Home Blog Page 2

বই – সেরা হোক এবারের রামাদান – ফ্রী ডাউনলোড

বই: সেরা হোক এবারের রামাদান

লেখক: রৌদ্রময়ী টিম

প্রকাশনায়: সমকালীন প্রকাশন

পৃষ্ঠা সংখ্যা: 184

সংক্ষিপ্ত বর্ণনা: রৌদ্রময়ী একটি প্লাটফর্মের নাম। এখানে আমাদের বোনেরা তাদের মনের কথাগুলো লিখে যান। ইসলামে নারীর অধিকার, নারীদের দ্বীন শিক্ষা, দ্বীন চর্চা, পারিবারিক ব্যবস্থা, সামাজিক বিভিন্ন কুপ্রথা-কুসংস্কার, ইত্যাদি বিষয়ে প্রতিনিয়ত লিখে চলেছেন। ‘সেরা হোক এবারের রামাদান’ বইটি তাদের রামাদান বিষয়ক লেখাগুলোর সংকলন।

PDF ফাইল ওপেন করার জন্য ফ্রি Software/Application

Android – ezPDF Reader  |  PlayStore | Adobe Reader – PlayStore

Windows 7/8/10 – Adobe Reader

বই – সেরা হোক এবারের রামাদান – QA Server
বই – সেরা হোক এবারের রামাদান – QA Server
বই – সেরা হোক এবারের রামাদান – 4Shared
বই – সেরা হোক এবারের রামাদান – 4Shared

বইটি ভালো লাগলে অবশ্যই একটি Hard Copy সংগ্রহ করে অথবা লেখক বা প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানকে সৌজন্য মূল্য প্রদান করে সহযোগিতা করুন।

রামাদান বিষয়ক সকল ফাইল – প্রবন্ধ, বই, অডিও/ভিডিও লেকচার ডাউনলোড করতে চাইলে এই লিঙ্ক এ ক্লিক করুন – রামাদান বিষয়ক সকল ফাইল – প্রবন্ধ, বই, অডিও/ভিডিও লেকচার

মানুষের সঙ্গে আপনার আচরণ কেমন হবে

লেখক: শায়খ মুহাম্মদ বিন আব্দুর রহমান আল-আরিফী | অনুবাদক: কাজী মুহাম্মদ হানিফ

মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের একজন গণিত শিক্ষক দেখলেন, তার ক্লাসের অধিকাংশ ছাত্র ক্লাসে অমনােযােগী। পড়াশােনায়ও দুর্বল। এদিকে এরা আবার দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। সামনে ফাইনাল পরীক্ষা। তাই তিনি তাদের সংশােধন করতে চাইলেন।

হঠাৎ একদিন তিনি ক্লাসে এসে চেয়ারে বসতে না বসতেই বললেন, সবাই বই বন্ধ করে পাশে রাখ, খাতা-কলম হাতে নাও। ছাত্ররা বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাে, ‘কেন স্যার? শিক্ষক বললেন, “আমি তােমাদের একটা সারপ্রাইজ পরীক্ষা নেব। ছাত্ররা বিড়বিড় করে অসন্তোষ প্রকাশ করা সত্ত্বেও এক পর্যায়ে শিক্ষকের কথা মেনে নিল। তবে তাদের মধ্যে বিশাল দেহের অধিকারী কিন্তু মােটা মাথার এক ছাত্র ছিল।

অঘটন ঘটানাের ক্ষেত্রে সে ছিল খুব পটু। সে চিৎকার করে বললাে, স্যার! আমরা পরীক্ষা দেব না। রিভিশন দিয়ে পরীক্ষা দিতেই আমাদের বারােটা বেজে যায়। কিন্তু এখন রিভিশন ছাড়া পরীক্ষা দেব কীভাবে? ছাত্রটি কথাগুলাে এতাে কঠিন স্বরে বললাে যে, শিক্ষক রাগে ফেটে পড়লেন। শিক্ষক তাকে বললেন, এখানে তােমার খেয়াল খুশিমতাে কিছুই হবে না। আমি শিক্ষক আমার কথা তােমাকে মানতে হবে। না চাইলেও পরীক্ষা তােমাকে দিতেই হবে। বুঝতে পেরেছ? আর যদি পরীক্ষা দিতে ভাল না লাগে তাহলে ক্লাস থেকে বের হয়ে যাও।’ ছাত্রটিও ক্রোধে পাগলের মতাে বলে উঠল, “আমি যাব না; বরং আপনি ক্লাস হতে বের হয়ে যান। ছাত্রের মুখে এমন কথা শুনে শিক্ষক আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলেন না। তিনি বেয়াদব’, ‘অদ্র’ ইত্যাদি গালি দিতে দিতে তিনি ছেলেটির দিকে এগিয়ে গেলেন। এদিকে ছাত্রটিও রুখে দাঁড়াল। এরপর যা ঘটার, তাই ঘটল। শুধু এতটুকু বুঝে নিন যে, খুব খারাপ কিছু ঘটেছিল। আমি এর চেয়ে বেশি কিছু বলতে চাই না।

এ ঘটনার খবর কর্তৃপক্ষের কাছে পৌছল। কর্তৃপক্ষ ছাত্রটিকে শাস্তি দিলেন। তার ফাইনাল পরীক্ষার মার্কশিটের গ্রেড দুই ধাপ নামিয়ে দেয়া হলাে এবং শিষ্টাচার বজায় রেখে চলার অঙ্গীকার করে তাকে একটি দরখাস্ত লিখতে বাধ্য করা হলাে। এদিকে ঐ শিক্ষক ‘টক অভ দ্যা স্কুলে পরিণত হলেন। স্কুলের সর্বত্র তাকে নিয়ে কানাঘুষা শুরু হলাে। যার পাশ দিয়েই তিনি যান, সে-ই তাকে নিয়ে ফিসফিস করে আলােচনা করে। অনেকে তাকে নিয়ে বাজে মন্তব্য ছুড়ে দেয়। উপায়ান্তর না দেখে অবশেষে তিনি অন্য বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে চলে যান। অন্য এক শিক্ষক একই ঘটনার মুখােমুখি হয়েছিলেন। কিন্তু তিনি খুব কৌশলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেন। তিনি কিভাবে তা করেছিলেন? দেখুন, তিনিও একদিন ক্লাসে এসে ছাত্রদের বললেন, সবাই কাগজ কলম হাতে নাও। তােমাদের আজ সারপ্রাইজ পরীক্ষা হবে। তাদের মধ্য থেকে এক ছাত্র দাঁড়িয়ে বললাে, আপনি যখন যা চাইবেন তা-ই হবে এমন মনে করবেন না। আপনার ইচ্ছামতাে সব চলবে না। এ শিক্ষক ছিলেন খুব বিচক্ষণ।

তিনি মানুষের নাড়ি ও প্রকৃতি বুঝতেন। তিনি জানতেন গোঁয়ার্তুমি দিয়ে গোয়ারের মােকাবিলা করা যায় না। তিনি ছেলেটির দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললেন, “ওহ আচ্ছা! খালেদ তুমি মনে হয় পরীক্ষা দিতে চাও না। ছাত্রটি চিৎকার করে বললাে, “অবশ্যই, আমি পরীক্ষা দেব না। শিক্ষক তখন খুব শান্তভাবে বললেন, ঠিক আছে, কোনাে সমস্যা নেই। যে পরীক্ষা দিতে চায় না, তার ব্যাপারে আমরা বিদ্যালয়ের আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবাে। ছেলেরা! তােমরা লেখ, প্রথম প্রশ্ন : নিচের সমীকরণটির সমাধান বের :… 15 +৫= ১০+ * এই বলে তিনি একের পর এক প্রশ্ন লেখাতে শুরু করলেন। গোঁয়ার ছাত্রটি আর ধৈর্য্য ধরতে পারল না। সে চিৎকার করে বললাে, ‘আমি বলেছি, আমি পরীক্ষা দেব না।’ শিক্ষক শান্তভাবে তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললেন, আমি কি তােমাকে পরীক্ষা দিতে বাধ্য করেছি? তুমি স্বাধীন মানুষ । তুমি যেমন করবে, তেমন ফল পাবে।’ শিক্ষকের এ কথার পর ছাত্রটি তাকে রাগানাের মতাে আর কিছু খুঁজে পেল

অবশেষে সে শান্ত হয়ে কাগজ কলম বের করলাে এবং সহপাঠীদের সঙ্গে প্রশ্ন লিখতে শুরু করলাে। পরবর্তীতে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শিক্ষকের সাথে তার অসদাচরণের উপযুক্ত শাস্তি দিয়েছিল।

কাল্পনিক এই ঘটনা দুটি থেকে আপনি অবশ্যই বুঝতে পারবেন যে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করার যােগ্যতা সবার এক রকম নয়। কেউ পরিস্থিতিকে উত্তাল করে তােলে, আবার কেউ দ্রুত তা শান্ত করে ফেলতে পারে। গোঁয়ার ব্যক্তির সঙ্গে গোঁয়ার্তুমি করলে পরিস্থিতি দ্রুত উত্তপ্ত হয়ে ওঠে এবং ভয়ানক অবস্থার সৃষ্টি হয়। এ কথা স্বতঃসিদ্ধ যে, আগুনের মােকাবিলা আগুন দ্বারা করা হলে উত্তাপ ও লেলিহান শিখাই বাড়তে থাকবে। অপরদিকে ঠাণ্ডার সঙ্গে সবসময় ঠাণ্ডা ব্যবহার করলে কোনাে কাজই ঠিক থাকবে না।

সুতরাং মানুষের সঙ্গে আপনার আচরণ কেমন হবে, তা বুঝতে মুয়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহু-এর সুতা দর্শনের শরণাপন্ন হতে পারেন।

মুয়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহু-কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, ‘আপনি গভর্নর হিসেবে বিশ বছর এবং খলিফা হিসেবে বিশ বছর এত দীর্ঘ সময় কীভাবে শাসন করলেন? মুয়াবিয়া বলেছিলেন, ‘আমি জনগণ ও আমার মধ্যে একটি সুতা রেখেছি। সুতার এক প্রান্ত আমার হাতে, অপর প্রান্ত জনগণের হাতে। তারা যখন সুতা ধরে টান দেয় তখন আমি ঢিল দেই, যেন সুতাটা ছিড়ে না যায়। আর যখন জনগণ ঢিল দেয় তখন আমি টেনে ধরি। মুয়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহু সত্য বলেছেন। মানুষের সঙ্গে আচরণের ক্ষেত্রে এটি একটি যথার্থ উক্তি। কত চমৎকার ও প্রজ্ঞাপূর্ণ কথা! দাম্পত্য জীবনে স্বামী স্ত্রী উভয়ই যদি গোঁয়ার হয়, কেউ কাউকে বিন্দু পরিমাণ ছাড় দিতে না চায় তাহলে তাদের সংসারে কখনাে সুখ আসবে

অনুরূপ দুই পার্টনারের উভয়ে যদি একগুঁয়ে প্রকৃতির হয় তাহলে তাদের অংশিদারিত্ব বেশি দিন টিকবে না। একবার আমি এক জেলখানায় ধর্মীয় আলােচনা করেছিলাম। ঘটনাক্রমে আমার আলােচনাটি ছিল জেলখানার সে অংশে যেখানে খুনের আসামীদেরকে রাখা হতাে। আমি যখন আলােচনা শেষ করলাম তখন কয়েদীরা সবাই নিজ নিজ সেলে ফিরে গেল । কিন্তু তাদের একজন এগিয়ে এসে আমাকে ধন্যবাদ জানালেন। তিনি জেলখানায় বিভিন্ন বিনােদনমূলক অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, এদের অধিকাংশের হত্যার মতাে অপরাধ সংঘটনের পেছনে কারণ কী? তিনি বললেন, ‘রাগ ও ক্রোধই হলাে মূল কারণ। এদের কেউ কেউ সামান্য কিছু টাকার জন্য সেলসম্যানের সঙ্গে ঝগড়া করে উত্তেজিত হয়ে কিংবা ফিলিং স্টেশনের কর্মচারীর সঙ্গে কথা কাটাকাটি করে হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। তখন আমার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর একটি হাদিস মনে পড়ে গেল ও ‘কাউকে ধরাশায়ী করতে পারা বীরত্ব নয়। প্রকৃত বীর তাে সে-ই, যে ক্রোধের সময় নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।’ (সহীহ বুখারী: ৫৬৪৯, সহীহ মুসলিম: ৪৭২৩)

কিন্তু যুবকটি তার গাড়ির গতি আরাে কমিয়ে দিল এবং হাত নেড়ে পেছনের গাড়িটিরও গতি কমাতে বললাে। পেছনের গাড়ির চালক খুব বেশি সময় ধৈর্য ধরতে পারল না। সে বিরক্ত হয়ে সাইড দিয়ে ওভারটেক করে চলে গেল। তবে কোনাে গাড়িরই কোনাে ক্ষতি হলাে না। তবে এটা দেখে যুবকটির মাথা গরম হয়ে গেল। অবশ্য এর চেয়ে তুচ্ছ কিছু ঘটনায়ও সে প্রচণ্ড রেগে যায়। সেও তাদের ধরার জন্য গাড়ির গতি বাড়িয়ে দিল এবং বারবার তাদেরকে থামার জন্য সিগনাল দিতে লাগল। এ অবস্থা দেখে সামনের গাড়িটি থামল। তখন যুবকটি তার মাথার রুমাল খুলে সিটের পাশে রেখে একটি রড (নাটবন্দু খােলার যন্ত্রবিশেষ, বড় রেঞ্চ) হাতে নিয়ে গাড়ি থেকে বের হয়ে এলাে। তার চোখ থেকে যেন আগুন ঝরছিল। এ অবস্থায় সে সামনের গাড়ির যাত্রীদের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। সামনের গাড়ি থেকে তিনজন যুবক নেমে আসল।

যুবকদের প্রত্যেকেই ছিল পেশিবহুল ও সুগঠিত দেহের অধিকারী। তাদের পেশী যেন তাদের পরিধেয় কাপড় ছিড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে! যুবকরা তার দিকে তেড়ে আসছিল। তারা তার হাতে রডটি দেখে তার মনােভাব বুঝতে পেরেছিল । তাই তারাও প্রস্তুতি নিয়ে এগিয়ে আসছিল। এটা দেখে যুবকটি খুব ভয় পেয়ে গেল। কিন্তু হঠাৎ তার মাথায় একটা বুদ্ধি এলাে। সঙ্গে সঙ্গে সে রডটা উচু করে ধরে বললাে, “সরি, এটা আপনাদের গাড়ি থেকে পড়ে গিয়েছিল। এটা আপনাদের কাছে ফেরত দিতে এসেছি।’ তিনজনের একজন শান্তভাবে তার হাত থেকে রডটা নিয়ে গাড়িতে উঠে। চলে গেল। আর সে দাঁড়িয়ে তাদের উদ্দেশ্যে হাত নেড়ে বিদায় জানাল।

সমীকরণ … গোঁয়ার + গোঁয়ার = বিস্ফোরণ !

