Home Blog Page 58

কোয়ান্টাম মেথড ও প্রতারণা

Quantum-Methodকোয়ান্টাম মেথড সম্পর্কে একটি তথ্য সম্বলিত ওয়েবসাইটের লিংক পেলাম।  কোয়ান্টাম মেথড সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে ভিজিট করুন

http://quantummethodbd.wordpress.com/

প্রতারণার আরেক নাম হচ্ছে কোয়ান্টাম মেথড। সুস্থভাবে ও সঠিকভাবে জীবন যাপন করার জন্য দয়া করে কোয়ান্টাম মেথডের কাছে নিজেকে সমর্পন করবেননা।

অনুরোধঃ দয়া করে লেখাটি সবার মাঝে ছড়িয়ে দিন, যাতে করে সবাই নিজ নিজ ঈমান রক্ষা করে বিদআত, কুফর ও শিরকের পথ হতে সরে আসতে পারেন।

মূল লেখা 

বইঃ বড় শির্ক কি ও কত প্রকার – ফ্রী ডাউনলোড

boro-sirk1লেখকঃ শেইখ মুস্তাফিজুর রহমান মাদানী

সংক্ষিপ্ত বর্ণনাঃ শির্ক বলতেই তা আল্রাহ্ তা’আলার প্রতি এক বড় যুলুম। তবে তার মধ্যে কিছু রয়েছে বড়। আর কিছু রয়েছে ছোট। বড় শির্ক এমন একটি ভয়াবহ অপরাধ যা তাতে লিপ্ত ব্যক্তিকে ইসলামের গণ্ডী থেকে সম্পূর্ণরূপে বের করে দেয়। এ জাতীয় লোকের সকল আমল বিনষ্ট হয়ে যায়। তার জান ও মালের কোন নিরাপত্তা থাকেনা। কোন ঈমানদার ব্যক্তি তার সাথে কোন ধরনের বন্ধুত্ব পাতাতে পারেনা। আল্লাহ্ তা’আলা তাওবা ছাড়া এ জাতীয় শির্ক কখনোই ক্ষমা করেননা। এতে লিপ্ত ব্যক্তির জন্য জান্নাত হারাম হয়ে যায়। জাহান্নামই হয় একমাত্র তার চিরস্থায়ী ঠিকানা। এরপরও এ জাতীয় শির্কের আজ যত্রতত্র ছঢ়াছড়ি। এর অনেকগুলো কারণ তো অবশ্যই রয়েছে। তবে এগুলোর মধ্যকারসর্ব প্রথম কারণ মূর্খতাটাই সব চাইতে বেশি চোখে পড়ার মতো। তাই এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট ধারনা পাওয়ার জন্য”বড় শির্ক কি ও কত প্রকার” বইটি ডাউনলোড করুন।

বড় শির্ক কি ও কত প্রকার? – QuranerAlo Server
বড় শির্ক কি ও কত প্রকার? – QuranerAlo Server

রোযা বিষয়ক সংক্ষিপ্ত প্রবন্ধ

লেখক: মুহাম্মাদ ইবন সালেহ আল-উসাইমীন | অনুবাদক: আব্দুররব আফফান

সকল প্রশংসা জগৎ সমূহের প্রতিপালক আল্লাহর জন্য এবং আমাদের নবী মুহাম্মাদ এবং তাঁর বংশধর ও সকল সাহাবীদের প্রতি দরুদ ও সালাম। রোযা বিষয়ে সংক্ষিপ্ত এই প্রবন্ধটিতে রোযার বিধান, রোযায় মানুষের শ্রেণিভেদ, রোযা ভঙ্গের কারণ ও অন্যান্য কতিপয় প্রয়োজনীয় মাসয়ালা সংক্ষেপে আলোচনা করা হয়েছে।

১) ‘সিয়াম’ বা রোযা: ফজরের শুরু হতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত রোযা ভঙ্গের কারণ থেকে বিরত হয়ে আল্লাহর উদ্দেশ্যে ইবাদত পালন করা।
২) রমযানের সিয়াম: রমাযানের সিয়াম ইসলামের পাঁচটি রুকনের অন্যতম একটি রুকন বা ভিত।

যেমন নবী সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: ইসলাম পাঁচটি স্তম্ভের উপর স্থাপিতঃ (১) সাক্ষ্য দেয়া যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন মাবুদ নেই এবং মুহাম্মাদ (সা:)আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর রাসূল (২) রীতি মত নামায আদায় করা (৩) যাকাত দেয়া (৪) রমযানের রোযা পালন করা (৫) বায়তুল্লাহ্র হজ্জ করা। [বুখারী ও মুসলিম]

সিয়াম পালনের ক্ষেত্রে মানুষের শ্রেণিভেদ

সিয়াম প্রত্যেক প্রাপ্ত বয়স, বিবেক সম্পন্ন, সামর্থ্যবান ও নিজ বাসস্থানে অবস্থানকারী মুসলিম ব্যক্তির উপর ফরয।যে সব লোকের প্রতি সিয়াম ফরয নয়:

১) কাফের : ইসলাম গ্রহণের পূর্বে কাফেরের উপর সিয়াম ফরয নয় এবং তার জন্য ইসলাম গ্রহণের পর কাযা করাও জরুরি নয়।
২) অপ্রাপ্ত বয়স : অপ্রাপ্ত বয়স্ক ছেলে-মেয়ের উপর সিয়াম ফরজ নয় কিন্তু অভ্যাস গড়ার জন্য রোযা পালনের আদেশ করা যাবে।
৩) পাগল : প্রাপ্ত বয়স্ক পাগলের উপর সিয়াম ফরয নয় এবং তার জন্য রোযা করিয়ে নেয়ারও প্রয়োজন নেই, অনুরূপ বিধান যার জ্ঞান লোপ পেয়েছে এবং যার অতি মাত্রায় মতিভ্রম হওয়ার কারণে ভাল-মন্দ তারতম্য করতে পারে না।
৪) অপারগ : স্থায়ী সামর্থ্যহীন যেমন অতিশয় বৃদ্ধ বা এমন রোগে আক্রান্ত যার আরোগ্য লাভের আর আশা নেই, এরূপ ব্যক্তির প্রতি সিয়াম ফরয নয়। তবে রমযানের প্রত্যেক দিনের জন্য একজন মিসকিনকে খাবার দিতে হবে।
৫) অসুস্থ : অস্থায়ী ভাবে রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির পক্ষে রোযা রাখা কঠিন হলে সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত রোযা রাখবে না, কিন্তু সুস্থ হওয়ার পর কাযা করবে।
৬) গর্ভবতী বা দুধ পান করায় এমন মহিলা : গর্ভ-ধারণ বা দুধপান করানোর কারণে যদি তাদের প্রতি রোযা রাখা কঠিন হয়, বা স্বীয় সন্তানের অনিষ্টের আশঙ্কা করে তবে রোযা না রেখে যখন আশঙ্কা মুক্ত হবে তখন সুবিধা মত সময়ে কাযা করে নিবে।
৭) মাসিক ঋতু স্রাব অথবা সন্তান প্রসব জনিত স্রাব হলে উক্ত অবস্থায় রোযা না রেখে, তা দূর হলে পরে কাযা করে নেবে।
৮) নিরুপায় : এমন ব্যক্তি যে রোযা ছেড়ে দিতে বাধ্য, যেমন কোন ছোট বাচ্চা পানিতে ডুবে গেছে অথবা আগুনে পুড়ে যাচ্ছে তাকে মুক্ত করার জন্য রোযা ছেড়ে দিতে হলে দেবে কিন্তু পরবর্তীতে কাযা করে নেবে।
৯) মুসাফির : মুসাফিরের জন্য সফরে রোযা রাখা, না রাখার স্বাধীনতা রয়েছে, তবে যদি না রাখে পরে কাযা করে নেবে। উল্লেখ্য, মুসাফির ইচ্ছা করলে যতদিন সফরে থাকবে, (উক্ত সফর স্বল্পস্থায়ী হোক বা স্থায়ী) ততদিন রোযা ছাড়তে পারবে।

রোযা ভঙ্গের কারণঃ

রোযাদার যদি ভুলক্রমে বা নাজেনে বা বাধ্য হয়ে কিছু খেয়ে পেলে, তবে রোযা নষ্ট হবে না, আল্লাহ বলেন: “হে আমাদের প্রতিপালক! যদি আমরা ভুল করে অথবা অজ্ঞাতসারে দোষে লিপ্ত হই তবে আমাদেরকে পাকড়াও কর না।” [সূরা আল-বাকারা : ২৮৬]

আল্লাহ তাআলা বলেন: “তবে তার জন্য মহা শাস্তি নয় যাকে কুফরী করতে বাধ্য করা হয়েছে কিন্তু তার অন্তর ঈমানে অবিচল।” [সূরা আন – নাহাল : ১০]

আল্লাহ তাআলা বলেন: “যা তোমরা অজ্ঞাতসারে ভুল করেছ তাতে তোমাদের কোন অপরাধ নেই কিন্তু তা তোমাদের সংকল্প থাকলে অপরাধ হবে।” [সূরা আল-আহ্যাব : ৫]

* অতএব, রোযাদার যদি ভুলবশত: পানাহার করে তবে ভুলের কারণে তার রোযা নষ্ট হবে না।
* আর কেউ যদি সূর্য ডুবে গেছে অথবা ফজর এখনও হয়নি এরূপ মনে করে পানাহার করে তবে তার অজ্ঞতার কারণে রোযা নষ্ট হবে না।
* যদি কুলি করা অবস্থায় অনিচ্ছা সত্ত্বেও গলায় পানি চলে যায় তবে রোযা নষ্ট হবে না।
* স্বপ্নদোষ হলেও এতে তার কোন ইচ্ছা না থাকায় রোযা ভঙ্গ হবে না।

রোযা ভঙ্গের কারণ ৮ টি:

স্ত্রী সহবাস : রোযাদার যদি রমাযানের দিনে স্ত্রী সহবাসে লিপ্ত হয় তবে উক্ত রোযা কাযা আদায়সহ জটিল কাফ্ফারা আদায় করতে হবে। আর তা হলো : একটি গোলাম আজাদ করা, যদি সামর্থ্য না থাকে তবে ধারাবাহিক দুই মাস (মাঝে বিরতি ছাড়া) রোযা রাখতে হবে আর যদি তার সামর্থ্য না থাকে তবে ৬০ জন মিসকীনকে খাওয়াতে হবে।
বীর্যপাত : জাগ্রতাবস্থায় হস্ত মৈথুন, স্ত্রীর সাথে মেলা মেশা করা, চুমো দেয়া, স্পর্শ করা অথবা অন্য কোন কারণে বীর্যপাত হলে রোযা বিনষ্ট হয়ে যাবে।
পানাহার : উপকারী বা ক্ষতি কারক (যেমন ধূমপান) কোন কিছু পানাহারে রোযা ভেঙে যায়।
ইনজেকশন যোগে খাদ্যের সম্পূরক খাদ্য জাতীয় কোন কিছু প্রয়োগ করলে। কিন্তু তা যদি খাদ্যের সম্পূরক না হয় তবে শরীরের যেখানেই প্রয়োগ করা হোক যদিও তার স্বাদ গলায় অনুভূত হয় রোযা নষ্ট হবে না।
ইনজেকশন যোগে রক্ত প্রয়োগ : যেমন রোযাদারের যদি রক্ত শূন্যতা দেখা দেয় আর তার ফলে ইন্জেকশন প্রয়োগে রক্ত প্রবেশ করান হয় তবে রোযা নষ্ট হয়ে যাবে।
মাসিক ঋতু স্রাব ও সন্তান প্রসব জনিত স্রাব।
শিংগা বা এ জাতীয় কিছু লাগিয়ে রক্ত বের করা, তবে যদি রক্ত স্বাভাবিকভাবে যেমন নাক থেকে রক্তক্ষরণ বা দাঁত উঠানোর ফলে বা এ ধরনের অন্য কারণে বের হয় তবে রোযা বিনষ্ট হবে না।
বমি করলে : ইচ্ছাকৃতভাবে বমি করলে রোযা নষ্ট হবে কিন্তু অনিচ্ছায় বমি করলে রোযা নষ্ট হবে না।

রোযার কতিপয় প্রয়োজনীয় মাসয়ালা:

১. অপবিত্র অবস্থায় রোযার নিয়ত করা জায়েয তবে ফজর হলে গোসল করবে।
২. কোন মহিলা যদি রমাযানে ফজরের পূর্বে মাসিক ঋতু-স্রাব বা সন্তান প্রসব জনিত স্রাব হতে পবিত্র হয় তবে সে ফজরের পূর্বে গোসল না করলেও তার প্রতি রোযা রাখা ফরয তারপর ফজরে গোসল করে নিবে।
৩. রোযা অবস্থায় দাঁত উঠানো, জখমে ঔষধ লাগানো চোখে বা কানে ঔষধের ফোটা নিক্ষেপ জায়েয, যদিও চোখে বা কানে ফোঁটা প্রয়োগের ফলে গলায় ঔষধের স্বাদ অনুভূত হয়।
৪. রোযা অবস্থায় দিনের প্রথমভাগে ও শেষ ভাগে মিসওয়াক করা জায়েয বরং অন্যের মত তার জন্যেও এ অবস্থায় সুন্নাত।
৫. রোযাদার গরম ও পিপাসার তীব্রতা কমানোর জন্য পানি, শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ বা অন্য কিছুর মাধ্যমে ঠান্ডা গ্রহণ করা বৈধ।
৬. প্রেশার বা অন্য কোন কারণে শ্বাস কষ্ট হলে রোযা অবস্থায় মুখে স্প্রে করা জায়েয।
৭. রোযাদারের ঠোঁট শুকিয়ে গেলে পানি দ্বারা ভিজান এবং মুখ শুকিয়ে গেলে গড় গড়া করা ছাড়া কুলি করা বৈধ।
৮. ফজরের সামান্য পূর্বে অর্থাৎ দেরী করে সেহরী খাওয়া এবং সূর্যাস্তের পর তাড়াতাড়ি ইফ্তার করা সুন্নাত। রোযাদার ইফ্তারের জন্য খেজুর, শুকনা খেজুর, পানি, যে কোন হালাল খাবার যথাক্রমে প্রথম থেকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে গ্রহণ করবে। আর যদি ইফ্তারের জন্য কিছুই না পাওয়া যায়, তবে কোন খাবার পাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত মনে মনে ইফ্তারের নিয়ত করে নিবে।
৯. রোযাদারের উচিত সৎকর্ম বেশি বেশি করা এবং সকল নিষিদ্ধ কাজ থেকে বিরত থাকা।
১0. রোযাদারের ফরয কাজ সমূহ নিয়মিত আঞ্জাম দেয়া এবং সকল হারাম থেকে দুরে থাকা একান্ত কর্তব্য; অতএব, পাঁচ ওয়াক্ত নামায সময় মত এবং যদি সে জামায়াতে উক্ত নামায আদায়ের ওযর বিহীন লোক হয় তবে জামায়াতের সাথে আদায় করবে এবং মিথ্যা কথা, পরনিন্দা, ধোঁকাবাজি, সুদী লেন-দেন করা ও সকল হারাম কথা ও কাজ থেকে বিরত থাকবে।
“নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: “যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা, অনুরূপ আচরণ ও জাহেলিয়াত বর্জন না করে, তবে তার পানাহার বর্জনের আল্লাহ্র কোনই প্রয়োজন নেই।” [বুখারী]

সকল প্রশংসা জগৎ সমুহের প্রতিপালক আল্লাহ্র জন্য এবং আমাদের নবী মুহাম্মাদ, তাঁর বংশধর ও তাঁর সকল সাহাবীর প্রতি সালাম বর্ষিত হোক। আমীন !

সমাপ্ত

ঢাকা শহরে মেয়েদের নামায পড়ার স্থান গুলোর একটা তালিকা

ঢাকা শহরে মহিলাদের নামায পড়ার স্থানগুলো কোথায়  তা আমাদের অনেক বোনই জানেন না। তাদের জন্য আজ আমারা একটি তালিকা প্রকাশ করতে যাচ্ছি ইনশাহআল্লাহ এই লিস্ট আপডেট হতে থাকবে। নিচে দেয়া স্থানগুলি ব্যাতিত অন্য কোন স্থান যদি আপনাদের জানা থাকে তাহলে কমেন্ট করে আমাদের জানান। ইনশাহআল্লাহ তা আমাদের বোনদের উপকারে আসবে।

ঢাকা শাহরের যে সকল স্থানে মেয়েদের নামায পড়ার ব্যাবস্থা রয়েছেঃ

১) ঢাকা নিউ মার্কেট মসজিদ
২) রাইফেলস স্কয়ার (জিগাতলা)
৩) ইস্টার্ন মল্লিকার ছাদে
৪) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদ
৫) রাপা প্লাজার ৫ম তলায় জয়ীতার শো-রুম ও মার্কেটের ছাদ (ধানমন্ডি ২৭)
৬) সোবহানবাগ জামে মসজিদ (ধানমন্ডি ২৭)
৭) গাউছিয়া মার্কেটের নিচ তলায় (ধানমন্ডি হকারস এর উল্টোদিকে)
৮) চাঁদনি চকের ৩য় তলায় (নিউমার্কেটের উল্টোদিকে)
৯) তাকওয়া মসজিদ (ধানমন্ডি ১২/এ লেকের সাথে)
১০) বসুন্ধরা শপিং কমপ্লেক্স, পান্থপথ (৪র্থ তলায়)
১১) বায়তুল মামুর মসজিদ, সায়েন্সল্যাব (২য় তলা)
১২) ফেরদৌসি মসজিদ, মিরপুর-১
১৩) মৌচাক মার্কেট (৪র্থ তলা)
১৪) জেনেটিক প্লাজা ১ম তলা (ধানমন্ডি ২৭)
১৫) বায়তুল আমান মসজিদ (ধানমন্ডি ৮)
১৬) উত্তরা ৪ নং, ৬ নং, ৭ নং সেক্টর মসজিদ
১৭) স্কয়ার হসপিটাল
১৮) ডিসিসি সুপার মার্কেট (গুলশান ১)
১৯) উত্তরা হাউস বিল্ডিং, নর্থ টাওয়ার (মার্কেট) ৯বম তলা
২০) রমনা থানা জামে মসজিদ
২১) ইউনাইটেড হসপিটাল (৩য় তলা)
২২) এপলো হসপিটাল (৫ম তলা)
২৩) পিঙ্ক সিটি (বেইজমেন্ট)
২৪) মোহাম্মদপুর এ স্যার সৈয়দ রোড এর আল আমিন মসজিদ
২৫) আযাদ মসজিদ (গুলশান ২)
২৬) নায়েম ভবন মসজিদ (ঢাকা কলেজের পেছনে)
২৭) ল্যাব এইড ডায়াগনস্টিক হসপিটাল (১.৫ তলা)
২৮) টুইন টাওয়ার শপিং সেন্টার (৪র্থ তলা)
২৯) ইবনে সিনা ডায়াগনস্টিক সেন্টার ধানমণ্ডি (বেইজমেন্ট)
৩০) North Tower (Market) 8th floor, Uttara House Building

অনুগ্রহ করে আপনার জানা তথ্য শেয়ার করুন। ধন্যবাদ

Source: Sister Ishrat Jahan Inu

বইঃ সালাতের পর রাসূল (ﷺ) যে সব দোয়া পড়তেন – ফ্রী ডাউনলোড

Salat er porer Duaলেখকঃ মুফতী  কাজী মুহাম্মাদ ইবরাহীম

সংক্ষিপ্ত পরিচিতিঃ রাসূল (ﷺ) সলাতের পরে যেসব দুয়া পড়তেন তা আমরা অনেকেই জানিনা। আর এই দুয়া গুল না জানার কারনে সালাম ফিরানোর পরেই আমরা দুয়া করার জন্য ব্যস্ত হয়ে যাই যা সুন্নাতের পরিপন্থী। লেখক শেইখ মুফতী  কাজী মুহাম্মাদ ইবরাহীম এই বইতিতে রাসূল (ﷺ) সলাতের পরে যেসব দুয়া পড়তেন তা দালিল সহ তুলে ধরেছেন। বইটি নিজে পড়ুন এবং অন্য দের সাথে শেয়ার করুন। এবং নিকটস্থ লাইব্রেরি থেকে আপনার কপিটি সংগ্রহ করুন।

সালাতের পর রাসূল (ﷺ) যে সব দোয়া পড়তেন – QA Server
সালাতের পর রাসূল (ﷺ) যে সব দোয়া পড়তেন – QA Server

সালাতের পর রাসূল (ﷺ) যে সব দোয়া পড়তেন – Mediafire
সালাতের পর রাসূল (ﷺ) যে সব দোয়া পড়তেন – Mediafire

বইঃ লা তাহযান হতাশ হবেন না – ফ্রী ডাউনলোড

La-Tahzan

সংক্ষিপ্ত বর্ণনাঃ আমাদের চারপাশে নানান সমস্যা যা আমাদের খুব দ্রুত হতাশ করে ফেলে। আর এই হতাশা শয়তান কে মানুষের  উপর বিজয়ী হতে সাহায্য করে। এই বিষয়ের উপর শেইখ ড. আয়িদ আল ক্বরনীর লেখা বিশ্বব্যাপী প্রবল সাড়া জাগানো বই  লা তাহযান বা হতাশ হবেন না এর বাংলা সংস্করণটির পিডিএফ কপি আপনাদের জন্য প্রকাশ করা হলে। নিজে পড়ুন ও অন্যদের সাথে শেয়ার করুন।

লা তাহযান হতাশ হবেন না – QA Server
লা তাহযান হতাশ হবেন না – QA Server

লা তাহযান হতাশ হবেন না – Mediafire
লা তাহযান হতাশ হবেন না – Mediafire

৪৭ বৎসর বয়স্ক এক বসনিয়ান মুসলিম পায়ে হেঁটে হজ্জ করতে আসলেন

12

অনুবাদঃ কুরআনের আলো

 

৪৭ বৎসর বয়স্ক এক বসনিয়ান মুসলিম হজের উদ্দেশ্যে পায়ে হেঁটে সৌদি আরবে এসে পৌঁছালেন এই সপ্তাহে । প্রায় ৩,৬০০ মাইল দূরত্ব ( ৫,৯০০ কি.মি ) তার গ্রাম থেকে পায়ে হেঁটে ভ্রমণ করে আসলেন ।

তার দুর্বার আকাঙ্ক্ষা ছিলো হজ করার কিন্তু অর্থের অভাবে তা বাস্তবায়িত হচ্ছিলো না বললেন সেনাদ হাদযিক ।  তাই তিনি মনস্থ করলেন পায়ে হেঁটে সৌদি আরবে আসার। তিনি মাত্র ২০০ ইউরো নিয়ে যাত্রা শুরু করেন।

হজের অনুপ্রেরণা বুকে  বেঁধে  হাদযিক সুদীর্ঘ পথে প্রথম পা বাড়ালেন উত্তর বসনিয়ার বনাভিচি গ্রাম থেকে ২০১১ সালের ডিসেম্বর মাসে ।

তার ভ্রমণ যাত্রায় , তিনি ৩,৬০০ মাইল (৫,৯০০ কি। মি ) অতিক্রম করে  সুদূর বসনিয়ার একটি গ্রাম হতে পায়ে হেঁটে মাক্কাতে এসে পৌঁছাতে পারলেন ।

দৈনিক ১২ থেকে ২০ মাইল অতিক্রম করে হাদযিক তুর্কী , জর্ডান , সিরিয়া  সহ ছয়টি দেশ  পেরিয়ে এই সপ্তাহে সৌদি আরবে প্রবেশ করতে সক্ষম হলেন ।

হাদযিক জানালেন বহু সুহৃদ পরিবারের আতিথেয়তা  সহ তিনি রাত কাটিয়েছেন মসজিদ , মাদ্রাসা এবং অন্যান্য নানা স্থানে ।

“কেহ কেহ আমাকে জিজ্ঞাসা করেছেন আমি কি কখনো ভীত হয় নি দুর্গম পথ অতিক্রম করতে ?” আমি জবাবে বলেছি , ” আল্লাহ আমার সাথে আছেন …আমি কেনো ভয় পাব ?”

 সমগ্র বিশ্বের মুসলিম সমাবেশ ঘটে ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের একটি হজ আদায়ের উদ্দেশ্যে এই মক্কাতে । যা শুরু হচ্ছে ইনশাআল্লাহ এই ৮ ই যিলহজ  ২৪ অক্টোবর থেকে !

 

উৎস: The World

ইসলামের দৃষ্টিতে ঋণ লেন-দেন

gold-dinar-silver-dirham

লেখকঃ  আব্দুর রাকীব মাদানী

আলহামদু লিল্লাহ, ওয়াস্ সালাতু ওয়াস্ সালামু আলা রাসূলিল্লাহ, আম্মাবাদ,

সুপ্রিয় পাঠক!  ঋণ-কর্জ মানুষের তথা সমাজের একটি প্রয়োজনীয় লেনদেন। সমাজে বসবাসকারী প্রত্যেক ব্যক্তি জিবন-যাপন করার ক্ষেত্রে কোনো না কোনো সময় ঋণ নেওয়ার কিংবা অন্যকে দেওয়ার সম্মুখীন  হতে হয়। তবে এই মানবীয় সুন্দর নিয়ম এবং অপরকে সহযোগিতা করার এই ইসলামী সুপ্রথাও অনেক সময় কুমতলবীর চক্রান্তে ও মায়াজালে ফেঁসে বিদ্বেষ, ঝগড়া-ঝাঁটি এমনকি বড় রকমের শত্রুতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আর অনেকে তো এই ঋণ প্রথাকেই পুঁজি জমা করার উপায় হিসেবে ব্যবহার করে বিশ্বে পুঁজিপতি হয়েছে ও হচ্ছে। আর দরিদ্র সম্প্রদায় তাদের মুখাপেক্ষী হওয়ার কারণে ঋণের জাঁতায় পিষ্ট হচ্ছে। আমরা এই প্রবন্ধে ইসলামে ঋণের বিধি-বিধান সম্পর্কে কিছুটা জানার চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ। যেন ঋণের সঠিক বিধান জানতে পারি এবং বেঠিক বিধান হতে নিরাপদে থাকতে পারি। ওয়ামা তাওফীকী ইল্লা বিল্লাহ।

ঋণের অর্থঃ ঋণের আরবী শব্দ ‘কায্র্’, যা প্রচলিত বাংলা ভাষায় কর্জ নামে পরিচিত।  এর বাংলা সমার্থবোধক শব্দ হচ্ছে, দেনা, ধার, হাওলাদ ইত্যাদি।

শরীয়তের পরিভাষায় ঋণঃ মাল-পণ্য অপরকে প্রদান করা, যেন তার মাধ্যমে সে উপকৃত হয়, অতঃপর দাতাকে সেই মাল কিংবা তার অনুরূপ ফেরত দেওয়া। [ফিক্হ বিশ্বকোষ, খন্ড ৩৩, পৃঃ১১১]

ঋণের বৈধতাঃ ঋণ প্রথা বৈধ, যা সুন্নত এবং ইজমা (ঐক্যমত) দ্বারা প্রমাণিত। [মুগনী, ইবনু কুদামাহ,৬/৪২৯]

নবী (সাঃ) একদা এক উষ্ট্রী ধার নেন এবং ফেরত দেওয়ার সময় সেই সমগুণের উষ্ট্রী না পাওয়ায় তার থেকে উত্তম গুণের পুরুষ উট ফেরত দেন এবং বলেনঃ “তোমাদের মধ্যে উত্তম ব্যক্তি সে, যে উত্তম ঋণ পরিশোধকারী।’’ [বুখারী ,অধ্যায়,ইস্তিকরায, নং২৩৯০]

ঋণ যোগ্য জিনিসাদিঃ অর্থাৎ কি কি জিনিস ঋণের অন্তর্ভুক্ত, যা ঋণ হিসাবে আদান-প্রদান করা যেতে পারে? এ বিষয়ে ফুকাহাদের মতভেদ বিদ্যমান। তবে নির্ভরযোগ্য মত হচ্ছে, প্রত্যেক এমন বস্তু যা বিক্রয় করা বৈধ, তা ঋণ দেওয়াও বৈধ। [যাদুল্ মুস্তাক্বনা’, হিজাভী/২১২]

ঋণ প্রদানের ফযীলতঃ ঋণ প্রদান একটি নেকির কাজ, যার মাধ্যমে বান্দা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করে।  এর মাধ্যমে লোকের সাহায্য করা হয়, তাদের প্রতি দয়া করা হয় এবং অনেক ক্ষেত্রে তাদের সমস্যা হ্রাস করা হয় কিংবা সমাধান করা হয়।

নবী (সাঃ) বলেনঃ ‘‘যে ব্যক্তি কোনো মুসলিম ব্যক্তির দুনিয়াবী বিপদ দূর করবে, আল্লাহ তাআলা তার আখেরাতের বিপদ দূর করবেন। আর যে ব্যক্তি কোনো অভাবীর কষ্ট সহজ করবে, আল্লাহ তার দুনিয়া ও আখেরাতে সহজ করবেন। আল্লাহ বান্দার সাহায্য করেন যতক্ষণে বান্দা তার ভাইয়ের সাহায্য করে।” [মুসলিম,অধ্যায়ঃ যিকর, দুআ,তাওবাহ ও ইস্তিগফার]

নবী (সাঃ) আরো বলেনঃ ‘‘যে কেউ কোনো মুসলিমকে দুই বার ঋণ দেয়, তা সেই অনুযায়ী এক বার সাদাকা করার মত।’’ [ইবনু মাজাহ, সূত্র হাসান,ইরওয়াউল গালীল নং১৩৮৯]

ঋণ লেন-দেনে মেয়াদ নির্ধারণঃ বিষয়টির ব্যাখ্যা হচ্ছে, ঋণ দাতা এবং ঋণ গ্রহীতা লেন-দেনের সময় একটি নির্দিষ্ট মেয়াদ নির্ধারণ করতে পারে কি পারে না? সঠিক মত হচ্ছে, মেয়াদ নির্ধারিত করতে পারে এবং প্রয়োজনে মেয়াদ বৃদ্ধিও করতে পারে। কারণ

