লেখক: উম্মে আব্দ মুনীব, শায়খ মুহাম্মদ বিন সাইদ কাহতানি (রহ) | সম্পাদনা: রাজিব হাসান
রমাদ্বান মাসের শেষ দশক মূলত ঐ দশক যাতে লাইলাতুল কদর রয়েছে। লাইলাতুল কদরের এক রাতের ইবাদত হাজার রাত ইবাদত করার চেয়েও বেশি ফজিলতপূর্ণ। যাতে মাগরিব থেকে নিয়ে ফজর পর্যন্ত শান্তি বর্ষণ হতে থাকে।
আবু হুরায়রা (রাঃ) বর্ণিত, ‘নবীজি (ﷺ) ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি কদরের রাত্রিতে ইমান ও সাওয়াবের আশায় দন্ডায়মান হবে তার পিছনের সকল গুনাহকে ক্ষমা করে দেওয়া হবে।‘ [1]
ইমাম শাবি (রাঃ) লাইলাতুল কদরের ব্যাপারে বলেন, “আমি এর দিনেও তেমনই ইবাদত করার চেষ্টা ও মেহনত করতে পছন্দ করি যেমন এর রাতগুলােতে করি।“ [2]
কোন কোন সালাফ লাইলাতুল কদরের আগমনকে এভাবে স্বাগতম জানাতেন যেভাবে সম্মানিত কোন মেহমানকে স্বাগতম জানানাে হয়। কদরের রাতকে সামনে রেখে উনারা আত্মিকভাবে প্রস্তুত হওয়ার পাশাপাশি শারীরিকভাবেও প্রস্তুত হওয়াকে পছন্দ করতেন।
ইবনু জারির (রহ) রমাদ্বানুল মুবারকের শেষ রাত্রিগুলাের প্রতি রাতেই গােসল করতেন। ইমাম নাখয়ি (রহ) শেষ দশকের প্রতি রাতেই গােসল করতেন। সালাফদের কেউ কেউ সে রাতে গােসল করে নিতেন যে রাত তাদের নিকট লাইলাতুল কদর হওয়ার বেশি সম্ভাব্য মনে হত। [3]
সাবিত আল বুনানি (রহ) বলেন, সাহাবী তামিম আদ-দারি (রাঃ) এর কাছে এক অলংকার ছিল। তিনি এক হাজার দিরহাম দিয়ে সেটি ক্রয় করেছিলেন। যে দিন তার কাছে মনে হত আজ লাইলাতুল কদরের রাত, সেদিনি তিনি। অলংকারটি পড়ে ইবাদাতে মশগুল হতেন। [4]
হাবিব ইবন আবি মুহাম্মাদ (রহ) এবং তার স্ত্রী, উনারা দুজনেই আল্লাহওয়ালা ও দুনিয়াবিমূখ ছিলেন। যখন রমাদ্বানের শেষ দশকে পৌঁছে যেতেন তিনি তখন তার স্ত্রী তাকে বলতেন, “রাত বিগত হল, অথচ আমাদের সামনে দীর্ঘ পথ, পাথেয় খুবই কম। সালাফ-আস-সালিহীনদের কাফেলা আমাদের আগে চলে গেছে, আর আমরা এখনও পিছনে পড়ে আছি।” [5]
আহ! আজকাল এমন স্ত্রী কোথায়, যারা তাদের স্বামীদেরকে ইবাদতের জন্য জাগিয়ে দিবে। যারা স্বামীকে মনে করিয়ে দিবে, আখিরাতের দীর্ঘ ও অফুরন্ত জীবনের জন্য এই দুনিয়া থেকেই পাথেয় জমাতে হবে। হায়! যদি আজকালকার মহিলাদের অন্তরে এই অনুভূতি জাগ্রত হত, আর নবীজি (ﷺ) এর ঐ দুআ অর্জনকারিণী হয়ে যেত ।
আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত, ‘রাসূলুল্লাহ ঙ ইরশাদ করেন, আল্লাহ ঐ ব্যক্তির উপর রহম করুন যে ব্যক্তি রাতে উঠে নফল আদায় করে, অতঃপর তার স্ত্রীকে জাগায় আর সেও নফল আদায় করে। আর স্ত্রী উঠতে আলসেমি করলে তাকে পানির ছিটা দিয়ে জাগায়। আল্লাহ রহম করুন ঐ মহিলার উপর যে মহিলা রাতে উঠে নফল আদায় করে এবং তার স্বামীকে জাগায় আর সেও নফল আদায় করে। আর যদি সে উঠতে অলসতা করে তাহলে সে তাকে পানির ছিটা দিয়ে জাগিয়ে দেয়।‘ [6]