উৎসঃ Enjoy Your Life (Bangla Version), অধ্যায়ঃ ২১, পৃষ্ঠা: ১৪২ – ১৪৭

ছাদাক্বাতুল ফিতরের বিধান

লেখক: মুহাম্মাদ লিলবর আল-বারাদী

আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে উদ্দেশ্যবিহীন সৃষ্টি করেননি। তিনি বলেন: ‘আমি জিন ও মানবজাতিকে কেবল আমার ইবাদতের জন্যই সৃষ্টি করেছি’ [যারিয়াত ৫১/৫৬]

ইবাদত এমন একটি ব্যাপক শব্দ যা প্রকাশ্যে ও অপ্রকাশ্যে পালনকৃত এমন সব কথা ও কাজের সমষ্টি, যা আল্লাহ পসন্দ করেন ও ভালবাসেন। আল্লাহর ইবাদত গ্রহণীয় হওয়ার জন্য দু’টি শর্ত রয়েছে। এক. একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যে সমস্ত ইবাদত হ’তে হবে। দুই. রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর সুন্নাতী পন্থা অনুযায়ী তা পালন করতে হবে।

ইবাদত পালনে ত্রুটি-বিচ্যুতি হ’লে আল্লাহ ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ারও ব্যবস্থা রেখেছেন। ছিয়াম হ’ল মহান আল্লাহর ইবাদতের মধ্যে অন্যতম। আর এই ছিয়াম পালনে যে সকল ত্রুটি-বিচ্যুতি হয়ে থাকে, তার ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার জন্য ছাদাক্বাতুল ফিতর আদায়ের বিধান রেখেছেন। এ বিধান আমাদের সুবিধার্থে পরিবর্তন ও পরিমার্জন করা সমীচীন নয়। কেননা ইসলাম হ’ল একমাত্র অভ্রান্ত, ত্রুটিমুক্ত ও পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা।

দ্বীন ইসলাম যখন পূর্ণতা পেয়েছে, তখন অপূর্ণতার সংশয় মনে ঠাঁই দেয়া নিতান্তই মূর্খতা। সুতরাং দ্বীনকে অপূর্ণাঙ্গ মনে করার অর্থই হ’ল কুরআন-হাদীছের অপূর্ণতা (নাঊযুবিল্লাহ)। আর এটা অসম্ভব, অযৌক্তিক ও ভ্রান্ত ধারণা মাত্র। পূর্ববর্তী নবী-রাসূলগণের প্রতি অবতীর্ণ আসমানী গ্রন্থ বিকৃত হয়েছে। কিন্তু শেষ নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর প্রতি অবতীর্ণ কুরআন অবিকৃত অবস্থায় বিদ্যমান। তবে রাসূল (সা:)-এর হাদীছ বিকৃত করার অপপ্রয়াস চলেছে নানাভাবে। কিন্তু বিভিন্ন মুহাদ্দিছগণের অক্লান্ত পরিশ্রমে তা আজও অম্লান রয়েছে। তথাপিও কিছু লোক ক্বিয়াস দ্বারা ছহীহ হাদীছ বিকৃত করে চলেছে। যেমন ছাদাক্বাতুল ফিতর খাদ্যদ্রব্যের পরিবর্তে তার সমমূল্য দিয়ে আদায় করা। আলোচ্য নিবন্ধে ছাদাক্বাতুল ফিতরের বিধান সম্পর্কে আলোকপাত করা হ’ল।-

ছাদাক্বাতুল ফিতর কার উপর ফরয :

ছাদাক্বাতুল ফিতর মুসলমান নারী-পুরুষ, ছোট-বড়, সকলের জন্য আদায় করা ফরয। এ মর্মে হাদীছে এসেছে: ইবনে ওমর (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) স্বীয় উম্মতের ক্রীতদাস ও স্বাধীন, নারী ও পুরুষ, ছোট ও বড় সকলের উপর মাথা পিছু এক ছা‘ পরিমাণ খেজুর বা যব যাকাতুল ফিৎর হিসাবে ফরয করেছেন এবং তা ঈদগাহের উদ্দেশ্যে বের হওয়ার পূর্বেই আদায় করার নির্দেশ দিয়েছেন’। [বুখারী-মুসলিম, মিশকাত হা/১৮১৫]

 ঈদের দিন সকালেও যদি কেউ মৃত্যুবরণ করেন, তার জন্য ফিৎরা আদায় করা ফরয নয়। আবার ঈদের দিন সকালে কোন বাচ্চা ভূমিষ্ঠ হ’লে তার পক্ষ থেকে ফিৎরা আদায় করা ফরয। ছাদাক্বাতুল ফিতর হ’ল জানের ছাদাক্বা, মালের নয়। বিধায় জীবিত সকল মুসলিমের জানের ছাদাক্বা আদায় করা ওয়াজিব। কোন ব্যক্তি ছিয়াম পালনে সক্ষম না হ’লেও তার জন্য ফিৎরা ফরয। [মিরআত ৬/১৮৫ পৃঃ]

ছাদাক্বাতুল ফিতরের পরিমাণ :

প্রত্যেকের জন্য মাথাপিছু এক ছা‘ খাদ্যশস্য যাকাতুল ফিৎর হিসাবে বের করতে হবে। ‘ছা’ হচ্ছে তৎকালীন সময়ের এক ধরনের ওযন করার পাত্র। নবী করীম (সা:)-এর যুগের ছা‘ হিসাবে এক ছা‘-তে সবচেয়ে ভাল গম ২ কেজি ৪০ গ্রাম হয়। বিভিন্ন ফসলের ছা‘ ওযন হিসাবে বিভিন্ন হয়। এক ছা‘ চাউল প্রায় ২ কেজি ৫০০ গ্রাম হয়। তবে ওযন হিসাবে এক ছা‘ গম, যব, ভুট্টা, খেজুর ইত্যাদি ২ কেজি ২২৫ গ্রামের বেশী হয়। ইরাকী এক ছা‘ হিসাবে ২ কেজি ৪০০ গ্রাম অথবা প্রমাণ সাইজ হাতের পূর্ণ চার অঞ্জলী চাউল। বর্তমানে আমাদের দেশে এক ছা‘তে আড়াই কেজি চাউল হয়।

অর্ধ ছা‘ ফিতরা আদায় করা সুন্নাত বিরোধী কাজ। মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর যুগে মদীনায় গম ছিল না। সিরিয়া হ’তে গম আমদানী করা হ’ত। তাই উচ্চ মূল্যের বিবেচনায় তিনি অর্ধ ছা‘ গম দ্বারা ফিৎরা দিতে বলেন। কিন্তু বিশিষ্ট ছাহাবী আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) সহ অন্যান্য ছাহাবীগণ মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর এই ইজতিহাদী সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেন এবং রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর নির্দেশ ও প্রথম যুগের আমলের উপরেই কায়েম থাকেন। যারা অর্ধ ছা‘ গম দ্বারা ফিৎরা আদায় করেন, তারা মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর রায়ের অনুসরণ করেন মাত্র। ইমাম নবভী (রহ:) বলেন: অর্ধ ছা‘ ফিৎরা আদায় করা সুন্নাহর খেলাপ। রাসূল (ছাঃ) যাকাতের ও ফিতরার যে হার নির্ধারণ করে দিয়েছেন তা রদবদল করার অধিকার কারো নেই।  [ফাৎহুল বারী ৩/৪৩৮ পৃঃ]

এ ব্যাপারে ওমর (রা:) একটি ফরমান লিখে আমর ইবনে হাযম (রাঃ)-এর নিকটে পাঠান যে: যাকাতের নিছাব ও প্রত্যেক নিছাবে যাকাতের যে, হার তা চির দিনের জন্য আল্লাহ তাঁর রাসূলের মাধ্যমে নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। এতে কোন যুগে, কোন দেশে কমবেশী অথবা রদবদল করার অধিকার কারো নেই। [তাফসীর মা‘আরেফুল কুরআন, পৃঃ ৫৭৫]

ছাদাক্বাতুল ফিতর আদায় ও বণ্টনের সময়কাল :

ছাদাক্বাতুল ফিতর ঈদের দু’এক দিন পূর্বে আদায় ও পরে বণ্টন করা ওয়াজিব। ঈদুল ফিতরের পূর্বে ছাহাবায়ে কেরাম বায়তুল মাল জমাকারীর নিকটে ফিৎরা জমা করতেন। ফিৎরা আদায়ের এটাই সুন্নাতী পন্থা, যা ঈদের ছালাতের পর হক্বদারগণের মধ্যে বণ্টন করতে হবে। [বুখারী হা/১৫১১, ‘যাকাত’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৭৭]

ইবনে ওমর (রা:) বলেন: রাসূলুল্লাহ (সা:) ঈদগাহে যাওয়ার পূর্বে ছাদাক্বাতুল ফিতর আদায় করার নির্দেশ দিয়েছেন।অন্যত্র রয়েছে, ঈদের ছালাতের পূর্বে দায়িত্বশীলের কাছে ফিৎরা জমা করা ওয়াজিব। ইবনে ওমর (রাঃ) ঈদের দু’এক দিন পূর্বে জমাকারীর কাছে ফিৎরা পাঠাতেন। [বুখারী হা/১৫০৯; মুসলিম হা/৯৮৬, বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/১৮১৫, মুয়াত্ত্বা মালেক, হা/৩৪৩; ইবনু খুযায়মাহ হা/২৩৯৭, সনদ ছহীহ]

ইবনে আববাস (রা:) বলেন: রাসূলুল্লাহ (সা:) ছিয়াম পালনকারীর জন্য ছাদাক্বাতুল ফিতর আদায় অপরিহার্য করে দিয়েছেন। যে ব্যক্তি ঈদের ছালাতের পূর্বে আদায় করবে তা ছাদাক্বাতুল ফিতর হিসাবে গণ্য হবে। আর যে ব্যক্তি ঈদের ছালাতের পর আদায় করবে তা সাধারণ ছাদাক্বা হিসাবে গণ্য হবে।ঈদের ছালাতের পূর্বে ফিৎরা বণ্টন করার কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না। বরং পরে বণ্টনের প্রমাণ পাওয়া যায়।ইবনে ওমর (রাঃ) অনুরূপভাবে জমা করতঃ ঈদের ছালাতের পরে হক্বদারগণের মধ্যে বণ্টন করতেন।অনেকে মনে করেন, ঈদের ছালাতের পূর্বে বণ্টন করা হ’লে গরীবদের সুবিধা হবে। কিন্তু এ মর্মে যে কয়টি বর্ণনা এসেছে, তা গ্রহণযোগ্য নয়। [আবূদাঊদ হা/১৬০৯, হাসান ছহীহ, বুখারী, মিশকাত হা/২১২৩,ফাৎহুল বারী ৩/৪৩৯-৪০; মির‘আত ১/২০৭,ইরওয়াউল গালিল হা/৮৪৪, ৩/৩৩২]

 সুতরাং মহান আল্লাহ তাঁর রাসূলের মাধ্যমে ফিৎরা বণ্টনের জন্য যে সময় নির্ধারণ করে দিয়েছেন তা পালন করা আবশ্যক।

ফিতরা পাওয়ার হক্বদারগণ :

ছাদাক্বাতুল ফিতর এলাকার অভাবী ও দরিদ্র মানুষের মাঝে বণ্টন করবে। কেননা ধনীদের সম্পদে গরীবের হক্ব আছে। মহান আল্লাহ বলেন:‘ধনীদের সম্পদে রয়েছে, ফকীর, বঞ্চিতদের অধিকার’ [যারিয়াত ৫১/১৯]

এতদ্ব্যতীত যাকাত আদায়ের নিম্নোক্ত আটটি খাতেও ফিতরা বণ্টন করা যাবে। মহান আল্লাহ বলেন: যাকাত হ’ল কেবল ফকীর, মিসকীন, যাকাত আদায়কারী ও যাদের চিত্ত আকর্ষণ প্রয়োজন তাদের হক্ব এবং তা দাস মুক্তির জন্য, ঋণগ্রস্তদের জন্য, আল্লাহর পথে জিহাদকারীদের জন্য ও মুসাফিরদের জন্য। এই হ’ল আল্লাহর নির্ধারিত বিধান’ [তওবা ৯/৬০]

উপরোক্ত আয়াতে আল্লাহ যাদের কথা বলেছেন তারা প্রত্যেকেই যাকাত পাওয়ার হক্বদার।

ছাদাক্বাতুল ফিতর কোন বস্ত্ত দ্বারা আদায় ওয়াজিব :

প্রত্যেক দেশের প্রধান খাদ্য দিয়ে ফিৎরা আদায় করবে। এ মর্মে হাদীছে এসেছে: আবু রাজা‘ (রহঃ) বলেন, আমি ইবনু আববাস (রাঃ)-কে তোমাদের মিম্বরে অর্থাৎ বছরার মিম্বরে দাঁড়িয়ে খুৎবা দানরত অবস্থায় বলতে শুনেছি, ছাদাক্বাতুল ফিতরের পরিমাণ হ’ল মাথাপিছু এক ছা‘ খাদ্যদ্রব্য। [নাসাঈ হা/২৫২২]

আবু সাঈদ খুদরী (রা:) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন: আমরা যাক্বাতুল ফিতর আদায় করতাম এক খাদ্য অথবা এক ছা‘ যব বা এক ছা‘ খেজুর অথবা এক ছা‘ পনীর অথবা এক ছা‘ কিশমিশ দিয়ে। [বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/১৮১৬]

আমাদের এই কৃষি প্রধান দেশে প্রধান খাদ্য চাউল। সেকারণ চাউল দিয়ে ছাদাক্বাতুল ফিতর আদায় করাই উত্তম। খাদ্যশস্যের মূল্য দিয়ে ছাদাক্বাতুল ফিতর প্রদানের স্বপক্ষে কুরআন-হাদীছে স্পষ্ট কোন দলীল নেই। সুতরাং মুদ্রা দিয়ে ফিৎরা আদায় করা কোন বিশিষ্ট জনের তাক্বলীদ (অন্ধ অনুসরণ) বৈ কিছুই নয়। আল্লাহর রাস্তায় দান-খয়রাত করতে হ’লে নবী করীম (সা:) প্রদর্শিত পন্থায়ই তা করা অপরিহার্য। তাছাড়া চার খলীফা, ছাহাবীগণ, তাবেঈ, তাবে-তাবেঈগণ সকলেই খাদ্যদ্রব্য দিয়ে ফিৎরা আদায় করেছেন। খাদ্যশস্যের মূল্যে ফিৎরা আদায়ের স্বপক্ষে একটি দুর্বল, মওযূ হাদীছও প্রমাণ হিসাবে পাওয়া যায় না। সুতরাং খাদ্যশস্য দিয়েই ফিৎরা আদায় করতে হবে।

খাদ্যশস্যের মূল্য দ্বারা ফিৎরা আদায় :

খাদ্যশস্য ব্যতীত অর্থ কিংবা দীনার-দিরহাম দিয়ে ফিৎরা আদায় করেছেন মর্মে রাসূলুল্লাহ (সা:), ছাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈ ও তাবে-তাবেঈদের কোন আমল পাওয়া যায় না। খাদ্যশস্যের স্বপক্ষেই হাদীছে এসেছে। আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেন: আমরা খাদ্যশস্য যব, খেজুর, পনীর, কিশমিশ দিয়ে যাকাতুল ফিতর আদায় করতাম। [বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/১৮১৬]

যব শব্দটির অর্থ হ’ল খাদ্য। পরিভাষায় যা দিয়ে ক্ষুধা নিবারণ করা যায়, তাই যব দ্বারা টাকা-পয়সা বুঝায় না। তাছাড়াও রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর পূর্ব যুগ হ’তেই মক্কা-মদীনায় দিরহাম-দীনার প্রভৃতি মুদ্রার প্রচলন ছিল। কিন্তু তিনি এক ছা‘ খাদ্যশস্যের মূল্য হিসাবে দিরহাম প্রদানের নির্দেশ দেননি। বরং খাদ্যশস্য দিয়ে ছাদাক্বাতুল ফিতর আদায় ওয়াজিব করেছেন।

