সম্পাদনা : ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া

সালাতের শর্তাবলী

সালাতের শর্তাবলী মোট ৯টি। যথাঃ

  1. ইসলাম
  2. বুদ্ধিমত্তা
  3. ভাল-মন্দ পার্থক্যের জ্ঞান হওয়া
  4. নাপাকি দূর করা
  5. ওজু করা
  6. সতরে আওরাত অর্থাৎ লজ্জাস্থানসহ শরীরের নির্ধারিত অঙ্গগুলো আবৃত রাখা
  7. সালাতের সময় উপস্থিত হওয়া
  8. কিবলামুখী হওয়া এবং
  9. নিয়ত করা, নিয়ত পড়া নয়

ওজুর ফরজসমূহ

এগুলো মোট ৬টি। যথাঃ

  1. মুখমণ্ডল ধৌত করা; পানি দিয়ে নাক ঝাড়া ও কুলি করা এর অন্তর্ভুক্ত,
  2. কনুই পর্যন্ত উভয় হাত ধৌত করা,
  3. সম্পূর্ণ মাথা মসেহ করা; উভয় কান উহার অন্তর্ভুক্ত,
  4. গোড়ালী পর্যন্ত উভয় পা ধৌত করা,
  5. ওজুর কার্যাবলী পর্যায়ক্রমে সম্পন্ন করা এবং
  6. এগুলো পরপর সম্পাদন করা

উল্লেখ থাকে যে, মুখমণ্ডল, উভয় হাত ও পা তিনবার করে ধৌত করা মুস্তাহাব। একইভাবে কুলি করা ও নাকে পানি দিয়ে তিনবার ঝাড়া মুস্তাহাব। ফরজ মাত্র একবারই। তবে, মাথা মসেহ একাধিকবার করা মুস্তাহাব নয়। এই ব্যাপারে কতিপয় সহীহ হাদীস বর্ণিত আছে।

 

সালাতের রুকন (ফরজ)সমূহ

সালাতের রুকন ১৪টি। যথাঃ

  1. সমর্থ হলে সালাতে দণ্ডায়মান হওয়া,
  2. ইহরামের তাকবীর বলা,
  3. সূরা ফাতিহা পড়া,
  4. রুকুতে যাওয়া,
  5. রুকু হতে উঠে সোজা দণ্ডায়মান হওয়া,
  6. সপ্তাঙ্গের উপর ভর করে সিজদা করা,
  7. সিজদা থেকে উঠা,
  8. উভয় সিজদান মধ্যে বসা,
  9. সালাতের সকল কর্ম সম্পাদনে স্থিরতা অবলম্বন করা,
  10.  সকল রুকন ধারাবাহিকভাবে তরতীবের সাথে সম্পাদন করা,
  11.  শেষ বৈঠকে তাশাহ্হুদ পড়া,
  12.  তাশাহহুদ পড়ার জন্য শেষ বারে বসা,
  13.  নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপর দরূদ পড়া এবং
  14.  ডানে-বামে দুই সালাম প্রদান করা।

 

সালাতের ওয়াজিবসমূহ

এগুলোর সংখ্যা হলো মোট ৮টি। যথাঃ

  1. ইহরামের তাকবীর ব্যতীত অন্যান্য তাকবীরগুলো বলা,
  2. ইমাম ও একা নামাজীর পক্ষে ‘সামি‘আল্লাহু লিমান হামিদাহ্’ বলা,
  3. সকলের পক্ষে ‘রববানা ওয়া লাকাল হামদ’ বলা,
  4. রুকুতে ‘সুবহানা রব্বিয়াল ‘আজীম’ বলা,
  5. সিজদায় ‘সুবহানা রব্বিয়াল আ‘লা’ বলা,
  6. উভয় সিজদার মধ্যে ‘রাব্বিগফিরলী’ বলা,
  7. প্রথম তাশাহ্হুদ পড়া
  8. দ্বিতীয় রাকা‘আতে প্রথম তাশাহ্হুদ পড়ার জন্য বসা। [1]

[1] বি.দ্র.: এখানে ওজুর শর্তাবলীসহ সালাতের শর্ত, রুকন ও ওয়াজিবগুলো মাননীয় মুফতী প্রধান শায়খ আব্দুল আযীয ইবন বায কর্তৃক লিখিত কিতাব ‘গুরুত্বপূর্ণ দরসসমূহ’ থেকে উদ্ধৃত করা হয়েছে। — অনুবাদক

শির্কের হাকিকত ও তার প্রকারসমূহ কি?

অনুবাদক: সানাউল্লাহ নজির আহমদ | সম্পাদনা: ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া
প্রশ্ন:

আমি প্রায় পড়ি “এটা বড় শির্ক ওটা ছোট শির্ক”, কিন্তু বিষয়গুলো আমার নিকট স্পষ্ট নয়, আপনি কি আমাকে শির্কের হাকিকত এবং ছোট ও বড় শির্কের মাঝে পার্থক্য স্পষ্ট করে বলবেন?

উত্তর:

আল-হামদুলিল্লাহ,

মুসলিম হিসেবে প্রত্যেকের জন্যই শির্কের অর্থ, ভয়াবহতা ও তার প্রকারসমূহ জানা ফরয ও অবশ্য জরুরি, তবেই তার তাওহীদ পরিপূর্ণ, ইসলাম নিরাপদ ও ঈমান বিশুদ্ধ হবে। অতএব আল্লাহর উপর ভরসা করে বলছি, তিনি আপনাকে তার হিদায়েতের তাওফিক দান করুন। জেনে রাখুন, শির্কের আভিধানিক অর্থ অংশীদার সাব্যস্ত করা, অর্থাৎ কাউকে অপরের অংশীদার বানানো। সাধারণত দু’জনের মাঝে কোনো বস্তু বণ্টন করা হলে বলা হয়: أشرك بينهما ‘সে তাদের উভয়ের মাঝে শরীক করেছে’, অথবা বলা হয়: أشرك في أمره غيره ‘সে তার বিষয়ে অপরকে অংশীদার করেছে’, যখন বিষয়টি দু’জনের জন্য নির্ধারণ করা হয়।

শরীয়তের পরিভাষায় শির্ক: আল্লাহর রুবুবিয়াত অথবা তার ইবাদত অথবা তার নাম ও গুণাবলিতে অংশীদার বা সমকক্ষ নির্ধারণ করা। আল্লাহ তা‘আলা কুরআনুল কারিমের বহু আয়াতে তার সমকক্ষ ও শরীক গ্রহণ করতে নিষেধ করেছেন, যারা তার সমকক্ষ নির্ধারণ করে, তাদের তিনি নিন্দা করেছেন, যেমন তিনি বলেন: “সুতরাং তোমরা জেনে-বুঝে আল্লাহর জন্য সমকক্ষ নির্ধারণ করো না।[1]

অপর আয়াতে তিনি বলেন: “আর তারা আল্লাহর জন্য সমকক্ষ নির্ধারণ করে, যেন তারা তার পথ থেকে বিভ্রান্ত করতে পারে। বল, ‘তোমরা ভোগ করতে থাক, কেননা, তোমাদের গন্তব্য তো আগুনের দিকে। [2]

নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “যে এমতাবস্থায় মারা গেল যে, সে আল্লাহ ছাড়া কোনো সমকক্ষ আহ্বান করত, সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে।[3]

শির্কের প্রকার:

কুরআন ও হাদিসের দলিলসমূহ প্রমাণ করে যে, আল্লাহর সাথে শির্ক ও তার সমকক্ষ নির্ধারণের ফলে ব্যক্তি কখনো দীন থেকে বের হয়ে যায়, কখনো দীন থেকে বের হয় না। এ জন্য আলেমগণ শির্ককে দু’ভাগে ভাগ করেছেন: বড় শির্ক ও ছোট শির্ক। নিম্নে প্রত্যেক প্রকার শির্কের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি পেশ করা হল:

(এক) বড় শির্ক বা শির্কে আকবার: শির্কে আকবার বলা হয়, একমাত্র আল্লাহর হককে আল্লাহ ব্যতীত কাউকে নিবেদন করা, যেমন তার রুবুবিয়াতের কোনো অংশ, অথবা তার উলুহিয়াতের কোনো অংশ, অথবা তার নাম ও গুণাবলির কোনো অংশকে তিনি ব্যতীত কাউকে নিবেদন করা বড় শির্ক। এ জাতীয় শির্ক কখনো হয় প্রকাশ্য, যেমন দেবদেবী ও মূর্তি পূজকদের শির্ক; কবর-মাজার, মৃত ও গায়েবি ব্যক্তি পূজকদের শির্ক ইত্যাদি।

কখনো হয় অপ্রকাশ্য, যেমন আল্লাহ ব্যতীত অন্যান্য প্রভুদের উপর ভরসাকারীদের শির্ক। অথবা যেমন মুনাফিকদের কুফর ও শির্ক, তাদের শির্ক যদিও বড়-ব্যক্তিকে দীন থেকে বের করে দেয় এবং তারা চিরদিন জাহান্নামে থাকবে, তবুও এ শির্ককে খফি ও অপ্রকাশ্য শির্ক বলা হয়, কারণ তারা বাহ্যিকভাবে ইসলাম প্রকাশ করে অন্তরে কুফর ও শির্ক গোপন করেছে, তাই তারা অপ্রকাশ্য মুশরিক, বাহ্যিকভাবে নয়।

এ জাতীয় শির্ক কখনো হয় আকিদাগত, যেমন বিশ্বাস করা যে, আল্লাহর সাথে কোনো সত্তা আছে যে সৃষ্টি করে, অথবা জীবিত করে, অথবা মৃত্যু দেয়, অথবা মালিকানার হকদার, অথবা এ জগতে কর্তৃত্বের অধিকারী। অথবা এরূপ বিশ্বাস করা যে, অমুক সত্তা আল্লাহর ন্যায় নিঃশর্ত আনুগত্যের হকদার, ফলে সে কোনো বস্তু হালাল ও হারাম করার ক্ষেত্রে তার ইচ্ছার আনুগত্য করে, যদিও তা রাসূলদের আনিত দীনের বিপরীত হয়। অথবা মহব্বত ও সম্মানের ক্ষেত্রে আল্লাহর সাথে শির্ক করা, যেমন আল্লাহকে মহব্বত করার ন্যায় কোনো মখলুককে মহব্বত করা। এ জাতীয় শির্ক আল্লাহ ক্ষমা করবেন না, এ শির্কের ব্যাপারে তিনি বলেছেন: “আর মানুষের মধ্যে এমনও আছে, যারা আল্লাহ ছাড়া অন্যকে আল্লাহর সমকক্ষরূপে গ্রহণ করে, তাদেরকে আল্লাহকে ভালবাসার মত ভালবাসে।[4]

অথবা এমন বিশ্বাস করা যে, কোনো সত্তা আছেন যিনি আল্লাহর সাথে গায়েব জানেন। এ জাতীয় বিশ্বাস সাধারণত গোমরাহ ও পথভ্রষ্ট দলসমূহে বেশী দেখা যায়, যেমন শিয়া-রাফেযী, সূফী ও বাতেনি ফেরকাসমূহ। শিয়া-রাফেযিরা তাদের ইমামদের ব্যাপারে বিশ্বাস করে তারা গায়েব জানেন, অনুরূপ বাতেনি ও সূফীরা তাদের অলীদের ব্যাপারে গায়েব জানার ধারণা করে। অথবা এরূপ বিশ্বাস করা যে, কোনো সত্তা আছেন যে আল্লাহর ন্যায় অনুগ্রহ প্রদর্শন করতে পারেন, যেমন পাপ মোচন করা, বান্দাদের ক্ষমা করা ও তাদের অপরাধ মাফ করা।

এ জাতীয় শির্ক কখনো হয় কথা-বার্তায়, যেমন আল্লাহ ব্যতীত কারো নিকট দোয়া করা, অথবা ফরিয়াদ করা, অথবা সাহায্য তলব করা, অথবা আশ্রয় প্রার্থনা করা, হোক সে নবী, অথবা অলী, অথবা ফেরেশতা অথবা জিন, অথবা অন্য কোনো মখলুক। এ সব বড় শির্ক, মানুষকে দীন থেকে বের করে দেয়। অথবা আল্লাহর দীনের সঙ্গে ব্যঙ্গ করা, অথবা আল্লাহকে তার মখলুকের সঙ্গে তুলনা করা, অথবা আল্লাহর সাথে দ্বিতীয় কাউকে সৃষ্টিকর্তা, অথবা রিজিকদাতা, অথবা পরিকল্পনাকারী জ্ঞান করা। এসবই বড় শির্ক ও মহাপাপ যা ক্ষমা করা হবে না।

কখনো এ জাতীয় শির্ক প্রকাশ পায় কাজে, যেমন আল্লাহ ব্যতীত কারো জন্য যবেহ করা, অথবা সালাত পড়া অথবা সেজদা করা, অথবা আল্লাহর বিধানের ন্যায় বিধান রচনা করে মানুষের উপর চাপিয়ে দেওয়া এবং তা মেনে নিতে বাধ্য করা। অনুরূপ কাফেরদের পক্ষ নেওয়া ও মুমিনদের বিরুদ্ধে তাদেরকে সাহায্য করা, ইত্যাদি কর্মগুলো মৌলিক ঈমান পরিপন্থী এবং ব্যক্তিকে ইসলাম থেকে বের করে দেয়। আল্লাহর নিকট এসব শির্ক থেকে আমরা ক্ষমা ও নিরাপত্তা চাই।

(দুই) ছোট শির্ক: যেসব শির্ক বড় শির্কের বাহন, অথবা যেসব শির্ককে কুরআন ও সুন্নায় ছোট শির্ক বলা হয়েছে, যতক্ষণ না সেগুলো বড় শির্কের পর্যায়ে পৌঁছে, ছোট শির্ক।

এ জাতীয় শির্ক সাধারণত দু’ভাবে হয়:

(১) কোনো বস্তুকে উপায় হিসেবে গ্রহণ করা, আল্লাহ যার অনুমতি প্রদান করেননি, যেমন হাতের পাঞ্জা ও পুঁতি ইত্যাদি এ বিশ্বাসে ঝুলিয়ে রাখা যে, এগুলো নিরাপত্তার উপায়, অথবা নজর লাগা প্রতিহত করবে, অথচ আল্লাহ সেগুলোকে শরীয়ত ও তাকদীর কোনো বিচারেই উপায় বানাননি।

(২) কোনো মহান বস্তুকে অতিরিক্ত সম্মান দেওয়া-যা আল্লাহর রুবুবিয়াতের সমান নয়, যেমন গায়রুল্লাহর নামে কসম খাওয়া; অথবা এরূপ বলা যে, ‘যদি আল্লাহ ও সে না থাকত …’ ইত্যাদি ছোট শির্কের অন্তর্ভুক্ত। আর যদি আল্লাহর রুবুবিয়াতের সমপরিমাণ মর্যাদা দেওয়া হয় তাহলে বড় শির্ক।

আলেমগণ কতক নীতিমালা তৈরি করেছেন, যার দ্বারা কুরআন ও হাদিসে বর্ণিত শির্কগুলো ছোট-বড় দু’ভাগে ভাগ করা যায়, যেমন:

(১) কোনো কাজকে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক ছোট শির্ক আখ্যা দেওয়া, যেমন মাহমুদ ইবনে লাবিদ সূত্রে মুসনাদে আহমদে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “নিশ্চয় সবচেয়ে বড় ভয়, যা আমি তোমাদের উপর আশঙ্কা করি, তা হচ্ছে ছোট শির্ক। তারা বলল, হে আল্লাহর রাসূল, ছোট শির্ক কি? তিনি বললেন: ‘রিয়া’, [লোক দেখানো আমল]। আল্লাহ তা‘আলা [রিয়াকারীদের] বলবেন, যে দিন বান্দাদেরকে তাদের আমলের প্রতিদান দেওয়া হবে, তোমরা তাদের কাছে যাও, দুনিয়াতে যাদেরকে তোমরা তোমাদের আমল দেখাতে, দেখ তাদের নিকট কোনো প্রতিদান পাও কিনা।[5]

(২) কুরআন ও হাদিসের কোথাও যদি শির্ক শব্দটি অনির্দিষ্টভাবে তথা নাকেরাহ ব্যবহৃত হয়, অর্থাৎ তার সাথে আলিফ ও লাম পদাশ্রিত নির্দেশক দু’টি হরফ সংযুক্ত না থাকে, তাহলে সাধারণত তার উদ্দেশ্য হয় ছোট শির্ক। এ প্রকার শির্কের উদাহরণ অনেক, যেমন নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “নিশ্চয় ঝাড়-ফুক, [6] তাবিজ ও তিওয়ালাহ্ হচ্ছে শির্ক। [7]