আল্লাহ তাআলা বলেনঃ “হে বিশ্বাসীগণ! যখন তোমরা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ধারে কারবার করবে, তখন তা লিখে রাখবে।” [সূরা বাকারাহ – ২৮২]

অতঃপর মেয়াদ নির্ধারিত থাকলে ঋণদাতা নির্ধারিত সময়ের পূর্বে ঋণ গ্রহীতার নিকট থেকে ঋণ ফেরত নেওয়ার দাবী করতে পারে না। বরং সে নির্ধারিত মেয়াদ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বাধ্য। কারণ নবী (সাঃ) বলেনঃ ‘‘মুসলিমগণ শর্ত পূরণে বদ্ধপরিকর।[আহমদ,আবু দাউদ,তিরমিযী]

ঋণের মাধ্যমে লাভ অর্জনঃ ইসলামে ঋণের উদ্দেশ্য হচ্ছে, মানুষকে সাহায্য করা, তাদের প্রতি দয়া করা তথা তাদের জীবন-যাপনে সহযোগিতা করা,সহযোগিতার আড়ালে সুবিধা অর্জন নয়। তাই বলা হয়েছে, ঋণের উদ্দেশ্য হবে আধ্যাত্বিক বৃদ্ধি বাহ্যিক বৃদ্ধি নয়। আর তা হচ্ছে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। এই কারণে ঋণ গ্রহীতা ঋণ ফেরত দেয়ার সময় যা নিয়েছে তা কিংবা সেই অনুরূপ ফেরত দিতে আদিষ্ট, অতিরিক্ত নয়। ঋণ দাতা এর অতিরিক্ত নিলে কিংবা ঋণ গ্রহীতা অতিরিক্ত ফেরত দিলে, তা সুদ হিসাবে গণ্য হবে। কারণ ফিক্হী মূলণীতিতে উল্লেখ হয়েছে, ‘কুল্লু কার্যিন র্জারা নাফ্আন ফাহুআ রিবা।’  অর্থাৎ প্রত্যেক ঋণ, যার মাধ্যমে লাভ উপার্জিত হয়, তা সুদ।

প্রকাশ থাকে যে, উপরোল্লেখিত ফিকহী মূলণীতিটি হাদীস হিসাবে যয়ীফ (দুর্বল)। দেখুন, ইরওয়াউল গলীল,আলবানী, নং ১৩৯৮। তবে কায়েদা ফিকহিয়্যাহ (ফিকহী মূলণীতি)  হিসাবে স্বীকৃত।

ঋণের মাধ্যমে লাভের উদাহরণঃ

ক) কাউকে এক হাজার টাকা ধার দেওয়া এবং ফেরত নেওয়ার সময় বেশী নেওয়া। এটা স্পষ্ট।
খ) কোনো দায়িত্বশীল ব্যক্তিকে ঋণ দেওয়া এই উদ্দেশ্যে বা এই শর্তে যে, ঋণ গ্রহীতা ঋণ দাতার কিংবা তার পরিবারের কাউকে চাকরি দিবে বা দেওয়ার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করবে।
গ) কাউকে ঋণ দেওয়া এই উদ্দেশ্যে যে, সে তাকে ঘর বা দোকান ভাড়া দিবে কিংবা এ ধরনের  অন্য কিছু, যা সমাজের অনেকাংশে প্রচলিত

ইসলামে উত্তম ঋণ পরিশোধ ব্যবস্থা এবং বর্তমান ব্যাংকিং প্রথা, একটি সংশয় নিরসনঃ ইসলাম ঋণ দেওয়াকে  যেমন লোকের সাহায্য তথা তাদের কষ্ট দূরীকরণ হিসাবে স্বীকার করে, তেমন ঋণ পরিশোধে উত্তম দৃষ্টান্ত পেশ করে। তাই ঋণ গ্রহীতা ঋণ ফেরত দেয়ার সময় বেশি বা উত্তম  ফেরত দিতে পারে, যাকে শরীয়তের পরিভাষায় ‘হুসনুল্ কাযা’ বা উত্তম পরিশোধ বলা হয়। অর্থ, আবু রাফে হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ “একদা নবী (সাঃ) এক ব্যক্তি হতে একটি উষ্ট্রী ধার নেন। তার পর সাদাকার উট আসলে আবু রাফেকে আদেশ দেওয়া হয়, সে যেন সেই ব্যক্তির উট ফেরত দেয়। আবু রাফে (রাযিঃ)  ফিরে এসে বলেঃ  [সেই সমগুণের উট নেই বরং তার থেকে উত্তম] রুবায়ী মুখতার [এমন পুরুষ উট যা ছয় বছর বয়স অতিক্রম করে সপ্তম বছরে প্রবেশ করেছে এমন] উট আছে। নবী (সাঃ) বলেনঃ তাই দিয়ে দাও; কারণ ভাল মানুষ তারা যারা উত্তম পরিশোধকারী।” [মুসলিম, অধ্যায়ঃ বয়ূ, নং ৪১০৮]

অনেকে ইসলামের এই সুন্দর বিধান না বুঝতে পেরে, কিংবা না বোঝার ভান করে, কিংবা অপরিপক্ক জ্ঞানের কারণে কিংবা অন্তরে প্রবৃত্তির রোগ থাকার কারণে, বিষয়টিকে বর্তমান ব্যাংকিং প্রথায় অতিরিক্ত প্রদান করা ও অতিরিক্ত গ্রহণ করা বৈধ বলে ফতুয়া দিয়েছে। তাদের মন্তব্য, নবী (সাঃ) যেমন ঋণ ফেরত দেওয়ার সময় বেশী দিলেন এবং ঋণ দাতা বেশী গ্রহণ করলেন, তেমন আমরা ব্যাংকে ঋণ ফেরত দেওয়ার সময় যদি বেশী দেই এবং তারা সেটা গ্রহণ করে তো অবৈধতার কিছু নেই।
উত্তরে বলবো, নবী (সাঃ) এর ঋণ ফেরতে বেশি দেওয়া এবং বর্তমান যুগের ব্যাংকিং প্রথায় বেশী লেন-দেনের প্রথার মধ্যে বিরাট পার্থক্য বিদ্যমান।

প্রথমতঃ নবী (সাঃ) কে ঋণ দাতা ঋণ প্রদানের সময় কোনো শর্ত দেয়নি যে, ঋণ ফেরত কালে বেশী ফেরত দিতে হবে। অন্যদিকে বর্তমান ব্যাংক সুক্ষ্ম হিসাবের মাধ্যমে বেশী দেওয়ার শতকরা হার নির্ধারণ করে দেয় এবং নির্ধারিত সময়ে তা ফেরত না দিতে পারলে শতকরা হার আরোও বৃদ্ধি পায়। আসলে ব্যাংক এই চক্রের মাধ্যমেই অর্থায়ন করে থাকে, আর আমরা বুঝেও বুঝি না।

দ্বিতীয়তঃ সমাজে এটা পরিচিত ছিল না যে,নবী (সাঃ) কে ঋণ দিলে তিনি অতিরিক্ত ফেরত দেন। বরং তিনি হঠাতই এই রকম আদেশ দেন। এই কারণে ইসলামী পন্ডিতগণের ঐক্যমত রয়েছে যে, যে কোনো ঋণে যদি বেশি ফেরতের শর্ত থাকে, তাহলে সেটা হারাম।

ইবনুল মুনযির বলেনঃ ‘তাদের ঐক্যমত রয়েছে যে, ঋণ দাতা যদি ঋণ গ্রহীতাকে ঋণ ফেরতের সময় বেশী দেওয়া কিংবা হাদিয়া সহ ঋণ ফেরত দেওয়ার শর্ত দেয় এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে ঋণ দেওয়া হয়, তাহলে বেশি নেওয়াটা সুদ।’ [মুগনী,৬/৪৩৬]  তাই ঋণ ফেরতের সময় বেশি গ্রহণ বৈধ নয়, যতক্ষণে দুটি শর্ত না পাওয়া যায়।

ক) ঋণ দাতা ঋণ গ্রহীতার সাথে লাভ নেওয়ার শর্ত দেয় নি।
খ) সমাজে বেশি দেওয়ার প্রথা প্রচলিত ও নয়।

যদি শর্ত দেওয়া হয় কিংবা এটা সমাজে প্রচলিত থাকে, তাহলে বেশি নেওয়া সুদ হবে। এখানে প্রচলিত শব্দটির উল্লেখ এই কারণে করা হচ্ছে যে, শারয়ী মূলণীতিতে প্রচলিত প্রথা শর্তর মতই। অর্থাৎ শর্তারোপ তো করে না কিন্তু প্রথা ও প্রচলন অনুযায়ী বেশি নেয় বা দেয়, তাহলে সেটা শর্ত হিসাবেই গণ্য হবে।

ঋণ পরিশোধে বিলম্ব না করাঃ ঋণ দাতা যখন মানুষের উপকার্থে ঋণ প্রদান করে, তখন ঋণ গ্রহীতার দ্বীনী ও নৈতিক দায়িত্ব হবে তা যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি ফিরিয়ে দেওয়া। যদি এইরকম না করে টাল-বাহানা শুরু করে, মিথ্যা ওজর পেশ করতে লাগে, তাহলেই আপসে মিল-মুহব্বত ও ভ্রাতৃত্ব নষ্ট হয়, শত্রুতা বৃদ্ধি পায় এবং একে অপরের প্রতি বিশ্বাস যোগ্যতা হারায়। মহান আল্লাহ বলেনঃ “উত্তম কাজের প্রতিদান উত্তম পুরস্কার ছাড়া আর কি হতে পারে?” [সূরা আর রাহমান – ৬০]

তিনি অন্যত্রে বলেনঃ “নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের নির্দেশ দিচ্ছেন, হকদারদের হক তাদের নিকট পৌঁছে দিতে।” [সূরা নিসা – ৫৮]
নবী (সাঃ) বলেনঃ “ধনী ব্যক্তির টাল-বাহানা করা অত্যাচার।” [মুত্তাফাকুন আলাইহ]
তিনি (সাঃ) আরো বলেনঃ ‘‘যে ব্যক্তি মৃত্যু বরণ করল এমতাবস্থায় যে, সে তিনটি স্বভাব থেকে মুক্ত ছিল, তাহলে সে জান্নাতে প্রবেশ করবেঃ অহংকার, গনীমতের সম্পদ হতে চুরি এবং ঋণ।” [ইবনু মাজাহ, আলবানী (রহঃ) সহীহ বলেছেন]

ঋণ পরিশোধের পূর্বে মৃত্যুবরণঃ ঋণ মানুষের হক-পাওনা, তা পূরণের পূর্বে মৃত্যুবরণ করা মানে মানুষের হক নিজ স্কন্ধে থেকে যাওয়া, যা বড় অপরাধ। সেই কারণে এই প্রকার ব্যক্তির জানাযার নামায নবী (সাঃ) নিজে পড়েন নি। ইমাম তিরমিযী হাসান-সহীহ সনদে আবু ক্বাতাদাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত করেন, “নবী (সাঃ) এর কাছে একদা এক ব্যক্তির জানাযা নিয়ে আসা হলে, তিনি (সাঃ) বলেনঃ ‘‘তোমরা তোমাদের সাথীর জানাযা পড়; কারণ সে ঋণী।’’ [তিরমিযী, অধ্যায়ঃ জানাযা, নং১০৬৯]

এই কারণে ইসলামী পন্ডিতগণ বলেন, “মাইয়্যেতের তারেকাহ (উত্তরাধিকার) বন্টণের পূর্বে কয়েকটি হক নির্ধারিত, তা পূরণের পরেই তার উত্তরাধিকার বন্টিত হবে। তন্মধ্যে মাইয়্যেতের উপর অপরের হক সমূহ অন্যতম। সেই হক আল্লাহর হোক, যেমন যাকাত কিংবা মানুষের হক হোক, যেমন ঋণ।” [আল্ মুলাখ্খাস আল্ ফিক্হী, ড. ফাউযান/৩৩৪]

অভাবী ঋণীকে অবকাশ প্রদানঃ সমাজে যেমন কিছু লোক পাওয়া যায়, যারা সক্ষম হওয়া সত্ত্বেও ঋণ শোধ করতে ঢিলেমি করে, তেমন সত্যিকারে এমন লোকও রয়েছে যারা নির্ধারিত সময়ে ঋণ পরিশোধ করতে অক্ষম। এই রকম ব্যক্তিকে ইসলাম অতিরিক্ত সময় দিতে উদ্বুদ্ধ করে। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ “যদি ঋণী দরিদ্র হয়, তবে স্বচ্ছল অবস্থা আসা পর্যন্ত অবকাশ দিবে আর মাফ করে দেয়া তোমাদের পক্ষে অতি উত্তম, যদি তোমরা জানতে!” [সূরা বাক্বারাহ – ২৮০]

নবী (সাঃ) বলেনঃ ‘‘যে ব্যক্তি পছন্দ করে যে, আল্লাহ তাকে কিয়ামত দিবসের কষ্ট থেকে নিষ্কিৃতি দিবে, সে যেন অভাবী ঋনীকে অবকাশ দেয় কিংবা তার ঋণের বোঝা লাঘব করে।” [মুসলিম, অধ্যায়, ক্রয়-বিক্রয়, নং ৪০০০]

এখানে একটি বিষয় বর্ণনা করা জরূরী মনে করছি, তা হল, “ঋণ গ্রহীতা যদি নির্ধারিত সময়ে ঋণ ফেরত দিতে না পারে, তাহলে তাকে অবকাশ দিতে হবে বিনা লাভের শর্তে। কিন্তু যদি ঋণ দাতা তার মেয়াদ বাড়িয়ে দেয় এবং এর বিনিময়ে লাভ নেয় তাহলে তা স্পষ্ট সুদ হবে। যেমন কেউ এক বছর পর তার ঋণ ফিরিয়ে দিতে চেয়েছিল কিন্তু বছর শেষ হলে সে ফেরত না দিতে পারায় ঋণ দাতার নিকট আরো ৫ মাস সময় বাড়িয়ে দেয়ার আবেদন করলো। অতঃপর ঋণ দাতা তাকে বললোঃ ঠিক আছে মেয়াদ বাড়াবো কিন্তু এর বিনিময়ে তোমাকে ঋণ ফেরতের সময় মূল ধনের বেশি দিতে হবে। অর্থাৎ সময় বৃদ্ধির বিনিময়ে লাভ গ্রহণ। এটা স্পষ্ট সুদ, যা নবী (সাঃ) এর যুগে আরবের জনপদে  ছিল এবং তা এখনও বিদ্যমান।” [আল্ মুলাখ্খাস আল ফিকহী, ড.ফাউযান /২৩৭]

ঋণ পরিশোধ না করার উদ্দেশ্যে ঋণ গ্রহণঃ আজ-কাল সমাজে আর এক প্রকার লোক দেখা যায়, যারা ঋণ নেয় পরিশোধ না করার উদ্দেশ্যে। অর্থাৎ আসলে তার অন্তরে থাকে অন্যের অর্থ কৌশলে আত্মসাত করা। আর ঋণ করাটা হচ্ছে তার একটি বাহানা মাত্র। এই রকম লোকেরা এক সাথে কয়েকটি হারাম কাজে লিপ্ত হয়।

১)বাতিল পদ্ধতিতে অন্যের মাল-সম্পদ ভক্ষণ, যা আল্লাহ নিষেধ করেছেন।” [বাক্বারাহ/১৮৮]
২) ধোকা তথা প্রতারণা।
৩) জেনে বুঝে সজ্ঞানে গুনাহ করা।
৪) মিথ্যা বলা।

নবী (সাঃ) বলেনঃ ‘‘যে ব্যক্তি অন্যের মাল পরিশোধ করার উদ্দেশ্যে নেয়, আল্লাহ তাআলা তার পক্ষ হতে পরিশোধ করে দেন। (পরিশোধ করতে সাহায্য করেন) আর যে ব্যক্তি তা নষ্ট করার উদ্দেশ্যে নেয়, আল্লাহ তা নষ্ট করে দেন।” [বুখারী, অধ্যায়ঃ ইস্তিকরায, নং২৩৮৭]

তাদের এই রকম জঘন্য কাজ থেকে বিরত থাকা উচিৎ। কারণ মানুষের এই হক পৃথিবীতে আদায় না করা হলেও  আখেরাতে আল্লাহর দরবারে তা অবশ্যই আদায় করতে হবে। বরং আল্লাহ তা নিজে আদায় করে দিবেন।

ঋণের যাকাতঃ অর্থাৎ কেউ কাউকে ঋণ দিলে এবং সেই ঋণ যাকাতের আওতায় পড়লে, যাকাত কাকে দিতে হবে? ঋণ গ্রহীতাকে যার কাছে সেই মাল আছে? না ঋণ দাতাকে? আসলে সেই অর্থ, দাতার নিকট থেকে গ্রহীতার কাছে স্থানান্তর হয়েছে মাত্র। নচেৎ প্রকৃতপক্ষে তার মালিক দাতাই। সেই কারণে ঋণ দাতাকেই সেই মালের যাকাত দিতে হবে। তবে ইসলামী গবেষকদের নিকট বিষয়টির একটু ব্যাখ্যা রয়েছে, তা হলঃ ঋণ গ্রহীতা যদি অভাবী হয়, যার কারণে সে সঠিক সময়ে ঋণ ফেরত দিতে অক্ষম কিংবা সক্ষম তবে টাল-বাহানাকারী , যার থেকে ঋণ আদায় করা কষ্টকর। এই ক্ষেত্রে ঋণ দাতার প্রতি সেই মালের যাকাত দেওয়া জরূরী নয়, যতক্ষণে তা তার হাতে না আসে। আর যদি ঋনী ব্যক্তি ঋণ পরিশোধে সক্ষম হয় তথা সেই ঋণ পাওয়ার পুরো সম্ভাবনা থাকে, তাহলে যাকাতের সময় হলেই ঋণ দাতাকে তার যাকাত আদায় করতে হবে। [ফতোয়া ও গবেষণা বিষয়ক স্থায়ী কমিটি, ৯/১৯১, ফতোয়া নং ৯০৬৯]

তবে টাল-বাহানাকারীর কাছ থেকে কয়েক বছর পর ঋণ পাওয়া গেলে বিগত সব বছরের যাকাত দিতে হবে না এক বছরের দিলেই হবে? এ ক্ষেত্রে উপরোক্ত ফাতাওয়া কমিটি এক বছরের দিলেই হবে বলে ফাতওয়া দিয়েছেন। [ ফাতাওয়া ও গবেষণা বিষয়ক স্থায়ী ফাতাওয়া কমিটি,৯/১৯০]

ঋণ হতে আশ্রয় প্রার্থনা এবং ঋণ পরিশোধের দুআঃ নবী (সাঃ) ঋণ হতে আল্লাহর নিকট বেশি বেশি আশ্রয় প্রার্থনা করতেন, যা দেখে এক ব্যক্তি তাঁকে জিজ্ঞাসা করেনঃ আল্লাহর রাসূল!  আপনি ঋণ থেকে খুব বেশি বেশি আশ্রয় প্রার্থনা করেন? নবী (সাঃ) বলেনঃ “মানুষ ঋণী হলে, যখন কথা বলে, মিথ্যা বলে এবং অঙ্গীকার করলে অঙ্গীকার ভঙ্গ করে।” [বুখারী, অধ্যায়ঃ ইস্তিকরায, নং ২৩৯৭]

তাই তিনি (সাঃ) বলতেনঃ উচ্চারণঃ “আল্লাহুম্মা! ইন্নী আউযুবিকা মিনাল্ কাসালি, ওয়াল্ হারামি, ওয়াল্ মা’ছামি, ওয়াল্ মাগ্রাম॥” অনুবাদঃ ‘‘হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছে আশ্রয় কামনা করছি অলসতা, অধিক বার্ধক্য, গুনাহ এবং ঋণ হতে।” [মুসলিম, অধ্যায়ঃ যিকর ও দুআ, নং৬৮৭১]

তিনি (সাঃ) আরো বলতেনঃ উচ্চারণঃ “আল্লাহহুম্মা ইন্নী আউযুবিকা মিনাল্ হাম্মি ওয়াল্ হাযানি, ওয়াল্ আজ্যি ওয়াল্ কাসালি, ওয়াল্ বুখ্লি ওয়াল্ জুব্নি, ওয়া যালাইদ্দাইনি ওয়া গালাবাতির রিজাল।” অর্থ, ‘হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি, চিন্তা-ভাবনা, অপারগতা,অলসতা, কৃপণতা এবং কাপুরুষতা থেকে। অধিক ঋণ থেকে এবং দুষ্ট লোকের প্রাধান্য থেকে।’ [নাসাঈ, অধ্যায়ঃ ইস্তিআযাহ, নং ৫৪৭৮]

গুনাহের দরজাসমূহ (পর্ব ২)

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম

লিখেছেনঃ আব্দুল্লাহ শহীদ আব্দুর রহমান । ওয়েব সম্পাদনাঃ মোঃ মাহমুদ -ই- গাফফার

 পর্ব ১ । পর্ব ২

তৃতীয়ত:

মেধার চিন্তা ও কল্পনা সমূহ: চিন্তা ও কল্পনা বিষয়ক অধ্যায়টি বিশেষ গুরুত্ববহ। কেননা মানুষের কথা, কাজ ও আচরণ সমূহে এর শক্তিশালী প্রভাব রয়েছে। কারণ, চিন্তাই হল ভাল মন্দের উৎস। এবং চিন্তা থেকেই নানা ইচ্ছা, প্রেরণা ও সংকল্পের সৃষ্টি হয়। অতএব সে তার কল্পনা শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করবে সে তার প্রবৃত্তির লাগাম এর নিয়ন্ত্রক হবে এবং সে প্রবৃত্তর ওপর বিজয় লাভ করবে। পক্ষান্তরে যার কল্পনা তাকে পরাজিত করবে তার প্রবৃত্তি মন তার ওপর বিজয়ী হবে। আর সে কল্পনাকে লঘু দৃষ্টিতে দেখবে তাকে ধ্বংসের প্রান্তসীমায় নিয়ে যাবে। এবং এই কল্পনা মনের মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকবে যাবৎ না তার নিরর্থক হিসেবে সাব্যস্ত হবে। আর কল্যাণময় কল্পনা যা মানুষের উপকারে আসে তা হচ্ছে, পার্থিব বা অপার্থিব কল্যাণ অর্জনের উদ্দেশে যা নিবেদিত অথবা কোন ইহলৌকিক বা পারলৌকিক অনিষ্ট দূর করার উদ্দেশে যা নির্দিষ্ট।

আর সর্বাধিক উপকারী হল যা আল্লাহ ও পরকাল-এর উদ্দেশে হয়ে থাকে যেমন পবিত্র কোরআনের আয়াতের অর্থসমূহ গভীর চিন্তা ভাবনা করা এবং তা দ্বারা আল্লাহর উদ্দেশ্য উপলব্ধি করা। এবং আমাদের সামনে উপস্থিত জাগতিক নিদর্শন সমূহে ধ্যান-মগ্ন হওয়া এবং তা দ্বারা আল্লাহর নাম, গুন ও প্রজ্ঞার ওপর প্রমাণ উপস্থাপন করা। এমন ভাবে আল্লাহর নেয়ামত অনুগ্রহ ও দান সমূহ সম্পর্কে চিন্তা ভাবনা করা। প্রবৃত্তির দোষ ত্র“টি ও সমস্যা সমূহ নিয়ে চিন্তা ভাবনা করা। সময়ের দায়িত্ব প্রয়োজন সম্পর্কে চিন্তা মগ্ন হওয়া। এই মোট ৫ প্রকার। পূর্ণতা হল হৃদয়কে কল্পনা শক্তি, চিন্তা-ভাবনা ও প্রভুর সন্তুষ্টি অর্জনের চিন্তায় নিমগ্ন ও পরিপূর্ণ রাখা। এবং তার পথ ও গন্তব্য সম্পর্কে চিন্তা করা। সবচে’ পূর্ণতম মানুষ সে যে কল্পনা, চিন্তা ও ইচ্ছায় এর বাস্তবায়নে অধিক মনোযোগী। পক্ষান্তরে সবচে’ অসম্পূর্ণ মানুষ সে যে কল্পনা, চিন্তা ও ইচ্ছায় তার প্রবৃত্তির অধিক অনুগামী। আর কেউ তো অধিক এমন বিষয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে যা পুরো পুরি অর্থহীন, ফলে তার ইচ্ছাশক্তি প্রকৃত অর্থবহ কাজ থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকে। অত:পর তার ইহকাল ও পরকাল উভয়ই নষ্ট হয়ে যায়। অতএব, অর্থহীন কল্পনা ও চিন্তা-ভাবনা এবং কাল্পনিক ও সুদূর পরাহত বিষয়ের চিন্তা কী উপকারে আসবে?

নি:সন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য হচ্ছে, মেধাকে নিয়ন্ত্রণ করা। এবং তাকে কল্পনা ও প্রশস্ত চিন্তায় নির্ভিঘ্নে খোরাখুরির সুযোগ না দেওয়া, যা তাকে পার্থিব উপকরণ তার বিভিন্ন শাখা-প্রশাখায় পরিভ্রমণ করাবে। আর তাকে এক বস্তু থেকে আরেক বস্তুর দিকে স্থানান্তর করবে। তবে তা তাকে প্রয়োজনীয় কোন স্থানে অবস্থান করাবে না। আর বিক্ষিপ্ত, অবিন্যস্ত চিন্তা-ভাবনার সুসংহত চিন্তা-ভাবনা মানুষের অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বস্তু। এবং জাতিকে উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাক্সিক্ষত গন্তব্য।

গন্তব্যে পৌঁছার উপায় কী?