সালাফ আস-সালিহীনগণ রমাদ্বান মাসে অত্যন্ত মনোেযােগের সাথে ইবাদতবন্দেগী, তিলাওয়াত, কিয়ামুল-লাইল এবং দান খয়রাত করতেন। এতদসত্ত্বেও আশা ও ভয়ের মাঝে থাকতেন যে, তাদের আমল রব্বল আলামিনের দরবারে কবুল হবে কিনা? উনারা জানতেন প্রত্যেক আমলের কবুলিয়্যাত নির্ভর করে ইখলাসের বা আন্তরিকতার উপর। আর ইখলাস এমনই এক অমূল্য, সুক্ষ্ম এবং দুষ্প্রাপ্য সম্পদ যাকে অর্জন করার জন্য সালাফগণ যারপরনাই চেষ্টা ও মেহনত করতেন। তবুও তাদের নিকট তা সামান্যই মনে হত।
কেননা বান্দার বড় বড় আমলও সামান্যতম রিয়া বা লৌকিকতা এবং গােপন তাকাব্বর বা অহংকারের কারণে একেবারে ধ্বংস হয়ে যায়। এ কারণেই আমাদের সালাফগণ এত আমল করেও আল্লাহ তা’য়ালার সামনে হাজির হওয়ার ভয়ে ভীতসন্ত্রস্ত থাকতেন।
রমাদ্বান মাস যখন শেষ দিনগুলাের দিকে চলে যেত, তখন সালাফগণ আফসােস করতেন। দুঃখভারাক্রান্ত হৃদয়ে অনুশােচনা করেতেন এই জন্য যে, গুনাহ মাফের মাসে যেসব আমল করা দরকার ছিল, তার কিছুই করা হয়ে উঠেনি। জানা নেই, আগামীতে এই মূল্যবান মাসটি নসিব হবে কিনা?
‘আবু কিলাবাহ (রহ) রমাদ্বানের শেষ দিনগুলােতে তার সুন্দরী দাসীদেরকে এই আশায় আজাদ করে দিতেন যে, আল্লাহ রাব্বল আলামিন তার এই আমলের কারণে জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তি দিবেন।‘ [7]
আমাদের সালাফগণ তাদের অন্তর্চক্ষু দিয়ে কুরআন ও হাদিসে বর্ণিত জাহান্নামের ভয়ানক দৃশ্য দেখতে পেতেন। এটা ছিল তাদের মজবুত ঈমানের পরিচয়। উনারা এটিও মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন যে, জান্নাতের ঐ অসাধারণ ও অতুলনীয় দৃশ্য দেখার জন্য ভঙ্গুর দুনিয়ার তুচ্ছ স্বাদগুলােকে বাদ দিতে হবে। উনারা এসব থেকে দূরে থাকতেন। আমাদের সালাফগণ জানতেন, জাহান্নামকে তার চতুর্দিক থেকে খাহেশাত ও দুনিয়াবি রঙ্গতামাশা দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে। দুনিয়ার এই সব রঙ্গতামাশা বান্দাকে জাহান্নামের দিকে টেনে নিয়ে যায়। অভিশপ্ত শাইত্বন দুনিয়ার জীবনকে ছলনার খােলসে আবৃত করে দেখানাের চেষ্টা করে। অথচ বাস্তবতা হল, এই ছলনার ফাঁদে পা দিয়ে নফস ও শাইত্বনের অনুসরণ করে বান্দার ঠিকানা হ্য উত্তপ্ত জাহান্নামের আগুনে। সালাফগণ কুরআনের এই শিক্ষাকে বুকে লালন করে দুনিয়াবী সকল চাকচিক্য থেকে নিজেদেরকে দূরে রেখেছিলেন।