এ হাদিসে شرك শব্দটি পদাশ্রিত নির্দেশক দু’টি হরফ ال বিহীন এসেছে, তাই এ শির্ক দ্বারা উদ্দেশ্য ছোট শির্ক, বড় শির্ক নয়। [8]

তামিমাহ: মাদুলি জাতীয় বস্তু, যা বদ নজর থেকে সুরক্ষার জন্য বাচ্চাদের গলায় ঝুলানো হয়।
তিওয়ালাহ: এটা তামিমাহ জাতীয় বস্তু, যা স্ত্রীকে স্বামীর নিকট ও স্বামীকে স্ত্রীর নিকট প্রিয়পাত্র বানানোর জন্য দেওয়া হয়।

(৩) কুরআন ও হাদিসে ব্যবহৃত শির্ক শব্দের অর্থ যদি সাহাবিগণ ছোট শির্ক বলেন, তাহলে তার উদ্দেশ্য ছোট শির্ক। সাহাবিদের কথা আমাদের জন্য দলিল, কারণ তারা আল্লাহর দীনকে সবচেয়ে বেশী বুঝতেন এবং শরীয়ত প্রণেতার উদ্দেশ্য সবচেয়ে বেশী জানতেন। একটি উদাহরণ, ইমাম আবু দাউদ রাহিমাহুল্লাহ ইবনে মাসদউদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু সূত্রে বর্ণনা করেন, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “কুলক্ষণ নেওয়া শির্ক, কুলক্ষণ নেওয়া শির্ক, তিনবার। আমাদের মধ্যে কেউ নেই, তবে অবশ্যই [সে কুলক্ষণ গ্রহণ করে], কিন্তু তাওয়াক্কুলের কারণে আল্লাহ তা দূর করে দেন।[9]

বিজ্ঞ মুহাদ্দিসগণ বলেছেন এ হাদিসে وَمَا مِنَّا إِلا থেকে পরবর্তী অংশ ইবনে মাসউদের বাণী। তার এ কথা প্রমাণ করে, তিনি বুঝেছেন কুলক্ষণ নেওয়া ছোট শির্ক, অন্যথায় তার কথা وَمَا مِنَّا إِلا এর অর্থ দাঁড়ায় “আমাদের মধ্যে কেউ নেই, যে বড় শির্কে পতিত হয় না”, যা বাস্তবতার বিপরীত। দ্বিতীয়ত বড় শির্ক আল্লাহ তা‘আলা তাওয়াক্কুলের কারণে দূর করেন না, বরং তার জন্য তাওবা জরুরি। অতএব এ হাদিসে শির্ক অর্থ ছোট শির্ক।

(৪) নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক শির্ক অথবা কুফর শব্দের ব্যাখ্যা দেওয়া যে, তার দ্বারা ছোট শির্ক উদ্দেশ্য, বড় শির্ক নয়, যেমন ইমাম বুখারি ও ইমাম মুসলিম যায়েদ ইবনে খালিদ আল-জুহানি রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু সূত্রে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন: নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের নিয়ে হুদাইবিয়ায় সকালের সালাত আদায় করলেন, সে রাতে বৃষ্টি হয়েছিল। সালাত শেষে তিনি মানুষের দিকে মুখ করে বসলেন, অতঃপর বললেন: “তোমরা কি জান, তোমাদের রব কি বলেছেন”? তারা বলল: আল্লাহ ও তার রাসূলই ভালো জানেন। তিনি [আল্লাহ] বলেছেন: “আমার কতক বান্দা আমার উপর ঈমানের হালতে ভোর করেছে, আর কতক কাফের অবস্থায়। অতএব যে বলেছে: আমরা আল্লাহর অনুগ্রহ ও রহমতে বৃষ্টি লাভ করেছি, সে আমার প্রতি বিশ্বাসী ও তারাসমূহের (প্রভাবের) প্রতি অবিশ্বাসী। আর যে বলেছে: অমুক অমুক তারার কারণে বৃষ্টি লাভ করেছি, সে আমার প্রতি অবিশ্বাসী ও তারাসমূহের (প্রভাবের) প্রতি বিশ্বাসী।[10]

এ হাদিসে কুফর শব্দের অর্থ অপর হাদিসে এসেছে, যা আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “তোমরা কি দেখনি তোমাদের রব কি বলেছে? তিনি বলেছেন: “আমি আমার বান্দাদের উপর যখনই কোনো অনুগ্রহ করেছি তখনই তাদের একদল তা অস্বীকারকারী অবশ্যই হয়েছে, তারা বলে তারকা ও তারকা দ্বারা”। এখানে স্পষ্ট করা হয়েছে যে, বৃষ্টি বর্ষণকে যে তারকার সাথে সম্পৃক্ত করল তারকা বৃষ্টি বর্ষণের কারণ হিসেবে, যদিও আল্লাহ তাকে বৃষ্টি বর্ষণের কারণ বানাননি, তার কুফরি হচ্ছে আল্লাহর নিয়ামত অস্বীকার করার কুফরি। আর নিয়ামতের কুফরি হচ্ছে ছোট কুফরি। হ্যাঁ, যে বিশ্বাস করে তারকাই জগতে কর্তৃত্ব করে এবং তারকাই বৃষ্টি বর্ষণ করে, তাহলে এটা বড় শির্ক।

ছোট শির্ক কখনো হয় প্রকাশ্য, যেমন কড়ি, তাগা ও তাবিজ পরিধান করা প্রকাশ্য ছোট শির্ক। আবার ছোট শির্ক কখনো হয় অপ্রকাশ্য, যেমন অল্প রিয়া (সামান্যতম লোকদেখানো বা লোক শোনানোর প্রবণতা)। ছোক শির্ক কখনো হয় বিশ্বাসে, যেমন কেউ কোনো বস্তু সম্পর্কে বিশ্বাস করল যে, তা উপকার হাসিল ও অনিষ্ট দূরীকরণের উপায়, অথচ আল্লাহ তাকে ভালো-মন্দের উপায় বানাননি। অথবা কোনো বস্তুতে বরকতের বিশ্বাস করল, অথচ আল্লাহ তাতে বরকত রাখেননি। ছোক শির্ক কখনো হয় কথার কারণে, যেমন কেউ বলল অমুক অমুক তারার কারণে আমরা বৃষ্টি হাসিল করেছি, ‘একমাত্র তারাই বৃষ্টি বর্ষণ করেছে’ যদি এ বিশ্বাস পোষণ না করে। অথবা কেউ গায়রুল্লাহর নামে কসম করল, যদি গায়রুল্লাহকে সম্মান দেওয়া বা আল্লাহর বরাবর করা উদ্দেশ্য না হয়। অথবা কেউ বলল, যা আল্লাহ ও আপনি চেয়েছেন, ইত্যাদি।

ছোট শির্ক কখনো হয় কর্ম দ্বারা, যেমন কেউ বালামুসিবত দূর বা প্রতিরোধ করার জন্যে তাবিজ লটকালো, অথবা আংটি কিংবা তাগা পরিধান করল। কারণ কোনো বস্তুকে কেউ যখন কোনো কিছুর উপায় নির্ধারণ করে, শরীয়ত বা তাকদীর কোনো বিবেচনায় আল্লাহ যা উপায় নির্ধারণ করেননি, সে আল্লাহর সাথে শির্ক করল। অনুরূপ কেউ যদি বরকতের আশায় কোনো বস্তু স্পর্শ করে, আল্লাহ যাতে বরকত রাখেননি, যেমন মসজিদের দরজাসমূহ চুমু খাওয়া, তার চৌখাট স্পর্শ করা ও তার মাটি থেকে রোগ মুক্তি কামনা করা ইত্যাদি কর্মসমূহ ছোট শির্ক।

এ হল ছোট শির্ক ও বড় শির্কের সংক্ষিপ্তসার, বিস্তারিত বর্ণনা এ সংক্ষিপ্ত উত্তরে দেওয়া সম্ভব নয়।

সমাপ্তি: মুসলিমের কর্তব্য হচ্ছে ছোট-বড় সব শির্ক থেকে বেচে থাকা, কারণ সবচেয়ে বড় নাফরমানি, যা আল্লাহর সাথে করা হয় তা হচ্ছে শির্ক, এবং তার অধিকারে সীমালঙ্ঘন করা, অর্থাৎ তার ইবাদত ও আনুগত্যে শির্ক করা, অথচ তার কোনো শরীক নেই। এ জন্য আল্লাহ তা‘আলা মুশরিকদের স্থায়ী নিবাস নির্ধারণ করেছেন জাহান্নাম। তিনি বলেছেন, মুশরিকদের তিনি ক্ষমা করবেন না, তাদের উপর জান্নাত হারাম। তিনি ইরশাদ করেন: “নিশ্চয় আল্লাহ তার সাথে শরীক করাকে ক্ষমা করবেন না। তিনি ক্ষমা করেন এ ছাড়া অন্যান্য পাপ, যার জন্য তিনি চান। আর যে আল্লাহর সাথে শরীক করে সে অবশ্যই মহাপাপ রচনা করে।[11]

অপর আয়াতে তিনি ইরশাদ করেন: “নিশ্চয় যে আল্লাহর সাথে শরীক করে, তার উপর অবশ্যই আল্লাহ জান্নাত হারাম করে দিয়েছেন এবং তার ঠিকানা আগুন। আর যালেমদের কোন সাহায্যকারী নেই।[12]

অতএব প্রত্যেক বিবেকী ও দীনদার ব্যক্তির জন্যে অবশ্য কর্তব্য শির্কের ভয়ে ভীত থাকা ও স্বীয় রবের নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করা, তিনি যেন তাকে শির্ক থেকে মুক্তি দেন, যেমন ইবরাহিম ‘আলাইহিস সালাম বলেছেন: “আমাকে ও আমার সন্তানদেরকে মূর্তির ইবাদত থেকে দূরে রাখুন। [13]

কোনো সালাফ বলেছেন: ইবরাহিমের পর কে নিজেকে নিরাপদ ভাবতে পারে।

অতএব সত্যিকার বান্দা শির্কের ভয়ে ভীত থাকবে, শির্ক থেকে মুক্ত থাকার জন্য স্বীয় রবের নিকট আকুতি করবে এটাই স্বাভাবিক। নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম “পিপড়ার চলার আওয়াজ থেকেও শির্ক তোমাদের মাঝে অধিক অস্পষ্ট, আমি তোমাকে একটি বিষয় বলছি, যার ফলে আল্লাহ তোমার থেকে ছোট-বড় শির্ক দূর করে দিবেন। তুমি বল: “হে আল্লাহ, আমার জানাবস্থায় আপনার সাথে শির্ক করা থেকে আপনার নিকট আশ্রয় চাই, আর আমি যা জানি না তার জন্য আপনার নিকট ক্ষমা চাই। [14]

এ যাবত আমরা শির্কের পরিচয় ও তার দু’টি প্রকার সম্পর্কে সংজ্ঞাসহ আলোচনা করলাম।

ছোট শির্ক ও বড় শির্কের হুকুম: বড় শির্ক ব্যক্তিকে ইসলাম থেকে বের করে দেয়, ফলে সে কাফির ও মুরতাদ গণ্য হয়। আর ছোট শির্ক ব্যক্তিকে ইসলাম থেকে বের করে দেয় না, তবে সে বড় ঝুঁকির মধ্যে থাকে, কারণ ছোট শির্কও কবিরা গুনাহ। ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন: “গায়রুল্লাহর নামে সত্য কসম অপেক্ষা আল্লাহর নামে মিথ্যা কসম আমার নিকট অধিক প্রিয়”। এখানে আমরা দেখছি তিনি ছোট শির্ক তথা গায়রুল্লাহর নামে কসম খাওয়াকে আল্লাহর নামে মিথ্যা কসম অপেক্ষা অধিক নিন্দনীয় জ্ঞান করছেন, আর আমরা জানি যে আল্লাহর নামে মিথ্যা কসম করা কবিরা গুনাহ।

আল্লাহর নিকট দোয়া করি, তিনি আমাদেরকে তার দীনের উপর প্রতিষ্ঠিত রাখুন, যতক্ষণ না আমরা তার সাথে সাক্ষাত করি। আমরা তার নিকট পানাহ চাই, তিনি যেন আমাদেরকে গোমরাহ না করেন। একমাত্র তিনিই চিরঞ্জীব, তিনি কখনো মারা যাবেন না, এ ছাড়া জিন ও মানব সবাই মারা যাবে। আল্লাহ তা‘আলাই ভালো জানেন।

 


[1] সূরা বাকারা: (২২)
[2] ইবরাহীম: (৩০)
[3] বুখারি: (৪৪৯৭), মুসলিম: (৯২)
[4] সূরা বাকারা: (১৬৫)
[5] আলবানি রহ. তার সহি হাদিস সমগ্রে হাদিসটিকে সহি বলেছেন: (৯৫১)
[6] তবে সব ঝাঁড়-ফুক শির্ক নয়। কুরআনের আয়াত ও হাদীসের দো‘আ বা আগত চিকিৎসা দিয়ে ঝাঁড়-ফুক করানো জায়েয। বরং তা উত্তম কাজ। হাদীসে সে ঝাঁড়-ফুকই উদ্দেশ্য নেওয়া হয়েছে যার ভিত্তি-কুরআন হাদীস নয়, অথবা ভিন্ন কোনো ভাষায় হয়, যার অর্থ জানা যায় না। [সম্পাদক]
[7] আবু দাউদ: (৩৮৮৩), আলবানি রহ. সহি হাদিস সমগ্রে হাদিসটিকে সহি বলেছেন: (৩৩১)
[8] তবে যদি এগুলোকে সরাসরি কার্যসম্পাদনকারী মনে করা হয়, তবে তা বড় শির্কে পরিণত হবে। [সম্পাদক]
[9] আবু দাউদ: (৩৯১০)
[10] বুখারি: (১০৩৮), মুসলিম: (৭১)
[11] সূরা নিসা: (৪৮)
[12] সূরা মায়েদা: (৭২)
[13] সূরা ইবরাহিম: (৩৫)
[14] সহি আলজামি: (৩৭৩১), আলবানি রহ. হাদিসটি সহি বলেছেন।

শুধু ‘আল্লাহু’ ’আল্লাহু’ বলে জিকির করা কি শরীয়ত সম্মত?

167

আজকাল আমাদের সমাজের অনেক কথিত ‘হাক্কানি পীর’ এবং ‘আল্লামা’ দের কিতাবে দেখা যায় যে, তাঁরা তাঁদের ভক্ত-আশেকানদের কে অসম্পূর্ণ বাক্য “আল্লাহ্‌-আল্লাহ্‌” শব্দ দ্বারা জিকির করতে বলেন! এ-ব্যাপারে সৌদি আরবের বর্তমানে অদ্বিতীয় আলেমে দ্বীন “শাইখ সালিহ আল ফাওযান” যাকে পুরো আরব বিশ্বের তালেবে এলেম তথা ইসলাম চর্চাকারী’রা চেনেন না এমন কোন আরব নেই! তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়, এইভাবে, ‘আল্লাহ-আল্লাহ” অসম্পূর্ণ বাক্য দ্বারা জিকিরের হুকুম কি! এর জবাবে উনি যা বলেন, তা নিন্মে পেশ করছিঃ

 __________(১)___________

প্রশ্নঃ আল্লাহর বিশেষ কোন নাম ধরে কি তাঁর যিকির করা জায়েয আছে। যেমন মানুষ বলে, ‘আল্লাহ আল্লাহ’ অথবা ‘ইয়া গাফূরু, ইয়া গাফূরু’ ইত্যাদি বলে যিকির করা। আমি জানি ‘আল্লাহ আল্লাহ’ বলা বিদআত। কিন্তু ‘হা’ অক্ষরে পেশ দিয়ে ‘আল্লাহু আল্লাহু’ বলার হুকুম কি?