খাদ্যশস্য ব্যতীত মূল্য দিয়ে ফিৎরা প্রদানে অনেক বৈষম্যের সৃষ্টি হয়। যেমন-

নং

ব্যক্তির নাম

চাউলের নাম

প্রতি কেজি

২১/২  কেজির মূল্য

মূল্য পার্থক্য

আব্দুল করীম মিনিকেট ৭০/= ১৭৫/= ১০০/=
আব্দুর রহীম দাউদকানী ৬০/= ১৫০/= ৭৫/=
আব্দুস সালাম জিরাশাল ৫০/= ১২৫/= ৫০/=
আব্দুল জববার ব্রি ২৮ ৪০/= ১০০/= ২৫/=
আব্দুস সাত্তার গুটি স্বর্ণা ৩০/= ৭৫/= ০০/=

এখানে আব্দুল করীম সবচেয়ে দামী ও আব্দুস সাত্তার কম দামী চাউলের ভাত খায়। এদের দু’জনে ছাদাক্বাতুল ফিতর হিসাবে খাদ্যশস্যের পরিবর্তে যদি মূল্য প্রদান করা হয়, তাহ’লে আড়াই কেজি চাউলের মূল্যের পার্থক্য হবে ১০০/= টাকা। কিন্তু তারা উভয়েই যদি খাদ্যশস্য দিয়ে ফিৎরা আদায় করে, তবে তাদের পরিমাণ আড়াই কেজি বা একই সমান হবে। তাছাড়া বণ্টনের সময় হতদরিদ্র ব্যক্তি সবচেয়ে দামী চাউলের ছাদাক্বা পেয়েও খুশী হবে।

খাদ্যশস্যের মূল্য দিয়ে ফিৎরা আদায় করা, ছাদাক্বা ক্রয় করার নামান্তর। যা ইসলামে নিষিদ্ধ। আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ) বলেন, ওমর (রাঃ) তাঁর একটি ঘোড়া এক ব্যক্তিকে সওয়ার হওয়ার জন্য আল্লাহর রাস্তায় ছাদাক্বা করে দিলেন, যে ঘোড়াটি রাসূল (ছাঃ) তাকে দান করেছিলেন। তারপর তিনি (ওমর) খবর পেলেন, লোকটি ঘোড়াটি বাজারে বিক্রি করছে। এ খবর শুনে ওমর (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সা:)-কে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমি কি ঘোড়াটি ক্রয় করতে পারি? রাসূল (ছা:) জবাবে বললেন: তা ক্রয় কর না এবং তোমার ছাদাক্বা ফেরৎ নিও না। [বুখারী হা/৩/২৫৭১ (কিতাবুল ওয়াসা)]

আলোচ্য হাদীছ হ’তে প্রমাণিত হয় যে, যে কোন প্রকারের ছাদাক্বা ক্রয় করা হারাম। যদি ক্রয় করা হালাল হ’ত তবে রাসূলুল্লাহ (সা:) ওমর (রাঃ)-কে ক্রয় করার অনুমতি দিতেন এবং ফিৎরা খাদ্যশস্যের পরিবর্তে দিরহাম-দীনার প্রদানের অনুমতিও দিতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। চার খলীফা, ছাহাবী, তাবেঈ, তাবে-তাবেঈ কেউই অনুরূপভাবে ছাদাক্বা ক্রয় করার পক্ষে ছিলেন না। যারা ফিৎরা দ্রব্যমূল্যে (টাকায়) প্রদানের স্বপক্ষে তাদের উদ্দেশ্য কি তা আদৌ বোধগম্য নয়। কেননা ফিৎরা হ’ল ফরয এবং কুরবানী হ’ল সুন্নাত। ফরযকে যদি পরিবর্তন অথবা পরিমার্জন করা জায়েয হয়, তাহ’লে কুরবানীর পরিবর্তে তার মূল্য প্রদানে বাধা কোথায়? নিয়ত তো বেশ ছহীহ। যেহেতু কুরবানীর সমমূল্য জায়েয নয়। সুতরাং ফিতরার মূল্য প্রদানও জায়েয নয়। এ সম্পর্কে ইবনে তায়মিয়াহ (রহ:) বলেন: ‘যদি কেউ কুরবানীর বদলে তার মূল্য ছাদাক্বা করতে চান, তবে তিনি মুহাম্মাদী শরী‘আতের প্রকাশ্য বিরোধিতা করবেন’। [মুগনী ১১/৯৪-৯৫ পৃঃ]

অতএব পরকালে পরিত্রাণের নিমিত্তে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছ অনুযায়ী আমল করা আমাদের সকলের জন্য অপরিহার্য। অন্যথা ইহকাল ও পরকালে ক্ষতিগ্রস্ত হ’তে হবে। আল্লাহ আমাদেরক হেফাযত করুন।

আমীন!!

রামাদান বিষয়ক সকল ফাইল – প্রবন্ধ, বই, অডিও/ভিডিও লেকচার ডাউনলোড করতে চাইলে এই লিঙ্ক এ ক্লিক করুন – রামাদান বিষয়ক সকল ফাইল – প্রবন্ধ, বই, অডিও/ভিডিও লেকচার

বই – রামাদান আল্লাহ’র সাথে সম্পর্ক করুন – ফ্রি ডাউনলোড

বই: রামাদান আল্লাহ’র সাথে সম্পর্ক করুন

লেখক: ড. মুহাম্মাদ ইবনে আবদুর রহমান আরিফী

প্রকাশনায়: হুদহুদ প্রকাশন

পৃষ্ঠা সংখ্যা: ৯৬

সংক্ষিপ্ত বর্ণনা: প্রত্যেকটা মানুষের জীবনে এমন কিছু আছে যা তার খুব প্রিয়, যা সে মন থেকে আকাঙ্ক্ষা করে, যাকে ঘিরে সে স্বপ্ন বুনে, দিন রাত যত কল্পনা জল্পনা সব সেই আকাঙ্ক্ষিত বিষয়কে নিয়েই। সর্বাত্মক চেষ্টার পাশাপাশি প্রতিনিয়ত আল্লাহর কাছে কাকুতি মিনতি করে, ‘হে আল্লাহ! আমাকে মিলিয়ে দাও!’

এরকম খুব প্রিয় একটি বিষয় আমাদের পূর্বসূরীদেরও ছিল।

মুআল্লা বিন ফজল রহ. বলেন- “আমাদের পূর্বসূরিগন নিরাপদে রামাদানে উপনীত হওয়ার আশায় ছয় মা আগে থেকেই আল্লাহর দরবারে দুয়া করতেন।” ইয়াহইয়া ইবনে আবী কাসীর রহ. সেই দুয়াটা উল্লেখ করেন- “হে আল্লাহ! রামাদান অবধি আমাদের সুস্থ ও নিরাপদ রাখুন। রামাদানের জন্যও নিরাপদ রাখুন। আমাদের এ মাস কবুল করে নিন”এক মিনিট! না খেয়ে থাকা- এটা আবার কারো প্রিয় হতে পারে!? হ্যাঁ, রামাদান, এই মাসকে তাঁরা এতটাই ভালোবাসতেন। আল্লাহর জন্য সিয়াম সাধনাকে তাঁরা কেবল ‘না খেয়ে থাকা’ গণ্য করতেন না। সিয়ামকে তাঁরা নিয়েছিলেন আল্লাহর ভালোবাসা অর্জনের মাধ্যম হিসেবে। তাই তো সেই মাসে উপস্থিত হওয়ার জন্য ছয় মাস আগে থেকেই আল্লাহর দরবারে তাওফিক চাইতে থাকতেন। একবার চলে গেলে বার বার ফিরে যাওয়ার জন্য উন্মুখ থাকতেন সেই বরকময় মাসে।

তাঁরা এ মাসে আল্লাহর রহমত অনুভব করেছিলেন, ইয়াকিনের সাথে বিশ্বাস করেছিলেন, আর তাই এই রামাদানেই তাঁরা জান্নাত কিনে নেয়ার কোমর বেধে প্রতিযোগিতায় নামতেন।

আমরা কি পারি না এই রামাদানকে ভালোবাসতে যেভাবে বেসেছিলেন আমাদের পূর্বসূরীরা? আমরা কি পারি না এই রামাদানকে ব্যবহার করতে যেভাবে করেছিলেন আমাদের পূর্ববসূরীরা?

Android – ezPDF Reader  |  PlayStore | Adobe Reader – PlayStore

Windows 7/8/10 – Adobe Reader

বই – রামাদান আল্লাহ’র সাথে সম্পর্ক করুন – QA
বই – রামাদান আল্লাহ’র সাথে সম্পর্ক করুন – QA

বইটি ভালো লাগলে অবশ্যই একটি Hard Copy সংগ্রহ করে অথবা লেখক বা প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানকে সৌজন্য মূল্য প্রদান করে সহযোগিতা করুন।

প্রত্যেক দিন একশবার তাসবীহ পড়ার ফযিলত

লেখক: শাইখ মোহাম্মাদ সালেহ আল মুনাজ্জিদ

প্রশ্ন:

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণিত এ হাদিসটির শুদ্ধতা কতটুকু? তিনি বলেন: “তোমাদের কেউ কি প্রতিদিন এক হাজার নেকী হাছিল করতে অক্ষম? তখন তাঁর সাথীদের একজন জিজ্ঞেস করল: আমরা কিভাবে এক হাজার নেকী হাছিল করতে পারি? তখন তিনি বললেন: একশবার তাসবীহ পড়লে তার জন্য এক হাজার নেকী লেখা হবে কিংবা এক হাজার গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে”। অন্য এক রেওয়ায়েতে আছে: “তার জন্য এক হাজার নেকী লেখা হবে ও এক হাজার গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে”।

যদি কেউ এর চেয়ে বেশি পড়ে তাহলে নেকী কি বাড়বে অর্থাৎ কেউ যদি ১,০০০ বার পড়ে সে কি ১০,০০০ নেকী পাবে?

উত্তর:

আলহামদু লিল্লাহ। উল্লেখিত হাদিসটি সহিহ। হাদিসটি ইমাম মুসলিম (২৬৯৮) তাঁর ‘সহিহ’ গ্রন্থে সংকলন করেছেন মুসআব বিন সাদ বিন আবি ওয়াক্কাস থেকে তিনি বলেন আমার পিতা হাদিস বর্ণনা করেছেন যে, তিনি বলেন: “একবার আমরা রাসূলুল্লাহ্‌সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে ছিলাম। তখন তিনি বললেন: তোমাদের কেউ কি প্রতিদিন এক হাজার নেকী হাছিল করতে অক্ষম? তখন তাঁর একজন সাহাবী জিজ্ঞেস করল: কিভাবে আমাদের কারো জন্য একজন হাজার নেকী লেখা হতে পারে? তখন তিনি বললেন: একশবার তাসবীহ পড়লে (সুবহানাল্লাহ্‌বললে) তার জন্য এক হাজার নেকী লেখা হবে কিংবা তার এক হাজার গুনাহ মাফ হবে।

ইমাম নববী “আল-আযকার” গ্রন্থে (পৃষ্ঠা-৫৩) বলেন: “ইমাম হাফেয আবু আব্দুল্লাহ্‌আল-হুমাইদী বলেন: সহিহ মুসলিমের সকল রেওয়ায়েতে أو يُحَطّ (কিংবা গুনাহ মাফ করা হবে) এভাবে বর্ণিত হয়েছে। আল-বারক্বানী বলেন: হাদিসটি বর্ণনা করেছেন শুবা, আবু আওয়ানা ও ইয়াহইয়া আল-কাত্তান প্রমুখ মূসা থেকে; যে মূসার সূত্রে ইমাম মুসলিমও হাদিসটি বর্ণনা করেছেন। তারা সকলে বলেছেন ويُحَطّ (এবং গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে) আলিফ ছাড়া।

আব্দুল্লাহ্‌বিন আহমাদ বিন হাম্বল বলেন: ‘আমার পিতা বলেছেন: ইবনে নুমাইরও বলেছেন: أو يُحَطّ (কিংবা গুনাহ মাফ করা হবে)। এবং ইয়া’লাও বলেছেন: أو يُحَطّ (কিংবা গুনাহ মাফ করা হবে)।‘ [মুসনাদে আহামদ (৩/১৩৩)]

ইমাম তিরমিযি (৩৪৬৩) হাদিসটি ويُحَطّ (এবং গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে) ভাষ্যে সংকলন করেছেন এবং বলেছেন: “হাসান সহিহ”

মোল্লা আলী ক্বারী “মিরক্বাতুল মাফাতীহ” গ্রন্থে (৪/১৫৯৪) বলেন: “যেহেতু এক নেকীর বদলে দশ নেকী দেওয়া হয়। কুরআনের আয়াত”যে ব্যক্তি একটি নেকী নিয়ে আসবে সে এর দশগুণ পাবে।” [সূরা আনআম, আয়াত: ১৬০] এবং “আল্লাহ্‌যার জন্য ইচ্ছা বৃদ্ধি করবেন।” [সূরা বাক্বারা, আয়াত: ২৬১]-এ প্রতিশ্রুত বৃদ্ধির এটি সর্বনিম্ন একক। হারাম এলাকার এক নেকী এক লক্ষ নেকীর সমান। কিংবা তার এক হাজার গুনাহ মাফ হবে” অর্থাৎ সগিরা গুনাহ হোক কিংবা কবিরা গুনাহ হোক; সেটা আল্লাহ্‌র ইচ্ছাধীন।”

উপরোক্ত আলোচনার ভিত্তিতে যে ব্যক্তি একশ এর চেয়ে বেশি পরিমাণ তাসবীহ পড়বে সে তার বৃদ্ধির জন্য বর্ধিত হারে সওয়াব পাবে। যেহেতু এক নেকীতে দশ নেকী দেওয়া হবে। সুতরাং যে ব্যক্তি এক হাজার বার তাসবীহ পড়বে সে ব্যক্তি দশ হাজার নেকী পাবে। এভাবে বৃদ্ধি করা হবে। আল্লাহ্‌র অনুগ্রহ প্রশস্ত।

এ হাদিসে যা বর্ণিত হয়েছে এর কাছাকাছি একটি হাদিস যা ইমাম বুখারী (৩২৯৩) ও ইমাম মুসলিম (২৬৯১) আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ্‌সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “যে ব্যক্তি এক আল্লাহ ছাড়া সত্য কোন উপাস্য নেই। তাঁর কোন শরীক নেই। রাজত্ব তাঁরই। সমস্ত প্রশংসাও তাঁর। তিনি সকল কিছুর ওপর ক্ষমতাবান) দিনে একশত বার বলবে­- এটা তার জন্য দশজন দাসমুক্তির অনুরূপ হবে, তার জন্য একশত সওয়াব লেখা হবে, তার একশটি গুনাহ মুছে দেওয়া হবে, সেই দিন সন্ধ্যা পর্যন্ত এটা তার জন্য শয়তান থেকে সুরক্ষা হবে। সে যে সওয়াব পাবে আর কেউ তার চেয়ে উত্তম সওয়াব পাবে না; তবে যে ব্যক্তি তার চেয়ে বেশি আমল করবে সে ব্যক্তি ছাড়া।

ইমাম মুসলিম (২৬৯২) আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্‌সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “যে ব্যক্তি سُبْحَانَ اللهِ وَبِحَمْدِهِ (উচ্চারণ: সুবহা-নাল্লা-হি ওয়া বিহামদিহী) (অর্থ: আমি আল্লাহর প্রশংসাসহ পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করছি) সকালে একশত বার ও সন্ধ্যায় একশত বার পড়বে, কিয়ামতের দিন তার চেয়ে উৎকৃষ্ট কিছু কেউ নিয়ে আসতে পারবে না। তবে সে ব্যক্তি ছাড়া যে তার মত বলবে বা তার চেয়ে বাড়িয়ে আমল করবে।

এ হাদিসে স্পষ্টভাবে উদ্ধৃত হয়েছে যে, যে ব্যক্তি “তার চেয়ে বাড়িয়ে আমল করবে” ও “তার চেয়ে বেশি আমল করবে”: সে ব্যক্তি একশ বার উচ্চারণকারীর চেয়ে উত্তম সওয়াবে পাবে। অর্থাৎ সে একদিনে এ যিকিরটি দুইশ বার বলবে, তিনশ বার বলবে… কিংবা আল্লাহ্‌যতবার চান ততবার বলবে। যে বাড়াবে সে আল্লাহ্‌র কাছে বাড়তি পাবে। আল্লাহ্‌র অনুগ্রহ প্রশস্ত।

আল্লাহ্‌ই সর্বজ্ঞ। 

করুন কিংবা না করুন!!