এই বিষয়ে আমরা অন্তরের দুর্বলতা ও রোগ সম্পর্কে বিশেষজ্ঞের অভিজ্ঞতার শরণাপন্ন হওয়ার অধিক প্রয়োজনীয়তা অনুভব করি। যে রোগ শনাক্ত করবে ও তার কারণ গুলো বিশে¬ষণ করবে এবং চিকিৎসা ব্যবস্থার ব্যাখ্যা দেবে। একটি নাতি দীর্ঘ বক্তব্যের মাধ্যমে বিষয়টি সুস্পষ্ট করা হচ্ছে ‘ জেনে রাখো ওয়াসওয়াসা ও প্ররোচনার সাথে সংশি¬ষ্ট বিষয়গুলো চিন্তা-ভাবনা কে পর্যন্ত আক্রান্ত করে। আর চিন্তা Ñভাবনা এ গুলোকে স্মরণের বিষয়ে পরিণত করে। তার পর স্মরণ এ গুলোকে ইচ্ছা পর্যন্ত পৌঁছে দেয়, ইচ্ছা তাকে বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও কাজে বাস্তবায়ন করে। অত:পর তা মজবুত হয়ে স্বভাব, অভ্যাসে পরিণত হয়। তাই এগুলোকে শুরু থেকেই মূলোৎপাটন করা অধিকতর সহজ তা দৃঢ় ও পূর্ণতা লাভ করার পর বিচ্ছিন্ন করার তুলনায়।

আর এটা জানা বিষয় যে, মানুষকে কল্পনা শক্তি মৃত বানিয়ে ফেলা এবং তা নির্মূল করার শক্তি দেওয়া হয়নি। প্রবৃত্তির বিভিন্ন উপসর্গ তার কাছে ভিড় করবেই। কিন্তু ইমানের শক্তি ও জ্ঞান তাকে সর্বোত্তম জিনিস গ্রহণ ও তার প্রতি সন্তুষ্টি এবং তা ধারণ করার ক্ষেত্রে সহায়ক হবে। আর সবচে’ মন্দ বিষয়কে প্রতিরোধ ও তার প্রতি ঘৃণা ও অসন্তুষ্টি প্রকাশে সহায়তা করবে। যেমন সাহাবারা বলতেন—হে আল্লাহর রাসূল, আমাদের কেউ তার মনের ভেতর এমনি কিছুর উপস্থিতি পায় যদি তা দাহ্য বস্তু হত তা কয়লায় পরিণত হয়ে যেত। তিনি বললেন, তোমরা কি এমন কিছুর উপলব্ধি করেছ? তারা বললেন, জি হ্যাঁ। তিনি বললেন, এটাই হচ্ছে সুস্পষ্ট ইমান। অন্য ভাষায়, সমস্ত প্রশংসা ওই আল্লাহর যিনি কুমন্ত্রণার দিকে তার কৌশলকে বানচাল করে দিয়েছেন।এ বিষয়ে দুটি বক্তব্য পাওয়া যায়।

একটি হচ্ছে: তা প্রত্যাখ্যান ও অপছন্দ করা ইমানের সুস্পষ্ট পরিচায়ক।
দ্বিতীয় হচ্ছে: তার মনে শয়তান-এর উপস্থিতি ও প্ররোচনা দেয়া সুস্পষ্ট ইমান। কেননা ইমানের সঙ্গে বৈপরীত্য সৃষ্টি ও তার দ্বারা মানকে নির্বাসিত করার ইচ্ছায় শয়তান এমনটি করে থাকে।

মহান আল্লাহ মানুষরে মনকে সর্বদা ঘুর্নায়মান বা তার সাদৃশ্য করে সৃষ্টি করেছেন। তাই তার এমন এক বস্তু দরকার যা সে বিচূর্ণ করবে। যদি তার মধ্যে কোন দানা রাখা হয় তবে তাকেই চূর্ণ করবে। আর যদি তার মধ্যে মাটি বা পাথর রাখা হয় তবে তাকেও বিচূর্ণ করবে। অতএব, মনের ভিতরে আন্দোলিত সমস্ত কল্পনা ও চিন্তাশক্তি জাঁতায় রক্ষিত দানা তুল্য। আর জাঁতা কখন ও কর্মহীন, নির্বিকার বসে থাকে না। তাই তার মধ্যে কিছু রাখতেই হবে। মানুষের মধ্যে কারও জাঁতা এমন যে নিজেও উপকৃত হয় এবং অন্যকেও উপকার পৌঁছায়। আর অধিকাংশ মানুষ তারা বালি, পাথর ও তৃন বিচূর্ণ করে। তারপর যখন খামির ও রুটি তৈরির সময় আসে তখনই চূর্ণ করার পরিচয় বেরিয়ে পড়ে।

আর এটাও জানা বিষয় যে, কল্পনার সংশোধন চিন্তার সংশোধনের তুলনায় অধিক সহজ। আর চিন্তার পরিশুদ্ধি ইচ্ছার পরিশুদ্ধির তুলনায় সহজ। এবং ইচ্ছার সংশোধন বিনষ্ট কর্মের প্রতিবিধানের তুলনায় সহজ। আর তার প্রতিবিধান —- তাই সবচে’ উপকারী চিকিৎসা হচ্ছে, তুমি নিজেকে অর্থহীন ভাবনায় না জড়িয়ে অর্থপূর্ণ কাজে ব্যস্ত রাখবে। অর্থহীন বিষয় চিন্তা-ভাবনা সব অনিষ্টের প্রবেশ পথ। আর যে নিরর্থক ভাবনায় জড়িয়ে পড়ে তার অর্থবহ কাজগুলো ছেড়ে অধিক লাভ জনক কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখবে। আর চিন্তা, কল্পনা, ইচ্ছা ও প্রেরণা শক্তিকে পরিশুদ্ধ করা অধিক বাঞ্ছনীয়। কেননা, এগুলোই হচ্ছে তোমার বৈশিষ্ট্য ও স্বরূপ যা দ্বারা তুমি আপন প্রভুর নৈকট্য বা বৈরাগ্য লাভ কর। অথচ তোমার প্রভুর নৈকট্য লাভ ও তার তোমার প্রতি সন্তুষ্টিই হচ্ছে সৌভাগ্যের সোপান। আর তার থেকে তোমার দূরত্ব ও তোমার প্রতি তার অসন্তুষ্টি হচ্ছে পূর্ণ অমঙ্গল। আর যার কল্পনাও চিন্তার সীমানায় দুর্বুদ্ধি ও মন্দ ভাবনার স্থান পায় তার সমস্ত কাজেই এর প্রভাব থাকে।

তোমার চিন্তা ও ইচ্ছা শক্তির পরিমণ্ডলে শয়তানকে স্থান দেয়া থেকে বিরত থাকবে। কেননা সে চিন্তাকে এমন ভাবে বিনষ্ট করে যার ক্ষতিপূরণ অনেক কঠিন হয়ে পড়বে। এবং সে তোমাকে ক্ষতিকর চিন্তা ও প্ররোচনায় নিক্ষেপ করবে। এবং সে তোমার ও তোমার মঙ্গলজনক চিন্তার মাঝে দেয়াল তৈরি করবে। অথচ তুমিই তাকে তোমার বিরুদ্ধে সহযোগিতা করেছ। তাকে তোমার হৃদয় ও কল্পনার মালিকানার আসনে বসিয়েছ সে এগুলোর মালিক বনে গেছে। এসব গুলির সমন্বিত সংশোধনের উপায় হচ্ছে, আপনার চিন্তাকে জ্ঞান ও ভাবনায় নিমগ্ন রাখা, যথা, তওহিদ ও তার দায়িত্ব সম্পর্কে জানা এবং মৃত্যুও তার পরবর্তী জান্নাত বা জাহান্নামের প্রবেশ সম্পর্কে ও মন্দ কর্ম ও তা থেকে বেঁচে থাকার উপায় সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা। ইচ্ছাও প্রতিজ্ঞার ক্ষেত্রে উপকারী ইচ্ছায় নিজেকে ব্যস্ত রাখা এবং অপকারী ইচ্ছা পরিত্যাগ করা। এই জাঁতাকে সংশোধনের মূল উপায় হচ্ছে অর্থবহ কাজে ব্যস্ত রাখা আর তার বিনাশ সাধান হচ্ছে অর্থহীন কাজে তাকে ব্যবহার করা।

চতুর্থ:

দায়িত্বে অবহেলাকারী অধিকাংশেরই সময় স্বল্পতা ও অবসরে অভাবের অভিযোগ তুলে। তবে সরেজমিনে অনুসন্ধানে তুমি লক্ষ করবে। এ গুলোর সবচে’ বড় কারণ হচ্ছে তাদের সময়ের বড় অংশ অর্থহীন কাজে বিনষ্ট হওয়া। তাদের বৈঠকগুলো থেকেও তুমি এসবের অনেক কিছুই অবহিত হতে পারবে। তুমি তা দেখতে পাবে ক্রীড়া-কৌতুক ও অসার গল্পের শুষ্ক পরিবেশ, নেতিবাচকতার নমুনা, অবহেলার আশ্রয়স্থল ও জীবনকে ধ্বংস করার পথ, অর্থবহ ও উপকারী বিষয়ে গুরুত্বহীন। আর এ নেতিবাচক কাজের ক্ষতি আরো তীব্র হয় যখন রোগাক্রান্ত কিছু সৎকর্মশীলরাও তাতে লিপ্ত হয়। অত:পর তাদের আসর গুলোই মন্দের দিক প্রতীক হয়ে যায়। আলেমে রব্বানী ইবনুল কায়্যিম তাদের সম্পর্কে আলোচনায় বলেন, সতীর্থদের মন্দ বৈঠক দুই প্রকার। তার একটি হচ্ছে, মনকে চাঙ্গা রাখা ও সময় কাটানোর উদ্দেশ্যে বৈঠক। এ প্রকারের বৈঠক তার পরকালের তুলনায় ক্ষতির পরিমাণ বেশি। আর ন্যূনতম ক্ষতি হচ্ছে, তা অন্তরকে দূষিত করে ও সময়ের অপচয় করে।

তবে কোন মজলিস উদ্দেশ্যপূর্ণ ও লক্ষ্য মুখী হয়, তবে তা কখন ও লক্ষ্য থেকে বিচ্যুতও হয়ে থাকে। ইবনুল কায়্যিম মজলিসের কিছু ক্ষতি থেকে সতর্ক করছেন। তিনি দ্বিতীয় প্রকারের উলে¬খ করে বলেন, দ্বিতীয়ত হচ্ছে, পরস্পর একে অপরকে সত্য ও ধৈর্যধারণের উপদেশ এবং নাজাতের উপকরণ সমূহের ক্ষেত্রে সহযোগিতার ব্যাপারে পারস্পরিক মিলন বা সমাবেশ। এটা হচ্ছে মহত্তম গনিমত ও সর্বাধিক উপকারী বিষয়। কিন্তু তাতেও দুটি ক্ষতির দিক রয়েছে।

প্রথমত: প্রয়োজনের তুলনায় অধিক কথাবার্তা ও মেলামেশা বা ঘনিষ্ঠতা অর্জন।
দ্বিতীয় হচ্ছে: এটি একটি মনের আকাক্সক্ষা ও অভ্যাসে পরিণত হয়ে যাবে। যা দ্বারা উদ্দেশ্য ব্যাহত হবে। এতদ সত্ত্বেও ভালোদের সংস্পর্শ অর্জন এবং নেককার মুরুব্বিদের সান্নিধ্যর প্রতি গুরুত্বারোপ করতে কোন নিষেধ নেই।

তবে গুরুত্বের বিষয় হচ্ছে, সঙ্গী নির্বাচন দুরদর্শিতা ও উত্তম নির্বাচন করা। আর নিজেকে উপকারী মজলিসে নিয়মানুবর্তিতার সাথে সময় দিতে প্রস্তুত করা। আর মজলিসে আলোচিত কথা-কাজ ও বিশ্বাসের সঙ্গে নিজেকে পরিমাপ করা এবং তার জন্যে চেষ্টা সাধনা করা। কেননা এ ব্যাপারে অবহেলা ক্ষতি ডেকে আনবে। আবার কখনোও এ অভিযান অর্থহীন বিষয়ের দিকেও মোড় নিতে পারে। আর সে মুহূর্তে অর্থহীন ও ক্রীড়া কৌতুকে আসক্ত অন্তর মন্দ ও অর্থহীন বৈঠক উপস্থিত হতে প্ররোচিত হতে পারে। আর এটাই হচ্ছে শয়তানের পদক্ষেপ। মোট কথা হচ্ছে আড্ডা ও মেলামেশা হচ্ছে অঙ্গী। নফ্সে আম্মারা বা নফ্সে মুতমাআন্নাহ উভয়ের জন্য। এই মিশ্রণ থেকে ফলাফল প্রকাশ পাবে। মিশ্রণ যদি উত্তম হয় তবে তার ফলাফল ও ভালো হবে। এমনকি পবিত্র আত্মাসমূহ তার মিশ্রণ ফেরেশতা থেকে। আর মন্দ আত্মা তার মিশ্রণ শয়তান থেকে। তাই আল্লাহ তাআলা তার প্রজ্ঞায় ও কৌশলে পুণ্যবতী নারীদেরকে পুণ্যবান পুরুষদের জন্য এবং মন্দ নারীদেরকে মন্দাপুরুষদের জন্য নির্বাচন করেছেন।

মানুষের কাজও গুরুত্বের বিষয়ের প্রতি দৃষ্টিপাত করলে তাদের অর্থহীন ব্যস্ততার পরিমাণ সম্পর্কে উপলব্ধি করতে পারবে। ক্রীড়া-কৌতুক, আনন্দ, উল¬স ও আনন্দদায়ক বা খেলাধুলা এবং হাত পায়ের নিরর্থক সমস্ত আন্দোলন। নানা ধরনের অর্থহীন প্রতিযোগিতা রান্না ও পোশাকের গ্রন্থাদী এবং গল্পের আসর ও নিরর্থক আনন্দ ভ্রমণ। বিভিন্ন চ্যানেল ও সম্প্রচারের পরিবেশিত অনুষ্ঠানের গভীর মনোনিবেশ এবং বিশ্ব সংবাদের গূঢ় রহস্য উদ্ঘাটন যা সংশি¬ষ্ট ব্যক্তিদের ছাড়া অন্যদের কোন উপকারে আসে না। পত্র-পত্রিকা, ম্যাগাজিন পাঠ ও অর্থহীন পড়াশোনা সহ আরো অনেক নিষিদ্ধ জিনিস রয়েছে। সুস্পষ্ট নিষিদ্ধ বস্তু দেখা ও শোনা যথা : পোশাক প্রদর্শনকারী নারীদের প্রতিযোগিতা ও সুন্দরী প্রতিযোগিতা। তারা এসব কিছু তোমাকে এই বিশ্ব ও তার কল্যাণ সম্পর্কে অবহিত করবে। আর তার ভ্রান্ত চেষ্টা তোমার কাছে সুস্পষ্ট করবে। অথচ সে মনে করছে কত উত্তম কাজই না সে করেছে। যারা আল্লাহ ও পরকালের বিশ্বাস রাখে না তাদের থেকে যদি এ কাজ প্রত্যাশিত না হয় তা হলে মুসলমানদের অবস্থা কী?

তিক্ত বাস্তবতা হচ্ছে, যাদের ওপর আল্লাহ হেদায়েতের নেয়ামত দিয়েছেন তাদের কারো অধিকাংশ গুরুত্ব মানুষ লক্ষ্য করে তাদের তিক্ততা বেড়ে যায়। এদের সম্পর্কে প্রথম বক্তব্য হচ্ছে তারা যেন বয়স ফুরিয়ে যাওয়ার নিজেদের নিয়ে হিসাব-নিকাশ করে। ইবনুল কায়্যূম রহ. বলেন: পদক্ষেপের সংরক্ষণ হচ্ছে নিজের কদমকে সওয়াবের প্রত্যাশা ছাড়া স্থানান্তর না করা। যদি তার পদক্ষেপে অতিরিক্ত সওয়াব প্রাপ্তি না হয়, তবে বসে থাকাই উত্তম। আর প্রত্যেক মুবাহ কাজে আল্লাহর উদ্দেশ্যে নিয়ত করলে তা সওয়াব হিসেবে পরিগণিত হবে। শরীর ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সমস্ত কাজ ও আন্দোলনও ঠিক অনুরূপ।

ইসলাম প্রচার ব্যুরো, রাবওয়াহ, রিয়াদ

মানুষের সাথে কথা বলার দিকনির্দেশনা

ভাষান্তর : জহিরুল কাইয়ুম | সম্পাদনা : আব্‌দ আল-আহাদ

 মানুষের সাথে একজন মুসলিম কীভাবে কথা বলবেন সে বিষয়ে ইসলাম কিছু সুনির্দিষ্ট নিয়ম পদ্ধতি প্রণয়ন করে দিয়েছে। সর্বাবস্থায় একজন মুসলিমকে অটুট বিশ্বাস নিয়ে মনে রাখতে হবে যে, তার মুখ দিয়ে উচ্চারিত প্রতিটি শব্দের জন্য তাকে জবাবদিহি করতে হবে। তিনি যদি উত্তম কিছু বলেন, তিনি পুরস্কৃত হবেন। আর তিনি যদি মন্দ কিছু বলেন, তবে সেই মন্দ কথার জন্য তাকে অবধারিতভাবেই শাস্তি ভোগ করতে হবে। আল্লাহ্‌ (সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা) বলেছেন: “মানুষ যে কথাই উচ্চারণ করে তা লিপিবদ্ধ করার জন্য তৎপর প্রহরী তার সাথেই রয়েছে।” [সূরা কাফ : ১৮]

রাসূল (সা) আমাদেরকে সতর্ক করে বলেছেন যে, মুখের কথা খুবই বিপদজনক। ইমাম আত-তিরমিযি এবং ইবনু মাজাহ কর্তৃক সংকলিত এবং সহীহ সূত্রে বর্ণিত একটি হাদীসে আল্লাহ্‌র রাসূল বলেছেন: “বান্দা অনেক সময় এমন কথা বলে যাতে সে গুরুত্ব দেয় না অথচ সেই কথা আল্লাহ্‌কে সন্তুষ্ট করে। ফলে আল্লাহ্‌ তা‘আলা এর দ্বারা তার মর্যাদা বৃদ্ধি করে দেন। পক্ষান্তরে, বান্দা অনেক সময় এমন কথাও বলে যাতে সে গুরুত্ব দেয় না অথচ সেই কথা আল্লাহ্‌কে অসন্তু করে। ফলে সেই কথাই তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করে।” [বুখারী; অধ্যায় : ৮, খণ্ড : ৭৬, হাদীস : ৪৮৫]

কাজেই মুখের কথা বিপদের কারণ হতে পারে। আল্লাহ্‌ এবং তাঁর রাসূলের (সা:) নির্দেশনা অনুযায়ী ইসলামের সীমারেখার মধ্যে থেকে আমাদেরকে কথা বলা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। মুখের কথা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য নীচে কিছু দিকনির্দেশনা দেওয়া হলো :

১) কথা বলার উদ্দেশ্য হতে হবে উত্তম এবং কল্যাণকর। যদি উত্তম কথা বলার উদ্দেশ্য বজায় রাখতে না পারেন, তবে চুপ থাকাই আপনার জন্য উত্তম এবং চুপ থাকাটাও একটি উত্তম কাজ। বুখারী এবং মুসলিম কর্তৃক সংকলিত একটি হাদীসে রাসূল (সা:) বলেছেন: “যে ব্যক্তি আল্লাহ্‌ এবং কিয়ামত দিবসে বিশ্বাস রাখে, সে যেন উত্তম কথা বলে, নয়তো চুপ থাকে।” [বুখারী; খণ্ড : ৮, অধ্যায় : ৭৬, হাদীস : ৪৮২]

২) কথাবার্তায় সত্যবাদী হোন এবং মিথ্যা বলা থেকে বিরত থাকুন। কারন মু’মিন ব্যক্তি সর্বদায় সত্যবাদী যিনি কৌতুক করেও মিথ্যা বলেন না। বুখারী এবং মুসলিমের অন্য একটি হাদীসে রাসূল (সা:) বলেছেন: “তোমরা অবশ্যই সত্য কথা বলবে। কারন সত্য সদ্‌গুণের দিকে এবং সদ্‌গুণ জান্নাতের পথে চালিত করে। যে সর্বদা সত্য কথা বলে এবং সত্যকে গুরুত্ব দেয়, আল্লাহ্‌র নিকট তার নাম সত্যবাদীদের খাতায় লিপিবদ্ধ করা হয়। মিথ্যা থেকে দূরে থাকো। কারন মিথ্যা পাপের দিকে এবং পাপ জাহান্নামের আগুনের দিকে চালিত করে। যে অনবরত মিথ্যা বলে এবং মিথ্যা বলা ইচ্ছা রাখে, আল্লাহ্‌র নিকট তার নাম মিথ্যাবাদীদের খাতায় লিপিবদ্ধ করা হয়।” [মুসলিম; খণ্ড : ৩২, হাদীস : ৬৩০৯]

৩) কথাবার্তার মাধ্যমে আল্লাহ্‌র বিরুদ্ধাচরণ করা যাবে না — তা ক্রীড়াচ্ছলেই হোক অথবা উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবেই হোক।কারন আল্লাহ্‌ অবাধ্য মন্দভাষীকে ঘৃণা করেন। আল্লাহ্‌ পছন্দ করেন এমন প্রতিটি শব্দের মাধ্যমেই কুফ্‌রী করা হয়। যেমন : অশ্লীল ও অশিষ্ট শব্দ ব্যবহার করা, মানুষকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করা ইত্যাদি। এ সম্পর্কে সহীহ সূত্রে বর্ণিত একটি হাদীসে নবী (সা:) আমাদেরকে সতর্ক করে বলেছেন, “মু’মিনগণ কখনো অভিযোগ করে না, অন্যের প্রতি খারাপ ভাষা ব্যবহার করে না, আল্লাহ্‌র বিরুদ্ধাচরণ করে না এবং নোংরা ভাষায় গালমন্দ করে না।” অন্য একটি সহীহ হাদীসে রয়েছে, “মুসলিমের জন্য গালিগালাজ করাই হলো কুফ্‌র।” জীবিত কোনো মানুষকে গালিগালাজ করা যেমন নিষিদ্ধ, মৃত ব্যক্তিকে গালিগালাজ করাও তেমনিভাবে নিষিদ্ধ। “মৃত ব্যক্তিদের গালমন্দ করবে না; তারা তাদের প্রতিদান পেয়ে গেছে।” অন্য একটি হাদীসে রাসূল (সা:) নির্দেশ দিয়েছেন, “মৃতদের ভালো কাজগুলো নিয়ে আলোচনা করো।”

৪) কথা বলার সময় গীবত তথা পরচর্চা থেকে বেঁচে থাকুন। গীবত হলো কোনো মুসলিমের অসাক্ষাতে তার সম্পর্কে অন্যকারও কাছে এমন কিছু বলা যা শুনলে সে কষ্ট পায়। অতএব, পরচর্চা করবেন না। নামীমাহ থেকেও বেঁচে থাকুন। নামীমাহ হলো লোকজনের মধ্যে এমন তথ্য ছড়ানো যা তাদের মধ্যে পারস্পরিক ঘৃণার সৃষ্টি করে। সহীহ সূত্রে বর্ণিত একটি হাদীসে রাসূল (সা:) বলেছেন, “যে ব্যক্তি গুজব ছড়ায় সে কখনো জান্নাতে প্রবেশ করবে না।” যারা নামীমাহ চর্চা করে তাদেরকে গোপনে নিষেধ করুন এবং সেগুলো শোনা থেকেও দূরে থাকুন। অন্যথায়, শুধু শোনার জন্যও আপনি সেই পাপের অংশীদার হবেন।

৫) কথায় কথায় কসম খাওয়া থেকে বেঁচে থাকুন। এই মর্মে সূরা আল-বাকারাতে আল্লাহ্‌ (সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা) বলেছেন : “আর নিজেদের শপথের জন্য আল্লাহর নামকে লক্ষ্যবস্তু বানিও না।” [আল-বাকারা : ২২৪]

৬) নিজের জ্ঞান ও প্রজ্ঞার পরিসীমার মধ্যে থেকে কথা বলুন। যে বিষয়ে জ্ঞান নেই, সে বিষয়য়ে মত প্রকাশ করবেন না। সূরা আল-ইসরা-তে আল্লাহ্‌ তা‘আলা বলেছেন: “যে বিষয়ে তোমার কোন জ্ঞান নেই সে বিষয়ের পিছে পোড়ো না।” [আল-ইস্‌রা : ৩৬]

৭) তদন্ত করে নিশ্চিত না হয়ে শুধু শোনা কথা নিয়ে মানুষের সাথে আলাপ করা যাবে না। কারন আপনি এমন কিছু শুনতে পারেন যে সত্যও হতে পারে আবার মিথ্যা কিংবা সন্দেহজনক হতে পারে। যা শুনবেন তা-ই প্রচার করলে আপনিও পাপের অংশীদার হবেন। একটি বিশুদ্ধ হাদীস অনুযায়ী, রাসূল (সা) সতর্ক করে বলেছেন: “একজন মানুষের মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য একটুকুই যথেষ্ট যে, সে যা শোনে তা-ই প্রচার করে বেড়ায়।” [সহীহ মুসলিম ১/৮, হাদীস ৫; সুনান আবু দাউদ ২/৬৮১, হাদীস ৪৯৮২]

৮) খেয়াল রাখবেন, মানুষের সাথে আপনার কথাবার্তা এবং আলাপ আলোচনার উদ্দেশ্য যেন হয় সত্যে উপনীত হওয়া।সত্য আপনার মাধ্যমে উন্মোচিত হোক আর অন্যকারও মাধ্যমেই উন্মোচিত হোক — কার দ্বারা উন্মোচিত হলো সেটা বড় করে দেখবেন না। এক্ষেত্রে সত্যে উপনীত হওয়াটাই বড় কথা।

৯) অন্যকে ছোটো করা এবং অন্যের উপর জয়লাভ করার উদ্দেশ্যে অনর্থক তর্কে লিপ্ত হওয়া থেকে বিরত থাকুন। অকারনে তর্কে লিপ্ত হওয়া বিপথগামীতার লক্ষন। এ থেকে আমরা আল্লাহ্‌র কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছি। এই মর্মে তিরমিযি কর্তৃক সংকলিত একটি হাদীসে রাসূল (সা:) বলেছেন: “আল্লাহ্‌ কাউকে পথ দেখালে সে বিপথগামী হয় না কিন্তু তারা বিনা কারনে তর্কাতর্কিতে লিপ্ত হয়।” আপনি নিজে সঠিক হলেও বিতর্ক পরিহার করুন। আবু দাঊদের একটি হাদীসে রাসূল (সা:) বলেছেন: “সঠিক হওয়া সত্ত্বেও যে ব্যক্তি বিনা কারনে তর্ক করা বন্ধ করে আমি জান্নাতের সমীপে তার জন্য একটি ঘরের নিশ্চয়তা দিচ্ছি। [আবূ দাঊদ; অধ্যায় : ৪১, হাদীস : ৪৭৮২]

১০) আপনার কথা হবে স্পষ্ট, সহজবোধ্য, দুর্বোধ্য শব্দমুক্ত।প্রয়োজন না হলে বাগ্মিতা পরিহার করুন এবং মানুষকে হেয় প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্যে কিছু বলা থেকে বিরত থাকুন। কারন রাসূল (সা:) এধরনের কথা অপছন্দ করতেন। আত-তিরমিযি কর্তৃক সংকলিত অন্য একটি সহীহ হাদীসে নবী (সা:) বলেছেন: “যাদেরকে আমি সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করি এবং যারা কিয়ামতের দিন আমার থেকে সবচেয়ে দূরে অবস্থান করবে, তারা হলো সেইসব যারা অনর্থক কথা বলে, এবং যারা অন্যকে ছোট করে, এবং যারা কথা বলার সময় নিজেদের (পাণ্ডিত্য) জাহির করে।” [আত-তিরমিযি; হাদীস : ৬৩১]

১১) আপনার কথা হবে শান্ত প্রকৃতির, পরিষ্কার, শ্রুতিগোচর এবং সর্ব সাধারণের নিকট বোধগম্য। রাসূল (সা) সকলের বুঝার সুবিধার্থে একটি কথা তিনবার পুনরাবৃত্তি করতেন। তাঁর কথা ছিল সহজ যা সকলেই বুঝতে পারতেন।

১২) কথাবার্তায় আন্তরিক হউন। অযথা কৌতুক করবেন না। কথাবার্তায় হাস্যরস আনতে চাইলে, সেই ভাবে আনুন যেভাবে নবী মুহাম্মদ (সা) তা করতেন।

) অন্যের কথায় ব্যাঘাত সৃষ্টি করবেন না। কেউ কিছু বলতে চাইলে তা মনোযোগ দিয়ে শুনুন এবং তাকে তার কথা শেষ করতে দিন। তার কথা শোনার পর যদি আপনার পক্ষ থেকে ভালো এবং প্রকৃত অর্থেই প্রয়োজনীয় কিছু বলার থাকে তবে বলুন। শুধু বলতে চাওয়ার স্বার্থেই কথা বলবেন না।

১৪) কথা বলুন আর তর্কই করুন — তা করতে হবে উত্তম পন্থায়। এতে করে যেন কারও ক্ষতি না হয়, মানসিকভাবে কেউ যেন আঘাত না পায়, কাউকে খাটো করা না হয় বা তাদের প্রতি ঠাট্টা-বিদ্রূপ প্রকাশ না পায়। সকল নবীদের মাধ্যমেই মানুষকে সুন্দরভাবে কথা বলার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ্‌ (সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা) যখন মূসা (আ) এবং তাঁর ভাই হারূনকে (আ) ফির‘আউনের কাছে প্রেরণ করেছিলেন, তখন তিনি তাঁদেরকে বলে দিয়েছিলেন: “তোমরা তার সাথে নম্র কথা বলবে। হয়তো সে উপদেশ গ্রহন করবে অথবা ভয় করবে।” [সূরা ত্ব-হা : ৪৪]

বলাই বাহুল্য যে, আপনি মূসা (আ:) এবং হারূন (আ:) থেকে উত্তম নন। আর যে লোকটির সাথে কথা বলছেন সেই লোকটিও ফির‘আউনের থেকে নিকৃষ্ট নয়।

১৫) অন্যদের কথাবার্তা সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাখ্যান করবেন না, বিশেষকরে যখন দেখবেন যে, তারা যা বলছে তার মধ্যে যেমন ভুল বা মিথ্যা রয়েছে, তেমনি কিছু পরিমাণ সঠিক বা সত্য তথ্যও রয়েছে। কারন সঠিক অংশটুকুকে প্রত্যাখ্যান করা মোটেও উচিত হবে না, যদিও তা ভুলের সাথে মিশিয়ে উপস্থাপন করা হয়। একইভাবে সত্য অসহটুকুকে প্রত্যাখ্যান করা মোটেও উচিত হবে না, তা মিথ্যার সাথে মিশিয়ে উপস্থাপন করা হলেও।  আপনাকে সঠিক ও সত্যটি গ্রহন করতে হবে এবং ভুল ও মিথ্যাটি ত্যাগ করতে হবে। এটিই হলো ন্যায়বিচার এবং ইনসাফ যা করার জন্য আল্লাহ্‌ আমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন।

১৬) মানুষের সামনে নিজের প্রশংসা করবেন না,নিজেই নিজেকে বাহবা দেবেন না। কারণ এমনটি করা উদ্ধত্যপূর্ণ আচরণের পরিচায়ক যা করতে আল্লাহ্‌ তা‘আলা আমাদেরকে নিষেধ করেছেন। তিনি বলেছেন: “অতএব তোমরা নিজেদের সাফাই গেয়ো না। তিনিই ভালো জানেন মুত্তাকী কে।” [সূরা আন-নাজ্‌ম : ৩২]

গুনাহের দরজা সমূহ (পর্ব ১)

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম

লিখেছেনঃ আব্দুল্লাহ শহীদ আব্দুর রহমান     ওয়েব সম্পাদনাঃ মোঃ মাহমুদ -ই- গাফফার

118

 পর্ব ১পর্ব ২

 গুনাহের কিছু কারণ ও ভূমিকা রয়েছে যা গুনাহের প্রতি টেনে নিয়ে যায়।

এবং তার কিছু প্রবেশ পথ রয়েছে যা সেখানে প্রবিষ্ট করে দেয়। গুনাহ থেকে বিরত ও বেঁচে থাকার জন্য এই সব বিষয়ের জানা নিতান্ত অপরিহার্য।

আল্লাহর অবাধ্য আচরণের অনেক কারণ রয়েছে। তন্মধ্যে সর্ববৃহৎ হল, অপ্রয়োজনীয় ও নিরর্থক কাজে মানুষের জড়িয়ে পড়া। তাকে দ্বীন বা দুনিয়ার কোন উপকার করবে না। উপরন্তু নিরর্থক কাজ বর্জন করা মানুষের ইসলামের পরিপূর্নতা ও তার ঈমান বৃদ্ধির পরিচায়ক। রাসূল বলেছেন,

من حسن إسلام المرء تركه ما لايعنيه. أخرجه الترمذي(২৩১৭)، وابن ماجه (৩৯৭৬)، وحسنه النووي في الأربعين النووية، والالباني في صحيح سنن الترمذي(১৮৮৭).