উত্তরঃ সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্যে। ‘আল্লাহ’ শব্দ দ্বারা যিকিরের মাধ্যমে আল্লাহর ইবাদত করতে চাইলে এই ইবাদতে নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর হেদায়াত কি ছিল তা আমাদের জানা দরকার। যেমনটি অন্যান্য ইবাদতের নিয়মও জানা দরকার। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সুন্নাতে যিকির ও দুয়ার ক্ষেত্রে শুধু ‘আল্লাহ’ শব্দ ব্যবহারের কোন প্রমাণ নেই। চাই আল্লাহ শব্দের ‘হা’ অক্ষরে পেশ দিয়ে হোক বা জযম দিয়ে হোক- কোন প্রমাণ নেই। অনুরূপভাবে শুধু আল্লাহর সুন্দর নামগুলো ধরে তাঁকে ডাকারও কোন দলীল নেই। যেমন মানুষ বলে থাকে, ইয়া লাতীফু ইয়া লাতীফু, অথবা ইয়া গারফূরু ইয়া গাফূরু.. ইত্যাদি।

তাছাড়া এ ধরণের যিকিরগুলোকে অর্থবোধক বাক্য বা কথা বলা হয় না। আর এতে উপকারী কোন অর্থও প্রকাশ পায় না। এটা একক শব্দ যাতে কোন উপকার পাওয়া যায় না। কেননা এই নামগুলো উল্লেখ করে ডেকে যদি কোন আবেদন বা প্রার্থনা পেশ না করা হয়, তবে এই ডাকটাই অনর্থক হয়ে যায়।

শাইখ সালেহ ফাওযান বলেন, এটা বিদআত। নামাযের পর বা বিশেষ কোন সময়ে আল্লাহর নাম সমূহ যিকির করা এবং তার অভ্যাস গড়ে তোলা বিদআত। যেমন ইয়া লাতীফু,ইয়া লাতীফু, বা এরকম কোন নাম বিশেষ সংখ্যা ও বিশেষ পদ্ধতিতে যিকির করা। এগুলো ইসলামে সবই নতুন সৃষ্টি তথা বিদআত। উত্তম হেদায়াত হচ্ছে মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর হেদায়াত। আর নিকৃষ্ট বিষয় হচ্ছে এই দ্বীনের মাঝে নতুন কিছু সৃষ্টি করা। প্রত্যেক বিদআতই হচ্ছে ভ্রষ্টতা।
(আল মুনতাকা মিন ফাতাওয়া ফাওযান ২/৮)

তাই যখন বলবে ‘ইয়া আল্লাহ ইরহামনী’ অর্থাৎ হে আল্লাহ আমাকে দয়া কর। ‘ইয়া গাফূরু ইগফির লী’ অর্থাৎ হে ক্ষমাশীল আমাকে ক্ষমা কর, ‘ইয়া রাজ্জাকু উরযুকনী’ হে রিযিকদাতা আমাকে রিযিকদান কর, তখন তা হবে অর্থবোধক বাক্য এবং সেটা বৈধ যিকির।

অনুবাদক: শেইখ আব্দুল্লাহ আল কাফী মাদানী

___________(২)_______________

শুধু “আল্লাহ” শব্দের যিকর:

যিকর শব্দের বাংলা আভিধানিক অর্থ হচ্ছে, স্মরণ। আল্লাহর স্মরণে যে সব শব্দ বা বাক্য মুখে উচ্চারণ করে বলতে হয়, সাধারণতঃ শরীয়ার পরিভাষায় তাহাই যিক্ র। অবশ্য আন্তরিক স্মরণকেও যিকির বলা যায়। আল্লাহ বলেনঃ (এবং তোমার প্রতিপালককে অধিক স্মরণ করবে এবং সকালে ও সন্ধায় তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করবে।) [আল ইমরান/৪১]

  •  সর্ব্বোত্তম যিক্ রঃ জ্ঞানীগণ ঐক্যমত পোষণ করেছেন যে, সব চেয়ে উত্তম যিকির হচ্ছে, কুরআনুল কারীম। ইমাম নবভী বলেনঃ ‘জেনে রাখো, কুরআনের তিলাওয়াত সর্ব শ্রেষ্ঠ যিকর আর তা হচ্ছে, চিন্তা-ভাবনার সাথে তিলাওয়াত করা। অতঃপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম  হতে প্রমাণিত যিকর সমূহ(দুআই মাসূরাহ)। আর তা অনেক তন্মধ্যে উত্তম হচ্ছে, [সুব্হানাল্লাহ, ওয়াল্ হামদু লিল্লাহ্ ওয়া লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ, ওয়াল্লাহু আক্ বার।]
  •  নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম  বলেনঃ আল্লাহর নিকট সবচেয়ে পছন্দনীয় বাক্য চারটি, [সুব্হানাল্লাহ, ওয়াল্ হামদু লিল্লাহ্ ওয়া লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ, ওয়াল্লাহু আক্ বার। এর মধ্যে যার দ্বারায় শুরু কর না কেন কোন অসুবিধা নেই।[মুসলিম]
  •  নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম  আরো বলেনঃ ‘সব্বোর্ত্তম যিকর হচ্ছে, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’। [ইমাম তিরমিযী হাদীসটিকে হাসান বলেছেন এবং ইবনু হিব্বান ও হাকেম সহীহ বলেছেন।]
  •  নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেনঃ ‘আমি ও আমার পূর্বের নবীগণ সব্বোর্ত্তম যা বলেছি, [তা হল,] ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহ্দাহু লা-শারীকা লাহু’। [মালেক তাঁর মুআত্তায় বর্ণনা করেন এবং তাববারানীও বর্ণনা করেন। সনদ হাসান]

উপরোক্ত হাদীসগুলির আলোকে একথা প্রমাণিত যে, শুধু আল্লাহ শব্দের মাধ্যমে যিকির করা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হতে প্রমাণিত নয় আর না তাঁর কোন সাহাবা হতে এটা প্রমাণিত।

শাইখুল ইসলাম ইবনে তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেনঃ ‘শুধু (আল্লাহর) নাম তা গোপনে হোক কিংবা প্রকাশ্যে তা একটি পূর্ণ কথা নয় আর না একটি পূর্ণ বাক্য। আর না এর সম্পর্ক কুফর বা ঈমানের সাথে আছে, না আদেশ কিংবা নিষেধের সাথে সম্পর্কিত। আর না সালাফ (পূর্বসুরী) থেকে প্রমাণিত আর না নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম  বৈধ করেছেন। [মাজমুউল ফাতাওয়া/১০/৫৫৬]
একারণে উক্ত যিক্ র কে অনেক উলামা বিদআত বলেছেন। দেখুন, সাইখ মুহাম্মদ সালেহ আল মুনাজ্জিদ হাফেযাহুল্লাহের ওয়েব সাইট। www.islam-qa.com

সংকলনে: শেইখ আব্দুর রাকীব মাদানী

____________(৩)   _____________

প্রশ্ন: শুধু ’আল্লাহু’ ’আল্লাহু’ বলে জিকির করা কি শরীয়ত সম্মত?

উত্তর: আল হামদুলিল্লাহ ওয়াস সালাতু ওয়া সালামু আলা রাসূলিল্লাহ। আম্মা বাদ:

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে দুয়া ও জিকিরের ব্যাপারে যতগুলো হাদীস পাওয়া যায় সবগুলোই পূর্ণাঙ্গ বাক্য। যেমন, সুবাহান আল্লাহ, আল হামদুলিল্লাহ, আল্লাহু আকবার, লাইলাহা ইল্লাল্লাহ ইত্যাদি। কতবার পড়তে হবে সংখ্যা সহ হাদীসগুলোতে উল্লেখ আছে।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:

أفضل ما قلت أنا والنبيون قبلي: لا إله إلا الله وحده لا شريك له له الملك وله الحمد وهو على كل شيء قدير.

“আমি এবং আমার পূর্ববর্তী নবীগণের বলা শ্রেষ্ঠ জিকির হল, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারীকালাহু, লাহুল মুলকু ওয়া লাহুল হামদু ওয়া হুয়া আলা কুল্লি শাইয়িন কাদীর।”

তিনি আরও বলেন:

أفضل الذكر لا إله إلا الله

“শ্রেষ্ট জিকির হল, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ।” 

তিনি আরও বলেন:

أفضل الدعاء الحمد الله

“শ্রেষ্ঠ দুয়া হল, আল হমদুলিল্লাহ।” এভাবে বহু হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদেরকে জিকিরের শব্দাবলী শিক্ষা প্রদান করেছেন।
কিন্তু আল্লাহ তায়ালার একটি মাত্র নাম নিয়ে একক শব্দে, (যেমন, আল্লাহু আল্লাহু… বা আর রাহমানু আর রাহমানু… ইত্যাদি) জিকির করার ব্যাপারে একটি হাদীস পাওয়া যায় না। সাহাবী তাবেঈদের নিকট থেকেও এমন নজির খুঁজে পাওয়া যায় না।

একক শব্দে জিকির করা যদি শরীয়ত সম্মত হত তবে অবশ্যই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উম্মতের জন্য উল্লেখ করতেন। সাহাবীগণও তা পালন করতে পিছুপা হতেন না।
ভ্রান্ত আকীদার পীর-ফকীর ও সূফীগণ এভাবে জিকির করে থাকেন। তাদের কেউ কেউ তো আল্লাহ শব্দ বাদ দিয়ে কেবল হু হু বলে জিকির করে থাকে। এভাবে তারা দীনের মধ্যে বিদআত আবিষ্কার করেছে। আর প্রতিটি বিদআতই গোমরাহী।

একটি হাদীস ও তার জবাব:

আল্লাহ আল্লাহ শব্দে জিকির করার ব্যাপারে নিম্নোক্ত হাদীসটি দ্বারা দলীল পেশ করা হয়:

« لاَ تَقُومُ السَّاعَةُ حَتَّى لاَ يُقَالَ فِى الأَرْضِ اللَّهُ اللَّهُ »

“কিয়ামত ততদিন পর্যন্ত সংঘটিত হবে না যত দিন না ‘আল্লাহ’ ‘আল্লাহ’ বলা বন্ধ হয়। (সহীহ মুসলিম, অনুচ্ছেদ: শেষ যমানায় ঈমান চলে যাওয়া।)
এর উত্তরে বলব: উক্ত হাদীসটি অন্য শব্দে এভাবে বর্ণিত হয়েছে:

لا تقوم الساعة حتى لا يقال لا إله إلا الله

“কিয়ামত ততদিন পর্যন্ত সংঘটিত হবে না যত দিন না লা ‘ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলা বন্ধ হয়।”
(দ্র: মাজমাঊয যাওয়ায়েদ ওয়া মামবাউল ফাওয়ায়েদ, অধ্যায়: কিতাবুল ফিতান, অনুচ্ছেদ: “কিয়ামত ততদিন পর্যন্ত সংঘটিত হবে না যত দিন না লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলা বন্ধ হয়।)

এ হাদীসেগুলো অর্থ অত্যন্ত স্পষ্ট যে, কিয়ামত এমন এক সময় সংঘটিত হবে যখন পৃথিবীর বুকে এমন একজন মানুষও বিদ্যমান থাকবে না যে ’লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বা ‘আল্লাহ’ শব্দটি মুখে উচ্চারণ করে। সব মানুষ যখন আল্লাহকে ভুলে শিরক, কুফুরী, নোংরামি, ও নানা পাপাচারে ডুবে যাবে তখন এ সকল নিকৃষ্ট মানুষদের উপর কিয়ামত সংঘটিত হবে।

উক্ত হাদীস থেকে ১০০, ২০০, ৫০০, ১০০০ বা এক লক্ষবার… আল্লাহু আল্লাহু জিকির করার বৈধতা আদৌ প্রমাণিত হয় না।
সুতরাং মুসলমানদের কর্তব্য, ইবাদত-বন্দেগী এখলাসের সাথে এমনভাবে করা যেভাবে দ্বীনের নবী শিখিয়ে দিয়ে গেছেন। তার দেখানো পন্থাই আমাদের জন্য যথেষ্ট। আল্লাহ সবচেয়ে ভাল জানোন।

কতিপয় কথোপকথন/ প্রশ্নোত্তর:

উক্ত বিষয়ে আমার লেখাটা ফেসবুকে ছাড়ার পর কিছু ভায়ের সাথে কথোপকথন হয়েছে। এগুলোর মধ্য থেকে গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় নিচে তুলে দেয়া হল:

জনৈক প্রশ্নকারী:আল্লাহ তাআলা তাঁর কালামে ইরশাদ করেছেন:

وَلِلّهِ الأَسْمَاء الْحُسْنَى فَادْعُوهُ بِهَا

“নিশ্চয়ই আল্লাহর জন্য সুন্দর নামসমূহ রয়েছে। তোমরা আল্লাহকে ঐ সমস্ত নামে ডাক।” (সুরা আ’রাফ) সুতরাং, যেখানে আল্লাহ স্বয়ং তাঁর কালামে তাঁকে এ সমস্ত নামে ডাকতে আদেশ দিচ্ছেন, সেখানে এ সমস্ত নামে ডাকা কিংবা বারবার জপা বা উচ্চারণ করা (অর্থাৎ যিকির করা) কে আপনি বিদআত কিভাবে বলেন?

আমার উত্তর: উক্ত আয়াতে আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে আদেশ করছেন, আমরা যেন তার নামের ওসীলায় তাঁর নিকট দুয়া করি। কোন কিছু চাইতে হলে তার নাম ধরে যেন চাই। তাঁকে যেন তাঁর সুন্দর সুন্দর নাম ধরে তাকে ডাকি। যেমন, রাসূল সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই ডাকার পদ্ধতি শিখিয়ে দিয়েছেন এভাবে:

(১) কোন ব্যক্তির জীবনে যখন বিপদ-আপদ, দু:শ্চিন্তা বা পেরেশানী নেমে আসে তখন সে যেন বলে:

لا إله إلا الله العظيم الحليم ، لا إله إلا الله رب العرش العظيم ، لا إله إلا الله رب السماوات والأرض ورب العرش الكريم رواه الشيخان والترمذي والنسائي

(২) তিনি ফাতিমা রা.কে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, তুমি সকাল সন্ধায় এ দুয়াটি পাঠ করবে: : يا حي يا قيوم برحمتك أستغيث, হে চিরঞ্চিব, হে সব কিছুর সংরক্ষক, তোমার রহমতের ওসিলায় তোমার নিকট সাহায্য প্রার্থনা করছি। (তিরমিযী, সহীহ)।

(৩) অনুরূপভাবে সূরা হাশরেরর ২২, ২৩ ও ২৪ নং আয়াতে আল্লাহ তায়াল অনেকগুলো নাম বর্ণিত হয়েছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উক্ত তিনটি আয়াত পাঠ করে আল্লাহর নিকট দুয়া করতে বলেছেন, (দারেমী, মাকাল ইবনে ইয়াসার রা. হতে বর্ণিত)

প্রশ্নকারী: আল্লাহ তাঁকে তাঁর সুন্দর নামে ডাকতে আদেশ দিয়েছেন। তাই আমি আল্লাহকে আল্লাহ, আর রাহমান, আর রাহিম নামে ডাকলাম এবং অনেক্ষণ ধরে ডাকলাম। এতে সমস্যাটা কোথায়? আপনার আলোচনা হতে পারে, নির্দিষ্ট সংখ্যাকে জরুরী মনে করা ঠিক না বেঠিক, আল্লাহ, আল্লাহ না বলে কেবল হু হু যিকির করা ঠিক না বেঠিক। কিন্তু একাধিকবার আল্লাহ আল্লাহ ডাকলেই সেটা বেদআত হবে কেন? 

উত্তর: আল্লাহর নাম ধরে ডাকার ব্যাপারে তো আপত্তি করা হয় নি। ইয়া আল্লাহ, ইয়া রাহমান, ইয়া হাইউ, ইয়া কাইয়ুমু, অথবা আল্লাহুম্মা.. এভাবে ডাকলে তো তখন সেটা আর অপূর্ণ বাক্য থাকল না। তবে কথা হল, এভাবে ডাকার পর নিজের চাহিদা তুলে ধরতে হবে। যেমন, ইয়া গাফুর, ইগফির লী অর্থাৎ হে ক্ষমাশীল, আমাকে ক্ষমা করুন। ইয়া রাযযাক, উরযুক নী..হে রিজিক দাতা, আপনি আমাকে রিজিক দিন। ডাকার পর যদি কোন কিছু না চাওয়া হয় তবে এই ডাকার কোন অর্থই থাকল না। আপত্তি হল, শুধু আল্লাহু আল্লাহু আল্লাহু বলে অপুর্ণ বাক্য দ্বারা জিকির করার ব্যাপারে।

প্রশ্নকারী:  রাসুল সাল্লা্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: إن لله تسعة وتسعين اسماً من حفظها دخل الجنة رواه البخاري লক্ষ্য করুন এখানে حفظها বলা হয়েছে। তো হিফয করার জন্য কি এক শব্দ বারবার পড়তে হয় না। বারবার পড়া বেদআত হলে এগুলোকে হিফয করতে কেন বললেন? 