অনুবাদ: আব্দুর রাকীব (মাদানী) | সম্পাদনা: আব্দুল্লাহিল হাদী

আমি এবং আপনি .. তিনি এবং সে .. অমুক এবং তমুক .. আমরা প্রত্যেকে এই জীবনে কিছু না কিছু করি …. হতে পারে আপনি এখন রুজি-রোজগারের তল্লাশে ব্যস্ত আছেন। কিংবা খাওয়ার টেবিলে রুচিসম্পন্ন খাদ্য ভক্ষণ করছেন। কিংবা নরম বিছানায় মধুর ঘুমে আচ্ছন্ন আছেন। কিংবা সুস্বাস্থের উদ্দেশ্যে ব্যায়াম করছেন। কিংবা সমুদ্র সৈকতে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য উপভোগের মাধ্যমে সাপ্তাহিক ছুটি কাটাচ্ছেন। কিংবা কোন মসজিদে নামায আদায় করছেন। কিংবা কুরআনের কিছু অংশ পড়ছেন। কিংবা আল্লাহর যিক্‌র করছেন। এর বিপরীতও হতে পারে!

হতে পারে প্রেম ভালবাসার হৈচৈ পূর্ণ গান শুনছেন ! কিংবা টেলিভিশনে অর্ধ নগ্ন নর্তকীদের দেখছেন ! কিংবা অন্য কিছু মন্দ কাজ করছেন .. হতে পারে ! যাই হোক না কেন , এসব কাজ আপনি করতে পারেন নাও করতে পারেন, অনুশীলন করতে পারেন আবার প্রত্যাখ্যানও করতে পারেন। আপনি, কেবল আপনিই শুরু এবং শেষ সিদ্ধান্তের মালিক।

তাই আপনি সানন্দে কাজে যেতে পারেন কিংবা নাও যেতে পারেন! খেতে পারেন কিংবা নাও খেতে পারেন ! অনুরূপ আপনার পুরো ইচ্ছাধীনে যে, আপনি নামায পড়তে পারেন আবার নাও পড়তে পারেন ! আল্লাহকে স্মরণ করতে পারেন আবার নাও করতে পারেন ! নিকৃষ্ট কাজসমূহ করতে পারেন আবার নাও করতে পারেন ! বর্ণিত প্রত্যেক বিষয়ের মালিক আপনি , আপনি এসব ব্যাপারে স্বাধীন । আপনি এসব কাজ করতেও পারেন নাও পারেন।

কিন্তু .. শুধু একটি কাজ এমন আছে , যা হবেই হবে। এ বিষয়টি কিন্তু আগের চেয়ে ভিন্ন .. এটি করা এবং না করার স্বাধীনতা আপনার নেই ! বরং অবশ্যই এটা ঘটবে, আপনি তাতে সন্তুষ্ট থাকুন কিংবা অসন্তুষ্ট , চান বা না চান ! সেই অটল সত্যটি হচ্ছে যে, আপনাকে মরতে হবে !!

অত:পর অবশ্যই আপনাকে এক নতুন বাসস্থান এবং ভিন্ন জীবনে প্রত্যাবর্তন করতে হবে। আপনার সেই নতুন বাসস্থানটি একটি সংকীর্ণ গর্ত ছাড়া কিছুই হবে না যা, কেবল আপনার দেহটাকে কোনরূপে সেখানে রাখা সম্ভব হবে । তাছাড়া জানালা বিহীন, আলো বিহীন, এই স্থানটি কতই না অন্ধকার হবে! শুধু এতটুকুই নয় বরং উপর থেকে আপনার আপন লোক-জন , আত্মীয়-স্বজনরা নিষ্ঠুরের মত মাটি চাপিয়ে দিবে । আর অজানা অচেনা লোকের মত আপনাকে সেখানে একা ফেলে রেখে নিজ নিজ বাড়ী ফিরবে। যেন আপনি তাদের কেউই নন। আপনি আর্তনাদ ও চিৎকার করে যদি তাদের ডাকতেও থাকেন, তারা শুনতে পাবে না। আপনি শত চেষ্টা করলেও কাফনে জোড়ানো শরীরটাকে খুলে উঠে বসতে পারবেন না। সেই ঘরে প্রচণ্ড গরমে ফ্যান বা এসির ব্যবস্থা থাকবে না ! এমনকি বাইরের একটু বাতাসও প্রবেশ করতে পারবে না। আর না দারুণ ঠাণ্ডার দিনে লেপ-কাঁথার ব্যবস্থা থাকবে! আপনার আশে পাশে হবে বিশ্রী কদাকার পোকা-মাকড় যারা আপনার কাফনকে কুরে কুরে খেয়ে আপনার নরম গোশত-মাংস আঁচড়ে আঁচড়ে খাবে।

এসবের পরেও আপনি জানেন না যে, আপনার সেই নতুন জীবনটা কেমন হবে? আপনি সৌভাগ্যবান হবেন না দুর্ভাগ্যবান! এটা আপনার সৎকাজের উপর নির্ভর করবে যা আপনি এর পূর্বের জীবনে করে ছিলেন। অবশ্যই এটা ভয়ংকর ব্যাপার। তবে যেহেতু আপনি এই কথাগুলো পড়ার সুযোগ পাচ্ছেন তার মানে আপনার হাতে নেক আমল করার এবং আল্লাহর নিকট ক্ষমা চাওয়ার সুযোগ আছে। তাই আসুন সুযোগ কাজে লাগাই। কারণ এই জীবন তো কয় দিনের মাত্র। তার পর হয়ত: লোকেরা বলবে: অমুক মারা গেছে .. দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছে .. ( আল্লাহ তাকে ক্ষমা করুক ).. দু-চার দিন হয়ত লোকেরা আপনার মৃত্যুতে আফসোস করবে। তার পর ভুলে যাবে।

তাই আসুন, এমন কাজ করি যা আল্লাহ পছন্দ করেন। যেন আপনার নতুন গৃহের জীবনটা সৌভাগ্যের হয়। আল্লাহর কসম! কারণ সেটাই আসল জীবন। যদি সৌভাগ্যবান হন তবে চিরকাল সৌভাগ্যবান থাকবেন। আর সতর্ক থাকুন যেন দুর্ভাগ্যবানদের মধ্যে গণ্য না হন। কারণ সেটি সর্বনাশা !

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: ‘মৃত ব্যক্তিকে যখন কবর দেওয়া হয়, তখন কাল বর্ণ ও নীল বর্ণ দুইজন ফেরেশতা আসে। একজনের নাম মুনকার অপর জনের নাম নাকীর। তারা মৃত ব্যক্তিকে কে জিজ্ঞেসকরবে : এই লোকটির সম্পর্কে (পৃথিবীতে) তুমি কি বলেছিলে? সে বলবে: ইনি আল্লাহর বান্দা এবং তাঁর রাসূল। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ব্যতীত সত্য কোন উপাস্য নেই এবং মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহর বান্দা ও রাসূল। দুই ফেরেশতা বলবে : আমরা জানি যা তুমি বলেছিলে। অত:পর তার কবর দৈর্ঘ্য প্রস্থে ৭০ গজ সম্প্রসারিত করে তা আলোয় আলোকিত করে দেওয়া হবে। তার পর বলা হবে : ঘুমিয়ে পড়। সে বলবে: আমার পরিবারের কাছে গিয়ে তাদের এ খবর দিতে চাই। ফেরেশতা বলবে: বাসর ঘরের সদ্য বিবাহিত বরের মত ঘুমাও যাকে তার একান্ত আপন জনই ঘুম থেকে জাগাবে। সে এই অবস্থাতেই থাকবে যতক্ষণ আল্লাহ তাকে পুনরুত্থান না করেন। আর যদি মৃত ব্যক্তি মুনাফেক হয় তাহলে সে বলবে: লোকেরা যা বলত আমিও তাই বলতাম আসলে কি তা জানি না। ফেরেশতা বলবে : আমরা জানতাম যা তুমি বলতে। অত:পর মাটিকে আদেশ করা হবে : জোড়া লেগে যাও। মাটি মিলে যাবে। যার কারণে মৃতের পাঁজরের হাড় চাপে এদিক ওদিক হয়ে যাবে। এই ভাবে তার শাস্তি হতে থাকবে যতক্ষণ আল্লাহ তাঁকে পুনরায় না ওঠান।‘ [ হাদীস হাসান, সহীহুল জামে নং ৭২৪]

আল্লাহর শপথ আমি নামাজ পড়তাম

রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন: ‘দুটি নিয়ামত এমন আছে, যে দুটোতে অনেক মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত। তা হল সুস্থতা আর অবসর।‘ [সহীহ বুখারী ৫৯৭০, ইফা]

এটি একটি সচিত্র সত্যি ঘটনা যা আপনার জীবন, আপনার চিন্তা ধারা ও জীবনের উদ্দেশ্য বদলে দিতে পারে। ঘটনাটি বাহরাইনের ইব্রাহিম নাসের নামের এক যুবকের। সে জন্মগতভাবেই পক্ষাঘাতগ্রস্ত, শুধু তার আঙ্গুল ও মাথা নাড়াতে সক্ষম। এমনকি তার নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের জন্যও তাকে যন্ত্রপাতির সাহায্য নিতে হয়। এই যুবকটির একটি আকাঙ্ক্ষা ছিল একদিন শেইখ নাবীল আল আওদির সাথে দেখা করার। এইজন্য ইব্রাহীমের বাবা শেইখের সাথে ফোনে আলাপ করলেন ইব্রাহীমের সাথে তার সাক্ষাতের ব্যবস্থা করা যায় কিনা।

ইনি শেইখ নাবীল। ইব্রাহীম শেইখ নাবীলকে তার ঘরের দরজা খুলে ঢুকতে দেখে কি ভীষণ খুশী হয়ে গেল! আমরা তার আনন্দের বহিঃপ্রকাশ তার চেহারাতেই দেখতে পাবো কারণ সে কথা বলে বোঝাতেও অক্ষম।

শেইখ নাবীল ইব্রাহীমের ঘরে ঢোকার মুহূর্ত।

আর এটি হল শেইখ নাবিলকে দেখে ইব্রাহীমের অভিব্যক্তি। লক্ষ্য করুন ইব্রাহীমের গলায় শ্বাস নেওয়ার যন্ত্রটি। সে স্বাভাবিকভাবে শ্বাস নিতেও অক্ষম।

শেইখ নাবীল ইব্রাহীমের কপালে চুমু খাচ্ছেন

ইব্রাহীম তার বাবা, চাচা ও শেইখ নাবীলের সাথে।

এভাবে শেইখ নাবীল আর ইব্রাহীম আলাপ করলেন ইন্টারনেটে ইসলামের দাওয়াত এবং এর জন্য প্রয়োজনীয় প্রচেষ্টার ব্যপারে। তারা কিছু ঘটনাও আলোচনা করলেন।

এবং তাদের আলাপচারিতার মাঝে শেইখ নাবীল ইব্রাহীমকে একটি প্রশ্ন করলেন। যে প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে ইব্রাহীম কেঁদে ফেললেন, তার গাল বেয়ে অশ্রুধারা গড়িয়ে পড়ল।

ইব্রাহীম না কেঁদে পারলেন না যখন তার কিছু বেদনাদায়ক স্মৃতি মনে পড়ল।

শেইখ নাবীল ইব্রাহীমের চোখের পানি মুছে দিচ্ছেন।

আপনি কি জানেন কি ছিল সেই প্রশ্ন যা ইব্রাহীমকে কাঁদিয়ে দিল?

শেইখ জিজ্ঞেস করেছিলেনঃ আচ্ছা ইব্রাহীম, আল্লাহ যদি তোমাকে সুস্থ করতেন…তাহলে তুমি কি করতে?

আর তখন ইব্রাহীম এমনভাবে কাঁদলেন যা শেইখ, ইব্রাহীমের বাবা, তার চাচা এবং ঘরের প্রত্যেককে কাঁদিয়ে দিল…এমন কি ক্যামেরাম্যানকেও। তার উত্তর ছিলঃ আল্লাহর শপথ, আমি তাহলে আনন্দের সাথে মসজিদে যেয়ে আমার নামাজ পড়তাম। আমি আমার সুস্বাস্থ্যের নেয়ামত এমন প্রতিটি কাজে ব্যবহার করতাম যা আল্লাহকে সন্তুষ্ট করতে পারে।

প্রিয় ভাই ও বোনেরা, আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে কর্মশক্তি ও সুস্বাস্থ্যের নেয়ামত দিয়ে রহমত করেছেন। কিন্তু আমরা মসজিদে যেয়ে নামাজ পড়ি না !!! অথচ আমরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা কম্পিউটার অথবা টিভির সামনে বসে সময় কাটিয়ে দেই। “এতে উপদেশ রয়েছে তার জন্য যার আছে অন্তঃকরণ অথবা যে শ্রবণ করে একাগ্রচিত্তে।” [সূরা ক্বাফঃ ৩৭]

আল্লাহ যেন আমাদের সঠিক পথে পরিচালিত করেন আর সেই পথে আমাদের দৃঢ় রাখেন।

আমীন!!