‘মানুষের সর্বোত্তম ইসলাম হল নিরর্থক কাজ বর্জন করা।অতএব যে ব্যক্তি অনর্থক কাজে ব্যস্ত রইল এবং দুনিয়ার কাজে তার পূর্ণ সময় ব্যয় করল এবং অধিক হারে মুবাহ কাজ করল- এই মুবাহ কাজ দ্বারা আল্লাহর আনুগত্য করার সাহায্য চাওয়া ছাড়া – সে তার জন্য গুনাহের উপকরণ সমূহ উন্মুক্ত করে দিল।

 

তবে মানুষের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সমূহ-ই হল গুনাহের দরজা : আর সবচে’ ক্ষতিকারক অঙ্গ প্রত্যঙ্গ।

ইবনুল কাইয়ুম বলেন, যে ব্যক্তি চতুষ্টয়কে সংরক্ষণ করল সে তার দ্বীনকে নিরাপদ করল সে গুলো হল:-

  • মুহূর্ত ও সময়
  • ক্ষতিকারক বস্তু সমূহ
  • বাকশক্তি এবং
  • পদক্ষেপ সমূহ।

 

অতএব, এই চারটি দরজায় নিজের পাহারাদার নিযুক্ত করা উচিত। এই গুলোর প্রাচীর সমূহে নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা সৃষ্টি করবে। কেননা, এগুলোর মাধ্যমেই শত্র প্রবেশ করে তাকে। অত:পর সে গোটা ভূমিকে গ্রাস করে নেয় এবং প্রবল পরাক্রম হয়ে বিস্তার লাভ করে। মানুষের কাছে অধিকাংশ গুনাহ এই চারটি পথেই প্রবেশ করে তাকে।

 

সুতরাং গুনাহের উপকরণ ও যে সব প্রবেশপথে গুনাহ বিস্তার লাভ করে থাকে সে গুলো সম্পর্কে সম্যক অবগতি লাভ করা মানুষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। যেন সে সে সব থেকে বেঁচে থাকতে পারে। এখন সে সব বিষয়ের বিশদ আলোচনা উপস্থাপিত হচ্ছে।

 

প্রথমত:

দৃষ্টিশক্তি- মানুষ দৃষ্টিশক্তি থেকে কোন ভাবেই অমুখাপেক্ষী নয়। যা দ্বারা সে তার পথ দেখতে পারে এবং তার গন্তব্য চিনতে পারে। এবং যা দ্বারা সে তার স্রষ্টার সৃষ্টি নিয়ে চিন্তা ভাবনা করে। কিন্তু আমাদের বাস্তব সম্পর্কে চিন্তাশীল ব্যক্তি মাত্রই পর্যবেক্ষণ করছেন সে, এ মহান নেয়ামত দ্বারা মানুষ কীভাবে অনর্থক কাজের উদ্দেশে সীমা-লঙ্ঘন করছে, যা কোন প্রগতিবাদী সার্থক উন্নতির জন্য প্রচেষ্টাকারীর কর্ম হতে পারে না। এরশাদ হচ্ছে-

 لِمَنْ شَاءَ مِنْكُمْ أَنْ يَتَقَدَّمَ أَوْ يَتَأَخَّرَ. الدهر : ৩৭

যার ইচ্ছে সামনে অগ্রসর হোক, যার ইচ্ছে পশ্চাৎপসরণ করুক।

এবং সন্দেহ নেই যে, দৃষ্টিকে নিছক নিরর্থক বিষয়ে নিবন্ধ করা উচিত নয়।

যদিও তা মুবাহ হোক বা না হোক। এবং নিজদের দৃষ্টি সংযত রাখার ব্যাপারে যত্নশীল হতে হবে যদিও তা যতই কঠিন হোক না কেন।

এবং তা অপরিষ্কার নয়। যে, এই মুবাহ দৃষ্টি নিষিদ্ধ হতে পারে যখন তা দায়িত্ব পালনে গাফেল বানাবে।

অর্থহীন দৃষ্টি : অপকারী বইপত্র ও ম্যাগাজিন পড়ার জন্য দৃষ্টি বোলানো যেমন কাল্পনিক গল্প ও রহস্য গল্প। বিভিন্ন ঘটনা ও চরিত্রের কাল্পনিক বর্ণনার মাধ্যমে মনের স্থূল আনন্দ ছাড়া এগুলোতে অর্থবহ কিছু নেই। এমনি ভাবে উপকার শূন্য আরো বিভিন্ন মাধ্যমে যেমন ক্রীড়াও শিল্পের সংবাদ ও কুকুরের সংবাদ ইত্যাদি। যখন বিষয়টি এরূপ তাহলে হারাম ও নিষিদ্ধ বস্তুর প্রতি দৃষ্টিদান আরো অধিক নিরর্থক কাজ। বিশেষত: মানুষের গোপনাঙ্গের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করা। কেননা তা আরো বেশি নিন্দনীয় কাজ ঐ সত্তার নিকট যিনি চক্ষুসমূহের খিয়ানত ও অন্তর এর গোপন সবকিছুর খবর রাখেন। এবং যার মন নিষিদ্ধ দৃষ্টির মাধ্যমে তার অন্তরকে হারাম থেকে বিরত রাখতে চায় তবে তা তার জন্য বৈধ। কেননা, তা দু’টি ক্ষতির মধ্যে লঘুতর। এবং এই চিকিৎসা প্রয়োগের মাধ্যমে সে তার অন্তরকে কল্যাণময় দৃষ্টির দিকে ফিরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করবে। এবং একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতি, যা দৃষ্টি এবং অন্যান্য বিষয় যথা অন্তর কথা ও সক্রিয় কর্মের ক্ষেত্র প্রযোজ্য।

 

দ্বিতীয়ত:

জিহ্বা- মানুষের অর্থহীন আচরণ যেমন কাজের ক্ষেত্রে হয় তদ্রুপ কথার ক্ষেত্রেও হয়। কেননা কথাও তার কাজের অংশ। তবে এ বিষয়ে অধি:কাংশ মানুষই বেখবর। তাই তারা তাদের কথাবার্তাকে কর্মের অঙ্গীভূত মনে করে না। উমর ইবনে আ: আযিয তাদের জন্য এ বিষয়টির তাৎপর্য সুস্পষ্ট করে দিয়েছেন: তিনি বলেন,

من علم أن الكلام من عمله أمسك عن الكلام إلا فيما يعنيه. الزهد للإمام أحمد ص২৯৬، وانظر:جامع العلوم والحكم، لابن رجب১/২৯১.

 ‘যে জানবে যে তার কথা কর্মেরই অংশ সে নিরর্থক কথা থেকে নিবৃত্ত থাকবে।’

বরং নিরর্থক কাজ থেকে বিরত থাকার নিকটতম উদ্দেশ্যে হল জিহ্বাকে অর্থহীন কথা থেকে বাঁচিয়ে রাখা।

 

এ বিষয়ে নবী সা.-এর কথা সাক্ষ্য দিচ্ছে,

إن من حسن إسلام المرء قلة الكلام فيما لايعنيه. أخرجه أحمد،১/২০১، وهو حسن لغيره.

‘মানুষের সৌন্দর্য ইসলাম হল অর্থহীন কথা থেকে জিহ্বাকে বাঁচিয়ে রাখা।  

 

আবু দারদা রা. বলেছেন—

من فقه الرجل قلة الكلام فيما لايعنيه. أدب المجالسة، لابن عبد البر، ص৬৮.

মানুষের বুদ্ধিমত্তার অংশ বিশেষ হল নিরর্থক বিষয়ে কথার স্বল্পতা।

 

مَا يَلْفِظُ مِنْ قَوْلٍ إِلَّا لَدَيْهِ رَقِيبٌ عَتِيدٌ. ق : ১৮

‘মানুষের বাক্য সংযমের ক্ষেত্রে আল্লাহর বাণী যথেষ্ট যে, সে যে কথা উচ্চারণ করে তার নিকট রয়েছে রক্ষণশীল প্রহরী।  

 

নবী সা.-এর বাণী—

وهل يكب الناس في النارعلى وجوههم-أوعلى مناخرهم- إلا حصائد ألسنتهم.

 ‘মানুষকে তাদের চেহারা বা কাঁধের উপর দিয়ে জাহান্নমে নিক্ষেপ করবে কেবল তাদের জিহ্বার শস্যসমূহ (কথা)।

 

জিহ্বাকে সংযত রাখবে এভাবে যে কোন শব্দ অনর্থক উচ্চারিত হবে না কেবলমাত্র ওইসব বিষয়ে কথা বলবে যেখানে তার দ্বীনের ক্ষেত্রে লাভ ও বৃদ্ধির আশা করা যায়। যখন সে কথা বলবে চিন্তা করবে তাতে কোন লাভ ও কল্যাণ আছে কি নেই? যদি কোন লাভ না থাকে নিজেকে সংযত রাখবে আর যদি তাতে কোন লাভ থাকে, তবে লক্ষ্য রাখবে এই কথার মাধ্যমে কী তার চেয়েও অধিক লাভ জনক কোন পথ ছুটে যাবে? এমন হলে এর দ্বারা ঐটিকে বিনষ্ট করবে না। ইবনে আব্বাস রা. বলেছেন—

خمس لهن أحسن من الدهم الموقفة: لا تتكلم فيما لا يعنيك، فإنه فضل ولا آمن عليك الوزر، ولا تتكلم فيما يعنيك حتى تجد له موضعا، فإنه رب متكلم في أمر قد وضعه في غير موضعه فيعنت..الصمت لابن أبي الدنيا ص৯৫(১১৪) إسناده ضعيف كما ذكره المحقق.

যখন তুমি অন্তরের কোন ইচ্ছাকে প্রকাশ করতে চাও তবে জিহ্বার নড়াচড়ার মাধ্যমেই প্রকাশ পায়। কেননা তার অভিব্যক্তি চেহারায় ফুটে ওঠে চাই সে চাক বা অস্বীকার করুক।

 

আশ্চর্যের বিষয় হল, মানুষের জন্য হারাম বস্তু খাদ্য হিসেবে গ্রহণ, জুলুম, মদ পান, ব্যভিচার, চুরি এবং নিষিদ্ধ দৃষ্টিদান ইত্যাদি বিষয় থেকে বেঁচে থাকা সহজ হয়। আর তার পক্ষে জিহ্বার আন্দোলন থেকে নিবৃত্ত থাকা খুবই কঠিন বিষয়। তাই তুমি এমন লোক দেখতে পাবে যার কাছে দ্বীন, এবাদত এবং দুনিয়া বিমুখতা সম্পর্কে পরামর্শ করা হয়। অথচ ঐ ব্যক্তি এমন সব কথা বলে যা তাকে নির্ঘাত আল্লাহর ক্রোধে নিপতিত করবে। এবং এমন বৈপরীত্য কথাবার্তা বলে যা আকাশ ও জমিনের চেয়ে ও অধিক দূরত্ব রাখে। এবং তুমি এমন অনেক লোক দেখেতে পাবে যারা অশ্লীল ও অন্যায় কাজ থেকে অনেক সচেতন অথচ তার জিহ্বা জীবিত বা মৃত সকলের ব্যাপারেই নির্বিচারে মন্তব্য করে সে কী বলেছে এ ব্যাপারে তার কোন পরওয়া নেই।

 

অর্থহীন কথাবার্তার সীমা বা পরিধি:

এমন কথাবার্তা বলা যদি সে চুপ থাকে তবে সে গুনাহগার হবে না এবং বর্তমান ও ভবিষ্যতে তার কোন ক্ষতি ও সাধিত হবে না। যেমন নিত্য দিনের ঘটনা এমন খাবার পোশাক ইত্যাদির আলোচনা। এবং অপরকে তার এবাদত সম্পর্কে প্রশ্ন করা এবং তার অবস্থান ও অপরের সঙ্গে তার কথাবার্তার অবস্থান ও কথাবার্তার বিবরণ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা। যা দ্বারা জিজ্ঞাসিত ব্যক্তি কোন মিথ্যা বা ক্ষতি শিকার হয়।

প্রকৃতপক্ষে মানুষ :

আর নিরর্থক কথার অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে অর্থপূর্ণ কাজের ক্ষেত্রে প্রয়োজনের চেয়ে অতিরঞ্জন করা। তবে এটা আপেক্ষিক বিষয়। অর্থহীন বেফায়দা কথাবার্তার ক্ষেত্রে ঈমানদের নিষিদ্ধকরণ সংক্রান্ত আলোচনা অনেক বেশি।

এটা অস্পষ্ট নয় যে, গিবত, পরনিন্দা, অপবাদ ও মিথ্যা কথা বলা ইত্যাদি অধিক যুক্তি সংগত ভাবে হাদিসের অন্তর্ভুক্ত।

 

মোট কথা জবানের ধ্বংসাত্মক পরিণাম ও তার বিপদ সমূহের পরিচয় লাভ এবং তা থেকে বেঁচে থাকার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া নেহায়েত জরুরি। এই ভয়ে যে এর মাধ্যমে এ গুলোর সংঘটকরা ধ্বংস ও ক্ষতির মধ্যে নিপতিত হবে। ন্যূনতম এতটুকু উন্নীত হতে পারত তা থেকে বঞ্চিত হবে। এবং অর্থহীন কথাবার্তায় অনেক ক্ষতি রয়েছে। যথা: রিজিক বিলম্বকরণ, হেফাজতকারী ফেরেশতাদের যন্ত্রণা প্রদান, আল্লাহর নিকট নিরর্থক কথাবার্তার

 

রেকর্ড প্রেরণ ও শীর্ষ সাক্ষীদের সামনে সে আমলনামা পঠন জান্নাতে থেকে বাধা প্রদান, হিসাব, ভর্ৎসনা, তিরস্কার, দলিল উপস্থাপন করা এবং আল্লাহর থেকে লজ্জা পাওয়া।

হাদিসে এসেছে,

إن أحدكم ليتكلم بالكلمة من رضوان الله، ما يظن أن تبلغ ما بلغت، فيكتب الله له بها رضوانه إلى يوم يلقاه، وإن أحدكم ليتكلم بالكلمة من سخط الله ما يظن أن تبلغ ما بلغت، فيكتب الله بها سخطه إلى يوم يلقاه. أخرجه الترمذي، ح২৩১৯،وقال: حسن صحيح، وصححه الألباني،ح১৮৮৮.

তোমাদের কেউ আল্লাহর সন্তুষ্টি দায়ক কোন কথা বলে অথচ সে ধারণা করতে পারে না তা কোথায় পৌঁছোবে, অত:পর আল্লাহ তার জন্য কেয়ামতের সাক্ষাৎ দিবসে আপন সন্তুষ্টি লিপিবদ্ধ করে রাখেন এবং তোমাদের একই আল্লাহর অসন্তোষ প্রদানকারী কোন কথা বলে অথচ সে ধারণাও করতে পারে না তার পরিণাম কী হবে, অত:পর আল্লাহ কেয়ামত দিবসের জন্য তার প্রতি অসন্তুষ্টি লিখে রাখেন। 

 

কথিত আছে, লোকমানকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল তিনি কীভাবে তার মর্যাদাও সম্মানের আসন লাভ করেছেন। তিনি বলেছেন,

صدق الحديث، وطول السكوت عما لا يعنيني.

সত্য কথনও অর্থহীন বিষয়ে দীর্ঘ নীরবতা পালন।

 

মুহাম্মদ ইবনে আজলান বলেছেন—

إنما الكلام أربعة: أن تذكر الله، أو تقرأ القرآن، أو تسأل عن علم فتخبر به، أو تتكلم فيما يعنيك من أمر دنياك. التمهيد لابن عبد البر،৯/২০২.

প্রকৃতপক্ষে কথা চার প্রকার : যথা; আল্লাহকে স্মরণ করা অথবা পবিত্র কোরআন পাঠ করা অথবা কোন জ্ঞান সম্পর্কে প্রশ্ন করে সে বিষয়ে অবগত হওয়া অথবা দুনিয়ার বিষয়ে উপকারী কথাবার্তা বলা।

 

হাসান ইবনে হুমাইদ বলেছে,

وقلت من مقالته الفضول       إذا عقل الفتى استحيا واتقى

যখন কোন যুবক বুদ্ধিদীপ্ত হবে সে সলাজ ও খোদা-ভীরু হবে। এবং সে কথাবার্তায় পরিমিত ও স্বল্পভাষী হবে।

 

 

ইসলাম প্রচার ব্যুরো, রাবওয়াহ, রিয়াদ

 

ইসরা ও মি‘রাজের ফলাফল ও আমাদের করণীয়

লেখক: শাইখ ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া

ইসরা ও মি‘রাজ পরিচিতি:

ইসরা শব্দটির অর্থ রাতের সফর। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে রাতের একাংশে মক্কার হারাম থেকে বাইতুল মুকাদ্দাস এর এলাকায় যে সফর করানো হয়েছে সেটাকে ইসরা বলা হয়।

আর মি‘রাজ হচ্ছে, উপরে আরোহন। আল্লাহ তাঁর হাবীব মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ভূমি থেকে আকাশে আরোহণ করিয়ে প্রথম আকাশ থেকে শুরু করে সপ্তাকাশ ভেদ করে সিদরাতুল মুন্তাহা পেরিয়ে তাঁর নিজের কাছে ডেকে নিয়েছিলেন। সেটাকেই মি‘রাজ বলা হয়।

ইসরা ও মি‘রাজের দলীল:

ইসরার দলীল পবিত্র কুরআনের সূরা আল-ইসরা বা বনী ইসরাঈল এর ১ম আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে: “পবিত্র ও মহান সে সত্ত্বা যিনি তাঁর বান্দাকে সফর করিয়েছেন রাতের একাংশে মাসজিদুল হারাম থেকে মাসজিদুল আকসার দিকে, যার চতুস্পার্শকে তিনি করেছেন বরকতময়। যাতে তিনি তাকে দেখাতে পারেন তাঁর নিদর্শনসমূহ। নিশ্চয় তিনি সর্বশ্রোতা সর্বদ্রষ্টা।“[আল-ইসরা:১]

আর মি‘রাজের দলীল হচ্ছে, অন্য আয়াত যেখানে বলা হয়েছে: “নিশ্চয় সে তাকে আরেকবার দেখেছিল, সিদরাতুলমুন্তাহার নিকটে, যার কাছে অবস্থিত বসবাসের জান্নাত। যখন বৃক্ষটি দ্বারা আচ্ছন্ন হওয়ার, তদ্দ্বারা আচ্ছন্ন ছিল। তাঁর দৃষ্টিবিভ্রম হয় নি এবং সীমালংঘনও করেনি। নিশ্চয় সে তার পালনকর্তার মহান নিদর্শনাবলী অবলোকন করেছে।” [সূরা নাজম ১৩-১৮]

তাছাড়া হাদীসে এসেছে, বুখারীতে সাতটি বর্ণনা এবং মুসলিমে ছয়টি বর্ণনা ছাড়াও বহু হাদীসগ্রন্থে এটি এসেছে।

ইসরা ও মি‘রাজের পটভূমি:

নবুওয়তের দশম বৎসরে একের পর এক বিপদ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ঘিরে ধরে। রাসূলের চাচা আবু তালেব মারা যান; যিনি কাফের হওয়া সত্ত্বেও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সার্বক্ষনিক নিজের তত্ত্বাবধানে রাখতেন। তার জীবদ্দশায় কেউ তার কোন ক্ষতি করতে চাইলেও সক্ষম হত না। কিন্তু তার মৃত্যুর পর কাফেররা অত্যন্ত বেপরোয়া হয়ে উঠে। এর কিছুদিন পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রী উম্মুল মুমিনীন খাদীজা রাদিয়াল্লাহু আনহাও মারা যান। যিনি শুধু রাসূলের স্ত্রীই ছিলেন না; বরং তার দাওয়াতের প্রধান সহযোগীও ছিলেন। তার সমস্ত সম্পত্তি রাসূলের জন্য অকাতরে বিলিয়ে দিয়েছিলেন। তার উপর প্রথম ঈমান এনেছিলেন। এ পথে যত কষ্ট হয়েছে সবই সহ্য করেছেন।

তাদের মৃত্যুর পর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অসহায় বোধ করলেন। তিনি বিভিন্ন গোত্রপতিদের কাছে নিজেকে পেশ করে বললেন, “কে আমাকে আশ্রয় দিবে যাতে আমি আমার রবের কথা প্রচার করতে পারি?” কিন্তু কেউ তার ডাকে সাড়া দিল না। এমতাবস্থায় তিনি তায়েফ গেলেন। সেখানে তায়েফের সর্দারদের কাছে তিনি একই কথা ব্যক্ত করলেন। তাদের কেউ তার কথায় কর্ণপাতই করল না। উপরন্তু তারা দুষ্ট শিশুদের তার বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিল। এমতাবস্থায় যা ঘটার তা-ই ঘটল। তারা তাকে পাথর মেরে রক্তাক্ত করে দিল। তিনি মক্কায় ফিরে আসলেন। মহান আল্লাহ্ তাকে সম্মানিত করতে চাইলেন। তিনি তাকে ইসরা ও মি‘রাজের মত বিরল সম্মানে সম্মানিত করলেন।

ইসরা ও মি‘রাজের সংক্ষিপ্ত কাহিনী

রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কাবা শরীফের হিজ্‌র বা হাতীমে শোয়া ছিলেন। তার সাথে আরও দু’জন শোয়া ছিলেন। কোন কোন বর্ণনায় তাদের নাম এসেছে, হামযাহ ও জা‘ফর। এমতাবস্থায় তিন ফেরেশতা এসে বললেন, এদের মধ্যে কোনটি সে লোক? একজন বলল, মাঝখানে যিনি শুয়ে আছেন তিনি। তারপর তারা চলে গেলেন। পরবর্তী দিন রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রাতের সালাত আদায় করে নিজ ঘরে ঘুমিয়ে ছিলেন। এমতাবস্থায় ঘরের ছাদ ভেদ করে ফেরেশতাগণ অবতরণ করলেন। জিবরাঈল আলাইহিস সালাম রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে যমযমের কাছে নিয়ে গেলেন। তারপর তার “সাক্কুস সাদর” বা বক্ষ বিদীর্ণ করলেন। তারপর তাকে যমযমের পানিতে ধুয়ে আবার যথাস্থানে লাগিয়ে দিয়ে বক্ষ মিলিয়ে দিলেন।

এরপর বুখারীর বর্ণনায় এসেছে, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নিয়ে আকাশের দিকে যাত্রা করা হয়। সেখানে প্রথম আকাশে আদম, দ্বিতীয় আকাশে ঈসা ও ইয়াহইয়া, তৃতীয় আকাশে ইউসুফ, চতুর্থ আকাশে ইদরীস, পঞ্চম আকাশে হারূন, ষষ্ট আকাশে মূসা এবং সপ্তম আকাশে ইবরাহীম আলাইহিমুস সালাম এর সাথে সাক্ষাত করেন। সেখানে তিনি বাইতুল মা‘মুর দেখতে পেলেন। সেখানে তাকে দুধ, মধু ও মদ এ তিনপ্রকার পানীয় দেয়া হয়। তিনি দুধ পছন্দ করে নেন। তখন জিবরীল বললেন যে, আপনি স্বাভাবিক বিষয় গ্রহণ করতে সমর্থ হলেন। তারপর তিনি সিদরাতুল মুন্তাহায় নীত হলেন। তারপর এত উচুতে গেলেন যে, কলমের লিখার খসখস আওয়াজ শুনতে পেলেন। এরপর আল্লাহ্ তার ও তার উম্মতের উপর পঞ্চাশ ওয়াক্ত সালাত ফরয করে দিলেন।

এরপর মুসা আলাইহিস সালাম এর কাছে আসার পর তিনি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সালাতের ব্যাপারে আল্লাহ্‌র কাছে কমানোর আবেদন করার পরামর্শ দিলেন। প্রথমে অর্ধেক, তারপর পাঁচ ওয়াক্ত পর্যন্ত কমানো হয়। অপর বর্ণনায়, প্রতিবারে পাঁচ, বর্ণনান্তরে দশ করে কমানোর পর সবশেষে পাঁচ ওয়াক্ত সালাতে এসে তা শেষ হয়। এরপর তিনি দুনিয়াতে ফেরত আসেন। অন্য বর্ণনায় এসেছে যে, সফরের শুরুতে বোরাক নিয়ে আসা হয়। ‘বোরাক’ বাইতুল মুকাদ্দাসের দিকে সফর করে। সেখানে তিনি নবীদের ইমামতি করেন। তারপর তাকে সেখানে তাকে দুধ মধু ও মদ এ তিনপ্রকার পানীয় দেয়া হয়। তিনি দুধ পছন্দ করে নেন। তখন জিবরীল বললেন যে, আপনি স্বাভাবিক বিষয় গ্রহণ করতে সমর্থ হলেন। তারপর তার জন্য মি‘রাজ বা সিড়ি নামিয়ে দেয়া হলে তিনি তাতে করে আকাশে গমন করলেন।

ইসরা ও মি‘রাজের ফলাফল:

১) ইসরা ও মি‘রাজের মাধ্যমে মহান আল্লাহ্ তার রাসূলকে বান্দা হিসেবে গ্রহণ করেছেন। এটি সৃষ্টিজগতের কারও জন্য সবচেয়ে বড় পাওয়া। মহান আল্লাহ্ বলেন: “পবিত্র ও মহান সে সত্ত্বা যিনি তাঁর বান্দাকে সফর করিয়েছেন রাতের একাংশে মাসজিদুল হারাম থেকে মাসজিদুল আকসার দিকে, যার চতুস্পার্শকে তিনি করেছেন বরকতময়। যাতে তিনি তাকে দেখাতে পারেন তাঁর নিদর্শনসমূহ। নিশ্চয় তিনি সর্বশ্রোতা সর্বদ্রষ্টা।” [আল-ইসরা:১]

২) ইসরা ও মি‘রাজের মাধ্যমে এটা প্রমাণিত হয়েছে যে, নবীগণ সবাই বৈমাত্রেয় ভাই। তাদের মিশন একটিই সেটি হলো, একমাত্র আল্লাহ্‌র ইবাদত প্রতিষ্ঠা করা।

৩) রাতের একটি অংশে ইসরা ও মি‘রাজ সংঘটিত হওয়ার মধ্যে এটাই উদ্দেশ্য যে, মহান আল্লাহ্র কাছে রাতের কাজই বেশী পছন্দ। কারণ তখন প্রকৃতি শান্ত থাকে। কাজে মন বসে। ইবাদতে একনিষ্ঠতা ও একাগ্রতা অর্জিত হয়।

৪) সূরা আল-ইসরার প্রথমে سُبۡحَٰنَ ٱلَّذِيٓ أَسۡرَىٰ বলার পরে নবম আয়াতে কুরআনের মাধ্যমে কারা হিদায়াত প্রাপ্ত হবে তাদের কথা আলোচনা করা হয়েছে। এ দুয়ের মাঝখানে ইয়াহূদীদের উপর আপতিত শাস্তি ও তাদের জাতীয় চরিত্রের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। এর মাধ্যমে এটাই বোঝানো হয়েছে যে, ইয়াহূদী ও নাসারাদের দীনের দাবী শেষ হয়ে গেছে এখন কুরআনের দিন এসেছে।

৫) ইসরা ও মি‘রাজে নবীদের ইমামতির মাধ্যমে এ বিষয় প্রমাণিত হলো যে, সমস্ত নবীর নবুওয়তের মাধ্যমে প্রাপ্ত শরী‘আত শেষ হয়েছে। এখন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুওয়ত ও তারই শরীয়ত চলবে। আর তার শরীয়তই সর্বশেষ শরী‘আত। তিনিই শেষ নবী ও রাসুল।

৬) দুই কেবলার ইমামতি ও নেতৃত্ব মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তার উম্মতদের জন্য নির্ধারিত হয়ে গেছে। এ দু’টির মালিকানা তাদেরই।

৭) এর মাধ্যমে মহান আল্লাহ্ এটাই প্রমাণ করতে চেয়েছেন যে, দুনিয়ার মানুষ আপনাকে সম্মান করতে কমতি করলেও আকাশে যারা আছে তারা আপনাকে সবচেয়ে বেশী সম্মানিত করে গ্রহণ করে নিচ্ছে। দুনিয়াতে মানুষের কর্মকাণ্ডে আপনি দুঃখিত হলেও আকাশে আপনাকে সাদর সম্ভাষণ জানানোর জন্য অনেকেই রয়েছেন। সর্বোপরি মহান আল্লাহ্ আপনাকে ছেড়ে যাবেন না।

৮) সালাত এমনই এক গুরুত্বপূর্ণ রুকন যার ফরয হওয়ার ঘোষণা কোন মাধ্যম ছাড়াই সরাসরি আল্লাহ্ ঘোষণা করেছেন। আর যা দুনিয়াতে ফরয না করে আকাশে প্রিয় নবীকে ডেকে এনে জানিয়ে দিয়েছেন। এটা যেন উম্মতের জন্য এক হাদীয়া। সে হাদীয়া যেন মাটিতে দেয়া যেত না, আকাশেই দিতে হবে।

৯) এর ফলে হিজরতের পথ প্রসারিত হলো, এর মাধ্যমে জানানো হলো যে, মূসা আলাইহিস সালামের উম্মতের চেয়েও তার উম্মত বেশী হবে। ফলে এর মাধ্যমে দাওয়াতের নতুন ক্ষেত্র আবিস্কৃত হবে এটাই বোঝা গেল।

১০) কারও রক্তচক্ষুর ভয় না করে হকের কথা বলতে সদা সচেষ্ট থাকা। যেমন রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মে‘রাজের কথা সবাইকে জানিয়েছিলেন। সুতরাং বীরত্বপূর্ণ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করাও এর লক্ষ্য ছিল।

১১) কারা ঈমানদার ও কারা বেঈমান বা দুর্বল ইমানের অধিকারী সেটা পরিস্কার হয়ে যাওয়া। মহান আল্লাহ বলেন: “আর আমরা আপনাকে যে দৃশ্য দেখিয়েছিলাম, তা তো কেবল মানুষকে পরীক্ষা করার জন্যই।” [সূরা আল-ইসরা: ৬০]

কারণ, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নতুন মিশনে যাচ্ছেন। সেখানে পাক্কা ইমানদারদের প্রয়োজন হবে।

১২) আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুর ঈমানের দৃঢ়তা এখানে প্রকাশ পেল। তিনি নির্দ্বিধায় সেটার উপর ঈমান এনেছিলেন

১৩) বিভিন্ন অপরাধের শাস্তি কেমন হতে পারে সেটার এক নির্দেশনা পেলে মানুষের পক্ষে দ্বীন ও ঈমানের উপর মজবুতি আসবে।

১৪) দুধ পান করা ও মদ থেকে দুরে থাকার মাধ্যমে ইসলাম যে স্বাভাবিক দ্বীন সেটা প্রমানিত হলো।