আমার উত্তর:  আমাদের আলোচনা একক শব্দে জিকির করা প্রসঙ্গে। আল্লাহর নাম মুখস্ত করার উদ্দেশ্যে বার বার পড়া আর জিকির করা এক কথা নয়।

আরেক জন প্রশ্নকারী: বিলাল রা. কে যখন তার মনীব পাথর চাপা দিয়ে নির্যাতন করছিলো তখন তিনি কেবল ‘আহাদ’ ‘আহাদ’ বলেছিলেন? এ থেকে কি একক শব্দে আল্লাহর জিকির প্রমাণিত হয় না?

আমার উত্তরখেয়াল করুন, বেলার রা. কে যখন উত্তপ্ত বালির উপর ফেলে বুকের উপর বিরাট পাথর চাপা দিয়ে এক আল্লাহর দাসত্ব পরিহার করার জন্য নির্যাতন করা হচ্ছিল তিনি তখন আল্লাহ আল্লাহ বলে জিকির করেন নি। তিনি আহাদ আহাদ বলেছেন। অর্থাৎ তিনি বুঝাতে চাচ্ছেন আহাদ মানে একক..আল্লাহ এককভাবে ইবাদতের যোগ্য। অন্য কেউ নয়। কারণ, তিনি জানতেন আরবের মুশরেকরা আল্লাহ অস্বীকার করত না। কিন্তু এককভাবে আল্লাহর ইবাদত করাকে অস্বীকার করত। তাই তিনি এই কঠিন পরিস্থিতিতেও তাদেরকে এই একত্তবাদের স্বীকৃতি প্রদান করেছেন। তিনি সেখান থেকে মুক্তি পাওয়ার পর কোন দিন আহাদ আহাদ বা আল্লাহ আল্লাহ বলে জিকির করেছেন মর্মে কি কোন প্রমাণ পাওয়া যায়?

– শেইখ আব্দুল্লাহিল হাদী

মাকতাবা শামিলা সফটওয়্যারের সমস্যার সমাধান

374534_214122512062192_622641294_n

بسم الله الرحمن الرحيم

গত কয়েকদিন আগে আমারা কুরআনের আলো ওয়েবসাইট এ সমগ্র মুসলিম বিশ্বে ইসলামী গবেষণার জন্য সবচেয়ে বেশী ব্যাবহৃত সফটওয়্যার মাকতাবা শামিলা পোষ্ট করেছিলাম। অনেক ভাই ও বোনেরা তা ডাউনলোড ও করেছেন। কিন্তু সফটওয়্যারটির আরবি লিখা গুলো পড়তে না পারার কারণে অনেকেই তা ব্যাবহার করতে পারেন নি। তাদের স্ক্রীন এ লিখা গুলর অবস্থা ছিল নিম্নরুপঃ

sw1y5x0kQzOkwHtpemU2_arabic font problemFnjah25eTYaNLQePovDV_font problem

আজ এই পোষ্টে  আমরা এর সমস্যার সমাধান দেখিয়ে দিচ্ছি। আপনাদের যা করতে হবে তা নিচে চিত্রের মাধ্যমে দেখানো হল।

১। প্রথমে আপনার Computer এর Start মেনুতে ক্লিক করুন তারপর  Control Panel এ ক্লিক করুন।

Shamela Solution 1

২। Control Panel ওপেন হলে region and Language ট্যাবে ক্লিক করুন। নিচের মত একটা উইন্ডো Open হবে।

Shamela Solution 3৩। এই উইন্ডো এর administrative Tab এ ক্লিক করুন। তারপর  Change System Locale এ ক্লিক করুন। নিচের মত পর্দা Open হবে।

Shamela Solution 4৪। এখান থেকে current System Locale  টা Arabic (Saudi Arabia)  করে দিন এবং OK তে ক্লিক করুন।

Shamela Solution 5৫। আবার OK তে ক্লিক করুন।  আবার আপনার PC রিস্টার্ট করতে বলবে। রিস্টার্ট হয়ে গেলে ইনশাহআল্লাহ ফন্ট এর এই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে এবং নিচের মত দেখাবে।

7

আশা করছি আপনাদের সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। যদি কোন সমস্যা হয় তবে কমেন্ট এর মাধ্যমে অথবা [email protected] এই ঠিকানায় ইমেইল করতে পারেন।

জাযাকআল্লাহু খাইরান

কুরআনের আলো

অমুসলিমদের প্রতি মুসলিমদের আচরণ কেমন হওয়া উচিত?

Image Courtesy: IERA Facebook Page

মূল লেখক: শায়েখ আব্দুল ‘আযীয্‌ ইবনু বাজ (রঃ) | ভাষান্তর ও সম্পাদনা: ‘আব্‌দ আল-আহাদ

প্রশ্ন:

একজন অমুসলিম কোনো মুসলিম দেশে প্রবাসী যিম্মি (মুসলিম শাসনে বসবাসকারী অমুসলিম) হিসেবে বসবাস করতে পারে। আবার একজন মুসলিম কোনো অমুসলিম দেশে প্রবাসী হিসেবেও বসবাস করতে পারে। পরিস্থিতি দুটোর যা-ই হোক না কেন, একজন অমুসলিমের প্রতি একজন মুসলিমের কী ধরণের আচরণ করা উচিত? অমুসলিমদের সম্ভাষণ জানানো থেকে শুরু করে তাদের বিভিন্ন উৎসব-অনুষ্ঠান পালন করা সহ, তাদের সাথে মসুলিমদের চালচলন কেমন হওয়া উচিত, সে ব্যাপারে আমি একটা সচ্ছ ধারণা পেতে চাই। শুধু কর্মক্ষেত্রে কোনো অমুসলিমকে কি বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করার অনুমতি আছে? দয়া করে জানাবেন।

উত্তর: 

প্রশংসা একমাত্র আল্লাহ্‌র জন্য। অমুসলিমদের প্রতি মুসলিমদের কর্তব্যের মধ্যে অনেকগুলো বিষয় অন্তর্ভুক্ত।

প্রথমত: একজন অমুসলিমের প্রতি একজন মুসলিমের প্রথম কর্তব্য হলো, তাকে আল্লাহ্‌র দ্বীন, ইসলামের দা‘ওয়াত দিতে হবে। ইসলামের দা‘ওয়াত দেওয়ার পাশাপাশি যতদূর সম্ভব, জ্ঞান নিজের বিশুদ্ধ অনুযায়ী বাস্তবিক অর্থে ইসলাম কী, সে ব্যাপারে অমুসলিম ব্যক্তিকে বুঝাতে হবে। কারণ অন্যান্য মুসলিমদের পাশাপাশি কোনো ইহুদী, খ্রিস্টান কিংবা মুশরিকের প্রতি একজন মুসলিমের সর্বোচ্চ পরিমাণ অনুগ্রহ দেখানো উপায় হলো, তাদেরকে আল্লাহ্‌র দ্বীনের দা‘ওয়াত দেওয়া। নবী (সা:) বলেছেন: যে ব্যাক্তি অন্যদেরকে কল্যাণের দিকে আহ্বান করবে, সে ‘আমলকারীর সমপরিমান সওয়াব পাবে।” [সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১৮৯৩]

‘আলীকে (রা:) খায়বারে প্রেরণের সময় রাসূল (সা:) নির্দেশ দিয়েছিলেন যে, তিনি যেন ইহুদীদেরকে ইসলামের দা‘ওয়াত দেন। রাসূল (সা:) বলেছিলেন: “আল্লাহ্‌র কসম! আল্লাহ্‌ যদি তোমার মাধ্যমে একজন মাত্র ব্যক্তিকে হিদায়াত দান করেন, তাহলে তোমার জন্য তা হবে লাল উট (সেরা প্রজাতির উট) থাকার চেয়েও অধিক উত্তম।তিনি (সা:) আরও বলেছিলেন: “যে ব্যক্তি অন্যদেরকে সঠিক পথের দিকে আহ্বান করে, সে তাদের সমপরিমান সওয়াব লাভ করবে, যারা সে পথের অনুসরণ করবে। অথচ তাদের কারও সওয়াব থেকে বিন্দুমাত্র কম করা হবে না।” [সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৪৮৩২]

কাজেই, আন্তরিকতার সাথে একজন অমুসলিমকে ইসলামের দা‘ওয়াত দেওয়া এবং তার কাছে ইসলামের বাণী পৌঁছে দেওয়া আল্লাহ্‌র নৈকট্য লাভের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপায়।

দ্বিতীয়ত: কোনো মুসলিম শারীরিক, আর্থিক কিংবা সম্মান-মর্যাদার দিক থেকে অমুসলিম ব্যাক্তির প্রতি কোনোরূপ অন্যায় করতে পারবে না। অমুসলিম ব্যক্তি যদি যিম্মি (মুসলিম শাসনাধীনে বসবাসকারী), মুস্তা’মান (মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় নিরাপত্তাপ্রাপ্ত) কিংবা মু‘আহিদ (যার দেশের সাথে মুসলিমদের শান্তিচুক্তিতে আবন্ধ) হয়, তাহলে তাকে তার প্রাপ্য অধিকার দিতে হবে এবং  চুরি, বিশ্বাসঘাতকতা বা প্রতারণার মাধ্যমে তার ধনসম্পদের ক্ষয়ক্ষতি করা যাবে না। তাকে হত্যা করা যাবে না এবং আঘাত করে শারীরিকভাবে কষ্ট দেওয়া যাবে না। কারণ সে মু‘আহিদ, যিম্মি কিংবা মুস্তা’মান হওয়ায় ইসলামী শারী‘আহ্‌ কর্তৃক তার নিরাপত্তা সুরক্ষিত।

তৃতীয়ত: এমন কোনো কারণ নেই যার ফলে আমরা অমুসলিম সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য, তাদের কাছে জিনিসপত্র ভাড়া দেওয়া বা তাদের কাছ থেকে ভাড়া নেওয়া ইত্যাদি কাজগুলো করতে পারবো না। সহীহ হাদীসের বর্ণনা অনুযায়ী, আল্লাহ্‌র রাসূল (সা) কাফের এবং মুশরিকদের থেকে জিনিসপত্র কিনেছেন। আর তাদের থেকে জিনিসপত্র কেনা মূলত তাদের সাথে সম্পর্ক রাখা। তাঁর (সা) মৃত্যুর সময়েও তাঁর একটি বর্ম একজন ইহুদীর কাছে বন্ধক ছিল। ইহুদীর কাছে একসময় বর্মটি বন্ধক রেখে রাসূল (সা) তাঁর পরিবারের জন্য খাবার কিনেছিলেন।

চতুর্থত: অমুসলিমদেরকে প্রথমে সম্ভাষণ জানানো মুসলিম ব্যক্তির উচিত নয়। নবী (সা:) বলেছেন: “ইহুদী কিংবা খ্রিস্টানদের প্রথমে তোমরা সালাম জানাবে না।” [সহীহ মুসলিম, সালাম অধ্যায়, হাদীস নং ২১৬৭]। তিনি (সা:) আরও বলেছেন: “যদি আহলে কিতাবদের কেউ সালামের (আস্‌সালামু ‘আলাইকুম) মাধ্যমে তোমাদের অভিবাদন জানায়, তাহলে বোলো, ‘ওয়া ‘আলাইকুম।” [আল-বুখারি, হাদীস নং ৫৯০১; মুসলিম, হাদীস নং ২১৬৫]

অতএব, নিজে থেকে প্রথমেই কোনো কাফিরকে সালাম জানানো মুসলিমের উচিত নয়। তবে কোন কাফের, ইহুদী বা খ্রিস্টান যদি কোনো মুসলিমকে সালাম জানায়, তাহলে রাসূলের (সা) নির্দেশ অনুযায়ী, “ওয়া ‘আলাইকুম” বলে উত্তর দিতে হবে।

ভালো প্রতিবেশী হওয়া মুসলিমদের উপর অমুসলিমদের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অধিকার। কাজেই কোনো অমুসলিম  আপনার প্রতিবেশী হলে তার প্রতি সদয় হউন। তাকে কোনোভাবে হয়রানি করবেন না। অসচ্ছল হলে তাকে সাহায্য করুন। উপহার দিয়ে, সুপরামর্শ দিয়ে তাকে সহায়তা করুন। এতে করে সে ইসলামের সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হবে এবং মুসলমান হওয়ার জন্য আগ্রহী হয়ে উঠবে। অধিকিন্তু, প্রতিবেশী হিসেবে আপনার উপর তার অধিকার রয়েছে। রাসূল (সা:) বলেছেন: “জিব্‌রীল (আ) প্রতিবেশীর প্রতি সদয় হওয়ার জন্য আমাকে এতটাই তাগিদ দিতে থাকলেন যে, আমি ভাবলাম, তিনি হয়তো প্রতিবেশীকে আমার উত্তরাধিকারী বানিয়ে ফেলবেন।” [আল-বুখারি ও মুসলিম]

প্রতিবেশী কাফির হলেও প্রতিবেশী হিসেবে তার অধিকার রয়েছে। প্রতিবেশী যদি কাফির হওয়ার পাশাপাশি আত্মীয়ও হয়, তাহলে তার অধিকার দ্বিগুন: প্রতিবেশী হিসেবে এবং আত্মীয় হিসেবে। প্রতিবেশী দরিদ্র হলে তাকে যাকাত না দিয়ে আর্থিকভাবে সাহায্য করুন। কারণ প্রতিবেশী হিসেবে এই সাহায্য পাওয়ার অধিকার তার আছে। এই সম্পর্কে আল্লাহ্‌ বলেন (অর্থের ব্যাখ্যা): “দ্বীনের ব্যাপারে যারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেনি এবং তোমাদেরকে স্বদেশ হতে বহিষ্কার করেনি, তাদের প্রতি সদ্ব্যবহার ও ন্যায় বিচার করতে আল্লাহ্‌ তোমাদেরকে নিষেধ করেন না। আল্লাহ্‌ তো ন্যায়-পরায়ণদেরকে  ভালোবাসেন।” [সূরা মুমতাহিনাহ্‌, আয়াত-৮]

আস্‌মা বিন্‌তে আবি বাক্‌র (রা:) থেকে বর্ণিত একটি বিশুদ্ধ বর্ণনানুযায়ী, মক্কার মুশরিক এবং রাসূলের (সা:) মধ্যে যুদ্ধবিরতি চলাকালীন তার মা — যে তখনও মুশরিকা ছিল — তার সাথে দেখা করে সাহায্য চাইলো। মায়ের সাথে তার সম্পর্কের বন্ধনকে বহাল রাখবে কি না, সে বিষয়ে আস্‌মা রাসূলের (সা:) কাছে অনুমতি চাইলেন। উত্তরে রাসূল (সা:) বলেছিলেন, “তার সাথে রক্তের বন্ধনকে বহাল রাখো।”

অমুসলিমদের উৎসব-অনুষ্ঠান উদ্‌যাপনের ক্ষেত্রে বিধান হলো, কোনো মুসলিম সেগুলোতে অংশগ্রহণ করতে পারবে না। তবে তাদের কোনো প্রিয়জন মারা গেলে, সমবেদনা জ্ঞাপন করাতে দোষের কিছু নেই। যেমন: ‘আল্লাহ্‌ আপনার ক্ষতিপূরণ করুন’ বা এই জাতীয় সহানুভূতিপূর্ণ কথা বলা যেতে পারে। তবে মৃত ব্যক্তি কাফির হলে “আল্লাহ্‌ তাকে ক্ষমা করে দিন” বা ‘আল্লাহ্‌ তার উপর দয়া করুন’ ইত্যাদি বলা যাবে না এবং মৃতের জন্য কোনো দো‘আও করা যাবে না। কিন্তু মৃত ব্যক্তির জীবিত আত্মীয়স্বজনদের ক্ষতিপূরণের জন্য এবং তাদের হিদায়াতের জন্য দোআ করা যাবে।

ফাতাওয়া নূর ‘আলা আদ্‌-দার্‌ব, ১/২৮৯-২৯১

মানুষ সম্পর্কে ভালো ধারনা পোষণ করা

মূল: ডঃ আলী আল-হাম্মাদী | অনুবাদ: মোঃ মুনিমুল হক

অন্যান্য মহৎগুণের পাশাপাশি একজন মুসলিমকে যে বিষয়ে বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে তা হল সে যেন তার অপর মুসলিম ভাই সম্পর্কে কোন অমূলক সন্দেহের বশবর্তী হয়ে না পড়ে। অপর মুসলিম ভাইকে সন্দেহের দৃষ্টিতে না দেখে তার সম্পর্কে সুধারনা পোষণের ব্যাপারটিকে সর্বদায় অগ্রাধিকার দিতে হবে। অপরের ভুল ধরার জন্য আমরা ওঁতপেতে বসে থাকি। কিন্তু হওয়া উচিৎ ছিল তার উল্টোটা। একজন মুসলিম সবসময় সুযোগ খুঁজবে কি করে অপর একজন মুসলিম ভাইকে তার দোষ-ত্রুটি কিংবা তার বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ থেকে তাকে অব্যাহতি দেয়া যায়। বিশেষ করে, যারা ন্যায়নিষ্ঠ মুসলিম এবং যারা আল্লাহ্‌র পথে মানুষদের ডাকে তাদের দোষ-ত্রুটি অন্বেষণ করা বা তাদের উপর একটুতেই দোষারোপ করা ইত্যাদি থেকে বেঁচে থাকতে হবে।