এতেকাফ তাৎপর্য, উদ্দেশ্য ও বিধান

সম্পাদনা: মুহাম্মদ শামছুল হক সিদ্দিক | সংকলন: মুহাম্মদ আকতারুজ্জাম

এতেকাফের সংজ্ঞা

বিশেষ নিয়তে বিশেষ অবস্থায় আল্লাহ তা-আলার আনুগত্যের উদ্দেশ্যে মসজিদে অবস্থান করাকে এতেকাফ বলে।

এতেকাফের ফজিলত

এতেকাফ একটি মহান ইবাদত, মদিনায় অবস্থানকালীন সময়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতি বছরই এতেকাফ  পালন করেছেন। দাওয়াত, তরবিয়ত, শিক্ষা এবং জিহাদে ব্যস্ত থাকা সত্ত্বেও রমজানে তিনি এতেকাফ ছাড়েননি। এতেকাফ ঈমানি তরবিয়তের একটি পাঠশালা, এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হিদায়েতি আলোর একটি প্রতীক। এতেকাফরত অবস্থায় বান্দা নিজেকে আল্লাহর ইবাদতের জন্য দুনিয়ার অন্যান্য সকল বিষয়  থেকে আলাদা করে নেয়।  ঐকান্তিকভাবে মশগুল হয়ে পড়ে আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের নিরন্তর সাধনায়। এতেকাফ  ঈমান বৃদ্ধির একটি মূখ্য সুযোগ। সকলের উচিত এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে নিজের ইমানি চেতনাকে প্রাণিত করে তোলা ও উন্নততর পর্যায়ে পৌছেঁ দেয়ার চেষ্টা করা।

আল-কুরআনুল কারিমে বিভিন্নভাবে এতেকাফ সম্পর্কে বর্ণনা এসেছে, ইবরাহিম আ. ও ইসমাইল আ.  এর কথা উল্লেখ করে এরশাদ হয়েছে: “এবং আমি ইবরাহিম ও ইসমাইলকে আদেশ করলাম, তোমরা আমার গৃহকে তাওয়াফকারী, এতেকাফকারী ও রুকু-সেজদাকারীদের জন্য পবিত্র করো।” [সূরা বাকারা : ১২৫] 

এতেকাফ অবস্থায় স্ত্রীদের সাথে কি আচরণ হবে তা বলতে গিয়ে আল্লাহ তা-আলা বলেন: “আর তোমরা মসজিদে এতেকাফ কালে স্ত্রীদের সাথে মেলামেশা করো না।” [সূরা বাকারা : ১৮৭]

ইবরাহিম আ.  তাঁর পিতা এবং জাতিকে লক্ষ্য করে মূর্তির ভর্ৎসনা করতে যেয়ে যা বলেছিলেন, আল্লাহ তা-আলা তা উল্লেখ করে বলেন: “যখন তিনি তাঁর পিতা ও তাঁর সম্প্রদায়কে বললেন: “এই মূর্তিগুলো কি, যাদের পূজারি (এতেকাফকারী) হয়ে) তোমরা বসে আছ?” [সূরা আম্বিয়া : ৫২] 

রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অসংখ্য হাদিস এতেকাফ সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে, তার মধ্য হতে ফজিলত সম্পর্কিত কিছু হাদিস নিচে উল্লেখ করা হল।

আয়েশা রাদি-আল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমজানের শেষের দশকে এতেকাফ করেছেন, ইন্তেকাল পর্যন্ত। এরপর তাঁর স্ত্রীগণ এতেকাফ করেছেন। [বুখারি ওমুসলিম]

আয়েশা রাদি-আল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি  ওয়াসাল্লাম প্রত্যেক রমজানে এতেকাফ করতেন। [বুখারি ২০৪১]

অন্য এক হাদিসে এসেছে: আমি (প্রথমে) এ রাতের সন্ধানে প্রথম দশে এতেকাফ পালন করি। অত:পর এতেকাফ পালন করি মাঝের দশে। পরবর্তীতে ওহির মাধ্যমে আমাকে জানানো হয় যে, এ রাত শেষ দশে রয়েছে। সুতরাং তোমাদের মাঝে যে (এ দশে) এতেকাফ পালনে আগ্রহী, সে যেন তা পালন করে। লোকেরা তার সাথে এতেকাফ পালন করল। রাসূল বলেন—আমাকে তা এক বেজোড় রাতে দেখানো হয়েছে এবং দেখানো হয়েছে যে, আমি সে ভোরে কাদা ও মাটিতে সেজদা দিচ্ছি। অত:পর রাসূল একুশের রাতের ভোর যাপন করলেন, ফজর পর্যন্ত তিনি কিয়ামুল্লাইল করেছিলেন। তিনি ফজর আদায়ের জন্য দণ্ডায়মান হয়েছিলেন। তখন আকাশ ছেপে বৃষ্টি নেমে এল, এবং মসজিদে চুঁইয়ে চুঁইয়ে পানি পড়ল। আমি কাদা ও পানি দেখতে পেলাম। ফজর সালাত শেষে যখন তিনি বের হলেন, তখন তার কপাল ও নাকের পাশে ছিল পানি ও কাদা। সেটি ছিল একুশের রাত।

আবু হুরাইরা রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতি রমজানে দশ দিন এতেকাফ  করতেন, তবে যে বছর তিনি পরলোকগত হন, সে বছর তিনি বিশ দিন এতেকাফে কাটান।

আবু হুরাইরা  রা. হতে বর্ণিত হাদিসে উভয়টির উল্লেখ পাওয়া যায়।  তিনি বলেন: আবু হুরাইরা রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন : রাসূলুল্লাহ  সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতি রমজানের শেষ দশদিন এতেকাফ করতেন। তবে যে বছর পরলোকগত হন তিনি বিশ দিন এতেকাফ করেছেন। [ বুখারি ]

আয়শা রাদিয়াল্লাহু  আনহা বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে তাঁর জনৈকা স্ত্রীও এতেকাফ করলেন। তখন তিনি ছিলেন এস্তেহাজা  অবস্থায়, রক্ত দেখছেন। রক্তের কারণে হয়তো তাঁর নীচে গামলা রাখা হচ্ছে। [ বুখারি ]

রাসূল বলেন: আমি কদরের রাত্রির সন্ধানে প্রথম দশ দিন এতেকাফ করলাম। এরপর এতেকাফ করলাম মধ্যবর্তী দশদিন। অত:পর ওহি প্রেরণ করে আমাকে জানানো হল যে তা শেষ দশদিনে। সুতরাং তোমাদের যে এতেকাফ পছন্দ করবে, সে যেন এতেকাফ করে। ফলে, মানুষ তার সাথে এতেকাফ যাপন করল।

এতেকাফের উপকারিতা

১- এতেকাফকারী এক নামাজের পর আর এক নামাজের জন্য অপেক্ষা করে থাকে, আর এ অপেক্ষার অনেক ফজিলত রয়েছে। আবু হুরাইরা রাদি-আল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: নিশ্চয় ফেরেশতারা তোমাদের একজনের জন্য দোয়া করতে থাকেন যতক্ষণ সে কথা না বলে, নামাজের স্থানে অবস্থান করে। তারা বলতে থাকে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দিন, আল্লাহ তার প্রতি দয়া করুন, যতক্ষণ তোমাদের কেউ নামাজের স্থানে থাকবে, ও নামাজ তাকে আটকিয়ে  রাখবে, তার পরিবারের নিকট যেতে নামাজ ছাড়া আর কিছু বিরত রাখবে না, ফেরেশতারা তার জন্য এভাবে দোয়া করতে থাকবে।

২- এতেকাফকারী কদরের রাতের তালাশে থাকে, যে রাত অনির্দিষ্টভাবে রমজানের যে কোন রাত হতে পারে। এই রহস্যের  কারণে আল্লাহ তা-আলা সেটিকে বান্দাদের থেকে গোপন রেখেছেন, যেন তারা মাস জুড়ে তাকে তালাশ করতে থাকে।

৩- এতেকাফের ফলে আল্লাহ তা’আলার সাথে সম্পর্ক দৃঢ় হয়,এবং আল্লাহ তা’আলার জন্য মস্তক অবনত করার প্রকৃত চিত্র ফুটে উঠে। কেননা আল্লাহ তা’আলা বলেন: আমি মানুষ এবং জিন জাতিকে একমাত্র আমারই ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছি। [সুরা আজ-জারিয়াত: ৫৬]

আর এ ইবাদতের বিবিধ  প্রতিফলন ঘটে এতেকাফ অবস্থায়। কেননা এতেকাফ অবস্থায় একজন মানুষ নিজেকে পুরোপুরি আল্লাহর ইবাদতের সীমানায় বেঁধে নেয় এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির কামনায় ব্যকুল হয়ে পড়ে।  আল্লাহ তা-আলাও তাঁর বান্দাদেরকে নিরাশ করেন না, বরং তিনি বান্দাদেরকে নিরাশ হতে নিষেধ করে দিয়ে বলেছেন: হে আমার বান্দাগণ! যারা নিজেদের উপর জুলুম করেছ তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ও না। নিশ্চয় আল্লাহ সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেন। তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। [সুরা ঝুমার : ৫৩]

আর আমার বান্দারা যখন তোমার কাছে জিজ্ঞেস করে আমার ব্যাপারে- বস্তুত আমি রয়েছি সন্নিকটে। প্রার্থনাকারীর প্রার্থনা কবুল করি যখন সে  প্রার্থনা করে। কাজেই তারা যেন আমার হুকুম মান্য করে এবং আমার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে। সম্ভবত তারা পথ প্রাপ্ত হবে। [আল-বাকারা : ১৮৬]

যখন কেউ মসজিদে অবস্থান করা পছন্দ করতে লাগে— যা সম্ভব প্রবৃত্তিকে অভ্যস্ত করানোর  মাধ্যমে,  কেননা প্রবৃত্তিকে যে বিষয়ে  অভ্যস্ত করানো  হবে  সে বিষয়েই সে অভ্যস্ত হয়ে পড়বে— মসজিদে অবস্থান করা পছন্দ হতে শুরু করলে মসজিদকে সে  ভালোবাসবে,  সেখানে নামাজ আদায়কে ভালোবাসবে। আর এ প্রক্রিয়ায় আল্লাহর সাথে তার সম্পর্ক মজবুত হবে। হৃদয়ে সৃষ্টি হবে নামাজের ভালোবাসা, এবং নামাজ আদায়ের মাধ্যমেই অনুভব করতে শুরু করবে হৃদয়ের প্রশান্তি। যে প্রশান্তির কথা  রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এভাবে বলেছিলেন: নামাজের মাধ্যমে আমাদেরকে শান্ত করো হে বেলাল, নামাজের মাধ্যমে আমাদেরকে শান্ত করো হে বেলাল।

মসজিদে এতেকাফের মাধ্যমে একমাত্র আল্লাহ তা’আলার উদ্দেশে নিজেকে আবদ্ধ করে নেওয়ার কারণে মুসলমানের  অন্তরের কঠোরতা দূরীভূত হয়, কেননা কঠোরতা সৃষ্টি হয়  দুনিয়ার প্রতি ভালোবাসা ও পার্থিবতায় নিজেকে আরোপিত করে রাখার কারণে। মসজিদে নিজেকে আবদ্ধ করে  রাখার কারণে দুনিয়ার প্রতি ভালোবাসায় ছেদ পড়ে এবং আত্মিক উন্নতির অভিজ্ঞতা অনুভূত হয়। মসজিদে এতেকাফ করার কারণে ফেরেশতারা দোয়া করতে থাকে, ফলে এতেকাফকারী ব্যক্তির আত্মা নিম্নাবস্থার নাগপাশ কাটিয়ে  ফেরেশতাদের স্তরের দিকে ধাবিত হয়। ফেরেশতাদের পর্যায় থেকেও বরং ঊর্ধ্বে ওঠার প্রয়াস পায়।  কেননা ফেরেশতাদের প্রবৃত্তি নেই বিধায় প্রবৃত্তির ফাঁদে তারা পড়ে না।  আর মানুষের  প্রবৃত্তি থাকা সত্ত্বেও সব কিছু থেকে মুক্ত হয়ে আল্লাহর জন্য একাগ্রচিত্ত হয়ে যায়।

এতেকাফের মাধ্যমে অন্তরে প্রশান্তি আসে।
বেশি বেশি  কুরআন তিলাওয়াতের সুযোগ সৃষ্টি হয়।
ঐকান্তিকভাবে তওবা করার সুযোগ লাভ হয়।
তাহাজ্জুদে অভ্যস্ত হওয়া যায়।
১০ সময়কে সুন্দরভাবে কাজে লাগানো যায়।

এতেকাফের আহকাম

ইসলামি শরিয়াতে এতেকাফের অবস্থান: এতেকাফ করা সুন্নাত। এতেকাফের  সবচেয়ে উপযোগীময় রমজানের শেষ দশক, এতেকাফ কুরআন, হাদিস ও এজমা দ্বারা  প্রমাণিত। ইমাম আহমদ রহ. বলেন: কোন মুসলমান এতেকাফকে সুন্নাত বলে স্বীকার করেনি এমনটি আমার জানা নেই।

এতেকাফের উদ্দেশ্য

১- আল্লাহর সাথে সম্পর্ক দৃঢ় করা

আল্লাহর দিকে আকৃষ্ট হওয়া ও আল্লাহ কেন্দ্রিক ব্যতিব্যস্ততা  যখন অন্তর সংশোধিত ও ঈমানি দৃঢ়তা অর্জনের  পথ,  কেয়ামতের দিন তার মুক্তিও বরং এ পথেই, তাহলে  এতেকাফ হল এমন একটি ইবাদত যার মাধ্যমে বান্দা সমস্ত সৃষ্টি-জীব থেকে আলাদা হয়ে যথাসম্ভব প্রভুর সান্নিধ্যে চলে আসে। বান্দার কাজ হল  তাঁকে স্মরণ করা, তাঁকে ভালোবাসা  ও তাঁর ইবাদত করা। সর্বদা তার সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভের চেষ্টা করা, এরই মাধ্যমে আল্লাহর সাথে বান্দার সম্পর্ক দৃঢ় ও মজবুত হয়।

২- পাশবিক প্রবণতা  এবং অহেতুক কাজ থেকে দুরে থাকা

রোজার মাধ্যমে আল্লাহ তা-আলা তাঁর  বান্দাদেরকে বাঁচিয়ে রাখেন অতিরিক্ত পানাহার ও যৌনাচারসহ পশু প্রবৃত্তির বিবিধ প্রয়োগ  থেকে, অনুরূপভাবে তিনি   এতেকাফের বিধানের মাধ্যমে  তাদেরকে বাঁচিয়ে রাখেন অহেতুক কথা-বার্তা, মন্দ সংস্পর্শ,  ও অধিক ঘুম হতে ।

এতেকাফের মাধ্যমে একজন ব্যক্তি সম্পূর্ণ অর্থে  আল্লাহর জন্য নিবেদিত হয়ে যায়। নামাজ, কুরআন তিলাওয়াত, জিকির ও দোয়া ইত্যাদির নির্বাধ চর্চার মাধ্যমে  আল্লাহর নৈকট্য লাভের অফুরান সুযোগের আবহে সে নিজেকে পেয়ে যায়।

৩- শবে কদর তালাশ করা

এতেকাফের মাধ্যমে শবে কদর খোঁজ করা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মূল উদ্দেশ্য ছিল, আবু সায়ীদ খুদরি রা. থেকে  বর্ণিত হাদিস সে কথারই প্রমাণ বহন করে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: আমি প্রথম দশকে এতেকাফ করেছি এই (কদর) রজনী  খোঁজ করার উদ্দেশে, অতঃপর এতেকাফ করেছি মাঝের দশকে, অত:পর মাঝ-দশক পেরিয়ে এলাম , তারপর আমাকে বলা হল, (কদর) তো শেষ দশকে। তোমাদের মধ্যে যদি কেউ এতেকাফ করতে চায় সে যেন এতেকাফ করে, অত:পর  লোকেরা তাঁর সাথে এতেকাফ করল। [মুসলিম:  হাদিস নং ১১৬৭]

৪-মসজিদে অবস্থানের অভ্যাস গড়ে তোলা

এতেকাফের মাধ্যমে বান্দার অন্তর মসজিদের সাথে জুড়ে যায়, মসজিদের সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার অভ্যাস গড়ে উঠে। হাদিস অনুযায়ী  যে সাত ব্যক্তিকে আল্লাহ তা-আলা তাঁর নিজের ছায়ার নীচে ছায়া দান করবেন তাদের মধ্যে একজন হলেন ওই ব্যক্তি মসজিদের সাথে যার হৃদয় ছিল বাঁধা।

৫- দুনিয়া ত্যাগ ও বিলাসিতা থেকে দুরে থাকা

এতেকাফকারী যেসব বিষয়ের স্পৃক্ততায় জীবন যাপন করত সেসব  থেকে সরে এসে নিজেকে  মসজিদে আবদ্ধ করে ফেলে।  এতেকাফ অবস্থায় দুনিয়া ও দুনিয়ার স্বাদ থেকে সে  বিচ্ছিন্ন   হয়ে পড়ে, ঠিক ঐ আরোহীর ন্যায় যে কোন গাছের ছায়ার নীচে বসল, অতঃপর সেখান থেকে উঠে চলে গেল।