১৫) মাসজিদুল আকসা সমস্ত মুসলিমের সম্পদ। যেখানে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সালাত আদায় করেছেন। ইমামতি করেছেন। আকাশে আরোহন করেছেন। সেখানে গেলে সওয়াব হওয়া কথা ঘোষণা করেছেন। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, বাইতুল মুকাদ্দাসের মুক্তির সাথেই মুসলিম উম্মাহর সম্মান ও প্রতিপত্তি নিহিত।

আমাদের করণীয়:

১) ঈমান বিল গায়েব। আবু বকরের মত ঈমানদার হওয়া। ইসরা ও মি‘রাজের প্রমাণিত কোন কিছুকে অস্বীকার না করা। করলে কুফরী হবে।

২) সালাতের ব্যাপারে গুরুত্ব দেয়া। কারণ, এ সালাত আকাশে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ডেকে সম্মানের সাথে প্রদান করা হয়েছে। দুনিয়ার কোন স্থানে বা অন্য কোন মাধ্যমে সেটা ফরয করা হয়নি।

৩) মি‘রাজের রাত্রিতে পবিত্র কুরআনের সূরা আল-বাকারার শেষ দু’টি আয়াতও রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে প্রদান করা হয়েছে। সে দু’টি আয়াত পাঠ করা এবং বাস্তব জীবনে সেগুলোর প্রচার ও প্রসার করা প্রয়োজন।

৪) বাইতুল মুকাদ্দাসকে মুক্ত করার জন্য সচেষ্ট থাকা।

যা করণীয় নয়:

১) যেহেতু এ রাত্রি নির্ধারনের ব্যাপারে সহীহ কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় নি, সেহেতু তা নির্ধারণ থেকে বিরত থাকা।

২) শুধুমাত্র এ রাত্রিকে নির্ধারণ করে বা কেন্দ্র করে কোনো প্রকার ইবাদত করা।

৩) শুধুমাত্র এ রাত্রে বা এ দিনকে কেন্দ্র করে কোন সালাত বা সাওম রাখা।

একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য ইলম অর্জন করা

অনুবাদ: আলী হাসান তৈয়ব | সম্পাদনা: ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া

ইলম হাসিলে নিয়ত খাঁটি করা

যাবতীয় প্রশংসা কেবল আল্লাহর জন্য। দরূদ ও সালাম বর্ষিত হোক মানবতার মুক্তিদূত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর। তাঁর পরিবার, সকল সাহাবী ও ঈমানদার উম্মতের ওপর। হামদ ও সালাতের পর কথা হলো, এটি জ্ঞান অন্বেষণকারী সম্পর্কিত ধারাবাহিক আলোচনার তৃতীয় কিস্তি। এতে আমি ইখলাস সম্পর্কে আলোচনা করার প্রয়াস পাব। আল্লাহ তা‘আলা বলেন: ‘আর তাদেরকে কেবল এই নির্দেশ দেয়া হয়েছিল যে, তারা যেন আল্লাহর ‘ইবাদাত করে তাঁরই জন্য দীনকে একনিষ্ঠ করে।’ {সূরা আল-বাইয়িনাহ্‌, আয়াত : ০৫}

পূর্বসুরী একজন মনীষী বলেন: ‘দুনিয়ার মধ্যে সবচে মূল্যবান বিষয় হলো ইখলাস। আমার অন্তর থেকে রিয়া বা লোক দেখানোর মানসিকতা তাড়াতে কত চেষ্টাই না করেছি; কিন্তু মনের সে নতুন রঙে গজিয়ে ওঠে।’ [1]

পূর্বসুরী মনীষী ও বুযুর্গগণ তাদের দো‘আয় বলতেন: ‘হে আল্লাহ আমি আপনার কাছে ওই কাজের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করছি, যা থেকে আমি তাওবা করেছি অতপর আবার তার পুনরাবৃত্তি ঘটিয়েছি। আমি সেই বিষয়ের জন্য আপনার কাছে মার্জনা প্রার্থনা করছি যা আমার অন্তরে কেবল আপনার জন্যই স্থাপন করেছি অতপর তার ব্যাপারে আপনার সঙ্গে বিশ্বস্ততার প্রমাণ দিতে পারি নি। আমি সেই বিষয়ের জন্যও আপনার কাছে মাফ চাইছি, যা কেবল আপনাকেই সন্তুষ্ট করতে চেয়েছি বলে ধারণা করেছি, অতপর তার সঙ্গে আমার অন্তরে তা মিশে গেছে যা সম্পর্কে আপনি অবগত।[2]

নিয়তের এই গুরুত্ব ও মাহাত্ম্যের কথা ভেবেই আমি আজ আলোচনার বিষয় নির্ধারণ করেছি ইলম অন্বেষণে নিয়ত খাঁটি করা, এর স্তম্ভসমূহ, অবস্থাদি ও প্রতিবন্ধকতাসমূহ ইত্যাদি। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা, তিনি যেন এই ধারাবাহিকটি শেষ করার তাওফীক দান করেন। কারণ, আমার প্রত্যাশা, এটি সকলের জন্য উপকারী হবে আর তাদের মধ্যে আমিই সর্বপ্রথম। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা, তিনি আমাদেরকে তাঁদের মধ্যে শামিল করেন যারা মনোযোগ দিয়ে কথা শোনে এবং তার উত্তমটি অনুসরণ করে। যাদের কথাগুলো কর্মের মাধ্যমে সত্যে প্রতিফলিত হয়। তিনি আমাদেরকে সত্যবাদী ও মুখলিস মুমিনদের অন্তর্ভুক্ত করুন। এ পর্যায়ে আমরা মূল আলোচনা শুরু করতে পারি :

প্রথমত : ইখলাসের তাৎপর্য

অনেকে ইখলাস শব্দ শুনে ভাবেন ইখলাস বলতে বুঝায় এমন কিছু বলা যে, আমি আল্লাহর জন্য শেখার নিয়ত করেছি বা ইত্যাকার কিছু। আসলে এ ব্যক্তির দৃষ্টান্ত ওই ক্ষুধার্থ ব্যক্তির ন্যায় যার সামনে খাবার উপস্থিত, আর সে বলে, আমি খাওয়ার নিয়ত করেছি। এমন বললে কি সেই ব্যক্তি তৃপ্ত হয়ে যাবেন? তার ক্ষুধা নিবারিত হয়ে যাবে? কিংবা ওই তৃষ্ণার্ত ব্যক্তির ন্যায় যে বলে, আমি পান করার ইচ্ছা করেছি। এতে কি তার তৃষ্ণা উধাও হয়ে যাবে? শপথ আল্লাহর তা কখনো হবার নয়। তেমনি ইখলাসও তা কেবল বলার নাম নয়। বরং তা এক ভিন্ন জিনিস।

ইখলাস হলো, অন্তরকে কাঙ্ক্ষিত দিকে পুরো মাত্রায় অভিমুখী করা। কেউ বলেন, অন্তরের চক্ষুকে আল্লাহ ছাড়া অন্য সবার থেকে বন্ধ করে নেওয়া। বলা হয়েছে, ইখলাস হলো, আল্লাহ ও বান্দার মধ্যে এক গোপন ব্যাপার। কোনো ফেরেশতা তা জানতে পারেন না যে তিনি লিখবেন, কোনো শয়তানও নয় যে তা বিনষ্ট করবে কিংবা প্রবৃত্তিও নয় যে তাকে অন্য কোনো দিকে ধাবিত করবে। অতএব ইখলাস হলো কর্মকে মাখলূক বা সৃষ্টির পর্যবেক্ষণ থেকে পরিচ্ছন্ন রাখা। সুতরাং আপনি যখন ইবাদতে একমাত্র আল্লাহকেই একক দ্রষ্টা ও লক্ষ্য ঠিক করবেন এবং খালেক বা স্রষ্টার প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করে মানুষের দৃষ্টির কথা একেবারে ভুলে যাবেন তখনই কেবল আপনার ইখলাস বাস্তব রূপ লাভ করবে। ইমাম বুখারী তদীয় সহীহ গ্রন্থে ঈমান অধ্যায়ে উল্লেখ করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: ‘আমল (কবুল হবে) নিয়ত অনুযায়ী। প্রত্যেকে তাই পাবে যা সে নিয়ত করবে। অতএব যার হিজরত হবে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উদ্দেশ্যে, তার হিজরত আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দিকে হয়েছে বলে গণ্য হবে। পক্ষান্তরে যার হিজরত হবে দুনিয়া লাভের আশায় কিংবা কোনো নারীকে বিয়ের অভিপ্রায়ে, তবে তার হিজরত যাকে উদ্দেশ্য করে তার জন্যই গণ্য হবে।‘ [3]

দ্বিতীয়ত : কেন আমরা ইলম শিখব? কেন আমরা ফিকহ অর্জন করব? কেন আমরা ইলম হাসিল করব?

ইলম হলো ইবাদতসমূহের একটি। নেকীগুলোর অন্যতম। তা অর্জনে তাই নিয়ত শুদ্ধ হলে কবূল করা হয় এবং তা বৃদ্ধি করা হয়। তার বরকত বর্ধিত হয়। আর যদি আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো সন্তুষ্টি হাসিলের উদ্দেশ্যে ইলম শেখা হয় তবে তা নিক্ষেপ করা হয়। তা অকেজো হয়ে যায় এবং তার মূল্য কমে যায়। ইমাম তিরমিযী তদীয় জামে গ্রন্থে বলেন, ইবন কা‌‘ব ইবন মালেক তদীয় পিতা থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, তিনি ইরশাদ করেন: ‘যে ব্যক্তি আলেমদের সঙ্গে বিতর্ক করার জন্য কিংবা অজ্ঞদের জব্দ করার উদ্দেশ্যে অথবা নিজের প্রতি মানুষের দৃষ্টি কাড়ার অভিপ্রায়ে ইলম শেখে, আল্লাহ তাকে (জাহান্নামের) অগ্নিতে প্রবেশ করাবেন। [4]

আবদুল্লাহ ইবন উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘যে ব্যক্তি ইলম হাসিল করে অজ্ঞদের জব্দ করার উদ্দেশ্যে কিংবা আলেমদের সঙ্গে বিতর্ক করার জন্য অথবা নিজের প্রতি মানুষের নজর কাড়ার অভিপ্রায়ে, সে (জাহান্নামের) অগ্নিতে থাকবে[5]

এই গুরুত্বপূর্ণ হাদীসগুলো জ্ঞান অন্বেষণকারীকে এ মর্মে সতর্ক করে যে, সে যেন ইলম শিখতে নিজের নিয়তকে শুদ্ধ করে। অতএব একমাত্র আল্লাহর জন্য তা শিখবে। তাঁরই সন্তুষ্টি তালাশ করবে। তাঁর কাছেই নেকীর প্রত্যাশা রাখবে। মানুষের দৃষ্টিতে উঁচু হওয়া অথবা তাদের কাছ থেকে মর্যাদা লাভের নিয়তে ইলম শিখবে না।

তৃতীয়ত : ইলম হাসিলের উপায় :

ইলম অর্জনের স্বীকৃত দুটি উপায় রয়েছে :

১. কিতাব:  প্রত্যেক জ্ঞান অন্বেষণকারীর জন্য এটি মেরুদণ্ড এবং ইলম হাসিলের মৌলিক মাধ্যম স্বরূপ। কিতাবের কিছু আদব আছে জ্ঞান অন্বেষণকারীর যা না জানলেই নয়। সম্ভব হলে আমরা এ বিষয়ে একটি স্বতন্ত্র আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ।

২. শায়খ বা শিক্ষক: আপনি কি জানেন শায়খ কী?

তিনি হলেন পিপাসার্তের জন্য ঠাণ্ডা পানির মতো। ডুবন্ত ব্যক্তির জন্য পরিত্রাণের রশি। তিনি ছাড়া ইলম হাসিল সঠিক হয় না। আগে বলা হত: ‘যার কিতাবই হয় তার শিক্ষক, তার সঠিকের চেয়ে ভুলই হয় বেশি’ ।

অবশ্য জ্ঞান অন্বেষণকারীগণ পরবর্তী পর্যায়গুলোয় কিতাব থেকে বিদ্যা আহরণে নিজের ওপর নির্ভর করতে পারে। কারণ এ পর্যায়ে সে আমার দৃষ্টিতে মৌলিক বিদ্যাসমূহের চাবিগুলোর কর্তৃত্ব লাভ করে। তবে এ ক্ষেত্রেও তার জন্য একজন স্নেহপরায়ন শিক্ষকের উপস্থিতি শ্রেয়।  যাতে কঠিন ও দুর্বোধ্য বিষয়গুলোয় সে তাঁর দিক নির্দেশনা এবং নির্দেশিকা গ্রহণ করতে পারে। জ্ঞান অন্বেষণকারীর আরেকটি কর্তব্য, অধিক জ্ঞানী, মুত্তাকী ও পরহেযগার শিক্ষক গ্রহণ করা। কেননা ইবন সীরীন, মালেক ও প্রমুখ পূর্বতন মনীষীবৃন্দ বলেন: ‘এই ইলম একটি দীন স্বরূপ, অতএব তোমরা কাদের কাছ থেকে তোমাদের দীন গ্রহণ কর তা খেয়াল রেখ[6]

জ্ঞান অন্বেষণকারীকে তার শিক্ষাগুরুর সঙ্গে কিছু অবশ্য পালনীয় মহৎ আদব ও শিষ্টাচারের প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে। আশা করছি এ বিষয়েও আমরা স্বতন্ত্র আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ।

চতুর্থত: জ্ঞান অন্বেষণকারী কিভাবে তার নিয়ত সহীহ করবে ?

একজন জ্ঞান অন্বেষণকারী যখন তার নিয়তকে পরিশুদ্ধ করতে চাইবেন তাকে নিম্নোক্ত বিষয়গুলোর প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে :

. সঠিক নিয়তইমাম বুখারী তদীয় সহীহ গ্রন্থে লিখেন, উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: ‘আমল (কবুল হবে) নিয়ত অনুযায়ী। প্রত্যেকে তাই পাবে যা সে নিয়ত করবে। অতএব যার হিজরত হবে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উদ্দেশ্যে তার হিজরত আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দিকে হয়েছে বলে গণ্য হবে। পক্ষান্তরে যার হিজরত হবে দুনিয়ার লাভের আশায় কিংবা কোনো নারীকে বিয়ের অভিপ্রায়ে, তবে তার হিজরত যাকে উদ্দেশ করে তার জন্যই গণ্য হবে।’  [7]

নিয়ত সম্পর্কে তোমার সাহায্য চাই হে আল্লাহ তোমার সাহায্য চাই। কেননা, অনেক ছোট আমল আছে যা তার নিয়তের বদৌলতে বড় হয়ে যায় আবার অনেক বড় আমল আছে যা তার নিয়তের দরুণ ছোট হয়ে যায়। যেমন ইয়াহইয়া ইবন আবী কাছীর বলেন, ‘তোমরা নিয়ত শিক্ষা কর। কারণ তা আমলের চেয়েও বেশি  গুরুত্বপূর্ণ।’ বলাবাহুল্য, বর্তমান প্রাচ্য ও প্রতীচ্যে উম্মাহর বিপর্যয়ের রহস্য হলো নিয়তে ইখলাস না থাকা!

এখন তোমাদের সামনে যুক্তি তুলে ধরা যাক। অতএব ইলম শিক্ষা করার সময় যদি জ্ঞান অন্বেষণকারীর নিয়ত সঠিক হয় এবং সে তার নিয়তের বিশুদ্ধতা অটুট রাখে সেই অবধি যতদিন সে একজন গণ্যমান্য বিদ্বানে পরিণত হয়। লোকেরা যার শরণাপন্ন হয়। তখন তিনি দ্ব্যর্থহীনভাবে সত্য তুলে ধরেন। আল্লাহর কথা বলতে গিয়ে তিনি ভর্ৎসনাকারীর ভর্ৎসনার পরোয়া করেন না। এভাবেই যদি সব আলিমই এ পথ অবলম্বন করেন তবে শাসক আর রাষ্ট্রপরিচালকরা কি এমন কাউকে খুঁজে পাবেন যারা কি-না দীনের বিষয়ে এমন ফতোয়া প্রদান করেন যাতে রাব্বুল আলামীন সন্তুষ্ট হন না ? তবেই তো দীন বিজয়ী হবে। আর মুসল্লীদের কাছে তার কোনো কাজকে বিতর্কিত মনে হবে না।

আর শাসকগণের নিয়ত যদি ঠিক হয়ে যায় তবে তো তাঁরা মানবজীবনের কল্যাণ সাধনায় সকল চেষ্টা নিয়োগ করতেন। এতে করে কল্যাণ ও শান্তি ব্যাপক হতো। যেমন বলা হয়েছে, ‘যদি শান্তি না থাকত তবে মানুষ ধ্বংস হয়ে যেত।’ সন্দেহ নেই নিয়তই হলো প্রকৃত অনুঘটক ও চালিকাশক্তি যা তোমার বোধ ও উপলব্ধিতে সুপ্ত থাকে। তাই তুমি ছাড়া কেউ সে সম্পর্কে অবগত হতে পারে না। যেমন তুমি এখন ইলম অন্বেষণ করছো, বলতে পারো কোন জিনিস তোমাকে এতে উদ্বুদ্ধ করেছে? সামাজিক মর্যাদা অর্জনের উদ্দেশ্য? নাকি এ জন্য যে মানুষ তোমার ব্যাপারে বলবে, এ একজন অসাধারণ জ্ঞান অন্বেষণকারী, নাকি বিশ্ববিদ্যালয়ে সফল হওয়ার জন্য, নাকি ওই সনদের জন্য যাকে তুমি শো কেসে সাজিয়ে রাখবে? ইবনু জামা‘আ রহ. বলেন, ‘ইলম অন্বেষণের সুন্দর নিয়ত হলো, তা দ্বারা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন, তদনুযায়ী আমল, নিজের হৃদয়কে আলোকিত করা, অন্তর্লোককে সুসজ্জিত করা, কিয়ামতের দিন আল্লাহর নৈকট্য লাভ এবং তিনি যে এর অধিবাসীর জন্য নিজের সন্তুষ্টি ও বিশাল মর্যাদা প্রস্তুত রেখেছেন তার উপযুক্ত হওয়া ইত্যাদি।’

সুফিয়ান ছাওরী রহ. বলেন: ‘আমি নিজের জন্য নিয়তের চেয়ে কঠিন আর কিছুর চিকিৎসা আমি করি নি।’

সুতরাং নিয়তই আসল। আল্লাহ হলেন হিসাবগ্রহীতা ও পর্যবেক্ষণকারী। তিনি গোপন ও অন্তরগত বিষয়াদি সম্পর্কে ওয়াকিফহাল। কোনো গোপনই তাঁর কাছে গোপন নয়। কত আমলকেই তো দুনিয়ার আমলের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ হওয়ায় দুনিয়াবী আমল ধারণা করা হয়, অথচ তা সুন্দর নিয়তের কারণে আখিরাতের আমল হয়ে যায়। আবার কত আমলকেই তো আখিরাতের আমলের সঙ্গে মিল থাকায় আখিরাতের আমল বলে মনে করা হয়। অথচ নিয়তের অশুদ্ধির কারণে তা দুনিয়ার আমলে পরিণত হয়। অতএব খুব সতর্ক থেকো।

. আখিরাতকে লক্ষ্য বানানো: পার্থিব কোনো বস্তু অর্জনকে কখনো ইলমের হাসিলের উদ্দেশ্য বানানো যাবে না। যেমন নেতৃত্ব, পদ বা সম্পদ লাভ কিংবা সমবয়সীদের সঙ্গে গর্ব করা, মানুষের সম্মান লাভ করা কিংবা মসলিসের মধ্যে সভাপতিত্ব লুফে নেওয়া ইত্যাদি। তাহলে তা হবে শ্রেয়তরের বিনিময়ে নিম্নতন কিছুকে টার্গেট বানানো। অন্যথায় খারাপ জিনিসও ভালোয় পরিবর্তিত হবে। আবূ ইউসুফ রহিমাহুল্লাহ বলেন, হে আমার সম্প্রদায়, তোমরা ইলমের লক্ষ্য বানাও আল্লাহ তা‘আলাকে। কেননা আমি যে মজলিসেই বসেছি নিজেকে আল্লাহর কাছে বিনীত বানানোর উদ্দেশ্যে, সেখান থেকে আমি উঠেছি তাদের মধ্যে সবচে মর্যাদাবান হয়ে। আর যে বৈঠকেই অংশ নিয়েছি নিজে মর্যাদাবান হবার নিয়তে সেখান থেকে কখনো লাঞ্ছিত না হয়ে উঠি নি। অতএব হে আমার ঈমানের ভাই, তোমার উচিত নিজের নিয়তকে খাঁটি বানানো, অন্তরকে রিয়া তথা লোক দেখানোর মানসিকতা থেকে মুক্ত করা এবং মনোযোগ কেবল দেয়া উচিত আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের প্রতি। তাহলে তুমি দুনিয়া ও আখিরাত উভয় জগতের কল্যাণ লাভ করতে পারবে। অন্যথায় কেবল ক্ষতি, ধ্বংস আর জনপদের বিলুপ্তি।

৩. আল্লাহর আনুগত্য:  কারণ ইলম এমন এক রিযক যা গুনাহ সমেত  লাভ করা যায় না : আবূ উমামা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: ‘নিশ্চয় রুহুল কুদুস (জিবরাঈল আলাইহিস সালাম) আমার অন্তরে ফুঁ দিয়েছেন যে, কোনো প্রাণই তার আয়ু পূর্ণ না করে এবং তার রিযক শেষ না করে মৃত্যু বরণ করবে না। অতএব তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং উত্তম পন্থায় (রিযক) অন্বেষণ করো। আর রিযকের ধীর গতি যেন তোমাদেরকে তা আল্লাহর অবাধ্য হয়ে তালাশে উদ্বুদ্ধ না করে। কারণ আল্লাহর কাছে যা আছে তা কেবল তাঁর আনুগত্যের মাধ্যমেই অর্জন করা যায়। [8]

জেনে রাখ হে আমার ঈমানের ভাই, তুমি কিন্তু আল্লাহর কাছে প্রাচুর্য প্রার্থনা করছো, আর আল্লাহর কাছে যা আছে তা কেবল তাঁর আনুগত্যের মধ্য দিয়েই লাভ করা যায়।

৪. রিয়া থেকে দূরে থাক: আবদুল্লাহ আনতাকী বলেন, ‘যে ব্যক্তি প্রকাশ্য আলমগুলোয় ইখলাস তালাশ করে আর সে তার উল্টো পীঠে সৃষ্টির প্রতি লক্ষ্য রাখে তবে সে যেন অসম্ভব কিছু পাবার প্রত্যাশা করে। কেননা, ইখলাস হলো প্রাণভোমরা, যার ওপর তার হায়াত। আর রিয়া তাকে মেরে ফেলে।’

অতএব ইখলাস ছাড়া আখিরাতে নাজাত লাভ, দুনিয়াতে ইলম দ্বারা উপকৃত হওয়া বা উপকার করা সম্ভব নয়। আল্লাহ আপনাকে আমাকে ইখলাস নসীব করুন। আমীন।

৫. নিফাক থেকে বেঁচে থাকা: এমনভাবে মুনাফিক হওয়া থেকে সাবধান থাক যে তুমি জানতেও পারলে না। এমনভাবে দেখিয়ে কাজ করলে যে তুমি তা ঠিক জানতেও পারলে না। গোপন লিপ্সা থেকে সতর্ক থাক। কেননা অনেক জ্ঞান অন্বেষণকারীর পতন হয়েছে এই গোপন বাসনা সম্পর্কে উদাসীন হওয়ার কারণে। আর এটি আল্লাহর কাছে কবীরা গুনাহর অন্তর্ভুক্ত। সম্ভবত তা যিনা ও মদ পানের চেয়েও বড়। আর এই গোপন বাসনাগুলো জ্ঞান অন্বেষণকারী মাত্রকেই হামলা করে। চাই তিনি ছোট হোন বা বড় কিংবা খ্যাতিমান বা অখ্যাত। এটি তার আমলকে বিনষ্ট করে দেয়। তার উদ্দেশ্যকে বরবাদ করে দেয়। আল্লাহ আপনাদের আমাদের এ থেকে মুক্তি দান করুন।

আর গোপন বাসনা হলো, পদ-মর্যাদা ও প্রদর্শনপ্রিয়তার লিপ্সা, মানুষের সম্মান ও ভক্তি অর্জনের লিপ্সা, প্রশংসা অর্জন এবং লোকেরা আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেবে সেই বাসনা। ইলম গ্রহণের বিপদ হলো তাকে জাগতিক স্বার্থগুলোর মধ্যে কোনো স্বার্থ উদ্ধারের উপায় বানানো। যেমন ব্যক্তিগত ইমেজ নির্মাণ, মানুষের মধ্যে বড় হবার বাসনা, অন্যদের চেয়ে নিজেকে বেশি সম্মানিত ভাবা, অন্যকে হীন জ্ঞান করা এবং অন্যের কুৎসা গাওয়া। নেতৃত্বপ্রিয়তা, মানুষ তাকে নিয়ে ব্যস্ত থাকুক এবং তার অনুগত হোক সেই প্রবৃত্তি। অতপর পরিণাম হবে : বড়ত্ব, অহমিকা, বড়াই, আমিত্ব, স্বার্থপরতা, নফসের দাসত্ব, তার জন্য বিজয়ী হওয়া, তার জন্য রাগান্বিত হওয়া এবং প্রবৃত্তির গোলামী। আর আল্লাহর শপথ, এসব হলো এমন বিপদ –আল্লাহ আমাদের রক্ষা করুন- যদ্বারা তোমার ঈমানের আকাশ তার ভূমিতে পতিত হয়। ফলে আত্মার কোনো দৃঢ় ভিত থাকে না। আল্লাহর শপথ, এই আত্মার ব্যাধির নামগুলো গণনা করতেও হৃদয় কেঁপে ওঠে। আল্লাহ আপনাদের আমাদের এ থেকে মুক্তি দান করুন।

আল্লাহর শপথ, রিয়া এবং গোপন প্রবৃত্তির ব্যাপারটিই বড় ভয়ঙ্কর বিপদ, সবচে বড় মুসীবত। কেননা নিয়তের অশুদ্ধি রিয়া ও শিরক জন্ম দেয়। আর রিয়া হলো মুনাফেকীর প্রবেশদ্বার। আর গুনাহ হলো অপকর্মের দূত। আর এ দুটি হলো কুফুরির সুরঙ্গ।

৬. দম্ভ ও অহংকার থেকে বেঁচে থাকা: আমি বারবার পুনরাবৃত্তি করছি কথাটা, দম্ভ ও অহংকার থেকে বেঁচে থাক। কারণ এটি জ্ঞান অন্বেষণকারীর জন্য প্রাণ সংহারক বিষের মতো। আল্লাহর শপথ করে বলছি, যে জ্ঞান অন্বেষণকারীই বিনয়ী হয়েছে, আল্লাহ তার মর্যাদা বুলন্দ করেছেন। আর যে জ্ঞান অন্বেষণকারীই দম্ভ বা অহংকারে আক্রান্ত হয়েছে, আল্লাহ তার ইলমের বরকত উঠিয়ে নিয়েছেন। আল্লাহর শপথ করে আরো বলছি, এটি সর্ব যুগের সর্বকালের অভিজ্ঞতালব্ধ কথা। অতএব কথাটাকে হেলায় গ্রহণ করো না, তাহলে তুমি ধ্বংসপ্রাপ্তদের দলে চলে যাবে।

আর জেনে রাখ, (আল্লাহ তোমাকে কল্যাণের পথ দেখান) গর্ব ও অহংকার তোমাকে দাওয়াত এবং মানুষের হেদায়াতের পথ থেকে সরিয়ে সমবয়সীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামিয়ে দেবে। যা থেকে পরস্পর হিংসা, বিদ্বেষ ও শত্রুতায় জড়িয়ে পড়বে।

. আমল এবং আমল: আমল হলো উপকারী ইলমের সুস্বাদু ফলস্বরূপ। কেননা ইলমের সঙ্গে যদি আমল অর্জিত না হয় তবে তা হবে নিষ্ফল ইলম। অতএব উপদেশ হলো, নিয়ত ঠিক না করতে পারলে এই জ্ঞান অন্বেষণকারী অন্য আরেকটি জিনিসের জন্যই যাবে যার সুফল রয়েছে। যেমন ব্যবসা, এর প্রাপ্তি হলো মুনাফা ও সম্পদ। এটি হতে পারে তার জন্য ইলম হাসিলের চেয়ে বেশি লাভজনক হবে। বলাবাহুল্য, আমলের মধ্যে রয়েছে মন্দ সকল কাজ পরিহার এবং সকল ভালো কাজ সম্পাদন করা।

. সবর বা ধৈর্য-সহিষ্ণুতা: আমি সবরের দ্বারা বুঝাতে চাচ্ছি ইলম হাসিলের পথে যে ধৈর্যের পরিচয় দিতে হয় তাকে। যেমন শিক্ষক যখন অপ্রত্যাশিত আচরণ করেন। তেমনি মুখস্থ করতে গিয়ে সবর করা, যখন তা মুখস্থ হতে না চায় এবং রিযিক স্বল্পতায় সবর করা, কারণ ইলম অর্জনে ব্যস্ততা সাময়িকভাবে আর্থিক সম্পদের স্বল্পতার কারণ হতে পারে।

. বিবাদ এড়িয়ে যাও, যদিও তুমি হও সত্যবাদী: নিজের অবস্থান সঠিক হলেও অনেক সময় ঝগড়া-বিবাদ এড়িয়ে যেতে হয়। কারণ, ঝগড়া-বিবাদ ইলমের প্রসার ঘটায় না, বরং হিংসা ও বিদ্বেষ ছড়ায়। দম্ভ ও অহংবোধের জন্ম দেয়। তবে সত্যের ব্যাপারে বিতর্ক ও গঠনমূলক সমালোচনার কোনো বিকল্প নেই। কারণ, আমরা সবাই যেমন জানি, বিতর্ক ও আলোচনার মাধ্যমে সত্য প্রকাশিত হয় এবং মিথ্যা অন্তর্হিত হয়। ইলমের গভীরতা পরিমাপ করা যায়। তবে বিতর্কের সময় নিয়ত দুর্বল হয়ে যায়। অতএব এ সম্পর্কে সজাগ থাকতে হবে।

১০. ইলম হাসিল করতে গিয়ে শুধু এক ইলমে সীমাবদ্ধ না থাকা: কারণ, ইলম হাসিল করাটা এক ধরনের সংখ্যার মতো যার সূচনা আছে কিন্তু তার সমাপ্তি নেই। সূচনাকালে তোমার অনেক ইলমের চাবির প্রয়োজন হবে। যাতে করে তুমি ইলমের পথে সহজে নিজে চলতে পার এবং অন্যকেও পরিচালিত করতে পার।

১১. গোঁড়ামি পরিহার করা: সত্যে উপনীত হবার পথে গোঁড়ামির মত কোনো অন্তরায় হয় না। কেউ যদি কোনো ব্যক্তি, দল, মত, ধারা, শিক্ষক, শাসক বা লেখকের পক্ষে গোঁড়ামি দেখায়, তবে তার পাত থেকে তোমার হাত ধুয়ে নাও। চার চারবার তাকবীর দিয়ে তার কাছ থেকে পালিয়ে যাও। আল্লাহর কাছে তার জন্য করুণা প্রার্থনা করো। কারণ, সে মৃতদের দলে চলে গেছে। সে আর জীবিত হবে না যাবৎ হকের ব্যাপারে গোঁড়ামি ত্যাগ করে। আর এ ধরনের লোকদের সঙ্গে বিতর্ক বা আলোচনায় প্রবৃত্ত হয়ে তুমি নিজেকে ক্লান্ত বানিয়ো না। আল্লাহর দোহাই দিয়ে জানতে চাই, মৃতের সঙ্গে কি আলোচনা করা যায়? তেমনি তার সঙ্গেও আলোচনা প্রয়াসও একেবারে নিষ্ফল ব্যাপার যাবৎ সে তার গোঁড়ামি পরিহার করে।

১২. চিত্ত বিনোদনে ভারসাম্য রক্ষা করো: এতে কোনো সন্দেহ নেই যে মানবমনকে বিনোদন বা ক্রিড়া-কৌতুকে আসক্ত বানিয়ে সৃষ্টি করা হয়েছে। এতে কোনো সমস্যাও নাই। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও কৌতুক করেছেন বলে হাদীসে প্রসিদ্ধ অনেক ঘটনা রয়েছে। তবে এ ক্ষেত্রে মূলনীতি হলো মৌলিকভাবে কাজটি শরীয়তসম্মত হতে হবে। এ ব্যাপারে তেমনি ভারসাম্যও রক্ষা করতে হবে, যাতে অন্তর মরে না যায়।

১৩. নিজের জিহ্বাকে সংযত করো: জ্ঞান অন্বেষণকারীকে অনেক সময় তার সম্মান হারানোর মতো পরিস্থিতিতে পড়তে হয়, মূর্খ ও নির্বোধদের সঙ্গে কখনো আলোচনা করতে হয়, পরশ্রীকাতর ও সমবয়সীদের গোলযোগের মুখোমুখী হতে হয়। সুতরাং সে যদি আত্মার শক্তি ও বিবেকের প্রহরায় সুসজ্জিত না হয় তবে একের পর এক সে ডানে-বাঁয়ে ঝুঁকতে থাকে। এক পর্যায়ে সে ধ্বংসই হয়ে যায়। পতিত হয় সে কর্দমাক্ত জলাশয়ে। যেমনটি অনেক সময়ই পরিলক্ষিত হয়।

পঞ্চমত : অন্তরে এসব রোগের অনুপ্রবেশ ঘটে কিভাবে ?