নিজের দ্বীন সম্পর্কে যত্নবান, জ্ঞানী এবং ন্যায়নিষ্ঠ মুসলিমদের সকলেরই উপরিউক্ত চারিত্রিক গুণাবলী থাকা উচিৎ যারা তাদের প্রতিপালককে ভয় করে থাকে এবং যারা আল্লাহ্‌র দ্বীনের বিজয়ের ব্যাপারে আশাবাদী। মানুষের সম্পর্কে সুধারনা পোষণ করা যদি ন্যায়নিষ্ঠ মুসলিমদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য না হত তাহলে পৃথিবীতে একজনও নিষ্কলুষ চরিত্রের ইসলামিক বিশেষজ্ঞ খুঁজে পাওয়া যেত না, খুঁজে পাওয়া যেত না এমন কোন মহৎ ব্যক্তিকে যার চরিত্রে মানুষ কলঙ্কের ছাপ লাগাতে বাকি রাখত! ফলে যা ঘটতো তা হল, মুসলিমদের সামনে অনুকরনীয় বা অনুসরনীয় কোন ব্যক্তিত্বকেই আর খুঁজে পাওয়া যেত না। আলহামদুলিল্লাহ্‌, মানুষ সম্পর্কে অমূলক কুধারনা পোষণ করা যেমন ইসলামের পরিপন্থী ঠিক তেমনি তা আমাদের বিচার বুদ্ধিরও পরিপন্থি।

এই বিষয়ের একটি মূলনীতি হিসেবে আল্লাহ্‌ রাব্বুল ‘আলামীন বলেনঃ “হে মু’মিনগণ! তোমরা বহুবিধ ধারনা হতে বিরত থাকো; কারণ কোন কোন ধারনা পাপ এবং তোমরা একে অপরের গোপনীয় বিষয় অনুসন্ধান করো না এবং একে অপরের পশ্চাতে নিন্দা করো না। তোমাদের মধ্যে কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের গোশত ভক্ষণ করতে ভালবাসবে? বস্তুতঃ তোমরাও এটাকে ঘৃণাই কর। তোমরা আল্লাহ্‌কে ভয় কর। আল্লাহ্‌ তাওবা গ্রহণকারী, দয়ালু।” [সূরা হুজুরাত : ৪৯ :১২]

মহাপরাক্রমশালী আল্লাহ্‌ রাব্বুল ‘আলামীন আমাদেরকে বহুবিধ সন্দেহ করা থেকে বিরত থাকতে বললেন এই বলে যে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা পাপ। এবং তাৎক্ষনিকভাবেই তিনি গোপনীয় বিষয় অনুসন্ধান করাকেও নিষিদ্ধ করে দিলেন কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই গোপনীয় বিষয় অনুসন্ধানের বিষয়টি জন্মলাভ করে মনের মধ্যে অন্যদের সম্পর্কে কুধারনা পোষণ করা থেকে! একজন মুসলিমের জন্য একটি সাধারন হুকুম হল সে অন্য মুসলিমের দোষ গোপন করবে এবং তাদের সম্পর্কে সুধারনা পোষণ করবে। এবং সে কারণেই আল্লাহ্‌ রাব্বুল ‘আলামীনের আদেশ হল কোন মুসলিম অন্য কোন মুসলিমের ব্যাপারে কোন অপবাদ শুনলেও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি সম্পর্কে সুধারনা বহল রাখতে হবে।

মু’মিনদের মাতা আ’য়েশা (রাদ্বিআল্লাহু ‘আনহা) -এর উপর মুনাফিকরা যে মিথ্যারোপ করছিল সে বিষয়টি আল্লাহ্‌ রাব্বুল ‘আলামীন নিজেই পবিত্র কুর’আন আল-কারীমে স্পষ্ট করে দিয়েছেন আমাদের মাতা আ’য়েশা (রাদ্বিআল্লাহু ‘আনহা)-কে নির্দোষ ঘোষণার মাধ্যমে। আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন বলেনঃ “যখন তোমরা একথা শুনলে, তখন মু’মিন পুরুষ এবং নারীগণ কেন নিজেদের বিষয়ে সৎ ধারনা করনি এবং বলনিঃ এটা সুস্পষ্ট অপবাদ।” [সূরা নূর; ২৪:১২]

[হিশাম ইসমাইল আস-সিনি, মানহাজ আহালুস সুন্নাহ ওয়াল জাম’আত ফীন নাকাব ওয়াল হুকম্‌ ‘আলাল আখীরিন, আল মুনতাদা, লন্ডন, ১৯৯২, পৃষ্ঠাঃ ২১]

ডঃ মুস্তাফা আস সিবা’ঈ বলেনঃ “কারো সম্পর্কে কুধারনা পোষণ করে পরে অনুতপ্ত হওয়ার চেয়ে তার সম্পর্কে সুধারনা পোষণ করে পরে অনুতপ্ত হওয়া বরং শ্রেয়।” [আস সিবা’ঈ, হাকাদা আল লামান্তি আল হায়াত, আল মাক্‌তাব আল ইসলাম, বৈরুত, ১৯৮৪, ভলিউমঃ ১, পৃষ্ঠাঃ ৪২]

[“ফী কাফাস আল ইত্তিহাম” থেকে সংগৃহীত]

আমি আল্লাহকে সব বলে দিবো!

লেখকঃ রফিকুজজামান রুমান

ফেসবুকের একটি স্ট্যাটাস হৃদয়ে হাহাকারের প্রতিধ্বনি তুলছে অবিরাম। মানুষ কতোটা সইতে পারে? চোখের কান্না পানি হয়ে ঝরে বলে দৃশ্যমান। কিন্তু হৃদয়ের কান্না? রক্তক্ষরণ? কোন্ শব্দ/বাক্য/প্রতিক্রিয়া দিয়ে মাপা যায় এর গভীরতা? সামাজিক মাধ্যমে স্ট্যাটাসটি ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র। সিরিয়ার তিন বছরের এক যুদ্ধাহত শিশু মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ার ঠিক আগ মুহূর্তে বললো- ‘আমি আল্লাহকে সব বলে দিবো!’ শিশুটির রক্তমাখা ছবিটির দিকে তাকালেই বুঝে নেওয়া যায় সে আল্লাহর কাছে কী বলবে।

সভ্যতার দ্বান্দ্বিক যুদ্ধ চলছে। এ দ্বন্দ্ব বিশ্বাসের, এ দ্বন্দ্ব আদর্শের। একটি আদর্শকে প্রত্যাখ্যান করতে হয় আর একটি আদর্শ দিয়ে।  ক্ষমতা, শক্তি, জোর দিয়ে আদর্শকে মোকাবেলা করতে গেলেই দ্বন্দ্ব তীব্র হয়ে ওঠে। সেই দ্বান্দ্বিক যুদ্ধে আদর্শবানরা কখনো কখনো পরাজিত হলেও তাদের বিশ্বাসের পরাজয় ঘটে না। বিশ্বাসী তো সে-ই, যে প্রয়োজনে জীবন দিয়েও প্রমাণ করতে পারে ‘আমার বিশ্বাসের প্রতি আমি অবিচল’।

সিরিয়ান এই শিশুটি সভ্যতা, যুদ্ধ, দ্বন্দ্ব, আদর্শ- এগুলো হয়তো পরিষ্কার করে বুঝতে পারেনি। কিন্তু তার ‘বিশ্বাস’ কতো প্রবল! ‘আমি আল্লাহকে সব বলে দিবো!’ সে নিশ্চিত সে আল্লাহর কাছে ফিরে যাচ্ছে। শুধু তা-ই নয়; আল্লাহর কাছে সে নালিশ করবে! যারা তাকে মেরেছে, শুধুমাত্র মুসলিম হওয়ার কারণে যারা তাকে রক্তাক্ত করেছে, যারা তার আদর্শকে আদর্শ দিয়ে প্রতিহত না করে বুলেট ছুড়ে মেরেছে, তাদের বিরুদ্ধে সে আল্লাহর কাছে নালিশ করবে। এছাড়া আর কীইবা করার আছে ছোট্ট এই শিশুটির!

পৃথিবীর কারো কাছে সে অভিযোগ করেনি। কারো কাছে সে তাকে মারার বিচার চায়নি। সে জানে এবং সবাইকে জানিয়ে দিয়ে গেল- এই আদর্শহীন একচোখা বিবেকহীন বিশ্বের কাছে মুসলিমদের কিছু চাইতে নেই। এ এমনই এক বিশ্ব যেখানে মানবাধিকারের ডেফিনিশনই নির্মিত হয় কিছু মানুষকে ‘অমানুষ’ বিবেচনা করে। এ এমনই এক বিশ্ব যেখানে শক্তিধররা/ক্ষমতাবানরা যা বলবে তা-ই সত্য। পূর্বতিমুরের যোদ্ধারা হয় স্বাধীনতাকামী, আর আরাকানের, কাশ্মীরের যোদ্ধারা জঙ্গী কিংবা বিচ্ছিন্নতাবাদী। কালো-সাদা’র তফাত ঘোছাতে ম্যান্ডেলার ভূমিকা ইতিহাস হয়ে থাকবে, সন্দেহ নেই। কিন্তু দেড় হাজার বছর আগে মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কালো বেলালকে প্রথম মুয়াজ্জিন বানিয়েছিলেন। বর্ণবাদ নিয়ে কোনো আলোচনায় এই উদাহরণ দিতে পারবেন না। দিলেই আপনি ‘ব্যাকডেটেড’ কিংবা মৌলবাদী/প্রতিক্রিয়াশীল। এমন একটি ন্যায়ভ্রষ্ট পৃথিবীর কাছে বিশ্বাসীদের কিছু চাওয়ার নেই। তাদের সমস্ত চাওয়া আল্লাহর কাছে।

বাংলাদেশেও বিশ্বাসের এই দ্বন্দ্ব ক্রিয়াশীল। এখানেও আদর্শকে পরাজিত করার জন্য আরেকটি আদর্শের পরিবর্তে বেছে নেওয়া হয় বুলেট বোমা অস্ত্র। একজন বিশ্বাসী মানুষ প্রশ্নহীনভাবে মেনে চলতে চাইবে আসমানী বাণীকে। তার কাছে কুরআনকে বিশ্বাস করার মানে হলো কুরআন নির্দেশিত পথে জীবন পরিচালনা করা। কুরআনের বিধানসমূহ জানা এবং সেগুলো মেনে চলা। এখন কুরআন যদি সমাজ বদলের কথা বলে, কুরআন যদি আল্লাহর সার্বভৌমত্বের কথা বলে, তাহলে তো সেই কাজটিই তাকে করতে হবে। যদি কেই মনে করে কুরআন এগুলো বলেনি, তাকে সেটা প্রমাণ করতে হবে। আর যদি কেউ বলে, সমাজ বদলের জন্য কুরআনের চেয়েও ভালো কোনো রেসিপি তার কাছে আছে, তাহলে সে সেই আদর্শের দিকে মানুষকে ডাকবে। মানুষ যেটি মেনে নেয়। আদর্শের জবাব আদর্শ দিয়ে। কিন্তু দু:খজনক হলো, বাংলাদেশে আদর্শের এই উদারতা নেই। প্রায়ই পত্রিকায় দেখা যায়, জিহাদী বই উদ্ধার। এর মানে কী? জিহাদী বই কি কোনো নিষিদ্ধ বই? তাহলে সবার আগে তো কুরআন নিষিদ্ধ করতে হবে। কুরআনে শতাধিক জায়গায় জিহাদের কথা বলা হয়েছে। কোনো খ্রিষ্টান কিংবা হিন্দু ধর্মাবলম্বীকে যদি নিজ ধর্মের কোনো বইসহ পাওয়া যায়, তাকে কি গ্রেফতার করা হবে?

মিডিয়া, সরকার, পুরো রাষ্ট্রযন্ত্র এভাবে বিশ্বাসীদের উপর আঘাত হানছে। সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক হওয়ার পরেও, শুধুমাত্র বিশ্বাসের কারণে, কোন সংগঠনকে বলা হচ্ছে জঙ্গী। আল্লাহ আমাদের সঠিক পথে চলার তৌফিক দিক।

আমিন!!

উৎসঃ দৈনিক মানবজমিন

সবচেয়ে বড় গুনাহ

লেখকঃ শাইখ মুহাম্মদ ইবন আহমদ আল-আম্মারী | অনুবাদক: আলী হাসান তৈয়ব |সম্পাদক: আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া

 

পৃথিবীতে যত পাপ আছে তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুতর গুনাহ হলো আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরীক করা। পৃথিবীতে শির্কের চেয়ে জঘণ্য আর গুনাহ নেই। যে আল্লাহর দয়া ও অনুগ্রহ ছাড়া আমাদের একটি মুহূর্তও কাটে না, কাউকে তাঁর সমকক্ষ, সমতুল্য বা সমমর্যাদায় অধিষ্ঠিত করার চেয়ে বড় অপরাধ আর কী হতে পারে? তাই আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেছেন: “নিশ্চয় আল্লাহ তাঁর সাথে শরীক করাকে ক্ষমা করেন না। তিনি ক্ষমা করেন এ ছাড়া অন্যান্য পাপ, যার জন্য তিনি চান। আর যে আল্লাহর সাথে শরীক করে সে অবশ্যই মহাপাপ রচনা করে।” {সূরা আন-নিসা, আয়াত : ৪৮}

আবদুল্লাহ ইবন মাসঊদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: “আমি জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহর রাসূল, সবচেয়ে বড় গুনাহ কোনটি? তিনি বললেন, ‘তুমি কাউকে আল্লাহর সমকক্ষ নির্ধারণ করবে; অথচ তিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন।” [বুখারী : ৬০০১; মুসলিম : ৮৬]

আল্লাহর সঙ্গে শির্ক করার অর্থ আল্লাহর ইবাদতের পাশাপাশি অন্য কারও ইবাদত করা। তাঁর দাসত্বের স্বীকৃতির পাশাপাশি অন্য কারও দাসত্বও মেনে নেওয়া। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন: “তোমরা ইবাদাত কর আল্লাহর, তাঁর সাথে কোনো কিছুকে শরীক করো না।” {সূরা আন-নিসা, আয়াত: ৩৬}। আরেক আয়াতে আল্লাহ বলেন: “বল, আমাকে কেবল আদেশ দেয়া হয়েছে, যেন আমি আল্লাহর ইবাদাত করি এবং তাঁর সাথে শরীক না করি।” {সূরা আর-রা‘দ, আয়াত: ৩৬}। আরেক আয়াতে তিনি ইরশাদ করেন: “সুতরাং যে তার রবের সাক্ষাৎ কামনা করে, সে যেন সৎকর্ম করে এবং তার রবের ইবাদাতে কাউকে শরীক না করে।” {সূরা আল-কাহফ, আয়াত : ১১০}

শির্ক যে সবচেয়ে বড় জুলুম ও নিকৃষ্টতম পাপ তা কতভাবেই না আল্লাহ আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন: “আর স্মরণ কর, যখন লুকমান তার পুত্রকে উপদেশ দিতে গিয়ে বলেছিল, ‘প্রিয় বৎস, আল্লাহর সাথে শির্ক করো না; নিশ্চয় শির্ক হল বড় জুলুম।” {সূরা লুকমান, আয়াত : ১৩}

যে শির্ক করে সে যালিম। কারণ আল্লাহ তাকে সৃষ্টি করেছেন আর সে ইবাদত করছে অন্য কারও। সে তো নিমকহারাম; অকৃতজ্ঞ। আল্লাহ ইরশাদ করেন: “তারা কি এমন কিছুকে শরীক করে, যারা কোনো কিছু সৃষ্টি করে না, বরং তাদেরকেই সৃষ্টি করা হয়? আর তারা তাদেরকে কোনো সাহায্য করতে পারে না এবং তারা নিজদেরকেও সাহায্য করতে পারে না।” {সূরা আল-আ‘রাফ, আয়াত : ১৯১-১৯২}। তিনি তাকে রিযিক দেন আর সে অন্য কারও শুকরিয়া আদায় করে। সে নুন খায় একজনের আর গুণ গায় আরেকজনের। আল্লাহ বলেন: “আর তারা আল্লাহ ছাড়া এমন কিছুর উপসনা করে, যারা আসমানসমূহ ও যমীনে তাদের কোনো রিযকের মালিক নয় এবং হতেও পারবে না।” {সূরা আন-নাহল, আয়াত : ৭৩}