৬- ইচ্ছাশক্তি প্রবল  করা এবং প্রবৃত্তিকে খারাপ অভ্যাস ও কামনা-বাসনা থেকে বিরত রাখার অভ্যাস  গড়ে তোলা

কেননা এতেকাফ  দ্বারা খারাপ অভ্যাস থেকে বিরত থাকার ট্রেন্ড গড়ে উঠে। এতেকাফ তার জন্য সুবর্ণ সুযোগ সৃষ্টি করে দেয় নিজেকে ধৈর্যের গুণে গুণান্বিত করতে ও নিজের ইচ্ছাশক্তিকে শানিত করতে।  এতেকাফ থেকে একজন মানুষ সম্পূর্ণ নতুন মানুষ হয়ে বের হয়ে আসার সুযোগ পায়।  যা পরকালে উপকারে আসবেনা তা থেকে বিরত থাকার ফুরসত মেলে।

এতেকাফের বিধানাবলি

১- এতেকাফের সময়-সীমা

সবচেয়ে কম সময়ের এতেকাফ হল, শুদ্ধ মত অনুযায়ী, একদিন একরাত। কেননা সাহাবায়ে কেরাম ( রাদি-আল্লাহু আনহুম)  নামাজ অথবা উপদেশ শ্রবণ করার অপেক্ষায় বা জ্ঞান অর্জন ইত্যাদির জন্য মসজিদে বসতেন, তবে তারা এ সবের জন্য  এতেকাফের নিয়ত করেছেন বলে শোনা যায়নি।সর্বোচ্চ কতদিনের জন্য এতেকাফ করা যায় এ ব্যাপারে ওলামাদের মতামত হল, এ ব্যাপারে  নির্ধারিত কোন সীমা-রেখা নেই।

২- এতেকাফে প্রবেশ ও বাহির হওয়ার সময়

এতেকাফকারী যদি রমজানের শেষ দশকে এতেকাফের নিয়ত করে তা হলে একুশতম রাত্রির সূর্য অস্ত যাওয়ার পূর্বে মসজিদে  প্রবেশ করবে, কেননা তার উদ্দেশ্য কদরের রাত তালাশ করা, যা আশা করা হয়ে থাকে বেজোড় রাত্রগুলোতে, যার মধ্যে একুশের রাতও রয়েছে।তবে এতেকাফ থেকে বের হওয়ার ক্ষেত্রে উত্তম হল চাঁদ রাত্রি মসজিদে অবস্থান করে পরদিন সকালে সরাসরি  ইদগাহে চলে যাওয়া। তবে চাঁদ রাতে  সূর্যাস্তের পর  মসজিদ থেকে  বের হয়ে গেলেও  কোন সমস্যা নেই, বৈধ রয়েছে।

৩- এতেকাফের শর্তাবলি

এতেকাফের অনেকগুলো শর্ত রয়েছে । শর্ত গুলো নিুরূপ: এতেকাফের জন্য কেউ কেউ রোজার শর্ত করেছেন, কিন্তু বিশুদ্ধ মত হল রোজা শর্ত নয়। কেননা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে প্রমাণিত আছে যে তিনি কোন এক বছর শাওয়ালের প্রথম দশকে এতেকাফ করেছিলেন, আর এ দশকে  ঈদের দিনও  আছে।  আর ঈদের দিনে তো রোজা রাখা নিষিদ্ধ।

  • এতেকাফের জন্য মুসলমান হওয়া শর্ত।  কেননা কাফেরের ইবাদত গ্রহণযোগ্য হয় না।
  • এতেকাফকারীকে বোধশক্তিসম্পন্ন হতে হবে, কেননা  নির্বোধ ব্যক্তির  কাজের কোনো উদ্দেশ্য থাকে না, আর উদ্দেশ্য ব্যতীত  কাজ শুদ্ধ হতে পারে না।
  • ভালো-মন্দ পার্থক্য করার জ্ঞান থাকতে হবে, কেননা কম বয়সী, যে ভাল-মন্দের পার্থক্য করতে পারে না, তার নিয়তও শুদ্ধ হয় না।
  • এতেকাফের নিয়ত করতে হবে, কেননা মসজিদে অবস্থান হয়তো এতেকাফের নিয়তে হবে অথবা অন্য কোনো  নিয়তে।  আর এ দুটোর  মধ্যে পার্থক্য করার জন্য নিয়তের প্রয়োজন।
  • উপরুন্তু  রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:প্রত্যেক কাজের নির্ভরতা নিয়তের উপর, যে যা নিয়ত করবে সে কেবল তাই পাবে। [বুখারি : ১]
  • এতেকাফ অবস্থায় মহিলাদের হায়েজ-নিফাস থেকে পবিত্র থাকা জরুরি, কেননা এ অবস্থায় মসজিদে অবস্থান করা হারাম, অবশ্য এস্তেহাজা অবস্থায়  এতেকাফ করা বৈধ। আয়েশা রা. আনহা বলেন : রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে তাঁর স্ত্রী-গণের মধ্য হতে কেউ একজন এতেকাফ করেছিলেন  এস্তেহাজা অবস্থায়।  তিনি লাল ও হলুদ রঙ্গের স্রাব  দেখতে পাচ্ছিলেন, আমরা কখনো তার নীচে পাত্র রেখে দিয়েছি নামাজের সময়। [বুখারি ২০৩৭]
  • এস্তেহাজাগ্রস্তদের সাথে অন্যান্য বেধীগ্রস্তদেরকে  মেলানো যায় , যেমন যার বহুমূত্র রোগ বিশিষ্ট ব্যক্তি আছে, তবে শর্ত হল মসজিদ যেন অপবিত্র না হয়।
  • গোসল ফরজ হয় এমন ধরনের অপবিত্রতা থেকে পবিত্র হতে হবে। অপবিত্র লোক মসজিদে অবস্থান করা হারাম। যদিও কোন কোন আলেম ওজু করার শর্তে মসজিদে অবস্থান বৈধ বলেছেন।  আর যদি অপবিত্রতা, যৌন স্পর্শ অথবা স্বামী -স্ত্রীর মিলনের ফলে হয়, তবে  সকলের মতে এতেকাফ ভঙ্গ হয়ে যাবে। আর যদি স্বপ্নদোষের কারণে হয়, তা হলে কারোর মতে এতেকাফ ভঙ্গ  হবে না। আর যদি হস্তমৈথুনের কারণে হয় তা হলে সঠিক মত অনুসারে এতেকাফ ভঙ্গ  হয়ে যাবে।
  • এতেকাফ মসজিদে হতে হবে এ ব্যাপারে সকল আলেম একমত যে এতেকাফ মসজিদে হতে হবে, তবে  জামে মসজিদ হলে  উত্তম কেননা এমতাবস্থায় জুমার নামাজের জন্য  এতেকাফকারীকে মসজিদ থেকে বের হতে হবে না।

মসজিদ থেকে বের হওয়ার বিধান

  • এতেকাফকারী যদি বিনা প্রয়োজনে মসজিদ থেকে বের হয় তাহলে তার এতেকাফ ভঙ্গ  হয়ে যাবে।
  • আর এতেকাফের স্থান থেকে যদি মানবীয় প্রয়োজন মিটানোর জন্য বের হয় তাহলে এতেকাফ ভঙ্গ  হবে না।
  • মসজিদে থেকে পবিত্রতা অর্জন সম্ভব না হলে মসজিদ থেকে বের হওয়ার অনুমতি আছে।
  • বাহক না থাকার কারণে এতেকাফকারীকে  যদি পানাহারের প্রয়োজনে  বাইরে যেতে হয় অথবা মসজিদে খাবার গ্রহণ করতে  লজ্জা বোধ হয় , তবে  এরূপ প্রয়োজনে বাইরে যাওয়ার অনুমতি আছে।
  • যে মসজিদে এতেকাফে বসেছে সেখানে জুমার নামাজের ব্যবস্থা না থাকলে  জুমার নামাজ আদায়ের প্রয়োজনে মসজিদ থেকে  বের হওয়া ওয়াজিব, এবং আগে ভাগেই রওয়ানা হওয়া তার জন্য মুস্তাহাব ।
  • ওজরের কারণে এতেকাফকারী মসজিদ থেকে বের হতে পারে। ছাফিয়্যা রা. থেকে বর্ণিত হাদিস এর প্রমাণ ছাফিয়্যা রা. আনহা রমজানের শেষ দশকে এতেকাফস্থলে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে সাক্ষাৎ করতে এলেন। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে কতক্ষণ  কথা বললেন, অতঃপর যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও তাকে বিদায় দিতে উঠে দাঁড়ালেন।[বুখারি : ২০৩৫]
  • কোন নেকির কাজ করার জন্য এতেকাফকারীর মসজিদ থেকে বের হওয়া বৈধ নয়। যেমন রোগী দেখতে যাওয়া, জানাজায় উপস্থিত হওয়া ইত্যাদি। এ মর্মে আয়শা রা. আনহা বলেন: এতেকাফকারীর জন্য সুন্নত হল, সে রোগী দেখতে যাবে না, জানাযায় উপস্থিত হবে না, স্ত্রীকে স্পর্শ করবে না ও তার সাথে কামাচার থেকে বিরত থাকবে  এবং অতি প্রয়োজন ব্যতীত মসজিদ থেকে বের হবে না। [আবু দাউদ, হাদিস নং ২৪৭৩]
  • এতেকাফ-বিরুদ্ধ কোন কাজের জন্য এতেকাফকারীর মসজিদ থেকে বের হওয়া বৈধ নয়, যেমন ক্রয়-বিক্রয়, স্বামী-স্ত্রীর মিলন ইত্যাদি।

এতেকাফকারীর  জন্য যা কিছু বিধিবদ্ধ

  • ইবাদত আদায়, যেমন  নামাজ, কুরআন তিলাওয়াত, জিকির ও দোয়া ইত্যাদি। কেননা এতেকাফের উদ্দেশ্য হল আল্লাহ তা’আলার সমীপে  অন্তরের একাগ্রতা নিবেদন করা এবং তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হওয়া যা  উপরোক্ত ইবাদত আদায় ছাড়া  সম্ভব নয়।অনুরূপভাবে যেসব ইবাদতের প্রভাব অন্যদের পর্যন্ত পৌঁছায় যেমন সালামের উত্তর দেওয়া, সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজ থেকে বারণ, প্রশ্নের উত্তর দেওয়া, পথ দেখানো, ইলম শিক্ষা দেওয়া কুরআন  পড়ানো ইত্যাদিও করতে পারবে। কিন্তু শর্ত হল এগুলো যেন এত বেশি না হয় যে এতেকাফের মূল উদ্দেশই ছুটে যায়।
  • এতেকাফকারীর জন্য মুস্তাহাব হল তার এতেকাফের স্থানে কোন কিছু দ্বারা পর্দা করে নেয়া। কেননা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তুর্কি গম্বুজের ভিতরে  এতেকাফ করেছেন যার  দরজায় ছিল চাটাই।
  • এতেকাফকারী তার প্রয়োজনীয় জিনিস-পত্র  সঙ্গে নেবেযাতে নিজের প্রয়োজনে তাকে বার বার মসজিদের বাইরে যেতে না  হয়; আবু সাইদ খুদরি রাদি আল্লাহু আনহুর হাদিসে এসেছে , তিনি বলেন: আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে রমজানের মাঝের  দশকে এতেকাফ করলাম, যখন বিশ তারিখ সকাল হল আমরা আমাদের বিছানা-পত্র সরিয়ে নিলাম, তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এসে বললেন: যে এতেকাফ করেছে সে তার এতেকাফের স্থানে ফিরে যাবে ।  [বুখারি : ২০৪০]

এতেকাফকারীর জন্য যা অনুমোদিত

  • এতেকাফকারীর জন্য মসজিদে পানাহার ও ঘুমানোর অনুমতি আছে। এ ব্যাপারে সকল ইমামদের ঐক্যমত রয়েছে। তবে এ ব্যাপারে সতর্ক হওয়া উচিত;  কেননা আল্লাহর প্রতি একাগ্রচিত্ত  এবং একনিষ্ঠভাবে মনোনিবেশের জন্য কম খাওয়া কম ঘুমানো সহায়ক বলে বিবেচিত।
  • গোসল করা, চুল আঁচড়ানো,  তেল ও সুগন্ধি ব্যবহার, ভাল পোশাক পরা, এ সবের  অনুমতি আছে। আয়েশা রা. আনহার হাদিসে এসেছে: তিনি মাসিক অবস্থায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মাথার কেশ বিন্যাস করে দিতেন, যখন রসুল মসজিদে এতেকাফরত অবস্থায় থাকতেন, আয়েশা রা. তার কক্ষে থাকা  অবস্থায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের  মাথার নাগাল পেতেন। [বুখারি : ২০৪৬]
  • এতেকাফকারীর পরিবার তার সাথে সাক্ষাৎ করতে পারবে, কথা বলতে পারবে, কেননা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের স্ত্রীগণ  এতেকাফকালীন তার সাথে সাক্ষাৎ করতেন। কিন্তু সাক্ষাৎ দীর্ঘ না হওয়া বাঞ্ছনীয়।

এতেকাফকারী যা থেকে বিরত থাকবে

  • ওজর ছাড়া এতেকাফকারী এমন কোন কাজ করবে না যা এতেকাফকে ভঙ্গ  করে দেয়, আল্লাহ তা-আলা বলেন: তোমরা তোমাদের কাজসমুহকে নষ্ট করো না।
  • ঐ সকল কাজ যা এতেকাফের উদ্দেশ্যকে ব্যাহত করে, যেমন বেশি কথা বলা, বেশি মেলামেশা করা, অধিক ঘুমানো, ইবাদতের সময়কে কাজে না লাগানো ইত্যাদি।
  • এতেকাফকারী মসজিদে অবস্থানকালে ক্রয়-বিক্রয় করবে না, কেননা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে ক্রয়-বিক্রয় করতে নিষেধ করেছেন। [মুসনাদে আহমদ : ৬৯৯১]

এমনিভাবে যা ক্রয় বিক্রয়ের কাজ বলে বিবেচিত যেমন বিভিন্ন ধরনের চুক্তিপত্র, ভাড়া, মুদারাবা, মুশারাকা, বন্দক রাখা ইত্যাদি। কিন্তু যদি মসজিদের বাহিরে এমন ক্রয়-বিক্রয় হয় যা ছাড়া এতেকাফকারীর সংসার চলে না তবে তা  বৈধ বলে বিবেচিত হবে।

মসজিদে বায়ু ত্যাগ করা  থেকে বিরত থাকতে হবে। আনাস রা. আনহুর হাদিসে এসেছে, যখন বেদুইন লোকটি মসজিদে প্রস্রাব করেছিল তখন  রাসূল বলেছিলেন: মসজিদ প্রস্রাব, ময়লা-আবর্জনার উপযোগী নয়, বরং মসজিদ অবশ্যই আল্লাহর জিকির এবং নামাজ ও কুরআন তিলাওয়াতের জন্য। [মুসলিম : ২৮৫]

এতেকাফ অবস্থায় যৌন স্পর্শ নিষেধ, এ ব্যাপারে সকল ওলামাদের ঐকমত্য রয়েছে।  তবে অধিকাংশ ওলামাদের মতে বীর্যস্খলনের দ্বারাই কেবল এতেকাফ ভঙ্গ  হয়।