পূর্বোল্লিখিত রোগগুলো অন্তরে প্রবেশের প্রকৃত কারণ হলো অজ্ঞতা, যা জটিল রোগ ও ভয়ঙ্কর ব্যধির মতো। হ্যা, কেউ কেউ তার মূর্খতায় আনন্দও বোধ করে! আল্লাহর কাছে মূর্খতা ও মূর্খদের থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করি। পূর্ববর্তী আলেমদের প্রতি আল্লাহ রহম করুন তাঁরা পরিত্রাণের পথগুলো ভালো চিনতেন :

আবুল হাসান মাওয়ারদী রহ. বলেন: ‘তুমি অল্প লোককেই তার ইলমে পরিতৃপ্ত এবং নিজের ইলমে অহংকারী দেখতে পাবে, তবে শুধু তাকেই পাবে এসব করতে যার ইলম সামান্য ও ত্রুটিপূর্ণ। কারণ সে কখনো নিজের অবস্থান ভুলে যায়। ধারণা করে সে বুঝি ইলম দরিয়ায় একটু বেশিই ঢুকে পড়েছে। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি ইলমের ক্ষেত্রে অতৃপ্ত থাকে, আরও বেশি অর্জনে আগ্রহী হয়, সে তার লক্ষ্যের দূরত্বে এবং প্রান্ত স্পর্শে অক্ষমতা সম্পর্কে সজাগ থাকে। আর এটি তাকে আত্মতৃপ্ত ও অহংকারী হতে বাধা দেয়।’ [9]

ইমাম শা‘বী রহ. বলেন: ‘ইলম হলো তিন বিঘত পরিমাণ : যে তা এক বিঘত পরিমাণ লাভ করে সে নাক উঁচু করে এবং ভাবে সে বুঝি পেয়েই গেছে। আর যে দ্বিতীয় বিঘত পায় সে নিজেকে ছোট ভাবে এবং ভাবে সে কিছুই পায় নি। আর তৃতীয় বিঘত, হায় হায় তা কেউ কখনো পায় নি।

ষষ্ঠত : কিভাবে আমার নিয়ত খাঁটি বানাবো ?

সাহাল তাসতারী রহ. কে জিজ্ঞেস করা হলো, কোন জিনিস অন্তরের জন্য কঠিন ?!!

নফস পছন্দ করে নেতৃত্ব, প্রশংসা ও প্রদর্শনী। ধাবিত হয় কর্মহীনতা ও অলস্যের প্রতি। আর তার জন্য সুসজ্জিত করা হয়েছে যাবতীয় লালসা ও বাসনাকে। এ জন্যই বলা হয়েছে, নিয়তকে খাঁটি বানানো কর্ম সম্পাদনকারীর জন্য কর্ম সম্পাদনের চেয়েও কঠিনতর। কেউ কেউ বলেন, ‘এক মুহূর্তের ইখলাস চিরকালের মুক্তি। কিন্তু ইখলাস বড় কঠিন’।

  • কেউ কেউ নিজের আত্মাকে সম্বোধন করে বলতেন,‘তুমি ইখলাস অর্জন করো তবে খালাস (মুক্তি) পেয়ে যাবে’।
  • আরো বলা হয়েছে, ‘ওই ব্যক্তির জন্য সুসংবাদ যার একটি পদক্ষেপ সঠিক হয়েছে যেখানে সে একমাত্র আল্লাহকে খুশি করতে চেয়েছে’।
  • সুফিয়ান সাওরী রহ. বলেন, ‘আমার মা আমাকে বলতেন, হে আমার প্রাণপ্রিয় পুত্র, একমাত্র আমলের নিয়ত ছাড়া তুমি ইলম শিখ না, অন্যথায় তা কিয়ামতের দিন তোমার জন্য বিপদের কারণ হবে’।
  • যুন্নূন মিসরী রহ. কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল বান্দা সম্পর্কে কখন জানা যাবে সে মুখলিসদের অন্তর্ভুক্ত ? তিনি উত্তর দেন,
  • ‘যখন আল্লাহর আনুগত্যে সব চেষ্টা নিয়োগ করে এবং মানুষের কাছে মর্যাদা পড়ে যাওয়া পছন্দ করে।
  • ইয়াহয়া ইবন মু‘আয রহ. কে জিজ্ঞেস করা হলো বান্দা কখন মুখলিস হয় ? তিনি উত্তর দেন,‘যখন তার স্বভাব হয় দুগ্ধপোষ্য শিশুর মতো; কে প্রশংসা করল আর কে ভর্ৎসনা দিল তার পরোয়া করে না’।

প্রশংসা ও সুনামের ক্ষেত্রে নির্লোভ হওয়ার সহজ কৌশল হলো এ কথা হৃদয়ে বদ্ধমূল করা যে, কারো সুনাম বা বিশেষণই উপকার দেয় না এবং কারো ভর্ৎসনা বা নিন্দাই ক্ষতি করে না একমাত্র আল্লাহরটা ছাড়া। অতএব তার প্রশংসার ব্যাপারে নির্লোভ হও যার প্রশংসা তোমাকে সৌন্দর্য দান করে না। তেমনি তার নিন্দারও পরোয়া কর না যার নিন্দা বা সমালোচনা তোমার মানহানী ঘটায় না। তুমি আগ্রহী হও তাঁর প্রশংসায়, সকল সৌন্দর্য যার প্রশংসায় এবং সকল মানহানী যার নিন্দায়। আর এটা পারবে না তুমি যাবৎ না সবর ও ইয়াকীন তথা আল্লাহর প্রতি ধৈর্য ও বিশ্বাস অর্জন কর। সম্বল হিসেবে তোমার কাছে সবর ও ইয়াকীন না থাকলে তোমার অবস্থা হবে ওই ব্যক্তির মতো যে সমতলে সফরের ইচ্ছা করে কোনো বাহন বা যান ছাড়া। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন: ‘অতএব, তুমি সবর কর। নিশ্চয় আল্লাহর ওয়াদা হক। আর যারা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে না তারা যেন তোমাকে অস্থির করতে না পারে।’ {সূরা আর-রূম, আয়াত : ৬০}

আরেক আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন: ‘আর আমি তাদের মধ্য থেকে বহু নেতা করেছিল, তারা আমার আদেশানুযায়ী সৎপথ প্রদর্শন করত, যখন তারা ধৈর্যধারণ করেছিল। আর তারা আমার আয়াতসমূহের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস রাখত।’ {সূরা আস-সাজদাহ, আয়াত : ২৪}

সপ্তমত. ইখলাসের অন্তরায়সমূহ এবং সেসবের প্রতিকার :

১. লোভ-লালসা: এর প্রতিকার হলো মানুষের কাছে যা আছে তা পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা না করা। আল্লাহর সঙ্গে আত্মিক সম্পর্ক গড়ে তোলা এবং তাঁর কাছে যা আছে তার প্রতি আগ্রহ রাখা।

২. প্রশংসাপ্রিয়তা: এর প্রতিকার হলো, এ কথা জানা যে সে-ই প্রকৃতপক্ষে প্রশংসা পাবার যোগ্য যার প্রতি আল্লাহ সন্তুষ্ট এবং আল্লাহ যাকে ভালোবাসেন। যদিও লোকে তার নিন্দা করে। জনৈক বুযুর্গ বলেন, সে পর্যন্ত কেউ মুত্তাকীদের অন্তর্ভুক্ত হবে না যাবৎ তার কাছে প্রশংসা ও নিন্দাকারী সমান মনে হয়।

৩. রিয়া বা লোক দেখানো মানসিকতা: ইখলাসপ্রত্যাশী সবার জানা উচিত যে, বস্তুত মাখলূক বা সৃষ্টি তার কোনো উপকার বা অপকার করতে পারে না। অতএব বৃথাই নিজেকে ক্লান্ত বানিয়ে, নিজের দীনের ক্ষতি করে, নিজের সব আমল বরবাদ করে, আল্লাহ তা‘আলার অসন্তুষ্টি কুড়িয়ে এবং তাঁর সন্তুষ্টি হারিয়ে মানুষের মন যোগাতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়বে না। মনে রাখবে, তুমি যাকে দেখিয়ে কাজ করছ তার অন্তর কিন্তু তাঁর হাতে যাকে তুমি রুষ্ট করছো।

৪. আত্মতুষ্টি: আত্মতুষ্টি থেকে বাঁচার উপায় হলো এ কথা জানা যে, আমল আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে তার জন্য এক ধরনের নিয়ামত। আর এটি তার কাছে অস্থায়ী আমানতস্বরূপ। কারণ, আল্লাহ যা নিয়ে নেন তা তাঁরই, যা দান করেন তাও তাঁর। আর তাঁর কাছে প্রতিটি জিনিসই সুনির্দিষ্ট মেয়াদধারী। অতএব তার জন্য এমন কিছু নিয়ে আত্মতুষ্টিতে ভোগা সমীচীন নয়, যা সে আবিষ্কার করে নি কিংবা যা তার মালিকানাধীন নয় তদুপরি সে তার স্থায়িত্বের ব্যাপারেও তো নিশ্চিত নয়।

৫. অন্যকে হেয় বা অবজ্ঞা করা কিংবা ছোট ভাবা: অন্যকে ছোট ভাবা কিংবা হেয়, অবজ্ঞা বা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা থেকে বাঁচার উপায় হলো, আল্লাহ তা‘আলা আমাদের যে চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেছেন সঠিকভাবে তা ভেতরে লালন করা। আল্লাহ তা‘আলা মানুষের সম্মানের মাপকাঠি নির্ধারণ করে ইরশাদ করেন: ‘হে মানুষ, আমি তোমাদেরকে এক নারী ও এক পুরুষ থেকে সৃষ্টি করেছি আর তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি। যাতে তোমরা পরস্পর পরিচিত হতে পার। তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সেই অধিক মর্যাদাসম্পন্ন যে তোমাদের মধ্যে অধিক তাকওয়া সম্পন্ন। নিশ্চয় আল্লাহ তো সর্বজ্ঞ, সম্যক অবহিত।’ {সূরা আল-হুজুরাত, আয়াত: ১৩}

.নিজেকে বড় ভেবে নিজেই নিজের সার্টিফেকেট দেয়া থেকে সতর্ক করে আল্লাহ তা‘আলা আমাদের বলেন: ‘যারা ছোট খাট দোষ-ত্রুটি ছাড়া বড় বড় পাপ ও অশ্লীল কার্যকলাপ থেকে বিরত থাকে, নিশ্চয় তোমার রব ক্ষমার ব্যাপারে উদার, তিনি তোমাদের ব্যাপারে সম্যক অবগত। যখন তিনি তোমাদেরকে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং যখন তোমরা তোমাদের মাতৃগর্ভে ভ্রুণরূপে ছিলে। কাজেই তোমরা আত্মপ্রশংসা করো না। কে তাকওয়া অবলম্বন করেছে, সে সম্পর্কে তিনিই সম্যক অবগত।’ {সূরা আন-নাজম, আয়াত: ৩২}

সুতরাং অনেক সময় সে যাকে নিজের চেয়ে নিম্ন মর্যাদার ভাবছে হতে পারে সে তার চেয়ে আল্লাহর ভীতিতে, অন্তরের পবিত্রতায়, নিয়তের শুদ্ধতায় এবং আমলের শুভ্রতায় এগিয়ে থাকতে পারে। তাছাড়া সে তো জানে না নিজের শেষ অবস্থা কী হবে।

শেষ কথা :

পরিশষে আমাদের এ ব্যাপারে সতর্ক হওয়া দরকার যে, নিয়ত খাঁটি নয় মনে করে কোনো দ্বীনী জ্ঞান অন্বেষণকারীর জন্য জ্ঞান অর্জন করা থেকে বিরত হওয়া উচিত নয়। কারণ, ইলমের বরকতে নিয়তের পরিশুদ্ধি অর্জন খুবই প্রত্যাশিত ও সম্ভাব্য বিষয়। যেমন জনৈক বুযুর্গ বলেছেন: ‘আমরা এ ইলম শিখেছি গাইরুল্লাহ তথা আল্লাহ ছাড়াও অন্য কারও উদ্দেশ্যে। কিন্তু এ ইলমই কেবল আল্লাহ ছাড়া অন্য কারোও জন্যে হাসিল হতে অস্বীকার করেছে।[10]

তেমনি ইমাম মুজাহিদ ও অন্য অনেকে বলেছেন: ‘আমরা এ ইলম শিখেছি, অথচ এতে আমার নিয়ত বড় কিছু ছিল না। অতপর আল্লাহ পরবর্তীতে আমাদেরকে ‘সহীহ নিয়তে’র তাওফীক দান করেছেন।’ [11]

একবার ইমাম আহমদ ইবন হাম্বল রহিমাহুল্লাহকে বলা হলো: ‘এক দল লোক আছে যারা হাদীস সংকলন করে অথচ তাদের ওপর এর কোনো সুপ্রভাব দৃষ্টিগোচর হয় না। তাদের কোনো গাম্ভীর্য প্রকাশ পায় না। তিনি বললেন, হাদীস তাদেরকে কল্যাণের দিকে নিয়ে যাবে।’

হাবীব ইবন আবী ছাবেত রহ. বলেন: ‘আমরা এ ইলম শিখেছি তখন আমাদের বড় কিছু নিয়ত ছিল না। অতপর পরবর্তীতে সহীহ নিয়ত এবং আমল যোগ হয়েছে।’

অতএব বান্দার হার মানা উচিত নয়। বরং নিয়ত শুদ্ধ করার চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। যদিও প্রথম দিকে এই শুদ্ধ করার কাজটিকে কঠিন মনে হবে। কারণ, শায়খ সুফিয়ান ছাওরী রহিমাহুল্লাহ বলেন: ‘আমি নিয়তে চেয়ে অন্য কিছু দেখি নি যা শুদ্ধ করা এত কঠিন।’

অতএব জ্ঞান অন্বেষণকারীর কর্তব্য হলো, ইলম তলবে নিজের নিয়তকে সুন্দর বানাবে, ইখলাস রচনা করবে এবং তাওহীদকে খাঁটি বানাবে। সুতরাং যে ইলম অন্বেষণে নিজের নিয়তকে খাঁটি করবে এবং এ পথে কষ্ট-সহিষ্ণুতার মাধ্যমে চেষ্টা অব্যাহত রাখবে, তাকে অবশ্যই দৃঢ়তার পরিচয় দিতে হবে। তাহলে সে এর মাধ্যমে তার অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছার যোগ্য হয়ে উঠবে।

এই হলো কিছু উপদেশ যা আমি তোমাদের সামনে উপস্থাপন করলাম। প্রতিটি আগ্রহী শ্রোতা যা গ্রহণ করবে। আর আমিই এসবের বেশি মুখাপেক্ষী। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা, তিনি যেন আমাদের এই খাঁটি নিয়ত অর্জনে সাহায্য করেন, আমরা যা শিখি তা থেকে আমাদের উপকৃত করেন এবং একে আমাদের বিপক্ষে নয়; পক্ষে দলীল বানান। এ হলো অল্প পূঁজির চেষ্টা। আমার ধারণা আমি আমার সব সামর্থ্য ব্যয় করেছি, আমি নিজেকে নির্দোষ দাবি করছি না। আমি এসব মূলত নসীহত হিসেবে লিখেছি। অতএব কেউ যদি এতে ভালো কিছু পান তাহলে আমার জন্য হিদায়াতের দু‘আ করবেন। আর যদি কেউ অন্য কিছু পান তবে বলব, আমি কোনো পদ বা অর্থ চাই নি; চেয়েছি কেবল অপরের কল্যাণ। আল্লাহ আমাদের সকল মহৎ বাসনা পূরণ করুন।

আমীন। 


[1]. আল- আরবাঈন আন- নাববিয়্যাহ : ১/৩।
[2]. আবূ নু‘আইম, হিলইয়াতুল আওলিয়া : ২/২০৭।
[3]. বুখারী : ৫৪।
[4]. তিরমিযী : ২৬৫৪।
[5]. ইবন মাজাহ্‌ : ২৫৩; সহীহ জামে‘তে শায়খ আলবানী হাদীসটিকে সহীহ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। সহীহ জামে‘ : ৬১৫৮।[6]. মুসলিম, ১/১৪। ভূমিকা। মুয়াত্তা মালিক, ১/২৫। [সম্পাদক]
[7]. বুখারী : ৫৪।
[8]. জামেউস সগীর : ৩৮৪৮; আবূ নাঈম, হুলইয়াতুল আওলিয়া : ৪১১২। আলবানী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন। দেখুন, সহীহুল জামে : ২০৮৫।
[9]. আদাবুদ্দুনইয়া ওয়াদ্দীন, পৃ. ৮১।
[10]. প্রাগুক্ত।
[11]. প্রাগুক্ত।

ইস্তিখারার বিধি-বিধান

istikhara

সংকলনে: আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল

ইস্তেখারা শব্দের অর্থ: ইস্তেখারা শব্দটি আরবী। আভিধানিক অর্থ, কোন কোন বিষয়ে কল্যাণ চাওয়া।

ইসলামী পরিভাষায়:দুরাকাত নামায ও বিশেষ দুয়ার মাধ্যমে আল্লাহর তায়ালার নিকট পছন্দনীয় বিষয়ে মন ধাবিত হওয়ার জন্য আশা করা। অর্থাৎ দুটি বিষয়ের মধ্যে কোনটি অধিক কল্যাণকর হবে এ ব্যাপারে আল্লাহর নিকট দু রাকায়াত সালাত ও ইস্তিখারার দুয়ার মাধ্যমে সাহায্য চাওয়ার নামই ইস্তেখারা।” [ইবনে হাজার, ফাতহুল বারী শরহু সহীহিল বুখারী]

ইস্তেখারা করার হুকুম: এটি সুন্নাত। যা সহীহ বুখারীর হাদীস দ্বারা প্রমাণিত।

ইস্তিখারা কখন করতে হয়?

মানুষ বিভিন্ন সময় একাধিক বিষয়ের মধ্যে কোনটিকে গ্রহণ করবে সে ব্যাপারে দ্বিধা-দন্ধে পড়ে যায়। কারণ, কোথায় তার কল্যাণ নিহীত আছে সে ব্যাপারে কারো জ্ঞান নাই। তাই সঠিক সিদ্ধান্তে উপণিত হওয়ার জন্য আসমান জমীনের সৃষ্টিকর্তা, অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যত সকল বিষয়ে যার সম্যক জ্ঞান আছে, যার হাতে সকল ভাল-মন্দের চাবী-কাঠি সেই মহান আল্লাহর তায়ালার নিকট উক্ত বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহনের জন্য সাহায্য প্রার্থনা করতে হয়। যেন তিনি তার মনের সিদ্ধান্তকে এমন জিনিসের উপর স্থীর করে দেন যা তার জন্য উপকারী। যার ফলে তাকে পরবর্তীতে আফসোস করতে না হয়। যেমন,  বিয়ে, চাকরী, সফর ইত্যাদি সে বিষয়ে ইস্তেখারা করতে হয়।

শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন: “সে ব্যক্তি অনুতপ্ত হবে না যে স্রষ্টার নিকট ইস্তিখারা করে এবং মানুষের সাথে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নেয় এবং তার উপর অটল থাকে।

আল্লাহ তায়ালা বলেন: “আর তুমি সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে মানুষের সাথে পরমর্শ কর। অত:পর আল্লাহর উপর ভরসা করে (সিদ্ধান্তে অটল থাক)। আল্লাহ ভরসাকারীদেরকে পছন্দ করেন।“ [সূরা আলে ইমরান: ১৫৯]

কাতাদা(রহ:) বলেন: “মানুষ যখন আল্লাহ তায়ালা সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে পরষ্পরে পরামর্শ করে তখন আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে সব চেয়ে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছার তওফীক দেন।

ইমাম নওবী রহ. বলেন: “আল্লাহ তায়ালার নিকট ইস্তেখারা করার পাশাপাশি অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ভাল লোকদের পরামর্শ গ্রহণ করা দরকার। কারণ, মানুষের জ্ঞান-গরীমা অপূর্ণ। সৃষ্টিগতভাবে সে দূর্বল। তাই যখন তার সামনে একাধিক বিষয় উপস্থিত হয় তখন কি করবে না করবে, বা কি সিদ্ধান্ত নিবে তাতে দ্বিধায় পড়ে যায়।

ইস্তিখারা করার নিয়ম:

১) নামাযের ওযুর মত করে ওযু করতে হয়।

২) ইস্তিখারার উদ্দেশ্যে দু রাকায়াত নামায পড়তে হয়। এ ক্ষেত্রে সুন্নত হল, প্রথম রাকায়াতে সূরা ফাতিহার পর কুল আইয়োহাল কাফিরূন এবং দ্বিতীয় রাকায়াতে সূরা ফাতিহার পর কুল হুওয়াল্লাহু আহাদ পড়া।

৩) নামাযের সালাম ফিরিয়ে আল্লাহ তায়ালা বড়ত্ব, ও মর্যাদার কথা মনে জাগ্রত করে একান্ত বিনয় ও নম্রতা সহকারে আল্লাহর প্রশংসা ও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর উপর দুরূদ পেশ করার পর নিচের দুয়াটি পাঠ করা:

اللَّهُمَّ إنِّي أَسْتَخِيرُكَ بِعِلْمِكَ , وَأَسْتَقْدِرُكَ بِقُدْرَتِكَ , وَأَسْأَلُكَ مِنْ فَضْلِكَ الْعَظِيمِ فَإِنَّكَ تَقْدِرُ وَلا أَقْدِرُ , وَتَعْلَمُ وَلا أَعْلَمُ , وَأَنْتَ عَلامُ الْغُيُوبِ اللَّهُمَّ إنْ كُنْتَ تَعْلَمُ أَنَّ هَذَا الأَمْرَ (………) خَيْرٌ لِي فِي دِينِي وَمَعَاشِي وَعَاقِبَةِ أَمْرِي) أَوْقَالَ : عَاجِلِأَمْرِيوَآجِلِهِ) فَاقْدُرْهُ لِي وَيَسِّرْهُ لِي ثُمَّ بَارِكْ لِي فِيهِ , اللَّهُمَّ وَإِنْ كُنْتَ تَعْلَمُ أَنَّ هَذَا الأَمْرَ(………) شَرٌّ لِي فِي دِينِي وَمَعَاشِي وَعَاقِبَةِ أَمْرِي (أَوْقَالَ : عَاجِلِأَمْرِيوَآجِلِهِ)  فَاصْرِفْهُ عَنِّي وَاصْرِفْنِي عَنْهُ وَاقْدُرْ لِي الْخَيْرَ حَيْثُ كَانَ ثُمَّ ارْضِنِي بِهِ (……).

হযরত জাবের (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল (সাঃ) প্রত্যেক কাজে আমাদের ইস্তিখারা করা সম্পর্কে এমন ভাবে শিক্ষা দিতেন যেভাবে কুরআনের সূরা শিক্ষা দিতেন। তিনি বলতেন, তোমাদের কেউ যখন কোন কাজ করার  করবে তখন সে দুরাকাত নফল নামাজ আদায় করবে, এরপর সে পাঠ করবে: আল্লাহুম্মাআস্তাখিরুকা বি ইলমিকা, ওয়া আস্তাকদিরুকা বি কুদরাতিকা ওয়া আসআলুকা মিনফাদ্বলিকাল আযীম,ফা ইন্নাকা তাকদিরু ওয়ালা আকদিরু ওয়া তা’লামু ওয়ালা আ’লামু ওয়া আন্তা আল্লামুল গুয়ূব। আল্লাহুম্মা ইনকুন্তা তা’লামু আন্না হাযালআমরা (এখানে নিজের কাজের কথা উল্লেখ করবে) খাইরুল্লি ফি দ্বীনী ওয়া মাশায়ী ওয়া আক্বিবাতি আমরী (অথবা বলবে: আ’ জিলি আমরি ওয়া আজিলিহি) ফাকদিরহু লি ওয়া ইয়াসসিরহু লী, সুম্মা বারিকলী ফিহি ওয়া ইন কুনতা তা’লামু আন্না হাযাল আমরা (এখানে নিজের কাজের কথা উল্লেখ করবে) শাররুল্লী ফী দীনী ওয়া মাশায়ী ওয়াআক্বিবাতি আমরী (অথবা বলবে: আ জিলি আমরী ওয়া আজিলীহি) ফাসরিফহু আন্নিওয়াসরীফনি আনহু ওয়াকদির লিয়াল খাইরা হাইসু কানা সুম্মা আরদ্বিনী বিহি। (এর পর নিজের কাজের কথা উল্লেখ করবে)

অর্থ: হে আ্ল্লাহ, আমি আপনার কাছে কল্যাণ চাই –আপনার ইলমের সাহায্যে। আপনার কাছে শক্তি কামনা করি আপনার কুদরতের সাহায্যে। আপনার কাছে অনুগ্রহ চাই আপনার মহা অনুগ্রহ থেকে। আপনি সর্বোময় ক্ষমতার অধিকারী –আমার কোন ক্ষমতা নাই। আপনি সর্বজ্ঞ – আমি কিছুই জানি না। আপনি সকল গোপন বিষয় পূর্ণ অবগত।

“হে আল্লাহ, আপনার ইলমে এ কাজ (এখানে নিজের কাজের কথা উল্লেখ করবে) আমার দ্বীন আমার জীবন-জিবীকা ও কর্মফলের দিক থেকে (বা তিনি নিম্নোক্ত শব্দগুলো বলেছিলেন –একাজ দুনিয়া ও আখিরাতের দিক থেকে ভাল হয়) তবে তা আমাকে করার শক্তি দান করুন। পক্ষান্তরে আপনার ইলমে এ কাজ (এখানে নিজের কাজের কথা উল্লেখ করবে) যদি আমার দ্বীন আমার জীবন-জিবীকা ও কর্মফলের দিক থেকে (অথবা বলেছিলেন, দুনিয়া ও পরকালের দিক থেকে মন্দ হয়) তবে আমার ধ্যান-কল্পনা একাজ থেকে ফিরিয়ে নিন। তার খেয়াল আমার অন্তর থেকে দূরীভূত করে দিন। আর আমার জন্যে যেখানেই কল্যাণ নিহিত রয়েছে এর ফায়সালা করে দিন এবং আমাকে এরই উপর সন্তুষ্ট করে দিন । (এরপর নিজের প্রয়োজনের কথা ব্যক্ত করবে।) (বুখারী )

যে কোন কাজে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছার দুটি উপায়:

প্রথমত: আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নিকট ইস্তেখারার সালাতের মাধ্যমে কল্যাণ প্রার্থনা করা। কারণ, তিনি অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত সম্পর্কে সব চেয়ে ভাল জানেন। তিনি সব চেয়ে চেয়ে বেশী জ্ঞাণ রাখেন মানুষের কল্যাণ কোথায় এবং কোন পথে নিহিত আছে।

দ্বীতিয়ত: অভিজ্ঞ, বিশ্বস্ত এবং জ্ঞানী লোকের পরামর্শ গ্রহণ করা। আল্লাহ তায়ালা এ ব্যাপারে বলেন: “সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে তাদের সাথে পরামর্শ করুন।” [সূরা আলে ইমরান: ১৫৯]

পরামর্শ আগে না ইস্তেখারার নামায আগে?