মুশরিকের শাস্তি:  

শির্ক যেহেতু বড় গুনাহ, তাই আল্লাহ শির্ককারী তথা মুশরিককে  শাস্তিও দেবেন বড় মর্মন্তুদ।

প্রথম শাস্তি: আল্লাহ মুশরিকের সিয়াম, সালাত, হজ বা যাকাত- কোনো কিছুই কবুল করেন না, যাবৎ সে তাওবা করে ফিরে আসে। আল্লাহ বলেন: “আর যদি তারা শির্ক করত, তারা যা আমল করছিল তা অবশ্যই বরবাদ হয়ে যেত।” {সূরা আল-আন‘আম, আয়াত : ৮৮}। আল্লাহ আরও বলেন: “আর অবশ্যই তোমার কাছে এবং তোমার পূর্ববর্তীদের কাছে ওহী পাঠানো হয়েছে যে, তুমি শির্ক করলে তোমার কর্ম নিষ্ফল হবেই। আর অবশ্যই তুমি ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে।” {সূরা আয-যুমার, আয়াত : ৬৫}

দ্বিতীয় শাস্তি: তাওবা না করে মারা গেলে আল্লাহ কোনো শির্ককারীকে ক্ষমা করবেন না, যদিও সে সিয়াম, সালাত, হজ ও যাকাত আদায় করে এবং নিজেকে মুসলিম হিসেবে দাবি করে। আল্লাহ বলেন: “নিশ্চয় আল্লাহ তাঁর সাথে শরীক করাকে ক্ষমা করেন না। তিনি ক্ষমা করেন এ ছাড়া অন্যান্য পাপ, যার জন্য তিনি চান। আর যে আল্লাহর সাথে শরীক করে সে অবশ্যই মহাপাপ রচনা করে।” {সূরা আন-নিসা, আয়াত : ৪৮}

অতএব সব গুনাহই আল্লাহ মাফ করতে পারেন যা পরিত্যাগ না করেই সে মৃত্যু বরণ করেছে, কেবল শির্ক ছাড়া। শির্ক থেকে তাওবা না করে মারা গেলে তার নিস্তার নেই। আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন ইরশাদ করেন: “তিনি ক্ষমা করেন এ ছাড়া অন্যান্য পাপ, যার জন্য তিনি চান।” {সূরা আন-নিসা, আয়াত : ৪৮}

হাদীসেও দেখুন সেই একই কথার পুনর্ধ্বনি। শির্ক না করে শত পাপ করেও নিস্তারের সম্ভাবনা আছে। কিন্তু শির্কের ক্ষমা নেই। সাহাবী আবূ যর (গিফারী) রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “আমার সামনে জিবরীল আবির্ভূত হলেন। তিনি বললেন, আপনি আপনার উম্মতদের সুসংবাদ দিন, যে ব্যক্তি আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরীক না করা অবস্থায় মারা যাবে, সে জান্নাতে দাখিল হবে। আমি বললাম, যদিও সে যিনা করে এবং চুরি করে থাকে? তিনি বললেন, যদিও সে যিনা করে এবং চুরি করে থাকে। আমি বললাম, যদিও সে যিনা করে এবং চুরি করে থাকে? তিনি বললেন, যদিও সে মদ পান করে।” [বুখারী : ৬৪৪৩; মুসলিম : ৯৪]

তৃতীয় শাস্তি: আল্লাহ তাকে জাহান্নামে প্রবেশ করাবেন। তার সঙ্গে কাফেরের অনুরূপ আচরণ করবেন। যদিও সে সিয়াম পালন করে, সালাত আদায় করে, হজ সম্পাদন করে এবং যাকাত প্রদান আর নিজেকে মুসলিম হিসেবে দাবি করে। আল্লাহ বলেন: “নিশ্চয় যে আল্লাহর সাথে শরীক করে, তার উপর অবশ্যই আল্লাহ জান্নাত হারাম করে দিয়েছেন এবং তার ঠিকানা আগুন। আর যালিমদের কোনো সাহায্যকারী নেই।” {সূরা আল-মায়িদা, আয়াত: ৭২}

পক্ষান্তরে অন্তত শির্ক না করে কেউ যদি মারা যায় তাহলে তার জন্য পরিত্রাণের বার্তা রয়েছে। জাবের ইবন আবদুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, তিনি বলেন: “যে ব্যক্তি আল্লাহর সঙ্গে অংশীদার না করে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে, আর যে ব্যক্তি তাঁর সঙ্গে কোনো অংশীদার সাব্যস্ত করে সাক্ষাৎ করবে সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে।” [মুসলিম : ৯৩]

চতুর্থ শাস্তি: মুশরিকের ক্ষেত্রে ফেরেশতা, নবী বা মুমিন তথা কোনো সুপারিশকারীই কাজে আসবে না। পীরের কথা তো বলাই বাহুল্য। আল্লাহ তা‘আলা বলেন: “অতএব সুপারিশকারীদের সুপারিশ তাদের কোনো উপকার করবে না।” {সূরা আল-মুদ্দাস্সির, আয়াত: ৪৮}

আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: “যখন আল্লাহ বান্দাদের বিচারকার্য সম্পাদন সম্পন্ন করবেন এবং জাহান্নামীদের থেকে যাদের প্রতি আল্লাহ রহমত করতে ইচ্ছা করবেন, তাদের ব্যাপারে ফেরেশতাগণকে নির্দেশ দেবেন যে যারা আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরীক করেনি, তাদের যেন জাহান্নাম থেকে বের করে আনা হয়। যাদের প্রতি আল্লাহ দয়া করবেন, যারা সাক্ষ্য দিয়েছে যে আল্লাহ ছাড়া কোনো সত্য ইলাহ নেই। জাহান্নামে ফেরেশতারা সিজদার চিহ্ন দেখে তাদের চিনতে পারবেন। আগুন বনী আদমের সবই ভষ্ম করতে পারবে কিন্তু সিজদার চিহ্ন ভক্ষণ করতে পারবে না। কেননা, আল্লাহ জাহান্নামের জন্য সিজদার চিহ্নগুলো মিটিয়ে দেওয়া হারাম করে দিয়েছেন। ফলে তাদের জাহান্নাম থেকে বের করে আনা হবে।” [বুখারী : ৭৪৩৭]

পঞ্চম শাস্তি: শির্ককারীদের জন্য নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুপারিশ করবেন না। আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: “প্রত্যেক নবীর জন্য একটি করে কবুল দো‘আ রয়েছে। প্রত্যেক নবীই আগেভাগে দো‘আ করে ফেলেছেন। আর আমি আমার দো‘আকে গোপন রেখেছে কিয়ামতের দিন আমার উম্মতের শাফায়াতের জন্য। অতএব সেটি আমার প্রত্যেক উম্মতই ইনশাআল্লাহ পাবে যে আল্লাহর সঙ্গে শির্ক না করে মারা যাবে।” [মুসলিম : ১৯৯]

কখনো মুশরিকদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে অজ্ঞতা হেতু কোনো কোনো মুসলিম শির্কে লিপ্ত হন। যেমন মূসা আলাইহিস সালামের সগোত্রীয় সুনির্বাচিত লোকেরা সমুদ্রডুবি ও ফেরাউনের কবল থেকে পরিত্রাণ লাভের পর শির্কে বিভ্রান্ত হয়। আল্লাহ তাদের ঘটনা তুলে ধরে বলেন: “আর বনী ইসরাঈলকে আমি সমুদ্র পার করিয়ে দিলাম। অতঃপর তারা আসল এমন এক কওমের কাছে যারা নিজদের মূর্তিগুলোর পূজায় রত ছিল। তারা বলল, ‘হে মূসা, তাদের যেমন উপাস্য আছে আমাদের জন্য তেমনি উপাস্য নির্ধারণ করে দাও। সে বলল, ‘নিশ্চয় তোমরা এমন এক কওম যারা মূর্খ। নিশ্চয় এরা যাতে আছে, তা ধ্বংসশীল এবং তারা যা করত তা বাতিল। সে বলল, ‘আল্লাহ ছাড়া আমি কি তোমাদের জন্য অন্য ইলাহ সন্ধান করব অথচ তিনি তোমাদেরকে সকল সৃষ্টির উপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন?” {সূরা আল-আ‘রাফ, আয়াত: ১৩৮-১৪০}

একইভাবে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবদ্দশায় দেখা যায়, মুসলিমরা হুনায়নের যুদ্ধে বের হলে অজ্ঞানতবশত তারাও নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে একই ধরনের আবেদন করে বসেন। যেমন সাহাবী আবূ ওয়াকেদ লাইছী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন: “আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে হুনায়নের (যুদ্ধের) উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। আমরা তখন সবেমাত্র ইসলাম গ্রহণ করেছি (নওমুসলিম)। একস্থানে পৌত্তলিকদের একটি কুলগাছ ছিল যার চারপাশে তারা একান্তভাবে বসত এবং তাদের সমরাস্ত্র ঝুলিয়ে রাখত। গাছটিকে তারা ‘যাত আনওয়াত’ বলত। আমরা একদিন একটি কুলগাছের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। আমরা তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললাম, ‘হে আল্লাহর রাসূল, মুশরিকদের যেমন ‘যাতু আনওয়াত’ আছে আমাদের জন্যও অনুরূপ ‘যাতু আনওয়াত’ (একটি গাছ) নির্ধারণ করে দিন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘আল্লাহু আকবার’, তোমাদের এ দাবিটি পূর্ববর্তী লোকদের রীতিনীতি ছাড়া আর কিছুই নয়। যার হাতে আমার জীবন তাঁর কসম করে বলছি, তোমরা এমন কথাই বলেছ যা বনী ইসরাঈল মূসা ‘আলাইহিস-সালামকে বলেছিল। তারা বলেছিল, ‘হে মূসা, মুশরিকদের যেমন মা‘বুদ আছে আমাদের জন্য তেমন মা‘বুদ বানিয়ে দাও। মূসা ‘আলাইহিস-সালাম  বললেন, তোমরা মূর্খের মতো কথাবার্তা বলছ’ {সূরা আল-আরাফ : ১৩৮}। তোমরা অবশ্যই তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের রীতিনীতিই অবলম্বন করছ।” [তিরমিযী : ২১৮; তাবরানী : ৩২৯১; আহমাদ : ২১৯০০; তিরমিযী এ হাদীসটিকে সহীহ বলে আখ্যায়িত করেছেন।]

শির্কের রয়েছে নানা ধরন ও প্রকরণ। আল্লাহ তা‘আলা সবগুলোই স্পষ্ট বলে দিয়েছেন। আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন ইরশাদ করেন: “অথচ তিনি তোমাদের জন্য বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন, যা তোমাদের উপর হারাম করেছেন।” {সূরা আল-আন‘আম, আয়াত : ১১৯}। আল্লাহ যা দ্ব্যর্থহীনভাবে হারাম বলে ঘোষণা দিয়েছেন, শির্ক করা তার অন্যতম। আল্লাহ বলেন: “বল, ‘এসো, তোমাদের উপর তোমাদের রব যা হারাম করেছেন, তা তিলাওয়াত করি যে, তোমরা তার সাথে কোনো কিছুকে শরীক করবে না এবং মা-বাবার প্রতি ইহসান করবে আর দারিদ্র্যের কারণে তোমাদের সন্তানদেরকে হত্যা করবে না। আমিই তোমাদেরকে রিযক দেই এবং তাদেরকেও। আর অশ্লীল কাজের নিকটবর্তী হবে না- তা থেকে যা প্রকাশ পায় এবং যা গোপন থাকে। আর বৈধ কারণ ছাড়া তোমরা সেই প্রাণকে হত্যা করো না, আল্লাহ যা হারাম করেছেন। এগুলো আল্লাহ তোমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন, যাতে তোমরা বুঝতে পার।” {সূরা আল-আন‘আম, আয়াত : ১৫১}

শির্কের প্রথম প্রকার: আল্লাহর সঙ্গে বা তাঁকে ছাড়াই ফেরেশতা বা নবীদের উদ্দেশে ইবাদত করা। যে তাদের ইবাদত করবে সে আল্লাহর সঙ্গে কুফুরী করবে এবং নিজ মুনিবের সঙ্গে অংশীদার সাব্যস্তকারী হিসেবে গন্য হবে। আল্লাহ বলেন: “আর তিনি তোমাদেরকে নির্দেশ করেন না যে, তোমরা ফেরেশতা ও নবীদেরকে রব রূপে গ্রহণ কর। তোমরা মুসলিম হওয়ার পর তিনি কি তোমাদেরকে কুফরীর নির্দেশ দিবেন?” {সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ৮০}

শির্কের দ্বিতীয় প্রকার: আল্লাহর সঙ্গে বা তাঁকে ছাড়াই ওলী-বুযুর্গানের উদ্দেশে ইবাদত করা। যে তাদের ইবাদত করবে সে নিজ মুনিবের সঙ্গে অংশীদার সাব্যস্ত করবে। আল্লাহ বলেন: “তারা আল্লাহকে ছেড়ে তাদের পণ্ডিতগণ ও সংসার-বিরাগী বুযুর্গদের রব হিসেবে গ্রহণ করেছে এবং মারইয়ামপুত্র মাসীহকেও। অথচ তারা এক ইলাহের ইবাদত করার জন্যই আদিষ্ট হয়েছে, তিনি ছাড়া কোনো (হক) ইলাহ নেই। তারা যে শরীক করে তিনি তা থেকে পবিত্র।” {সূরা আত-তাওবা, আয়াত: ৩১}। আর তারা বলে,”তোমরা তোমাদের উপাস্যদের বর্জন করো না; বর্জন করো না ওয়াদ, সুওয়া‘, ইয়াগূছ, ইয়া‘ঊক ও নাসরকে।” {সূরা নূহ, আয়াত: ২৩}

ওয়াদ, সুওয়া‘, ইয়াগূছ, ইয়া‘ঊক ও নাসর- এদের প্রত্যেকেই ছিলেন একেকজন পুণ্যবান মানব ও বুযুর্গ ব্যক্তিত্ব। আল্লাহর সন্তুষ্টির সঙ্গে তারা এসব ব্যক্তির সন্তুষ্টিও খুঁজত ইবাদতে। তাই বুযুর্গকে খুশী করতে কোনো ইবাদতের অবকাশ নেই।

শির্কের তৃতীয় প্রকার: আল্লাহর সঙ্গে বা তাঁকে ছাড়াই বৃক্ষরাজি বা ইট-পাথরের উদ্দেশে ইবাদত তথা ভক্তি নিবেদন করা। যে এসবের উদ্দেশে ভক্তি নিবেদন করবে সে নিজ মুনিবের সঙ্গে অংশীদার সাব্যস্ত করবে। আল্লাহ বলেন: “তোমরা লাত ও ‘উয্যা সম্পর্কে আমাকে বল’? আর মানাত সম্পর্কে, যা তৃতীয় আরেকটি?” {সূরা আন-নাজম, আয়াত: ১৯-২০}

শির্কের চতুর্থ প্রকার: শয়তানের উদ্দেশে ইবাদত তথা ভক্তি নিবেদন করা। আল্লাহ বলেন: “হে বনী আদম, আমি কি তোমাদেরকে এ মর্মে নির্দেশ দেইনি যে, ‘তোমরা শয়তানের উপাসনা করো না। নিঃসন্দেহে সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু? আর আমারই ইবাদাত কর। এটিই সরল পথ।” {সূরা ইয়াসীন, আয়াত: ৬০-৬১}

এককথায় রহমান আল্লাহ ছাড়া যার উদ্দেশেই ভক্তি-ইবাদত নিবেদন করা হবে তা শয়তানের জন্য বলে গণ্য হবে। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন: “আল্লাহ ছাড়া তারা শুধু নারীমূর্তিকে ডাকে এবং কেবল  অবাধ্য শয়তানকে ডাকে। আল্লাহ তাকে লা‘নত করেছেন এবং সে বলেছে, ‘অবশ্যই আমি তোমার বান্দাদের এক নির্দিষ্ট অংশকে (অনুসারী হিসেবে) গ্রহণ করব।” {সূরা আন-নিসা, আয়াত : ১১৭-১১৮}