রামাদান : ভ্রাতৃত্ব প্রকাশের গুরুত্বপূর্ণ উপলক্ষ্য

লেখকঃ ড. আইদ আল কারণী | সম্পাদনা ও সংযোজনঃ আকরাম হোসাইন

সমস্ত মুসলিম এক দেহ এক প্রাণ। মুসলিমদের সম্পর্কের এই সরূপ বর্ণনা করতে গিয়ে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) বলেন—মুসলিমরা এক দেহের মতাে। যদি তার চক্ষু ব্যথিত হয় তাহলে তার সমস্ত শরীর ব্যথিত হয়।

এই যে একতা ও ভ্রাতৃত্ব—এর ভিত্তিই হলাে ইসলাম। ইসলামের সুশীতল ছায়া-ই তাদের একতাবদ্ধ হতে উদ্বুদ্ধ করে। এটা কোনাে ব্যক্তি বা দলের কারিশমা নয়। এটা আল্লাহ তাআলার অনুগ্রহ। আল্লাহ তাআলা বলেন—

এবং তিনি তাদের হৃদয়ে পরস্পরের প্রতি সম্প্রীতি সৃষ্টি করে দিয়েছেন। তুমি যদি পৃথিবীর যাবতীয় সম্পদও ব্যয় করতে তবে তাদের হৃদয়ে এ সম্প্রীতি সৃষ্টি করতে পারতে না; কিন্তু তিনি তাদের অন্তরসমূহে প্রীতি স্থাপন করে দিয়েছেন। নিশ্চয়ই তিনি ক্ষমতারও মালিক, হিকমতেরও মালিক।[1]

মুসলিমদের নিকট রক্ত, ভাষা, দেশ বা জাতিগত ঐক্য বলতে কিছু নেই। তাদের একতা কোনাে সীমিত গণ্ডিতে আবদ্ধ নয়। তাদের একতা বহু বিস্তৃত। তাদের। একতার উৎস হলাে দ্বীন ও ইসলাম। লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ এই কালেমা-ই তাদের ঐক্যের মানদণ্ড। তাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্ব নিরূপিত হয় তাকওয়ার নিক্তিতে এবং ইলম ও আমলের ভিত্তিতে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেন—

আমি তােমাদের সকলকে একজন পুরুষ ও একজন নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং তােমাদের বিভিন্ন জাতি ও গােত্রে বিভক্ত করেছি, যাতে তােমরা একে অন্যকে চিনতে পারাে। প্রকৃতপক্ষে তােমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সর্বাপেক্ষা মর্যাদাবান সেই, যে তােমাদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা বেশি মুত্তাকী। নিশ্চয় আল্লাহ সব কিছু জানেন, সব বিষয়ে অবগতি রাখেন।[2]

নবুওয়াতপ্রাপ্তির পর মুহাম্মাদ : যখন লােকদের ইসলামের দিকে দাওয়াত দেন তখন হাবশার বিলাল রাযিয়াল্লাহু আনহু তার ডাকে সাড়া দেন। পারস্যের সালমান ও রােমের সুহাইব রাযিয়াল্লাহু আনহুমা তার প্রতি ঈমান আনেন। এর মাধ্যমে তারা আল্লাহর নিকট প্রিয়পাত্র হয়ে যান। অপরদিকে বংশীয় গর্ব থাকার পরেও ওয়ালীদ ইবনু মুগীরা, আবু জাহল, আবু লাহাব পেছনে পড়ে থাকে। নিজেদের জন্য অনিবার্য ধ্বংস ডেকে আনে।

কিন্তু বংশ-মর্যাদা তাে তখন কোনাে কাজ আসবে না। কারণ, রাসূল (সাঃ) ইরশাদ করেন—

যার আমল তাকে পিছিয়ে দেবে তার বংশ-মর্যাদা তাকে এগিয়ে নিতে পারবে না।[3]

বস্তুত ইসলাম একটি বৈশ্বিক সমাজ-ব্যবস্থা। প্রতিটি মুমিন-মুসলিম এর একেকজন সদস্য। ইসলাম কোনাে নির্দিষ্ট গােত্র বা দেশের মুক্তির জন্য আবির্ভূত হয়নি। ইসলাম তাে আরব, আজম, হিন্দুস্তান, তুর্কিস্তান, আফ্রিকা, ইউরােপ—তথা সমগ্র বিশ্বের মুক্তির জন্যই আবির্ভূত হয়েছে।

এই যে আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু-তিনি ছিলেন কুরাইশী; বিলাল রাযিয়াল্লাহু আনহু ছিলেন হাবশী; সুহাইব রাযিয়াল্লাহু আনহু ছিলেন রুমী; সালমান রাযিয়াল্লাহু আনহু ছিলেন ফারসী; সালাহ উদ্দীন আইয়ুবী রাহিমাহুল্লাহ ছিলেন কুর্দী; মুহাম্মাদ আল-ফাতিহ রাহিমাহুল্লাহ ছিলেন তুর্কী; আল্লামা ইকবাল রাহিমাহুল্লাহ ছিলেন হিন্দুস্তানী; একমাত্র ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’—এই কালেমাই তাদের সকলকে এক পতাকাতলে নিয়ে এসেছে।

রামাদানে এই বিশাল ঐক্যের বিষয়টি আরও সুন্দরভাবে পরিস্ফুট হয়ে ওঠে। একই মাস। একই সিয়াম। একই কিবলা। একই পথ। একই গন্তব্য।

অধিকন্তু রামাদানে আমরা সবাই এক ইমামের পেছনে সালাত আদায় করি। আল্লাহ তাআলা বলেন—

আর তােমরা রুকুকারীদের সঙ্গে রুকু করাে।[4]

অন্যত্র বলেন—

তােমরা সকলে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর সামনে দণ্ডায়মান হও।[5]

আল্লাহ তাআলা আমাদের সিয়াম রাখার আদেশ দিয়ে বলেন—

হে মুমিনগণ, তােমাদের ওপর সিয়াম ফরয করা হয়েছে যেভাবে তােমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর ফরয করা হয়েছে—যেন তােমরা মুত্তাকী হতে পারাে।[6]

আমাদের হজ এক হজের সময় এক। হজের স্থান এক। ঘােষিত হয়েছে—

অতঃপর তােমরা যখন আরাফাহ থেকে রওনা হবে তখন মাশআরুল হারামের নিকট [7] আল্লাহর যিকির করাে। আর তার যিকির তােমরা সেভাবেই করবে, যেভাবে তিনি তােমাদের নির্দেশ দিয়েছেন।[8]

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা আমাদের সকলকে তার রঞ্জু আঁকড়ে ধরার নির্দেশ দিয়েছেন। বিচ্ছিন্নতা ত্যাগ করে এক হয়ে চলার আদেশ করেছেন। কুরআনে কারীমে ঘােষিত হয়েছে—

আল্লাহর রশিকে দৃঢ়ভাবে ধরে রাখে এবং পরস্পরে বিভেদ করাে না। আল্লাহ তােমাদের প্রতি যে অনুগ্রহ করেছেন তা স্মরণ রাখাে। একটা সময় ছিল, যখন তােমরা একে অপরের শত্রু ছিলে। অতঃপর আল্লাহ তােমাদের অন্তরসমূহ জুড়ে দিয়েছেন। ফলে তার অনুগ্রহে তােমরা ভাই ভাই হয়েছ।[9]

বিচ্ছিন্নতা থেকে বেঁচে থাকার নির্দেশ দিয়ে আল্লাহ তাআলা বলেন—

এবং তােমরা সেই সকল লােকের মতাে হয়াে না, যারা তাদের নিকট সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলী আসার পরও পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল ও আপসে মতভেদ সৃষ্টি করেছিল। এরূপ লােকদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি।[10]

রাসূল (সাঃ) বলেছেন—

নিশ্চয় আল্লাহ আমার নিকট ওহী প্রেরণ করে বলেছেন, তােমরা বিনয় অবলম্বন করাে। একজনের ওপর অন্যজন সীমালঙ্ঘন করাে না এবং কেউ কারও ওপর গর্ব করাে না।[11]

আবু মুসা আশআরী রাযিয়াল্লাহু আনহু কর্তৃক বর্ণিত অপর একটি সহীহ হাদীসে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল (সাঃ) বলেন—

মুমিন মুমিনের জন্য ইমারত সদৃশ। একজন আরেকজনকে শক্তিশালী করে।[12]

অন্য হাদীসে আবু হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে—

মুসলিম মুসলিমের ভাই। কেউ কারও ওপর যুলুম করে না। কেউ কাউকে অপদস্থ করে না। কেউ কাউকে তুচ্ছ মনে করে না। মুসলিম ভাইকে হেয় জ্ঞান করা প্রত্যেক মুসলিমের জন্য অকল্যাণকর। প্রতিটি মুসলিমের জান, মাল এবং ইজ্জত অপর মুসলিমের জন্য হারাম।[13]

এই যে একতা ও ভ্রাতৃত্ব—এর কিছু স্বতন্ত্র দাবি আছে। একজন মুসলিম হিসাবে এই দাবিগুলাে আমি এড়িয়ে যেতে পারি না। যেমন—অপর মুসলিম ভাইয়ের খোঁজ-খবর নেওয়া। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য তার সাক্ষাতে যাওয়া। অসুস্থ হলে দেখতে যাওয়া। সাক্ষাৎ হলে সালাম দেওয়া। হাসিমুখে কথা বলা। হাঁচির উত্তর দেওয়া। তার দাওয়াত কবুল করা। জানাযায় উপস্থিত হওয়া। তার অনুপস্থিতিতে তার জন্য দুআ করা। তার ইজ্জত-আবু সংরক্ষণ করা। প্রয়ােজন পুরা করা। তার পাশে দাঁড়ানাে। অত্যাচারিত হলে সাহায্য করা। তার কল্যাণ কামনা করা। তাকে সদুপদেশ দেওয়া। এছাড়াও আরও অনেক হক রয়েছে। প্রতিটি মুসলিমই আমার ভাই। প্রত্যেকের সাথেই আমার ঈমানী ও কুরআনী বন্ধন রয়েছে। এই বন্ধন আল্লাহ তাআলাই সৃষ্টি করে দিয়েছেন। আর মুহাম্মাদ শু সেই বন্ধনের দাবি ও হকের প্রায়ােগিক রূপরেখা দেখিয়ে গিয়েছেন।

ইয়া আল্লাহ, আপনি আমাদের মাঝে মুহাব্বত সৃষ্টি করুন। আমাদের বিচ্ছিন্নতা দূর করুন এবং আমাদের সবাইকে একতাবদ্ধ করুন।

উৎসঃ ভালোবাসার রামাদান, পৃষ্ঠাঃ ১৫২ – ১৫৭


[1] সূরা আনফাল, আয়াত : ৬৩
[2] সূরা হুজুরাত, আয়াত : ১৩
[3] সহীহ মুসলিম : ২৬৯৯
[4] সূরা বাকারা, আয়াত : ৪৩
[5] সূরা বাকারা, আয়াত : ১৮৩
[6] সূরা বাকারা, আয়াত : ১৮৩
[7] এ এলাকাটি মুযদালিফার নিকটে অবস্থিত
[8] সূরা বাকারা, আয়াত : ১৯৮
[9] সূরা আলে ইমরান, আয়াত : ১০৩
[10] সূরা আলে ইমরান, আয়াত : ১০৫
[11] সহীহ মুসলিম : ২৮৬৫
[12] সহীহ বুখারী : ২৪৪৬
[13] সহীহ মুসলিম: ২৫৬৪

শেষ ভালাে যার সব ভাল তাঁর -পর্ব ২

1

লেখক: উম্মে আব্দ মুনীব, শায়খ মুহাম্মদ বিন সাইদ কাহতানি (রহ) | সম্পাদনা: রাজিব হাসান

পর্ব- ১ | পর্ব- ২

অবশ্যই ঈদুল ফিতরের দিন এই উম্মাহর আনন্দের দিন। কেননা, রােজাদারেরা এ মাসেই ক্ষমা পেয়ে যায়, জাহান্নাম থেকে আজাদ হয়ে যায়। গুনাহগারের দল নেককারদের সাথে একাকার হয়ে যায়। এ দিনে এতসংখ্যক লােক জাহান্নাম থেকে মুক্তি পায়, যা বছরের অন্য কোন দিনে পায় না। কাজেই, যে ব্যক্তি ঈদের দিনে জাহান্নাম থেকে মুক্তি পেয়ে যায়, আনন্দ তাে তাঁর জন্যই, আর যে জাহান্নাম থেকে আজাদি পায় না তাঁর জন্য অপেক্ষা করছে কঠিন আযাব। আল্লাহর ক্ষমা ও জাহান্নাম থেকে মুক্তি নির্ভর করে রমাদ্বানের দিনগুলােতে সিয়াম পালন এবং রাতের বেলায় সলাতে দণ্ডায়মান হওয়ার উপর।

অতএব যে কারাে উচিৎ রমাদ্বানে আল্লাহর তারিফ ও প্রশংসা করা, দিনে সিয়াম পালন করা, রাতে সলাত আদায় করা। তাঁর দয়া ভিক্ষা চাওয়া, গুনাহ থেকে বারবারক্ষমা চাও, জাহান্নাম থেকে বেশী বেশী মুক্তি চাওয়া। অন্তরে তাঁর ভয়ভীতি লালন পালন করে তাঁর স্মরণে কাটিয়ে দেওয়া।

আল্লাহর ক্ষমা হাসিলের কিছু উপায়ঃ

  • আল্লাহর একত্ববাদ স্বীকার করলে ও মেনে নিলে, এর দ্বারা গুনাহ মাফ হয়। এর দ্বারা গুনাহ ধুয়ে মুছে যায়। কোন গুনাহই আর। অবশিষ্ট থাকে না।
  • বেশী বেশী ইস্তিগফার পাঠ, আল্লাহর ক্ষমা অর্জনের অনন্য উপায়। ইস্তেগফার মানেই আল্লাহর কাছে ক্ষমা ভিক্ষা চাওয়া। আর রােজাদের দুআ কবুল হয়।

হাসান আল বসরী (রহ) বলেন, “বেশী বেশী ইস্তেগফার করাে, নিঃসন্দেহে তুমি জানাে না আল্লাহর রহমত তােমার ওপর কখন বর্ষিত হয়।

লুকমান (আঃ) তাঁর ছেলেকে বলেছিলেন, “হে আমার ছেলে! তােমার জিহবাকে আল্লাহর ক্ষমা চাওয়াতে ব্যস্ত রাখাে, নিশ্চয়ই আল্লাহর নির্ধারিত সময় রয়েছে, যে সময়ে তিনি দুআ ফিরিয়ে দেন না।“

এ ব্যাপারে শাইত্বনের বক্তব্যে এসেছে, ‘আমি মানবজাতিকে গুনাহের মাধ্যমে ধুলিস্যাৎ করে দিয়েছি, আর তাঁরা আমাকে লা-ইলাহা-ইলাল্লাহ এবং ইস্তিগফারের মাধ্যমে ধুলিস্যাৎ করে দিয়েছে।

ইস্তিগফার হলাে সকল আমলের উপসংহার। রমাদ্বানের সকল আমলের শেষে ইস্তিগফার হল মুক্তির দরজা। সিয়াম, সলাত, দুআ ইত্যাদি আমলের সাথে ইস্তিগফার, যার মাধ্যমে আল্লাহ বান্দাকে ক্ষমা করে দিবেন। এজন্যই রমাদ্বানে সকল আমলের শেষে আমাদের উচিৎ বেশী বেশী আল্লাহর কাছে ইস্তিগফার বা ক্ষমা প্রার্থণা করা। উমার বিন আব্দুল আযীয (রহ) তাঁর গভর্ণর বরারব চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন, রমাদ্বান মাস যেন ইস্তিগফার ও সদাক্বা (সদাকাতুল ফিতর) দিয়ে শেষ হয়।