আমাদের সালাফগণ কুরআন ও হাদিসে জান্নাতের অপূর্ব দৃশ্য সমূহ অন্তর্চক্ষু দিয়ে দেখতে পেতেন। উনারা জানতেন, জান্নাতের উঁচু উঁচু প্রাসাদ, বালাখানা, মহল, আনতনয়না পবিত্র হুরগণ, দুধ-শরাবের ঝর্ণা সুস্বাদু ফলফলাদি, আর সবচাইতে বড় নিয়ামত রব্বে কারীমের স্বাক্ষাৎ – এগুলাে শুধুমাত্র আল্লাহ তা’য়ালার আদেশ-নিষেধ মানার মাধ্যমেই অর্জন করা সম্ভব। এজন্যই উনাদের এত দৌড়ঝাপ। নিজেদের আমল আরশের মালিকের কাছে পছন্দ হল কি তাঁর জন্য তাদের এত চেষ্টা তদবির। মনে একটাই আশা আল্লাহকে খুশি করতে পারলে জান্নাতে তাদের অবস্থান পাকা।
আলী ইবন আবি তালিব (রাঃ) রমাদ্বানের শেষ রাতে আওয়াজ দিয়ে বলতেন, “সে কোথায় আছে, যার আমলগুলাে কবুল হয়েছে। আমরা তাকে মুবারকবাদ জানাবাে। সে কোথায় আছে যে রমাদ্বানের বরকত থেকে মাহরূম রয়ে গেছে। আমরা তাকে সান্তনা দিব।” [8]
আলী (রাঃ) ববাঝাতে চাইতেন, যখন আমার জানা নেই যে রমাদ্বানে আমার কৃত আমলগুলাে কবুল হয়েছে কি না – তাহলে কীসের এত খুশি? কোন সে জ্ঞান আমাকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে? কোন সে জ্ঞান আমাকে জান্নাত হাসিল করেছি বলে জানিয়েছে? আল্লাহর সামনে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে উপস্থিত না হওয়া পর্যন্ত কে আমাকে জানাবে এসব।
জনাব উহাইব বিন ওয়ারদ (রহ) একদল লােককে ইদের দিন বেশ হাসাহাসি করতে দেখে ব্যথিত হৃদয়ে বললেন, “যদি তাদের রােজা কবুল হয়ে থাকে, তাহলে শুকরিয়া আদায়কারীদের পদ্ধতি এরকম নয়, আর যদি তাদের রােজা কবুল না হয়ে থাকে, তাহলে পেরেশানী প্রকাশের রীতিনীতি বা আচরণ এরকম নয়।“ [9]
উৎসঃ সালাফদের সিয়াম, পৃষ্ঠা: ৬৮ – ৭১
[1] বুখারি: ১৯০১
[2] লাতায়েফুল মাআরেফ: ২৮৮
[3] লাতায়েফুল মাআরেফ: ২৬১
[4] লাতায়েফুল মাআরেফ: ২৬৯
[5] লাতায়েফুল মাআরেফ: ২৬৫
[6] আবু দাউদ: ১৩০৮, নাসায়ি: ৩/২০৫
[7] লাতায়েফুল মাআরেফ: ৩০০
[8] লাতায়েফুল মাআরেফ: ২৯৮
[9] লাতায়েফুল মাআরেফ: ২৯৪
'আপনিও হোন ইসলামের প্রচারক'
প্রবন্ধের লেখা অপরিবর্তন রেখে এবং উৎস উল্লেখ্য করে আপনি Facebook, Whatsapp, Telegram, ব্লগ, আপনার বন্ধুদের Email Address সহ অন্য Social Networking ওয়েবসাইটে শেয়ার করতে পারেন, মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিন। ইসলামি দা’ওয়াহ্র ৮০ টিরও বেশী উপায়! বিস্তারিত জানতে এইখানে ক্লিক করুন "কেউ হেদায়েতের দিকে আহবান করলে যতজন তার অনুসরণ করবে প্রত্যেকের সমান সওয়াবের অধিকারী সে হবে, তবে যারা অনুসরণ করেছে তাদের সওয়াবে কোন কমতি হবেনা" [সহীহ্ মুসলিম: ২৬৭৪]