আবূ তোফায়েল থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: “মক্কা বিজয়ের পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খালেদ ইবন ওলীদ (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু)-কে নাখলাহ নামক স্থানে পাঠালেন। সেখানে উজ্জা নামের মূর্তি ছিল। খালেদ (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু) সেখানে গেলেন। সেটি ছিল তিনটি গাছের উপর স্থাপিত। তিনি গাছগুলো কেটে ফেললেন এবং তার ওপরের ঘর ভেঙ্গে দিলেন। পরবর্তীতে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এলেন এবং এ ব্যাপারটি অবহিত করলেন। তিনি বললেন, তুমি ফিরে গিয়ে দেখ, কোনো কাজই করোনি তুমি। তখন খালেদ (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু) সেখানে পুনরায় গেলেন। খালেদ ফিরে গেলেন। তাকে দেখে (ওই আশ্রমের) প্রহরীরা, হে উজ্জা হে উজ্জা বলে পাহাড়ের আড়ালে পলায়ন করল। খালেদ তার সামনে পৌঁছামাত্র এক চুল খোলা উলঙ্গ নারীকে দেখলেন সে নিজের মাথায় মাটি নিক্ষেপ করছে। তিনি তাকে তরবারি দিয়ে আঘাত করে হত্যা করলেন। তারপর নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে ফিরে এসে বৃত্তান্ত তুলে ধরলেন। শুনে তিনি বললেন, সে ছিল উজ্জা।” [নাসায়ী, সুনান আল-কুবরা : ১১৪৮৩]

আর যে শয়তানের অনুসরণ-ইবাদত করে, শয়তান তাকে রহমান আল্লাহর সঙ্গে শির্ক, কুফর ও বিদআত শেখায়। আল্লাহ বলেন: “আর তোমরা তা থেকে আহার করো না, যার উপর আল্লাহর নাম উচ্চারণ করা হয়নি এবং নিশ্চয় তা সীমালঙ্ঘন এবং শয়তানরা তাদের বন্ধুদেরকে প্ররোচনা দেয়, যাতে তারা তোমাদের সাথে বিবাদ করে। আর যদি তোমরা তাদের আনুগত্য কর, তবে নিশ্চয় তোমরা মুশরিক।” {সূরা আল-আন‘আম, আয়াত: ১২১}

শয়তান মানুষের সঙ্গে কথা বলে স্বর ও সুরতে এবং স্বরূপে ও ভিন্নরূপে। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন: “তোমার কণ্ঠ দিয়ে তাদের মধ্যে যাকে পারো প্ররোচিত কর, তাদের উপর ঝাপিয়ে পড় তোমার অশ্বারোহী ও পদাতিক বাহিনী নিয়ে এবং তাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততিতে অংশীদার হও এবং তাদেরকে ওয়াদা দাও’। আর শয়তান প্রতারণা ছাড়া তাদেরকে কোনো ওয়াদাই দেয় না।” {সূরা বানী ইসরাঈল, আয়াত: ৬৪}

আবূ তোফায়ল থেকে বর্ণিত হয়েছে যে জাহেলী যুগের দেবী উজ্জার সম্মুখে শয়তান আত্মপ্রকাশ করেছিল। তখন খালেদ ইবন ওয়ালীদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু তাকে হত্যা করে ফেলেন। অতঃপর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে ফিরে এসে বৃত্তান্ত তুলে ধরলে তিনি বললেন, সে ছিল উজ্জা। [নাসায়ী : প্রাগুক্ত]। ইমাম বুখারী দীর্ঘ এক হাদীসে ঘটনা তুলে ধরেন যে আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর কাছে শয়তান এসেছিল এবং তিন রাত অবস্থান করেছিল। এ কথা শুনে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: “তুমি কি জানো তিন রাত তুমি কার সঙ্গে কথা বলেছ হে আবূ হুরায়রা? তিনি বললেন, জী না। নবীজী বললেন, সে ছিল শয়তান।” [বুখারী : ২৩১১]

মোটকথা, শয়তান তার কণ্ঠ ও কর্ম দিয়ে মুশরিকদের বিভ্রান্ত করেছে। অথচ তারা ভেবেছে এ বুঝি কেবল একটি চিত্র বা কবরস্থ কেউ। কিয়ামত পর্যন্তই সে এভাবে ছলে-বলে-কৌশলে মানুষকে পথভ্রষ্ট করে যাবে। আমাদের কর্তব্য হবে, সর্বদা শয়তানের চক্রান্ত ও প্ররোচনা সম্পর্কে সতর্ক থাকা। আল্লাহর কাছে দিবারাত্র শয়তানের কুমন্ত্রণা ও কূটচাল থেকে বাঁচার জন্য প্রার্থনা করা। আল্লাহ আমাদেরকে সব ধরনের শির্ক থেকে দূরে থাকার তাওফীক দান করুন। আমাদেরকে শির্কমুক্ত ঈমান নিয়ে কবরের যাত্রী বানান।

আমীন!!

আবু বকর সিদ্দীক (রা) এর একটি ঘটনা এবং আমাদের জন্যে শিক্ষা

get

আবু বকর সিদ্দীক (রা:) এর এই ঘটনাটি মোটামুটি আমরা সবাই জানি, কিন্তু ঘটনাটির মাঝে একটি গুরত্বপূর্ণ শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে যা আমাদের অনেকেরই নজর এড়িয়ে গেছে। ইনশাল্লাহ, সেই বিষয়েই এখানে আলোকপাত করব। আহমদ ইবনে হাম্বল রহিমাহুল্লাহ কর্তৃক বর্ণিত, জাবির বিন আব্দুল্লাহ (রা:) এই হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।

রাসূল (ﷺ) মিরাজ থেকে ফিরে এসেছেন। সকালবেলা তিনি যখন মক্কার কুরাইশদের মিরাজের ঘটনাটি বললেন তখন কুফ্ফার সম্প্রদায় হাসি-তামাশায় লিপ্ত হয়েছিল। মক্কার এই কুরাইশ সম্প্রদায়ের কুফ্ফারগণ ছিলেন অনেকটা বস্তুবাদি। যা দেখা, যায় ধরা যায়, ছোয়া যায় শুধু তাই তারা আমলে নিত। রাসূল (ﷺ) এর মিরাজের ঘটনাটিকে তারা একটা হাতিয়ার হিসেবে ধরে নিল আর এর মাধ্যমে মিরাজের ঘটনাটিকে মিথ্যা প্রমাণ করতে চাইল। কুফ্ফার সম্প্রদায়ের কিছু লোক আবু বকর সিদ্দীক (রা:) এর নিকট গেলেন। তিনি বাণিজ্য থেকে কিছুক্ষণ আগে ফিরে এসেছেন, তাই তখনও রাসূল (ﷺ) এর সাথে দেখা করতে পারেননি। কুফ্ফার সম্প্রদায় তাকে বলল, শুনেছ কি তোমার সঙ্গী কি সব বলা শুরু করেছে? সে বলছে, সে নাকি এক রাতের মধ্যে মক্কা থেকে বাইতুল মাকদাস(জেরুজালেম) যেয়ে আবার মক্কায় ফিরে এসেছে।

আবু বকর (রা:) বললেন, এই কথাগুলো কি তিনি বলেছেন? তারা জবাব দিল, হ্যাঁ। এরপর আবু বকর (রা:) বললেন, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, যদি তিনি সত্যিই বলে থাকেন, তাহলে তিনি সত্য বলেছেন। কুফফার সম্প্রদায়ের বিস্ময়ে চোখ কপালে উঠে গেল। তারা বলল, তুমি বিশ্বাস কর সে বৃহত্তর সিরিয়ায় যেয়ে আবার এক রাতের মধ্যে ফিরে এসেছে! আবু বকর (রা:) বললেন, আমি তাকে বিশ্বাস করি বরং এর চেয়েও বেশী বিশ্বাস করি ঐসব বিষয়ে যেগুলো তাঁর নিকট ওহী হিসেবে এসেছে। মোটামুটি এই ঘটনাটুকু আমরা সবাই জানি, কোন বইতে পড়ে কিংবা কারো নিকট থেকে এই ঘটনা শুনে আমরা পুলকিত হই কিন্তু এই ঘটনার মাঝে গুরুত্বপূর্ণ একটি হিকমা রয়েছে যা আমাদের অনেকেরই নজর এড়িয়ে গেছে।

কুফ্ফার সম্প্রদায় যখন আবু বকর (রা:) কে রাসূল (ﷺ) এর মিরাজ সম্পর্কিত কথাটি বলল তখন, আবু বকর (রা:) এর যদি দূর্বল ঈমান থাকত তাহলে তিনি বলতেন, না এই ঘটনাটি সত্য নয় অথবা, আবু বকর (রা:) যদি এমন হতেন যাকে খুব সহজেই কথার চাতুরী দ্বারা অভিভূত করা যায় তাহলে তিনি বলতেন ঘটনাটি সত্য। আবু বকর (রা:) চমৎকারভাবে উত্তর দিয়েছিলেন, মাশাল্লাহ। তিনি ঘটনাটি শুনেছেন কুফ্ফারদের নিকট থেকে আর তাই আবু বকর (রা:) বললেন, যদি তিনি সত্যিই বলে থাকেন, তাহলে তিনি সত্য বলেছেন।

এর দুইটি অংশ রয়েছে, প্রথমত, ‘যদি তিনি সত্যিই বলে থাকেন’ – হাদীস বিশেষজ্ঞগণ এই পদ্ধতীতে কাজ করেন, অর্থাৎ যদি উৎস সত্যিই রাসূল (ﷺ) এর নিকট থেকে আসে- দ্বিতীয়ত, তাহলে তা সত্য। সেটা হচ্ছে ওহী, আল্লাহর নিকট থেকে রাসূল (ﷺ) এর উপর নাযিলকৃত। অর্থাৎ সহীহ হাদীস পাওয়া গেলে তার উপর বিশ্বাস স্থাপন করা, সেই অনুযায়ী কর্তব্য পালন করা ঈমানী দায়িত্ব, কারণ সেটা ওহী। এমন কথা বলা যাবে না যে, এটা তো আমার যুক্তিতে টিকল না বা আমার বাপ-দাদাদের কখনও এমন কিছু বলতে বা করতে দেখিনি কিংবা আমার মাযহাবে এমনটি সমর্থন করে না’।

আবু বকর সিদ্দীক (রা:) এর এই ঘটনা থেকে আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে এটাই, রাসূল (ﷺ) এর কথা সহীহভাবে আমাদের নিকট পৌছালে বিনা বাক্য ব্যয়ে তা মেনে নিতে হবে, তার উপর বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে এবং সেই অনুযায়ী কর্ম পালন করতে হবে। সেটা আমার নিকট যুক্তিতে টিকুক আর না টিকুক, আমার চারপাশে লোকজন সেটা মানুক আর না মানুক আমাকে রাসূল (ﷺ) এর কথায় বিশ্বাস স্থাপন করতেই হবে এবং তার যথাসাধ্য অনুসরণ করতে হবে। আল্লাহ তাআলা আমাদের রাসূল (ﷺ) এর সাহাবীদের মতো করে দ্বীন ইসলামকে বুঝার তৌফিক দান করুন এবং সেই অনুযায়ী আমল করার তৌফিক দান করুন।

আমীন!!

মুসলিমদের মাবুদ কে?

লেখকঃ শায়খ মুহাম্মাদ সালেহ আল-মুনাজ্জিদ | অনুবাদঃ শায়খ সানাউল্লাহ নজির আহমদ | সম্পাদনা : শায়খ আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া

প্রশ্ন:

জনৈক অমুসলিম কিশোরীর প্রশ্ন: মুসলিমদের মাবুদ কে?

উত্তর:

আল-হামদুলিল্লাহ। উত্তর দেওয়ার পূর্বে আমাদের অবাকের কথা জানাচ্ছি যে, অল্প বয়স সত্যেও ইসলামের প্রতি তোমার গুরুত্বারোপের ফলে হয়তো আল্লাহ তা‘আলা তোমার সামনে কল্যাণের মহান দ্বার উন্মুক্ত করে দিবেন, তোমাকে হিদায়েতের তৌফিক দিবেন, যা তোমার কল্পনাতেও ছিল না, এ প্রশ্নের সাহসিকতা তারই প্রমাণ বহন করে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন: “এ হচ্ছে আল্লাহর হিদায়েত, এ দ্বারা তিনি নিজ বান্দাদের মধ্য থেকে যাকে ইচ্ছা হিদায়েত করেন।[1]

অপর আয়াতে তিনি বলেন: “সুতরাং যাকে আল্লাহ হিদায়েত করতে চান, ইসলামের জন্য তার বুক উন্মুক্ত করে দেন।[2]

“মুসলিমরা কার ইবাদত করে” তোমার এ প্রশ্নের উত্তরে কুরআনুল কারিমের আয়াত পেশ করছি যা ইসলামের মৌলিক গ্রন্থ, অনুরূপভাবে তার উত্তর ইসলামের নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী থেকে প্রদান করছি, যার শব্দ ও অর্থ তার রবের পক্ষ থেকে তার নিকট অহি করা হয়েছে।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন: “পরম করুণাময় অতি দয়ালু আল্লাহর নামে। সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি সৃষ্টিকুলের রব। দয়াময়, পরম দয়ালু, বিচার দিবসের মালিক। আপনারই আমরা ইবাদত করি এবং আপনারই নিকট আমরা সাহায্য চাই।[3]

অপর আয়াতে তিনি ইরশাদ করেন: “হে মানুষ, তোমরা তোমাদের রবের ইবাদত কর, যিনি সৃষ্টি করেছেন তোমাদেরকে এবং তোমাদের পূর্বে যারা ছিল তাদেরকে, যাতে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন কর।[4]

অপর আয়াতে তিনি বলেন: “তিনিই আল্লাহ, তোমাদের রব। তিনি ছাড়া কোনো (সত্য) ইলাহ নেই। তিনি প্রতিটি জিনিসের স্রষ্টা, সুতরাং তোমরা তাঁর ইবাদত কর। আর তিনি প্রতিটি জিনিসের উপর তত্ত্বাবধায়ক।[5]

অপর আয়াতে তিনি বলেন: “আর তোমার রব আদেশ দিয়েছেন যে, তোমরা তাকে ছাড়া অন্য কারো ইবাদত করবে না এবং পিতা-মাতার সাথে সদাচারণ করবে। তাদের একজন অথবা উভয়ে যদি তোমার নিকট বার্ধক্যে উপনীত হয়, তবে তাদেরকে ‘উফ’ বলো না এবং তাদেরকে ধমক দিও না। আর তাদের সাথে সম্মানজনক কথা বল। [6]

অতএব মুসলিমরা তাঁরই ইবাদত করে, যার ইবাদত করেছে সকল নবী ও রাসূলগণ। আল্লাহ তা‘আলা বলেন: “নাকি তোমরা সাক্ষী ছিলে, যখন ইয়াকুবের নিকট মৃত্যু উপস্থিত হয়েছিল? যখন সে তাদের সন্তানদেরকে বলল, ‘আমার পর তোমরা কার ইবাদত করবে’? তারা বলল, ‘আমরা ইবাদত করব আপনার ইলাহের, আপনার পিতৃপুরুষ ইবরাহীম, ইসমাঈল ও ইসহাকের ইলাহের, যিনি এক ইলাহ। আর আমরা তারই অনুগত।[7]

মুসলিমরা আল্লাহর ইবাদত করে এবং অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদেরকে কেবল এক আল্লাহর ইবাদত করার প্রতি আহ্বান করে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন: “বল, ‘হে কিতাবিগণ, তোমরা এমন কথার দিকে আস, যেটি আমাদের মধ্যে ও তোমাদের মধ্যে সমান যে, আমরা একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কারো ইবাদত না করি। আর তার সাথে কোনো কিছুকে শরীক না করি এবং আমাদের কেউ কাউকে আল্লাহ ছাড়া রব হিসাবে গ্রহণ না করি’। তারপর যদি তারা বিমুখ হয় তবে বল, ‘তোমরা সাক্ষী থাক যে, নিশ্চয় আমরা মুসলিম।[8]

আল্লাহ এক, তার কোনো শরীক নেই। নূহ আলাইহিস সালাম স্বীয় কওমকে তাঁর ইবাদতের দিকেই আহ্বান করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন: “আমি তো নূহকে তার কওমের নিকট প্রেরণ করেছি। অতঃপর সে বলেছে, ‘হে আমার কওম, তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর। তিনি ছাড়া তোমাদের কোনো (সত্য) ইলাহ নেই। নিশ্চয় আমি তোমাদের মহাদিনের আযাবের ভয় করছি।[9]