এ ব্যাপারে আলেমগণের মাঝে মতোবিরোধ রয়েছে। তবে সবচেয়ে সঠিক হল, আল্লামা মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল ইসাইমীন (রহ.) এর মত যা তিনি রিয়াদুস সালিহীনের ব্যাখ্যা গ্রন্থে প্রাধান্য দিয়েছেন। তা হল, আগে ইস্তেখারার সালাত আদায় করতে হবে। কারণ, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “তোমাদের কেউ কোন কাজের মনস্থ করলে সে যেন, (সালাতুল ইস্তিখারার) দুরাকায়াত সালাত আদায় করে….।” এখানে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সর্ব প্রথম সালাতুল ইস্তিখারা আদায় করার কথা বলেছেন।

ইস্তিখারা প্রসঙ্গে কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন:

১) ছোট-বড় সকল বিষয়ে ইস্তিখারা করার অভ্যাস গড়ে তোলা ভাল।
২) দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করুন, আল্লাহ আপনাকে যে কাজ করার তাওফীক দিয়েছেন তাতেই আপনার কল্যাণ নিহীত রয়েছে। তাই একান্ত মনোযোগ সহকারে স্থীর চিত্তে এবং আল্লাহর মহত্ব ও বড়ত্বের কথা স্বরণ করে তার নিকট দুয়া করুন।
৩) খুব তাড়াহুড়া বা একান্ত জরুরী প্রয়োজন না হলে যে সকল সময়ে সাধারণ নফল নামায পড়া নিষিদ্ধ সে সকল সময়ে সালাতুল ইস্তিখারা আদায় করা থেকে বিরত থাকুন। তবে তাড়াহুড়া থাকলে নিষিদ্ধ সময়গুলোতেও তা পড়া যাবে।
৪) মহিলাদের ঋতু স্রাব বা সন্তান প্রসব জনিত রক্ত প্রবাহের সময় সালাতুল ইস্তিখারা আদায় করা থেকে বিরত থাকতে হবে। তবে এমতাবস্থায় নামায না পড়ে শুধু ইস্তিখারার দুয়াটি পড়া যাবে।
৫) ইস্তিখারার দুয়া মুখস্ত না থাকলে দেখে দেখে তা পড়তে অসুবিধা নেই। তবে মুখস্ত করার চেষ্টা করা ভাল।
৬) ইস্তিখারা করার পর তার উদ্দিষ্ট বিষয়ে স্বপ্ন দেখা আবশ্যক নয়। স্বপ্নের মাধ্যমেও সঠিক জিনিসটি জানতে পারে আবার স্বপ্ন ছাড়াও মনের মধ্যে সে কাজটির প্রতি আগ্রহ বা অনাগ্রহ তৈরি হতে পারে।
৭) উক্ত বিষয়ে সিদ্ধান্তে উপনিত হলে আল্লাহর উপর ভরসা করে দৃঢ়ভাবে কাজে এগিয়ে যান। পিছুপা হবেন না বা হীনমন্যতায় ভূগবেন না। আল্লাহ তায়ালা বলেন: “আর যখন সিদ্ধান্ত গ্রহন করে ফেল তখন আল্লাহর উপর ভরসা কর।” [সূরা আলে ইমরান: ১৫৯]
৮) সালাতুল ইস্তিখারা পড়ার পরও সঠিক সিদ্ধান্তে উপণিত না হতে পারলে একধিকবার তা পড়া জায়েয আছে।
৯) ইস্তিখারার দুয়াতে যেন অতিরিক্ত কোন শব্দ যোগ না হয় বা সেখান থেকে কোন শব্দ বাদ না যায় সে দিকে লক্ষ্য রাখুন। বরং হাদীসে বর্ণিত শব্দাবলী যথাযথভাবে পড়ার চেষ্টা করুন।
১০) যে বিষয়ে আপনি সিদ্ধান্ত নিতে চান সি বিষয়ে অভিজ্ঞতা সম্পন্ন, সৎ ও বিশ্বস্ত ব্যক্তির পরামর্শ গ্রহণ করুন। সেই সাথে সালাতুল ইস্তিখারাও আদায় করুন।
১১) এক জনের পক্ষ থেকে আরেকজন সালাতুল ইস্তিখারা আদায় করতে পারবে না। তবে সাধারণভাবে তার কল্যাণের জন্য দুয়া করতে পারে। যেমন, মা-বাবা তাদের সন্তানের কল্যাণের জন্য নামাযের বাইরে কিংবা নফল নামাযে সাজদাহ রত অবস্থায় এবং তাশাহুদের দুরুদ পাঠের পরে দুয়া করতে পারে।
১২) প্রশ্ন: একাধিক বিষয়ের জন্য কি একবার ইস্তিখারা করাই যথেষ্ট না প্রত্যেকটি বিষয়ের জন্য পৃথকভাবে করতে হবে?
উত্তর: প্রতিটি কাজের জন্য পৃথকভাবে ইস্তিখারা করা উত্তম। তবে একবার ইস্তিখারা করে দুয়ায় সকল বিষয়ের নিয়ত করলেও যথেষ্ট হবে।
১৩) অন্যায় বা হারাম কাজে এমন কি মাকরূহ কাজে ইস্তিখারা করা জায়েজ নাই।

ইস্তিখারার ব্যাপারে কয়েকজন মনিষীর বক্তব্য:

১) সাদ ইবনে আবী ওয়াক্কাস রা. বলেন: “আল্লাহর নিকট ইস্তিখারা করা আদম সন্তানদের সৌভাগ্যের বিষয়। অনুরূপভাবে আল্লাহর ফয়সালায় সন্তুষ্ট থাকাও তাদের সৌভাগ্যের বিষয়। পক্ষান্তরে আল্লাহর নিকট ইস্তিখারা না করা আদম সন্তানদের দূর্ভাগ্যের বিষয় অনুরূপ ভাবে আল্লাহর ফয়সালায় অসন্তুষ্ট হওয়াও তাদের দূর্ভাগ্যের বিষয়।”

২) উমর ইবনুল খাত্তাব রা. বলেন: “আমার সকালটা আমার কাঙ্ক্ষিত অবস্থায় না কি অনাকাঙ্ক্ষিত অবস্থায় হল তা নিয়ে আমি ভাবি না। কারণ, আমি জানি না কল্যাণ কোথায় নিহিত আছে; যা আমি আশা করি তাতে না কি যা আমি আশা করি না তাতে।”

সুতরাং সুপ্রিয় মুসলিম ভাই ও বোন, বিপদাপদ বা দূর্ঘটনা ঘটলেই তাতে হাহুতাশ করার কারণ নেই। কারণ, আমাদের জীবনে এমন ঘটনা ঘটে যা আমরা চাই না কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তার মধ্যেই আমাদের কল্যাণ নিহিত রয়েছে। আবার অনেক সময় এমন কিছু আশা করি যার মধ্যে হয়ত কোন অকল্যাণ ও ক্ষতি অপেক্ষা করছে। আমরা কেউই ভবিষ্যত সম্পর্কে জানি না। আল্লাহ তায়ালা বলেন: “তোমদের কাছে হয়তবা কোন একটা বিষয় পছন্দনীয় নয়, অথচ তা তেমদের জন্য কল্যাণকর। আর হয়তোবা কোন একটি বিষয় তোমাদের কাছে পছন্দনীয় অথচ তোমাদের জন্যে অকল্যাণকর। বস্তুত: আল্লাহই জানেন, তোমরা জান না।” [সূরা বাকারা: ২১]

৩) শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন: “সে ব্যক্তিকে অনুতপ্ত হতে হবে না যে স্রষ্টার নিকট ইস্তিখারা করে এবং মানুষের নিকট পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নেয় এবং তার উপর অটল থাকে।”

আল্লাহ আমাদের সকলকে তার সন্তোষ মূলক কাজ করার তাওফীক দান করুন।

আমীন।

বইঃ সারা বিশ্বের মুসলিমদের জন্য অত্যাবশ্যকীয় পাঠ সমূহ – ফ্রী ডাউনলোড

New-bookলেখকঃ শাইখ আব্দুল আযীয বিন বায (রহঃ) | অনুবাদঃ শাইখ ইব্রাহীম আব্দুল হালীম

সংক্ষিপ্ত বর্ণনাঃ  দীন ইসলাম সম্পর্কে বিশ্বের সকল মুসলিমদের জন্য যা জানা ওয়াজিব তার কিছুর বর্ণনার ব্যাপারে শাইখ আব্দুল আযীয বিন বায (রহঃ) কতৃক লিখিত চমৎকার এই পুস্তিকাটি আপনাদের জন্য ইন্টারনেটে প্রকাশ করা হল। পুস্তিকাটি অনুবাদ করেছেন শাইখ ইব্রাহীম আব্দুল হালীম (হাফিজাহুল্লাহ)। পুস্তিকটি নিজে পড়ুন এবং অন্যের সাথে শেয়ার করুন।

মুসলিমদের জন্য অত্যাবশ্যকীয় পাঠ – QA Server
মুসলিমদের জন্য অত্যাবশ্যকীয় পাঠ – QA Server

অনলাইনে কুরআন পড়ুন – Online Quran Reader Bangla/Bengali

Online Quran Reader Bangla/Bengali – Download Quran in other Language

হিফজুল কোরআন প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের ফারিহা তাসনিম প্রথম

38

farihatasnimজর্দানের রাজধানী আম্মানে বিশ্বের নির্বাচিত নিজ নিজ দেশে প্রথম স্থান অধিকারকারী বালিকা হাফেজাদের মধ্যে ৪৩টি দেশের হাফেজাদের পরাজিত করে উপস্থিত দর্শক ও বিচারকদের মন জয় করে প্রথম স্থান অধিকার করে বাংলাদেশের খুদে বালিকা হাফেজা ফারিহা তাসনিম

এদিকে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে সৌদি আরব এবং তৃতীয় স্থান অধিকার করে লিবিয়া। প্রথম স্থান অধিকারী ফারিহা তাসনিম মাত্র ছয় বছর বয়সেই নেছার আহমাদ আন নাছিরী কর্তৃক পরিচালিত মারকাজুত তাহফিজ ইন্টারন্যাশনালে মহাগ্রন্থ আল-কোরআন হিফয করতে সক্ষম হয়। এ প্রতিযোগিতায় পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন জর্দানের ধর্মমন্ত্রী ড. মুহাম্মদ নুহ, কুটনৈতিক, রাষ্ট্রদূত, সরকারি কর্মকর্তা ও দেশ-বিদেশি রাষ্ট্রীয় মেহমান।

ধর্মমন্ত্রী ড. মুহাম্মদ নুহ বিশ্বসেরা হাফেজা ফারিহা তাসনিমকে আন্তর্জাতিক সার্টিফিকেট, ক্রেস্ট ও নগদ অর্থ প্রধান করেন। বিশ্বের সেরা হাফেজা ফারিহা তাসনিমের অপরিবীহ মাধূর্যের প্রসংশা করে বলেন, সৌদি আরবে আন্তর্জাতিক হিফজুল কোরআন প্রতিযোগিতায় ৭৩টি দেশের মধ্যে একাধিক গ্রুপে বাংলাদেশ প্রথম স্থান অধিকার করার পর এবার জর্দানেও বাংলাদেশি মেয়ে হাফেজা প্রথম স্থান অধিকার করায় আমি মুগ্ধ। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন. বাংলাদেশের হাফেজ ছেলেদের সঙ্গে হাফেজা মেয়েরাও বিশ্ব কোরআন প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অধিকারের গৌরব অর্জন করছে। আমি বাংলাদেশের সুখ-সমৃদ্ধি কামনা করছি।

প্রসঙ্গত, গত ২৩ মার্চ সারা বাংলাদেশের নির্বাচিত সেরা বালিকা হাফেজাদের মধ্যে চুড়ান্ত বাছাইয়ে বায়তুল মুকাররমের ইসলামিক ফাউন্ডেশন আয়োজিত সভাকক্ষে সবাইকে মুদ্ধ করে প্রথম স্থান অধিকার করে ফারিহা তাসনিম, দ্বিতীয় স্থান আমেনা ও তৃতীয় স্থান রাফিয়া হাসান জিনাত। এ তিনজনই হাফেজ নেছার আহমাদ আন নাছিরী পরিচালিত ঢাকার যাত্রাবাড়ীস্থ মারকাজুত তাহফিজ ইন্টারন্যাশনাল মহিলা হিফজ বিভাগের ছাত্রী। একই মাদ্রাসার পুরুষ বিভাগের ছাত্র হাফেজ মহিউদ্দিন ২০১২ আগস্টে আলজেরিয়ায় ৬০টি দেশের মধ্যে দ্বিতীয় ও ডিসেম্বরে সৌদি বিশ্ব হিফজুল কোরআন প্রতিযোগিতায় ৭৩টি দেশের মধ্যে ৩০ পারা গ্রুপে অন্ধ হাফেজ তানভির এবং ১০ পারা গ্রুপে সা’আদ সুরাইল দুজনই প্রথম স্থান অধিকার করে।

বাংলাদেশের সুনাম বয়ে আনার সঙ্গে সৌদি আরবে ৩৪ বছরের কোরআন প্রতিযোগিতার ইতিহাসে এ প্রথম কোনো দেশ প্রত্যেক গ্রুপে প্রথম স্থান লাভ করে। অত্রপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র এবং প্রিন্সিপালকে বাংলাদেশ মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড  (বেফাক) এবং প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মাননা অ্যাওয়ার্ড প্রধান করে।

সবরের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা

মূল: শাইখ ড. সালিহ ফাউযান আল ফাউযান (হাফিযাহুল্লাহ) | অনুবাদক: আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল

সবর বা ধৈর্য ধারণ করা আকীদার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। জীবনে বিপদ-মুসিবত নেমে আসলে অস্থিরতা প্রকাশ করা যাবে না। বরং ধৈর্য ধারণ করতে হবে। পাশাপাশি আল্লাহর নিকট প্রতিদান পাওয়ার আশা করতে হবে। ইমাম আহমদ রহঃ বলেন, “আল্লাহ তায়ালা কুরআনে নব্বই স্থানে সবর সম্পর্কে আলোচনা করেছেন।”

হাদীসে বর্ণিত হয়েছে: “সবর হল জ্যোতি।” (মুসনাদ আহমদ ও মুসলিম)
উমর রা. বলেন: “সবরকে আমরা আমাদের জীবন-জীবিকার সর্বোত্তম মাধ্যম হিসেবে পেয়েছি।” (বুখারী)
আলী রা. বলেন: “ঈমানের ক্ষেত্রে সবরের উদাহরণ হল দেহের মধ্যে মাথার মত।” এরপর আওয়াজ উঁচু করে বললেন, “যার ধৈর্য নাই তার ঈমান নাই।

আবু সাঈদ খুদরী রা. হতে বর্ণিত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: “আল্লাহ তায়ালা ধৈর্যের চেয়ে উৎকৃষ্ট এবং ব্যাপকতর দান কাউকে দেন নি।” [সুনান আবু দাঊদ, অনুচ্ছেদ: নিষ্কলুষ থাকা। সহীহ]

সবরের প্রকারভেদ: সবর তিন প্রকার:

১) আল্লাহর আদেশের উপর সবর করা।
২) আল্লাহর নিষেধের উপর সবর করা।
৩) বিপদাপদে সবর করা।

আল্লাহ তায়ালা বলেন: “আল্লাহর হুকুম ছাড়া কোন বিপদ আসে না। আর যে আল্লাহর প্রতি ঈমান আনে তিনি তাঁর অন্তরকে সঠিক পথের সন্ধান দেন।” [সূরা তাগাবুনঃ ১১]

আলকামা বলেন, “আল্লাহ তায়ালা ‘যার অন্তরকে সঠিক পথের সন্ধান দেন’ সে হল ঐ ব্যক্তি যে বিপদে পড়লে বিশ্বাস করে এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে। ফলে বিপদে পড়েও সে খুশি থাকে এবং সহজভাবে তাকে গ্রহণ করে।

অন্য মুফাসসিরগণ উক্ত আয়াতের তাফসীর প্রসঙ্গে বলেন, “যে ব্যক্তি বিপদে পড়লে বিশ্বাস রাখে যে এটা আল্লাহর ফায়সালা মোতাবেক এসেছে। ফলে সে সবর করার পাশাপাশি পরকালে এর প্রতিদান পাওয়ার আশা রাখে এবং আল্লাহর ফয়সালার নিকট আত্মসমর্পণ করে আল্লাহ তায়ালা তার অন্তরকে সঠিক পথে পরিচালিত করেন, আর দুনিয়ার যে ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে তার বিনিময়ে তিনি তার অন্তরে হেদায়াত এবং সত্যিকার মজবুত একীন দান করেন। যা নিয়েছেন তার বিনিময় দান করবেন।”

সাঈদ বিন জুবাইর রা. বলেন: “যে ব্যক্তি ঈমান আনে আল্লাহ তার অন্তরকে হেদায়াত দেন।” এ আয়াতের তাফসীর প্রসঙ্গে বলেন, অর্থাৎ সে কোন ক্ষয়-ক্ষতি ও বিপদের সম্মুখীন হলে বলে ‘ইন্নাল্লিাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজেঊন’ অর্থাৎ আমরা আল্লাহর জন্যই আর তাঁর নিকটই ফিরে যাব।” [সূরা বাকারাঃ ১৫৬]

উক্ত আয়াতে প্রমাণিত হয় যে, আমল ঈমানের অন্তর্ভুক্ত। আরও প্রমাণিত হয় যে, ধৈর্য ধরলে অন্তরের হেদায়াত অর্জিত হয়।

জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ধৈর্যের প্রয়োজন:

প্রতিটি পদক্ষেপে মুমিনের ধৈর্যের প্রয়োজন। আল্লাহর নির্দেশের সামনে ধৈর্যের প্রয়োজন। আল্লাহর পথে দাওয়াতের ক্ষেত্রে ধৈর্যের প্রয়োজন। কারণ, এ পথে নামলে নানা ধরণের কষ্ট ও বিপদের মুখোমুখি হতে হবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন: “তোমার প্রভুর পথে আহবান কর হেকমত এবং ভাল কথার মাধ্যমে। আর সর্বোত্তম পন্থায় তাদের সাথে বিতর্ক কর। তোমার প্রভু তো সব চেয়ে বেশি জানেন, কে তাঁর পথ থেকে বিপথে গেছে আর তিনিই সব চেয়ে বেশি জানেন কারা সঠিক পথের উপর প্রতিষ্ঠিত রয়েছেন।…আর ধৈর্য ধর। ধৈর্য ধর কেবল আল্লাহর উপর।” [সূরা নাহল: ১২৫-১২৭]

সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ করতে গেলেও চরম ধৈর্যের পরিচয় দেয়া প্রয়োজন। কারণ, এ পথে মানুষের পক্ষ থেকে নান ধরণের যাতনার সম্মুখীন হতে হয়। যেমন আল্লাহ তায়ালা লোকমান সম্পর্কে বলেন, (তিনি তার সন্তানকে উপদেশ দিতে গিয়ে বলেন): “হে বৎস, নামায প্রতিষ্ঠা কর, সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ কর। আর যে বিপদ আসে তাতে ধৈর্য ধারণ কর। বিপদে ধৈর্য ধরণ করা তো বিশাল সংকল্পের ব্যাপার।” [সূরা লোকমান: ১৭]

মুমিনের ধৈর্যের প্রয়োজন জীবনের নানান বিপদ-মুসিবত, কষ্ট ও জটিলতার সামনে। সে বিশ্বাস করে যত সংকটই আসুক না কেন সব আসে আল্লাহর পক্ষ থেকে। ফলে সে তা হালকা ভাবে মেনে নেয়। বিপদে পড়েও খুশি থাকে। এ ক্ষেত্রে ক্ষোভ, হতাশা ও অস্থিরতা প্রকাশ করে না। নিজের ভাষা ও আচরণকে সংযত রাখে। কারণ, সে আল্লাহর প্রতি গভীরভাবে বিশ্বাসী। সে তকদীরকে বিশ্বাস করে। তকদীরকে বিশ্বাস করা ঈমানের ছয়টি রোকনের একটি।

তাকীরের উপর ঈমান রাখলে তার অনেক সুফল পাওয়া যায়। তন্মধ্যে একটি হল, বিপদে ধৈর্য ধারণ। সুতরাং কোন ব্যক্তি বিপদে সবর না করলে তার অর্থ হল, তার কাছে ঈমানের এই গুরুত্বপূর্ণ খুঁটিটি অনুপস্থিত। অথবা থাকলেও তা খুব নড়বড়ে। ফলে সে বিপদ মূহুর্তে রাগে-ক্ষোভে ধৈর্যহীন হয়ে পড়ে। অথচ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খবর দিয়েছেন যে, এটা এমন এক কুফুরী মূলক কাজ যা আকীদার মধ্যে ফাটল সৃষ্টি করে।

বিপদ-আপদের মাধ্যমে বান্দার গুনাহ মোচন হয়:

আল্লাহ তায়ালা তার বান্দাদেরকে বিভিন্ন বালা-মুসিবত দেন এক মহান উদ্দেশ্যে। তা হল এসবের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা বান্দার গুনাহ মোচন করে থাকেন। যেমন আনাস রা. বর্ণিত হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: “আল্লাহ যখন কোন বান্দার কল্যাণ চান তখন দুনিয়াতেই তাকে শাস্তি দেন। কিন্তু বান্দার অকল্যাণ চাইলে তিনি তার গুনাহের শাস্তি থেকে বিরত রেখে কিয়ামতের দিন তার যথার্থ প্রাপ্য দেন।

ইবনে তাইমিয়া রহঃ বলেন: “বিপদ-মুসিবত হল নেয়ামত। কারণ এতে গুনাহ মাফ হয়। বিপদে ধৈর্য ধারণ করলে তার প্রতিদান পাওয়া যায়। বিপদে পড়লে আল্লাহর কাছে আরও বেশি রোনাজারি করতে হয়। তার নিকট আরও বেশি ধর্না দিতে হয়। আল্লাহর নিকট নিজের অভাব ও অসাহয়ত্তের কথা তুলে ধরার প্রয়োজন হয়। সৃষ্টি জীব থেকে বিমুখ হয়ে এক আল্লাহর দিকে ফিরে আসতে হয়।…বিপদের মধ্যে এ রকম অনেক বড় বড় কল্যাণ নিহিত রয়েছে।

বিপদে পড়লে যদি গুনাহ মোচন হয়, পাপরাশী ঝরে যায় তবে এটা তো বিশাল এক নেয়ামত। সাধারণভাবে বালা-মসিবত আল্লাহর রহমত ও নেয়ামত লাভের মাধ্যম। তবে কোন ব্যক্তি যদি এ বিপদের কারণে এর থেকে আগের থেকে আরও বড় গুনাহের কাজে জড়িয়ে পড়ে তবে তা দ্বীনের ক্ষেত্রে তার জন্য বিশাল ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। কারণ, কিছু মানুষ আছে যারা দারিদ্রতায় পড়লে বা অসুস্থ হলে তাদের মধ্যে মুনাফেকি, ধৈর্য হীনতা, মনোরোগ, স্পষ্ট কুফুরী ইত্যাদি নানান সমস্যা সৃষ্টি হয়। এমনকি অনেকে কিছু ফরয কাজ ছেড়ে দেয়। অনেকে বিভিন্ন হারাম কাজে লিপ্ত হয়। ফলে দ্বীনের ক্ষেত্রে তার বড় ক্ষতি হয়ে যায়। সুতরাং এ রকম ব্যক্তির ক্ষেত্রে বিপদ না হওয়াই কল্যাণকর। মুসীবতের কারণে নয় বরং মুসীবতে পড়ে তার মধ্যে যে সমস্যা সৃষ্টি তার কারণে বিপদ না আসাই তার জন্য কল্যাণকর।

পক্ষান্তরে বিপদ-মুসীবত যদি কোন ব্যক্তির মধ্যে ধৈর্য ও আনুগত্য সৃষ্টি করে তবে এই মুসীবত তার জন্য দ্বীনের ক্ষেত্রে বিশাল নেয়ামতে পরিণত হয়….।”

বিপদ-আপদ দিয়ে আল্লাহ তায়ালা বান্দার ধৈর্যের পরীক্ষা নেন:

বিপদ দিয়ে আল্লাহ পরীক্ষা করেন কে ধৈর্যের পরিচয় দেয় এবং আল্লাহর সিদ্ধান্তে সন্তুষ্ট থাকে পক্ষান্তরে কে ধৈর্য হীনতার পরিচয় দেয় ও আল্লাহর সিদ্ধান্তে অসন্তোষ প্রকাশ করে। যেমন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: “বিপদ যত কঠিন হয় পুরস্কারও তত বড় হয়। আল্লাহ কোন জাতিকে ভালবাসলে তাদেরকে পরীক্ষা করেন। সুতরাং যে তাতে সন্তুষ্ট থাকে আল্লাহ তার প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে যান আর যে তাতে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করে আল্লাহ তার উপর সন্তুষ্ট হয়ে যান।

অত্র হাদীসে আমাদের জন্য অনেক শিক্ষণীয় দিক রয়েছে। যেমন:

১) বান্দা যেমন আমল করবে তেমনই প্রতিদান পাবে। “যেমন কর্ম তেমন ফল।”
২) এখানে আল্লাহর একটি গুনের পরিচয় পাওয়া যায়। তা হল ‘সন্তুষ্ট হওয়া’। আল্লাহ তায়ালার অন্যান্য গুনের মতই এটি একটি গুন। অন্য সব গুনের মতই এটিও আল্লাহর জন্য প্রযোজ্য হবে যেমনটি তার জন্য উপযুক্ত হয়।
৩) অত্র হাদীসে জানা গেল যে, আল্লাহ তায়ালা এক বিশাল উদ্দেশ্যে বান্দা উপর বিপদ-মসিবত দিয়ে থাকেন। তা হল তিনি এর মাধ্যমে তার প্রিয়পাত্রদেরকে পরীক্ষা করেন।
৪) এখানে তকদীরের প্রমাণ পাওয়া যায়।
৫) মানব জীবনে যত বিপদাপদই আসুক না কেন সব আসে আল্লাহর তকদীর তথা পূর্ব নির্ধারিত ফয়সালা অনুযায়ী।
৬) এখান থেকে শিক্ষা পাওয়া যায় যে, বিপদ নেমে আসলে ধৈর্যের সাথে তা মোকাবেলা করতে হবে। পাশাপাশি প্রতিটি মূহুর্তে প্রতিটি বিপদের মুখে আল্লাহর নিকটই ধর্না দিতে হবে এবং তার উপরই ভরসা রেখে পথ চলতে হবে।

ধৈর্যের পরিণতি প্রশংসনীয়:

জীবনের সকল কষ্ট ও বিপদাপদে আল্লাহ তায়ালা নামায ও সবরের মাধ্যমে তাঁর নিকট সাহায্য চাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। কারণ, এতেই মানুষের কল্যাণ নিহিত রয়েছে। ধৈর্যের পরিণতি প্রশংসনীয়। আল্লাহ তায়ালা খবর দিয়েছেন যে, তিনি ধৈর্যশীলদের সাথেই থাকেন। অর্থাৎ তাদেরকে তিনি তাদের সাহায্য করেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন: “হে ঈমানদারগণ, তোমরা নামায ও সবরের মাধ্যমে আল্লাহর সাহায্য অনুসন্ধান কর। নিশ্চয় আল্লাহ সবরকারীদের সাথে থাকেন।” [সূরা বাকরা: ১৫৩]

এখান থেকে ধৈর্য ধারণ করার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করা যায়। মুমিন ব্যক্তির জন্য জীবনের প্রতিটি পদে পদে ধৈর্যের পরিচয় দেয়া দরকার। এই সবরের মাধ্যমে আকীদা ও বিশ্বাস দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হয়।

আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে ধৈর্য ধারণ করার তাওফীক দান করুন।

আমীন।

লেকচারঃ সলাতের বিধি বিধান

DVD009

সংক্ষিপ্ত বর্ণনাঃ এই আলোচনা সিরিজে শাইখ ড মনজুর ই ইলাহী সলাতের বিধি বিধান গুলো বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। নিজে শুনুন ও শেয়ার করুন। জাযাকাল্লাহ খাইরন।

ডাউনলোড

পর্ব ১

পর্ব ২

পর্ব ৩

কীভাবে আপনি জান্নাত লাভ করবেন পর্ব – ২

Natural-beauty1

লেখকঃ ইউসুফ ইবন মুহাম্মাদ আল ‘উয়াইয়েদ | অনুবাদ: ড. মোহাম্মাদ মানজুরে ইলাহী |  সম্পাদনা: ড. আবু বকর মোহাম্মদ যাকারিয়া

পর্ব- ১ | পর্ব – ২

যে সকল সহজ আমল জান্নাতে প্রবেশের কারণ ও উপায়, তন্মধ্যে রয়েছে:

১. রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক কিছু সরিয়ে দেয়া, জন্তু জানোয়ারের প্রতি করুণা করা, উত্তম চরিত্র, কথা ও কাজে সততা, ক্রোধ সংবরণ করা এবং রাগ না করা, রোগী দেখতে যাওয়া ও সেবা করা, মুসলিম ভাইদের সাথে দেখা সাক্ষাৎ করা, বেচাকেনার ক্ষেত্রে উদার হওয়া এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির মানদন্ডে কথা বলা। আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি: ‘‘আমি একজন লোককে জান্নাতে এপাশ ওপাশ করতে দেখেছি রাস্তার উপর থেকে একটি গাছ কেটে ফেলার কারণে যার দরূন মানুষের চলাফেরায় কষ্ট হতো।’’ [মুসলিম]

আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বর্ণনা করেন: ‘‘এক ব্যক্তি একটি কুকুরকে পিপাসায় মাটি চাটতে দেখে। অতঃপর লোকটি নিজের মোজার সাহায্যে কুকুরটিকে পানি পান করালো। ফলে আল্লাহ তাকে প্রতিদান দিলেন এবং জান্নাত দান করলেন।’’ [বুখারী]

আবু উমামা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: ‘‘আমি জান্নাতের আঙ্গিনায় এমন একটি ঘরের গ্যারান্টিদাতা, যে ঘরটি ঐ ব্যক্তির জন্য হবে, হকদার হওয়া সত্ত্বেও যে ঝগড়া করে না। অনুরূপভাবে আমি জান্নাতের মাঝে ঐ ঘরেরও গ্যারান্টিদাতা, যে ঘরটি ঐ ব্যক্তির জন্য, যে ঠাট্টা করেও মিথ্যা বলে না। তদুপরি জান্নাতের উপরিভাগের ঐ ঘরেরও আমি জামিনদার, যে ঘরটি হবে উত্তম চরিত্রের অধিকারী ব্যক্তির জন্য।’’ [আবু দাউদ এ হাদীস রেওয়ায়েত করেছেন এবং আলবানী একে সহীহ বলেছেন]

আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: ‘‘নিঃসন্দেহে সততা পূণ্যের দিকে পথ দেখায়। আর পূণ্য জান্নাতের দিশা দেয়। একজন ব্যক্তি সত্য বলতে বলতে সত্যবাদী হয়ে যায়। পক্ষান্তরে মিথ্যা কথা খারাপ ও গুনাহের দিকে ঠেলে দেয়। আর গুনাহ ও পাপ দোযখের দিকে নিয়ে যায়। একজন ব্যক্তি মিথ্যা বলতে থাকে। এভাবে সে আল্লাহর নিকট মিথ্যাবাদী বলে লিখিত হয়ে যায়।’’ [বুখারী ও মুসলিম]

আবুদ দারদা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত যে, এক ব্যক্তি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বললেন: ‘‘আমাকে এমন একটি আমল শিক্ষা দিন যা আমাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ক্রোধান্বিত হয়ো না, তাহলে জান্নাতে যাবে।’’ [তাবারানী এ হাদীস বর্ণনা করেছেন এবং আলবানী সহীহ বলেছেন]

সাওবান রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: ‘‘যে ব্যক্তি কোন রুগীকে দেখতে গেল, সে ফিরে না আসা পর্যন্ত জান্নাতের ফল কুড়ানো অবস্থায় থাকে।’’ [মুসলিম]

আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: ‘‘যে ব্যক্তি কোন রুগীকে দেখতে গেল অথবা আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে কোন ভাইকে দেখতে গেল, তখন একজন আহবানকারী তাকে ডেকে বলে: তোমার ও তোমার চলার পথ কল্যাণময় হোক, সুন্দর হোক। তুমি জান্নাতে তোমার বাসস্থান করে নিয়েছ।’’ [ইবনে মাজাহ, তিরমিযী হাদীসটি বর্ণনা করেছেন এবং আলবানী অন্যান্য হাদীসের সমর্থনে একে সহীহ বলেছেন]

উসমান ইবন আফফান রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: ‘‘আল্লাহ তা’লা এমন এক ব্যক্তিকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন, যে বেচাকেনায়, বিচার ফয়সালা করায় এবং বিচার চাওয়ায় সরলতা অবলম্বন করেছে।’’ [ইমাম আহমাদ ও নাসায়ী হাদীসটি রেওয়ায়েত করেছেন এবং আলবানী একে উত্তম বলেছেন। আর আহমাদ শাকির এর সনদকে সহীহ বলেছেন]

আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: ‘‘যে বান্দা আল্লাহর সন্তুষ্টির মানদন্ডে কথা বলে, এ ব্যাপারে কোন ভ্রূক্ষেপ করে না। একথার দরূন আল্লাহ তার মান-মর্যাদা বৃদ্ধি করেন। অন্যদিকে যে ব্যক্তি আল্লাহর অসন্তুষ্টিমূলক কথা বলে অথচ এ ব্যাপারে ভ্রূক্ষেপও করে না, আল্লাহ তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করেন।’’ [বুখারী]

২. জান্নাতের মধ্যে মুসলিম ব্যক্তির সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ ও সুন্দর স্থান হলো যে ব্যক্তি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথী হবে। আর কন্যাদের সঠিক শিক্ষাদান ও লালন পালন করা এবং ইয়াতীমের দায়িত্ব গ্রহণ করা জান্নাতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সান্নিধ্য পাওয়া ও তাঁর প্রতিবেশী হওয়ার সুনিশ্চিত কারণ।  আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: ‘‘যে ব্যক্তি দু’ কন্যাকে সাবালিকা হওয়া পর্যন্ত লালন পালন করে, কিয়ামতের দিন আমি ও সে একত্রে থাকব’’ , এই বলে তিনি তাঁর দু’ আঙ্গুলকে একত্র করে দেখালেন। [মুসলিম]

সহল ইবন সা’দ থেকে বর্ণিত যে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: ‘‘আমি এবং ইয়াতিমের অভিভাবক জান্নাতে এভাবে থাকব’’। এ কথা বলে তিনি শাহাদাত ও মধ্যমা আঙ্গুল দু’টোকে একত্রে মিলিয়ে দু’টোর মাঝে একটু ফাঁক রাখলেন।’’ [বুখারী]

৩. পিতামাতা উভয়ের প্রতি অথবা যে কোন একজনের প্রতি সদ্ব্যবহার করাও জান্নাতে যাওয়ার উপায়। আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি: ‘‘ঐ ব্যক্তির নাক ধুলো মলিন হোক (৩ বার) অর্থাৎ সে ধ্বংস হোক। প্রশ্ন করা হলো: হে আললাহর রাসূল! কোন ব্যক্তির? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জবাব দিলেন: ‘‘যে ব্যক্তি পিতামাতাকে অথবা তাদের যে কোন একজনকে বৃদ্ধ অবস্থায় পেল, তারপরও জান্নাতে যেতে পারলো না।’’ [মুসলিম]

আবুদ দারদা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি: ‘‘পিতা হলো জান্নাতের মাঝের দরজা। তুমি চাইলে এ দরজার হেফাযত করতে পার অথবা হারাতে পার।’’ [তিরমিযী, ইবনে মাজাহ ও আহমাদ এটি বর্ণনা করেছেন এবং আলবানী একে সহীহ বলেছেন]

জনৈক ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট এসে যুদ্ধে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলো। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে তার মা আছে কিনা জিজ্ঞাসা করলো। লোকটি বললো: জী, আমার মা আছেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন: ‘‘তুমি সার্বক্ষণিক তার দেখাশুনা কর, কেননা তার পায়ের নিকটেই জান্নাত রয়েছে।’’ [আহমাদ, নাসায়ী ও ইবনে মাজাহ এ হাদীস রেওয়ায়েত করেছেন এবং আলবানী একে উত্তম ও সহীহ বলেছেন]

৪. মানুষের সবচেয়ে বড় কাজ হল তার জিহবা ও লজ্জাস্থানের হেফাযত করা। সুতরাং যে ব্যক্তি এ দু’টো হেফাযতের দায়িত্ব নিবে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার জান্নাতের ব্যাপারে দায়িত্ব নিবেন। সহল ইবন সা’দ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত যে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: ‘‘যে ব্যক্তি তার দুই চোয়ালের মাঝের বস্তু (জিহবা) এবং দু’ পায়ের মধ্যখানের (লজ্জাস্থান) হেফাযতের গ্যারান্টি দিবে, আমি তার জান্নাতের ব্যাপারে গ্যারান্টি দেব।’’ [বুখারী]

৫. মানুষ পৃথিবীতে আল্লাহর পক্ষ থেকে সাক্ষীস্বরূপ। সুতরাং মানুষ যার পক্ষে ভাল সাক্ষ্য দেয়, সে জান্নাতে প্রবেশ করে।

আনাস ইবন মালেক রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: একদা একটি লাশের পাশ দিয়ে অতিক্রম করার সময় তার ভাল প্রশংসা করা হল। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন: ‘‘ওয়াজিব হলো, ওয়াজিব হলো, ওয়াজিব হলো।’’ অনুরূপভাবে আরো একটি লাশের পাশ দিয়ে অতিক্রম করা হল। এটি সম্পর্কে খারাপ বর্ণনা করা হলো। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন বললেন: ‘‘ওয়াজিব হলো’’ (৩ বার)। এরপর উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এর কারণ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উত্তরে বললেন: ‘‘তোমরা যার ভাল প্রশংসা কর, তার জন্য জান্নাত অপরিহার্য হয়ে যায়। আর তোমরা যার খারাপ বর্ণনা কর, তার জন্য জাহান্নাম অপরিহার্য হয়ে যায়। তোমরা পৃথিবীতে আল্লাহর সাক্ষী।’’ (৩ বার বললেন) [বুখারী ও মুসলিম]

৬. আল্লাহ তা’লা এরশাদ করেন: ‘‘নিশ্চয় সবরকারীগণকে বেহিসাবী প্রতিদান দেয়া হয়।’’ [সূরা আযযুমার: ১০]

তাই সবর হলো আল্লাহর প্রতি বান্দার ঈমান এবং তাঁর নৈকট্যের আলামতসমূহের একটি আলামত। সুতরাং যে ব্যক্তি তার প্রিয়জন যথা: সন্তান, ভাই-বেরাদার ইত্যাদির মৃত্যুতে ধৈর্য্য ধারণ করে, সে জান্নাতী। আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত যে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: ‘‘আল্লাহ তা’লা বলেন, আমার মু’মিন বান্দার নিকট থেকে যখন তার অতি প্রিয়জনের জান কবয করা হয়, আর সে আল্লাহর নিকট সাওয়াবের আশা করে ধৈর্য্যধারণ করে, তার প্রতিদান আমার নিকট জান্নাত ছাড়া আর কিছু নয়।’’ [বুখারী]

আবু মূসা আশআরী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: ‘‘যখন কোন বান্দার সন্তান মারা যায়, তখন আল্লাহ তাঁর  ফেরেস্তাদের জিজ্ঞাসা করেন: তোমরা কি আমার বান্দার সন্তানের জান কবজ করেছো? তারা বলেন, হ্যাঁ। আল্লাহ বলেন, তোমরা কি তার কলিজার টুকরার জান কবজ করেছো? তারা বলেন, হ্যাঁ। আল্লাহ আবার বলেন, আমার বান্দা কি বললো? ফেরেস্তারা জবাব দেন, সে আল্লাহর প্রশংসা করেছে এবং বলেছে: (إنا لله وإنا إليه راجعون) ‘নিশ্চয়ই আমরা আল্লাহরই জন্য এবং আল্লাহর দিকেই আমাদের প্রত্যাবর্তন করতে হবে’। আল্লাহ তখন বলেন: তোমরা আমার বান্দার জন্য জান্নাতে একটি ঘর নির্মাণ কর এবং এ ঘরটির নাম দাও ‘বায়তুল হামদ’ বা প্রশংসার ঘর।’’ [তিরমিযী এ হাদীস বর্ণনা করেছেন এবং আলবানী উত্তম বলেছেন]

৭. যে ব্যক্তি অন্ধ হয়েও ধৈর্য্যধারণ করে সে জান্নাতে যাবে। আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: আমি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি: ‘‘আল্লাহ তা’লা বলেন, ‘আমার বান্দাকে তার দু’টি প্রিয় বস্তু (অর্থাৎ চোখ) কেড়ে নিয়ে পরীক্ষা করি। অতঃপর সে ধৈর্য্যধারণ করে। আমি এ দু’টোর পরিবর্তে তাকে জান্নাত দান করি।’’ [বুখারী]

৮. যে মুসলিম নারী সৎ কাজে তার স্বামীর আনুগত্য করে এবং আল্লাহর হুকুম আহকাম পালন করে, সে জান্নাতের যে দরজা দিয়ে ইচ্ছা প্রবেশ করবে। আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত যে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: ‘‘যদি কোন মহিলা পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করে, রমযানের রোযা পালন করে, লজ্জাস্থানের হেফাযত করে এবং স্বামীর আনুগত্য করে, সে জান্নাতের যে দরজা দিয়ে ইচ্ছা প্রবেশ করবে।’’ [ইবনু হিববান এটি বর্ণনা করেছেন এবং আলবানী একে সহীহ বলেছেন]

৯. মুসলিম মহিলা প্রসবের সময় মারা গেলে তার সন্তান ভূমিষ্ট হওয়ার সাথে সাথে তার প্রসব বেদনা তাকে জান্নাতের দিকে নিয়ে যায়। রাশেদ ইবন হুবাইশ থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: ‘‘আল্লাহর পথে নিহত ব্যক্তি শহীদ, প্লেগরোগে মারা যাওয়া ব্যক্তি শহীদ, ডুবে মরে যাওয়া ব্যক্তি শহীদ, পেটের পীড়ায় মারা যাওয়া ব্যক্তি শহীদ, আগুনে পুড়ে মারা যাওয়া ব্যক্তি শহীদ, অসুস্থ অবস্থায় মৃত ব্যক্তি শহীদ এবং সন্তান প্রসবের পর নেফাস অবস্থায় মৃত মহিলা, তার সন্তান ভূমিষ্ট হওয়ার কারণে সে জান্নাতে চলে যায়।’’ [আহমাদ হাদীসটি বর্ননা করেছেন, আলবানী একে উত্তম বলেছেন]

১০. যে ভিক্ষাবৃত্তি থেকে বিরত থাকলো আল্লাহর রাসূল তাকে জান্নাতে নেয়ার জামিন হলো। সাওবান রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: ‘‘যে ব্যক্তি মানুষের নিকট হাত না পাতার দায়িত্ব নিবে, আমি তাকে জান্নাতে নেয়ার দায়িত্ব নেব।’’ [আহমাদ, নাসায়ী, ইবনে মাজাহ ও আবু দাউদ হাদীসটি রেওয়ায়েত করেছেন এবং আলবানী একে সহীহ বলেছেন]

১১. যে ব্যক্তি নিজের সম্পত্তি রক্ষা করতে গিয়ে নিহত হয়, সেও জান্নাতী। আবদুল্লাহ ইবন আমর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত যে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: ‘‘যে ব্যক্তি সম্পদ রক্ষার নিমিত্তে নিপীড়িত হয়ে মারা যায়, তার জন্য রয়েছে জান্নাত।’’ [নাসায়ী এটি বর্ণনা করেছেন এবং আলবানী সহীহ বলেছেন]

১২. প্রিয় পাঠক! আপনার জন্য রয়েছে জান্নাত, যদি আপনি সালাম প্রচার করেন, অন্যকে খাদ্য দান করেন, আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখেন এবং রাতের বেলা মানুষ ঘুমিয়ে গেলে সালাত আদায় করেন। আবদুল্লাহ ইবন সালাম থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: ‘‘হে মানব সকল! তোমরা সালামের প্রসার কর, খাদ্য প্রদান কর, আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখ এবং মানুষ ঘুমিয়ে গেলে রাতের সালাত আদায় কর। তাহলে নিরাপদে জান্নাতে যেতে পারবে।’’ [তিরমিযী, ইবনে মাজাহ, আহমাদ ও হাকেম হাদীসটি রেওয়ায়েত করেছেন এবং আলবানী সহীহ বলেছেন]

শুরাইহ ইবন হানী তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন: ‘‘হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে এমন বিষয়ে অবহিত করুন যা আমার জান্নাতে যাওয়াকে নিশ্চিত করবে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উত্তরে বললেন:তুমি সর্বদা উত্তম কথা বলবে এবং খাদ্য দান করবে।’’ [বুখারী আদাবুল মুফরাদে এবং হাকেম হাদীসটি বর্ণনা  করেছেন এবং আলবানী সহীহ বলেছেন]

১৩. যে ব্যক্তি অহংকার, ঋণ ও যুদ্ধে লব্ধ গণীমতের মালের খেয়ানত থেকে মুক্ত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করবে, সে জান্নাতে যাবে। সাওবান রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: ‘‘যে ব্যক্তি অহংকার, গণীমতের সম্পদে খেয়ানত করা এবং ঋণ থেকে মুক্ত অবস্থায় মারা গেল, সে জান্নাতে প্রবেশ করলো।’’ [তিরমিযী, নাসায়ী ও ইবনে মাজাহ এটি রেওয়ায়েত করেছেন এবং আলবানী সহীহ বলেছেন]

১৪. আল্লাহর কিতাব ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাতকে অবলম্বন করে যারা মুসলিম জামায়াতকে মজবুতভাবে আঁকড়ে ধরে থাকবে, তারা জান্নাতের মধ্যবর্তী স্থানে প্রবেশ করবে। উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত যে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: ‘‘তোমাদের জন্য ইসলামী জামায়াতকে আঁকড়ে ধরা অপরিহার্য। আর বিচ্ছিন্ন হওয়া থেকে বেঁচে থাক। কেননা একা একা থাকলে শয়তান তার সঙ্গী হয়। আর জামায়াতবদ্ধ দু’ ব্যক্তি থেকে শয়তান অনেক দূরে অবস্থান করে। যে ব্যক্তি জান্নাতের মধ্যবর্তী স্থান পাওয়ার আশা করে, সে যেন অবশ্যই ইসলামী জামায়াতকে আঁকড়ে ধরে।’’ [তিরমিযী এ হাদীস বর্ণনা করেছেন এবং আলবানী সহীহ বলেছেন]

১৫. ন্যায়পরায়ণ শাসক, কোমল হৃদয়ের অধিকারী দয়ালু ব্যক্তি এবং চরিত্রবান ও সুরুচিপূর্ণ পরিবার প্রধান জান্নাতবাসীদের অন্তর্গত। ইয়ায ইবন হিমার রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত যে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্ল­াম বলেছেন: ‘‘তিনশ্রেণীর লোকেরা জান্নাতবাসী হবে। এক: ন্যায়পরায়ণ, দাতা ও আল্লাহর তাওফীকপ্রাপ্ত শাসক, দুই: দয়ালু ব্যক্তি যার অন্তর প্রতিটি আত্মীয় ও মুসলিমের জন্য কোমল, এবং তিন: সুরুচিপূর্ণ চরিত্রবান পরিবার প্রধান।’’ [মুসলিম]

১৬. যে বিচারক ন্যায় ও ইনসাফের সাথে মানুষের বিচার ফয়সালা করে, সে জান্নাতী। বুরাইদাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্ল­াম থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন: ‘‘বিচারকগণ তিন প্রকার। দুই শ্রেণীর বিচারক হবে জাহান্নামী আর এক শ্রেণীর বিচারক হবে জান্নাতী। যে ব্যক্তি সত্য জেনে সে অনুযায়ী ফয়সালা করলো, সে জান্নাতী। অন্য দিকে যে ব্যক্তি না জেনে মূর্খতাবশতঃ ফয়সালা দেয়, সে জাহান্নামী। আর যে ব্যক্তি সত্য জানার পরও যুল্ম করলো, সে জাহান্নামী।’’ [আবু দাউদ, তিরমিযী,নাসায়ী, ইবনে মাজাহ ও হাকেম হাদীসটি রেওয়ায়েত করেছেন এবং আলবানী সহীহ বলেছেন]

১৭. সত্তর হাজার লোক বিনা হিসাবে জান্নাতে প্রবেশ করবে, তারা হল যারা কারো নিকট ঝাড়ফুঁক চায়নি, পাখি দ্বারা ভাগ্য নির্ণয় করেনি এবং কারো নিকট বিশেষ চিকিৎসা চায়নি। ইমরান ইবন হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত যে, আল্লাহর রাসূল সাল্ল­াল্ল­­াহু আলাইহি ওয়া সাল্ল­­াম বলেন: ‘‘আমার উম্মাতের মধ্যে ৭০ হাজার হিসাব ছাড়াই জান্নাতে প্রবেশ করবে। সাহাবাগণ জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! তারা কারা? নবী সাল্ল­াল্ল­­াহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন: তারা হলো যারা কারো নিকট ঝাড়ফুঁক চায়না, পাখির সাহায্যে ভাগ্য নির্ধারণ করে না, কারো নিকট বিশেষ চিকিৎসার জন্য যায় না। বস্তুতঃ তারা তাদের প্রতিপালকের উপর ভরসা করে।’’ [বোখারী ও মুসলিম]

লক্ষ্যণীয় যে, শরীয়তসম্মত ঝাড়ফুঁক এবং বিশেষ চিকিৎসা করা শরীয়তে নিষিদ্ধ নয়। কিন্তু আল্লাহর উপর পরিপূর্ণ ভরসা করা উত্তম।

১৮. কতগুলো গুণ ও বৈশিষ্ট্য কোন মুসলিম ব্যক্তির মধ্যে অর্জিত হলে এগুলোর কারণে সে জান্নাতবাসীদের অন্তর্ভূক্ত হবে। উবাদাহ ইবন সামিত রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: ‘‘তোমরা তোমাদের নিজেদের মধ্যে ৬টি গুণ অর্জনের জামিন হও, আমি তোমাদের জন্য জান্নাতের জামিন হবো। এক: কথা বলার সময় সত্য বলবে, দুই: ওয়াদা করে তা পূরণ করবে, তিন: তোমাদের নিকট আমানাত রাখা হলে সে আমানাত আদায় করবে, চার: লজ্জাস্থানের হেফাযত করবে, পাঁচ: দৃষ্টিকে সংযত রাখবে, ছয়: তোমদের হাতকে অন্যায় করা থেকে বিরত রাখবে।’’ [আহমাদ, ইবনু হিববান ও হাকিম হাদীসটি বর্ণনা করেছেন এবং আলবানী সহীহ বলেছেন]

আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: ‘‘তোমাদের মধ্যে আজ কে রোযা রেখেছো? আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, আমি। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন: তোমাদের মধ্যে আজ কে জানাযার অনুসরণ করেছো? আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, আমি। নবী সাল্লাল্ল­­াহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন: তোমাদের কে আজ মিসকীনকে খাদ্য দান করেছো? আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, আমি। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পুনরায় বললেন: তোমাদের মধ্যে কে আজ রুগীর সেবা করেছো? আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, আমি। অতঃপর রাসূল সাল্ল­ল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লা­ম বললেন: উপরোক্ত গুণাবলী যে ব্যক্তির মধ্যে একত্রিত হবে সে অবশ্যই জান্নাতে প্রবেশ করবে।’’ [বুখারী ও মুসলিম]

প্রিয় পাঠক! পরিশেষে আপনাকে তাওবার কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি। বস্তুতঃ গুনাহ থেকে তাওবাকারী নিষ্পাপ, যার কোন গুনাহ নেই। আল্লাহর নিকট খাঁটি তাওবাকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে। মহান আল্লাহ তা’লা বলেন: ‘‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর নিকট নিষ্ঠাপূর্ণ খাঁটি তাওবা কর। আশা করা যায় তোমাদের প্রতিপালক তোমদের সকল ত্রুটি বিচ্যুতি মিটিয়ে দেবেন এবং তোমাদেরকে এমন জান্নাতে প্রবেশ করাবেন যার তলদেশ দিয়ে নদী প্রবাহিত।’’ [সূরা আত তাহরীম: ৮]

উপসংহার

পরিশেষে প্রিয় পাঠক! আপনি আপনার নিজের ভেতরে ঈমানে পরিপূর্ণ একটি মন আর আল্লাহর সন্তুষ্টি ও জান্নাতের আকাংখায় ভরপুর একটি আত্মার অধিকারী। আপনার সুখ ও আনন্দ হলো – নেয়ামতপূর্ণ জান্নাতে আপনি নবী, সত্যবাদী শহীদ এবং সৎকর্মশীল ব্যক্তিগণের সঙ্গী হতে চান, যাদের প্রতি আল্লাহ অনুগ্রহ করেছেন।

বস্তুতঃ জান্নাত প্রস্তুত ও নিকটবর্তী। দয়ালু ও করুণাময় আল্লাহই এর দিকে আহবান করছেন। আপনার প্রিয় নবী মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জান্নাতের দরজায় দাঁড়িয়ে আপনাকে ডাকছেন – ‘হে মু’মিন! আস, জান্নাতবাসী হও’।

অতএব জান্নাত আপনার জন্য দুনিয়ার জীবনে, মৃত্যুর সময় এবং হিসাব-নিকাশের সময় আল্লাহর পক্ষ থেকে সুসংবাদ। মহান আল্লাহ আপনাকে জান্নাতের ফল এবং এর অসংখ্য নেয়ামত দ্রুত অর্জনের জন্য আদেশ করছেন। আর আল্লাহ ওয়াদা ভঙ্গ করেন না।

মহান প্রতিপালক জান্নাতের অতি সুন্দর ও উত্তম বর্ণনা দিয়েছেন এবং একে মানুষের কল্পনাতীত বস্তু দিয়ে সুসজ্জিত করেছেন। যাতে আপনি সেখানে চিরস্থায়ী সুখ ও ভোগের  সাথে জীবন যাপন করতে পারেন।

সুতরাং আপনি জান্নাতে প্রবেশের জন্য অগ্রসর হোন। আপনার প্রতি আল্লাহ তা’লার ভালবাসা ও খুশীর বহিঃপ্রকাশ এটাই। এসব কিছুই প্রতিফলিত হবে স্বল্প আমল করার মাধ্যমে, যে আমল করার জন্য আল্লাহ ও তাঁর রাসূল আপনাকে নির্দেশ দিয়েছেন। এ আমলগুলো করার পর আল্লাহর রহমত ও মাগফিরাত আপনার জন্য প্রশস্ত হবে। সুতরাং আসুন এবং এ দিকে অগ্রসর হোন। মহান আল্লাহর ঘোষণা: ‘‘তোমার রবের মাগফিরাত এবং ঐ জান্নাতের দিকে ধাবিত হও যার  প্রশস্ততা আসমানসমূহ ও যমীনের সমান, যা মুত্তাকীদের জন্য তৈরী করা হয়েছে।’’ [সূরা আল ইমরান: ১৩৩]

বন্ধুগণ! মুত্তাকীরাই হলো আল্লাহর অলী ও বন্ধু। তারাই দুনিয়া ও আখিরাতের সুসংবাদের হকদার। তাদের আমলই গ্রহণযোগ্য। তারাই জান্নাতে আল্লাহর নিকট অধিক মর্যাদাসম্পন্ন। আর মুত্তাকীগণ এ তত্ত্বগুলো ভাল করেই জানে। কেননা তারা আল্লাহ তা’লার একত্ববাদে বিশ্বাসী। তাঁর সাথে কোন কিছুকে তারা শরীক করেনি। তারা আল্লাহ সুবহানাহু ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কথার উপর অন্য কারো কথাকে প্রধান্য দেয় না। তারা সকল আমলকে কুরআন কারীম ও সহীহ হাদীস থেকে গ্রহণ করে। আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বাদ দিয়ে তারা কোন অলী, শায়খ কিংবা আলেম উলামার কথাকে গুরুত্ব দেয় না। অহী থেকে প্রাপ্ত কুরআন ও সুন্নাহই হলো সত্য – এটা গ্রহণ করাই তাদের স্বভাব। এছাড়া অন্য কিছুকে তারা মানে না।

মুত্তাকীগণ আল্লাহর মর্যাদার হকদার। কেননা তারা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নিষ্ঠার সাথে সকল কাজ সম্পন্ন করে। এর দ্বারা মানুষের কোন প্রশংসা, স্তুতি ও কৃতজ্ঞতা পাওয়ার আশা তারা করে না। বরং আল্লাহর সন্তুষ্টি ও পরকালীন মুক্তিই তাদের লক্ষ্য।

মুত্তাকীরাই জান্নাতী। কেননা তারা সরল সঠিক মনের অধিকারী। তাদের পাকস্থলীতে হালাল খাদ্য রয়েছে। তাছাড়াও তারা সর্বদা তাদের মাওলা ও মনিবের নিকট তাদের আমলগুলো কবুল হওয়ার জন্য কাতরভাবে দো‘আ করে।

মুত্তাকীগণই তাদের রবের জান্নাত, তাঁর সন্তুষ্টি, সম্মান ও মর্যাদা লাভে ধন্য হবে। তাদেরকেই ফেরেস্তাগণ জান্নাতের দিকে দলে দলে নিয়ে যাবে। ফেরেস্তাগণ তাদেরকে স্বাগতম জানাবে, সালাম বলবে। তাদের প্রতিপালক তাদের আনন্দ ও স্বচ্ছন্দের জন্য তাদের উদ্দেশ্যে সাক্ষাৎ দেবেন।

বন্ধুগণ! এ হলো জান্নাত। উপরোক্ত আমলগুলো হলো জান্নাতীদের আমল। সুতরাং উক্ত আমলগুলো করুন এবং জান্নাতের সুশংবাদ গ্রহণ করুন। আর নিরাশ হবেন না। কেননা আল্লাহর রহমত নেককারদের অতি নিকটে।

ওয়াস্ সালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু।

পর্ব- ১ | পর্ব – ২

সাবস্ক্রাইব করুন

2,018,267FansLike
1,685FollowersFollow
1,150FollowersFollow
6,143FollowersFollow
4,600SubscribersSubscribe