ঈসা আলাহিস সালামও এক আল্লাহর ইবাদতের দিকেই আহ্বান করেছেন, আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন: “অবশ্যই তারা কুফরি করেছে, যারা বলেছে, ‘নিশ্চয় আল্লাহ হচ্ছেন মারইয়াম পুত্র মসীহ’। আর মসীহ বলেছে, ‘হে বনী ইসরাইল, তোমরা আমার রব ও তোমাদের রব আল্লাহর ইবাদত কর’। নিশ্চয় যে আল্লাহর সাথে শরীক করে, তার উপর অবশ্যই আল্লাহ জান্নাত হারাম করে দিয়েছেন এবং তার ঠিকানা আগুন। আর যালিমদের কোনো সাহায্যকারী নেই।[10]

অপর আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন: “আর আল্লাহ যখন বলবেন, ‘হে মারইয়ামের পুত্র ঈসা, তুমি কি মানুষদেরকে বলেছিলে যে, ‘তোমরা আল্লাহ ছাড়া আমাকে ও আমার মাতাকে ইলাহরূপে গ্রহণ কর?’ সে বলবে, ‘আপনি পবিত্র মহান, যার অধিকার আমার নেই তা বলা আমার জন্য সম্ভব নয়। যদি আমি তা বলতাম তাহলে অবশ্যই আপনি তা জানতেন। আমার অন্তরে যা আছে তা আপনি জানেন, আর আপনার অন্তরে যা আছে তা আমি জানি না; নিশ্চয় আপনি গায়েবী বিষয়সমূহে সর্বজ্ঞাত’। ‘আমি তাদেরকে কেবল তাই বলেছি, যা আপনি আমাকে আদেশ করেছেন যে, তোমরা আমার রব ও তোমাদের রব আল্লাহর ইবাদত কর। আর যতদিন আমি তাদের মধ্যে ছিলাম ততদিন আমি তাদের উপর সাক্ষী ছিলাম। অতঃপর যখন আপনি আমাকে উঠিয়ে নিলেন তখন আপনি ছিলেন তাদের পর্যবেক্ষণকারী। আর আপনি সব কিছুর উপর সাক্ষী।[11]

মুসা আলাহিস সালামের সাথে কথার সময় আল্লাহ তাকে বলেন: নিশ্চয় আমি আল্লাহ, আমি ছাড়া কোনো (সত্য) ইলাহ নেই; সুতরাং আমার ইবাদত কর এবং আমার স্মরণার্থে সালাত কায়েম কর। [12]

আল্লাহ্‌ তা‘আলা তার নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নির্দেশ প্রদান করেন: “বল, ‘হে মানুষ, তোমরা যদি আমার দীনের ব্যাপারে সন্দেহে থাক, তবে আল্লাহ ছাড়া তোমরা যার ইবাদত কর আমি তার ইবাদত করি না, বরং আমি ইবাদত করি আল্লাহর, যিনি তোমাদের মৃত্যু দেন। আর আমি আদিষ্ট হয়েছি মুমিনদের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার।[13]

আসমানের মালায়েকাও তার ইবাদত করে, তার সাথে কাউকে তারা শরীক করে না, যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন: “আর আসমান-জমিনে যারা আছে তারা সবাই তাঁর; আর তাঁর কাছে যারা আছে তারা অহঙ্কারবশতঃ তাঁর ইবাদত হতে বিমুখ হয় না এবং ক্লান্তিও বোধ করে না।[14]

আল্লাহ ব্যতীত কোনো উপাস্য উপকার ও অপকার এবং সৃষ্টি ও রিজিকের মালিক নয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন: “বল, ‘তোমরা কি আল্লাহ ছাড়া এমন কিছুর ইবাদত করবে, যা তোমাদের জন্য কোন ক্ষতি ও উপকারের ক্ষমতা রাখে না? আর আল্লাহ, তিনিই সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ। [15]

অপর আয়াতে তিনি বলেন: “তোমরা তো আল্লাহকে বাদ দিয়ে মূর্তিগুলোর পূজা করছ এবং  মিথ্যা বানাচ্ছ। নিশ্চয় তোমরা আল্লাহ ছাড়া যাদের উপাসনা কর তারা তোমাদের জন্য রিযক-এর মালিক নয়। তাই আল্লাহর কাছে রিযক তালাশ কর, তাঁর ইবাদত কর এবং তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর। তাঁরই কাছে তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে।[16]

এবার আরেকটি প্রশ্নের উত্তর দিয়ে বিষয়টি শেষ করছি, আর তা হচ্ছে আমরা কেন এক আল্লাহর ইবাদত করি, যার কোনো শরীক নেই। এর উত্তর:

প্রথমত: আমরা এ জন্যই তার ইবাদত করি, যেহেতু তিনি ব্যতীত এ জগতে কেউ ইবাদতের হকদার নয়। কারণ তিনি সৃষ্টিকারী ও রিজিকদাতা, তিনি অস্তিত্বহীন থেকে আমাদেরকে অস্তিত্ব দান করেছেন। তিনি বলেন: “অতএব তোমরা আল্লাহর তাসবীহ কর, যখন সন্ধ্যায় উপনীত হবে এবং সকালে উঠবে। আর অপরাহ্ণে ও যোহরের সময়ে; আর আসমান ও জমিনে সকল প্রশংসা একমাত্র তাঁরই। তিনি মৃত থেকে জীবিতকে বের করেন এবং জীবিত থেকে মৃতকে বের করেন। আর তিনি জমিনকে জীবিত করেন তার মৃত্যুর পর। আর এভাবেই তোমরা উত্থিত হবে। আর তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে যে, তিনি তোমাদেরকে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন, তারপর তোমরা মানুষ হয়ে ছড়িয়ে পড়ছ। আর তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের থেকেই স্ত্রীদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে প্রশান্তি পাও। আর তিনি তোমাদের মধ্যে ভালবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন। নিশ্চয় এর মধ্যে নিদর্শনাবলী রয়েছে সে কওমের জন্য, যারা চিন্তা করে। আর তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে আসমান ও জমিনের সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও তোমাদের বর্ণের ভিন্নতা। নিশ্চয় এর মধ্যে নিদর্শনাবলী রয়েছে জ্ঞানীদের জন্য। আর তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে রাতে ও দিনে তোমাদের নিদ্রা এবং তাঁর অনুগ্রহ থেকে তোমাদের (জীবিকা) অন্বেষণ। নিশ্চয় এর মধ্যে নিদর্শনাবলী রয়েছে সে কওমের জন্য যারা শোনে। আর তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে তিনি তোমাদেরকে ভয় ও ভরসাস্বরূপ বিদ্যুৎ দেখান, আর আসমান থেকে পানি বর্ষণ করেন। অতঃপর তা দ্বারা জমিনকে তার মৃত্যুর পর পুনর্জীবিত করেন। নিশ্চয় এর মধ্যে নিদর্শনাবলী রয়েছে সে কওমের জন্য যারা অনুধাবন করে। আর তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে, তাঁরই নির্দেশে আসমান ও জমিন স্থিতিশীল থাকে। তারপর তিনি যখন তোমাদেরকে জমিন থেকে বের হয়ে আসার জন্য একবার আহবান করবেন তখনই তোমরা বের হয়ে আসবে। আর আসমানসমূহ ও জমিনে যা কিছু আছে সব তাঁরই। সব কিছুই তাঁর অনুগত। আর তিনিই সৃষ্টির সূচনা করেন তারপর তিনিই এর পুনরাবৃত্তি করবেন। আর এটা তো তাঁর জন্য অধিকতর সহজ। আসমান ও জমিনে সর্বোচ্চ মর্যাদা তাঁরই এবং তিনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।[17]

তিনি অপর আয়াতে বলেন: “বরং তিনি (শ্রেষ্ঠ), যিনি আসমানসমূহ ও জমিনকে সৃষ্টি করেছেন এবং তোমাদের জন্য তিনি আসমান থেকে পানি বর্ষণ করেন। অতঃপর তা দ্বারা আমি মনোরম উদ্যান সৃষ্টি করি। তার বৃক্ষাদি উৎপন্ন করার ক্ষমতা তোমাদের নেই। আল্লাহর সাথে কি অন্য কোন ইলাহ আছে? বরং তারা এমন এক কওম যারা শির্ক করে। বরং তিনি, যিনি জমিনকে আবাসযোগ্য করেছেন এবং তার মধ্যে প্রবাহিত করেছেন নদী-নালা। আর তাতে স্থাপন করেছেন সুদৃঢ় পর্বতমালা এবং দুই সমুদ্রের মধ্যখানে অন্তরায় সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহর সাথে কি অন্য কোনো ইলাহ আছে? বরং তাদের অধিকাংশই জানে না। বরং তিনি, যিনি নিরুপায়ের আহবানে সাড়া দেন এবং বিপদ দূরীভূত করেন এবং তোমাদেরকে জমিনের প্রতিনিধি বানান। আল্লাহর সাথে কি অন্য কোনো ইলাহ আছে? তোমরা কমই উপদেশ গ্রহণ করে থাক। বরং তিনি, যিনি তোমাদেরকে স্থলে ও সমুদ্রের অন্ধকারে পথ দেখান এবং যিনি স্বীয় রহমতের প্রাক্কালে সুসংবাদবাহী বাতাস প্রেরণ করেন। আল্লাহর সাথে কি অন্য কোনো ইলাহ আছে? তারা যা কিছু শরীক করে আল্লাহ তা থেকে ঊর্ধ্বে। বরং তিনি, যিনি সৃষ্টির সূচনা করেন, তারপর তার পুনরাবৃত্তি করবেন এবং যিনি তোমাদেরকে আসমান ও জমিন থেকে রিজিক দান করেন, আল্লাহর সাথে কি কোনো ইলাহ আছে? বল, ‘তোমাদের প্রমাণ নিয়ে এসো যদি তোমরা সত্যবাদী হও।’ বল, ‘আল্লাহ ছাড়া আসমানসমূহে ও জমিনে যারা আছে তারা গায়েব জানে না। আর কখন তাদেরকে পুনরুত্থিত করা হবে তা তারা অনুভব করতে পারে না।[18]

অতএব আল্লাহ ব্যতীত কেউ কি আছে, যে ইবাদতের হকদার?

দ্বিতীয়ত: আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে শুধু তার ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছেন। তিনি ইরশাদ করেন: “আর আমি জিন ও মানুষকে কেবল এ জন্যই সৃষ্টি করেছি যে তারা কেবল আমার ইবাদত করবে।[19]

তৃতীয়ত: কিয়ামতের দিন একমাত্র তারাই নাজাত পাবে, যারা যথাযথভাবে আল্লাহর ইবাদত সম্পাদন করেছে। বান্দাদের হিসাব-নিকাশ ও আমলের প্রতিদান প্রদানের নিমিত্তে মৃত্যুর পর আল্লাহ পুনরায় তাদেরকে উঠাবেন, সেদিন একমাত্র তারাই মুক্তি পাবে, যারা শুধু এক আল্লাহর ইবাদত করেছে, আর অবশিষ্টদের জাহান্নামে নিয়ে যাওয়া হবে, যা খুব নিকৃষ্ট স্থান। ইসলামের নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে যখন তার সাথীগণ জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘কিয়ামতের দিন আমরা কি আমাদের রবকে দেখব? তিনি বলেছেন: “তোমরা কি সূর্য ও চাঁদ দেখতে কষ্ট অনুভব কর যখন পরিষ্কার থাকে? আমরা বললাম: না, তিনি বললেন: সে দিন তোমাদের রবকে দেখতে কোনো কষ্ট অনুভব হবে না, যেমন কষ্ট অনুভব কর এ দু’টোকে দেখতে। অতঃপর এক ঘোষণাকারী ঘোষণা দিবে, প্রত্যেক কওম যেন তাদের উপাস্যদের নিকট চলে যায়, ফলে ক্রুশ পূজারিরা তাদের ক্রুশের সাথে চলে যাবে, মূর্তি পূজারিরা তাদের মূর্তির সাথে চলে যাবে এবং প্রত্যেক উপাস্যদের ইবাদতকারিরা তাদের উপাস্যদের সাথে চলে যাবে, অবশেষে শুধু আল্লাহকে ইবাদতকারী নেককার অথবা বদকার লোকেরা বাকি থাকবে এবং অবশিষ্ট কতক আহলে কিতাব। অতঃপর জাহান্নামকে এনে পেশ করা হবে, যেন তা মরীচিকা। ইহুদিদেরকে বলা হবে: তোমরা কার ইবাদত করতে, তারা বলবে আমরা আল্লাহর ছেলে উযায়ের এর ইবাদত করতাম। তাদেরকে বলা হবে: তোমরা মিথ্যা বলেছ, আল্লাহর কোনো সন্তান ও স্ত্রী ছিল না। তোমরা কি চাও? তারা বলবে: আমাদেরকে পানি পান করান। বলা হবে: তোমরা পান কর, ফলে তারা জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে। অতঃপর খ্রিস্টানদের বলা হবে: তোমরা কার ইবাদত করতে, তারা বলবে: আমরা আল্লাহর ছেলে মাসীহের ইবাদত করতাম। তাদেরকে বলা হবে: তোমরা মিথ্যা বলেছ, আল্লাহর কোনো সন্তান ও স্ত্রী ছিল না, তোমরা কি চাও? তারা বলবে: আমাদেরকে পানি পান করান। বলা হবে: তোমরা পান কর, ফলে তারা জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে, অবশেষে শুধু আল্লাহকে ইবাদতকারী নেককার কিংবা বদকার অবশিষ্ট থাকবে। অতঃপর তাদেরকে বলা হবে: তোমাদেরকে কিসে আটকে রেখেছে, অথচ লোকেরা চলে গেছে? তারা বলবে: আমরা তাদের থেকে পৃথক হয়ে গেছি। আজ আমরা তার (রবের) খুব মুখাপেক্ষী। আমরা এক ঘোষণাকারীকে ঘোষণা করতে শুনেছি, প্রত্যেক কওম তাদের উপাস্যদের সাথে গিয়ে মিলুক, ফলে আমরা আমাদের রবের অপেক্ষা করছি। তিনি বলেন, তাই তাদের নিকট আল্লাহ আসবেন… তিনি বলবেন: আমি তোমাদের রব, তারা বলবে: আপনি আমাদের রব, নবীগণ ব্যতীত তার সাথে  কেউ কথা বলবে না…, অতঃপর প্রত্যেক মুমিন তাকে সেজদা করবে।[20]

তারা সবাই মুমিন, তারাই একমাত্র জান্নাতবাসী, তাদের উপর কোনো ভয় নেই, তারা কখনো চিন্তিত হবে না, তারা সেখানে সর্বদা থাকবে। আশা করছি বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে। অতঃপর শুধু আল্লাহর বাণী দ্বারাই শেষ করছি, তিনি বলেন: “যে হিদায়েত গ্রহণ করে, সে তো নিজের জন্যই হিদায়েত গ্রহণ করে এবং যে পথভ্রষ্ট হয় সে নিজের (স্বার্থের) বিরুদ্ধেই পথভ্রষ্ট হয়।[21]

হিদায়েত অনুসারীর উপর সালাম।


[1] সূরা আন‘আম: (৮৮)
[2] সূরা আন‘আম: (১২৫)
[3] সূরা ফাতেহা: (১-৫)
[4] সূরা বাকারা: (২১)
[5] সূরা আন‘আম: (১০২)
[6] সূরা আল-ইসরা: (২৩)
[7] সূরা বাকারা: (১৩৩)
[8] সূরা আলে-ইমরান: (৬৪)
[9] সূরা আরাফ: (৫৮)
[10] সূরা আল-মায়েদাহ্‌: (৭২)
[11] সূরা মায়েদা: (১১৬-১১৭)
[12] সূরা ত্বহা: (১৪)
[13] সূরা ইউনুস: (১০৪)
[14] সূরা আম্বিয়া: (১৯)
[15] সূরা মায়েদাহ্‌: (৭৬)
[16] সূরা ‘আনকাবুত: (১৭)
[17] সূরা রূম: (১৭-২৭)
[18] সূরা নামল: (৬০-৬৫)
[19] সূরা যারিয়াত: (৩৩)
[20] বুখারি: (৬৮৮৬), (৭৪৪০)
[21] সূরা ইসরা: (১৫)

সাবস্ক্রাইব করুন

2,018,267FansLike
1,685FollowersFollow
1,150FollowersFollow
6,143FollowersFollow
4,600SubscribersSubscribe