কেননা, নিঃসন্দেহে, সদাকাতুল ফিতর হল রমাদ্বানের বান্দার অনর্থক কথবার্তা ও ফাহেশা কাযকর্মের কাফফারা এবং ইস্তিগফার হল আমলের ত্রুটি-বিচ্যুতি যার কারণে সিয়ামের ক্ষতি সাধিত হয়, তার কাফফারা।

উমার বিন আব্দুল আযীয (রহ) তাঁর চিঠিতে আরাে লিখেন, তােমাদের পিতা আদম (আঃ) যে দুআ পড়ে ক্ষমা চেয়েছিল, তােমরাও পড়বে – রব্বানা জালামনা আনফুসানা ওয়া ইল্লাম তাগফিরলানা ওয়া তার হামনা লানা নান্না মিনাল খাসিরীন।

“হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা নিজেদের প্রতি অন্যায় জুলুম করেছি, যদি আপনি আমাদেরকে ক্ষমা না করেন এবং দয়া না করেন তবে অবশ্য আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হব।

তােমরা নূহ (আঃ) যে দুআ করেছিল, সেই দু’আও পড়বে – ওয়া ইন্না তাগফিরলী, ওয়া তারহামনী, আকুস্মিনাল খসিরীন

আপনি যদি আমাকে ক্ষমা না করেন এবং আমাকে দয়া না করেন, তবে আমি ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হব।

আর তােমরা মুসা (আঃ) এর মত বলবে, রব্বি ইন্নি যলামতু নাফসী ফাগফিরলী ফাগফারালাহু, ইন্নাহু হুয়াল গাফুরুর রাহীম

হে আমার পালনকর্তা, আমি তাে নিজের উপর জুলুম করে ফেলেছি। অতএব, আমাকে ক্ষমা করুন।

অতঃপর তােমরা নবী ইউনুস (আঃ) এর মত বলবে – লা ইলাহা ইল্লা আন্তা সুবহানাকা ইন্নি কুনতু মিনাজ জলিমীন।

আপনি ব্যতীত আর কোনাে উপাস্য নেই। আমি আপনার পবিত্রতা ঘােষণা করছি। অবশ্যই আমি পাপী।

সিয়াম হল জাহান্নামে থেকে বাঁচার জন্য ঢাল যতক্ষণ না কেউ অনর্থক ও আজেবাজে কথার দ্বারা এই ঢালকে ভেঙে ফেলে। ইস্তিগফার সেই ঢালকে বহাল তবিয়তে রাখে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আম্মাজান আইশা (রাঃ) কে লাইলাতুল কদরের রাত্রিতে ইস্তিগফারের জন্য একটি বিশেষ দুআ শিখিয়ে দিয়েছিলেন।

কেননা, ঈমানদারগণ রমাদ্বান মাসজুড়ে দিনে রােজা রাখে আর রাতে সলাতে দণ্ডায়মান হয়, যখন মাস শেষ হতে থাকে আর লাইলাতুল কদরের সময় আসতে থাকে, তখন যে কেউ এই দুআ পড়ে সারা মাসের ঘাটতি বা কমতির জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থণা করতে পারে।

ইয়াহইয়া বিন মুয়ায (রহ) বলেন, “বুদ্ধিমান তাে সেই লােক যার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হয় আল্লাহর ক্ষমা হাসিল করা। বুদ্ধিমান তাে সে নয় যে শুধু মুখে মুখে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চায়, আর তাঁর অন্তর গুনাহর সাথে জড়িয়ে থাকে, রমাদ্বানের পর পুনরায় গুনাহতে ফিরে যাওয়ার মানসিকতা রাখে। তাঁর সিয়াম প্রত্যাখ্যাত এবং তা তাঁর মুখে ওপর ছুঁড়ে ফেলা হয়।”

সাহাবী কা’ব (রাঃ) বলেন, “যে ব্যক্তি রমাদ্বানে রােজা রেখে মনে মনে বলল, এই মাস শেষ হলেই আমি ফের আল্লাহর অবাধ্যতায় লিপ্ত হব, তাহলে সেই লােকের সিয়াম বাতিল। আর যে ব্যক্তি রমাদ্বানে রােজা রেখে মনে মনে বলল, এ মাস শেষ হয়ে গেলেও আমি আল্লাহর অবাধ্যতা করব না, তাহলে কোন প্রশ্ন ব্যতিরিকে ঐ লােকের ঠিকানা জান্নাতে হবে।

হে আল্লাহর বান্দারা! নিঃসন্দেহে আর অল্প কিছুদিনের মাঝেই রমাদ্বান মাস চলে যাবে। যে ব্যক্তি রমাদ্বান মাস ভালােভাবে কাটিয়ে দিতে পারবে, তাঁর সামনের দিনগুলাে ভালােভাবেই কাটবে। আর এখনও যাদের মধ্যে ঘাটতি বা

কমতি আছে, তাদের উচিৎ ভালােভাবে মাসটি শেষ করে দেওয়া। কেননা, শেষ ভাল যার, সব ভালাে তাঁর। রমাদ্বানের বাকী দিনগুলাে হেলায়ফেলায় কাটিয়ে না দিয়ে এর সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করুন। এই মাসকে বিদায় দিন সর্বোত্তম উপায়ে, শান্তির সাথে।

মুমিনের অন্তর এ মাসের বিদায় ঘনিয়ে এলে কাঁদে, হা-হুতাশ করে। এর চলে যাওয়া দেখে শােকে বিহবল হয়ে পড়ে। আপনজন কেউ বিদায় নিলে যেমন অনুভূত হয়, ঠিক তেমনি রমাদ্বান চলে যাওয়াতেও তাঁর কষ্ট অনুভূত হয়। রমাদ্বান চলে যাওয়াতে এই যদি হয় মুমিনের অবস্থা, তাহলে যারা দিনরাত অবহেলা আর অবজ্ঞায় কাটিয়ে দিয়েছে তাদের অবস্থা কি? একজন অবহেলাকারীর মেকি কান্না তখন আর কি কাজে আসবে তাঁর জন্য? এই মিসকিনদের কত করে বােঝানাে হয়েছে, কিন্তু তাঁরা বুঝতে চায়নি। পরিশুদ্ধির জন্য তাঁদেরকে হাজারবার নসিহত দেওয়া হয়েছে, কিন্তু তাতে তাঁরা সাড়া দেয়নি। চোখের সামনে কতজনকে দেখেছে আমল কুড়িয়ে নিতে, তবুও সে নির্বিকার থেকেছে। আল্লাহর কত অবাধ্য বান্দাকে অনুগত হতে দেখেছে, তবুও সে পাশ কাটিয়ে চলে গেছে। আর এখন এসে সে বাস্তবতার সম্মুখীন হয়ে মেকী কান্না করছে। নিজের ভুলের অপনােদন করতে চাচ্ছে। যার কোন প্রতিকার এখন আর নেই। [1] (অনুবাদ সমাপ্ত)

রসুল  (ﷺ) ইরশাদ করেন, “কোন ব্যক্তি এমন আমল করে যা দেখে মানুষ মনে করে যে, সে জান্নাতবাসী হবে, অথচ সে জাহান্নামী। আবার কোন কোন মানুষের আমল দেখে মানুষ মনে করে যে, সে জাহান্নামী হবে, অথচ সে জান্নাতী। কেননা সর্বশেষ আমলের উপরই ফলাফল নির্ভরশীল।” [2]

ইবনুল যাওজি (রহ) বলেছেন, “যখন রেসের ঘােড়া বুঝতে পারে আর অল্পক্ষণ বাদেই পথ শেষ হয়ে যাবে তখন সে তার সর্বশক্তি দিয়ে রেস জিততে উদ্যত হয়; রেসের ঘােড়া যেন তােমার চাইতে চালাক না হয়; প্রকৃতপক্ষে, আমল বিচার করা হয় তা কিভাবে শেষ হয় তার মাধ্যমে; সুতরাং যদি ভালােভাবে রামাদ্বান শুরু নাও করতে পারাে শেষদিকেরটা যেন ভালােয় ভালােয় বিদায় করতে পারাে।” [3]

ইবনে তাইমিয়াহ (রহ) বলেছেন, “কোন জিনিসের শেষ কত পরিপূর্ণভাবে হয়েছে সেটাতেই রয়েছে শিক্ষা, শুরুর ভুল-ত্রুটির মধ্যে কোন শিক্ষা নেই।”

হাসান আল-বাসরী (রহ) একই কথা বলেছেন। তিনি বলেন, “যতটুকু (সময়) বাকী আছে তার মধ্যে তােমার আমল বাড়িয়ে নাও এবং তােমাকে ক্ষমা করে দেওয়া হবে যতটুকু (সময়) গত হয়েছে তার জন্য; যতটুকু সময় পাও তার জন্য জীবন ঢেলে দাও, কারণ তুমি জানাে না কখন তােমার আত্না আল্লাহর রহমতের দিকে ধাবিত হবে।“ [4]

সুতরাং এই অন্তিম মুহুর্তে আমাদের সবারই উচিৎ রমাদ্বানের প্রতিটি দিনকে গুরুত্ব দেওয়া এবং প্রতিটি দিনকে জীবনের শেষ দিন মনে করে আল্লাহর নাফরমানী থেকে দুরে থাকা। এবং নিজেকে সৎআমলের দিকে ধাবিত করা। শপিংএ ব্যস্ত না থেকে নিজেকে প্রতিপালকের দিকে ন্যস্ত করা। মাত্র দশটা দিন, শেষের এই দশটা রাত, হতে পারে আপনার ও আমার দিন বদলের রাত।

শেষের এই দশ দিনে আমরা যে সব আমল করতে পারি ইন শা আল্লাহ

  • সলাত (ফরজ, সুন্নাহ ও কিয়ামুল লাইল ও অন্যান্য নফল সলাত)
  • কুরআন তিলাওয়াত
  • তাসবীহ, তাহলীল ও তাহমীদ
  • দরূদ – দান-সদাক্কা বেশী বেশী)
  • এদিক সেদিক বেহুদা ঘােরাফেরা না করা।
  • সময় মত ইফতার ও সাহরী করা।
  • মাসজিদে একদম সামনের কাতারে দাঁড়িয়ে ফরজ স্বলাত আদায় করা।
  • খােশ গল্প ও আড্ডাবাজী ত্যাগ করা।
  • দুনিয়াবিমুখ হয়ে আল্লাহমুখী হওয়া।
  • ফেসবুক, ইন্টারেন্ট, ইউটিউব ও অনলাইনে বেহুদা সময় না কাটানাে।
  • ঈদ শপিং আগেভাগেই করে রাখা, এই দশটিন শুধুমাত্র ইবাদাতের জন্য বরাদ্দ রাখা।
  • বেশী বেশী দুআ করা।
  • ইস্তিগফার তথা বেশী বেশী ক্ষমা প্রার্থণা করা।

হে মহান আল্লাহ! রামাদ্বানের বাকী দিনগুলিতে আমাদেরকে বেশী বেশী আমলে সালেহ করার তাউফীক দিন। সেই সাথে মৃত্যুর পূর্বে বেশি বেশি নেক আমল করার ফুরসৎ দান করেন। আপনার সন্তুষ্টি নিয়ে প্রত্যাবর্তন করার ব্যবস্থা করে দেন। (আমীন)

পর্ব- ১ | পর্ব- ২

উৎসঃ সালাফদের সিয়ামপৃষ্ঠা: ১০৭ – ১১২


[1] এই অধ্যায়টি ঈমাম ইবনু রজব হাম্বলী (রহ) এর লাতায়েফুল মা’রিফ এর শেষ অধ্যায় থেকে অনুদিত। শাইখ আব্দুর রহমান বিন মুহাম্মাদ বিন কাসিম এই অধ্যায়টিকে সংক্ষিপ্ত আকারে তুলে ধরেছেন। সেই সাথে ইবনু তাইমিয়াহ (রহ) এর মাজমুউ আল ফাতােয়া” থেকেও কিছু। অংশ তিনি যােগ করেছেন। আর একদম শেষের অংশ আমি অধমের (রাজিব হাসান) পক্ষ থেকে এখানে যােগ করা হয়েছে।
[2] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৬৪৯৩, শারহুস সুন্নাহ, হাদীস নং ৭৯ বর্ণনাকারী: সাহল ইবনে সা’দ (রাদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহু)।
[3] html sihttps://www.islamicboard.com/fasting-ramadhan-amp-eid-ulfitr/134326258-horses.html
[4] https://www.islamicboard.com/fasting-ramadhan-amp-eid-ulfitr/-134340303regret-wasting-ramadan.html

শেষ ভালাে যার সব ভাল তাঁর -পর্ব ১

লেখক: উম্মে আব্দ মুনীব, শায়খ মুহাম্মদ বিন সাইদ কাহতানি (রহ) | সম্পাদনা: রাজিব হাসান

পর্ব- ১ | পর্ব- ২

রমাদ্বানে আল্লাহর ক্ষমাপ্রাপ্ত হওয়া শর্তসাপেক্ষ। এটা নির্ভর করে আল্লাহর হুকুম আহকাম মেনে চলা ও রক্ষণাবেক্ষণ করা এবং নিষিদ্ধ বিষয়াদি থেকে হিফাজতে থাকার উপর। জমহুর উলামাগণ বলেন, রমাদ্বানে গুনাহ থেকে মুক্তির বিষয়টি ছগিরা গুনাহের ক্ষেত্রে প্রযােজ্য।

কেননা সহিহ মুসলিমের এক হাদিসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ  (ﷺ)  ইরশাদ করেন, “দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত সলাত, এক জুমুআ থেকে আরেক জুমুআর সলাত, এবং এক রমাদ্বান থেকে আরেক রমাদ্বান এগুলাে গুনাহ মুক্তির কারণ হয়, যতক্ষণ পর্যন্ত কেউ কবিরাহ গুনাহয় না লিপ্ত হয়।

তবে, কোন কোন সালাফ এই মতের বিপক্ষে রায় দিয়েছে। ইবন মুনছির (রহ) লাইলাতুল কদরকে উদ্দেশ্য করে বলেন, “আশা করা যায় এ রাতে ছগিরা ও কবিরা উভয় গুনাহকেই ক্ষমা করে দেওয়া হয়।

তবে অধিকাংশ উলামা বলেছেন, কবির গুনাহর জন্য খাস দিলে আল্লাহর দরবারে ক্ষমা চাইতে হবে। ইখলাসের সাথে ক্ষমা না চাইলে কবিরা গুনাহ ক্ষমা করা হবে না।

কাজেই লাইলাতুল কদর সম্পর্কিত সকল হাদীস একসাথে করলে, এটাই প্রতীয়মান হয় যে, যদি কেউ সে রাতে ক্ষমা প্রার্থণা করে, যদিও ঐ রাত লাইলাতুল কদরের রাত না হয়, তবুও সে ক্ষমা পেয়ে যাবে।

রমাদ্বান মাসে সিয়াম পালন করলেও হাদীসের ঘােষণানুযায়ী বান্দার গুনাহ মাফ হয়ে যাবে। এটাও বর্ণিত আছে যে, সিয়াম পালনের জন্য বান্দাকে রমাদ্বানের শেষ রাতে ক্ষমা করে দেওয়া হয়। আবু হুরাইরা (রাঃ) বর্ণিত একটি হাদীস, ঈমাম আহমদ (রহ) তাঁর মুসনাদে সংকলন করেন, যেখানে বলা হয়েছে,

যারা সিয়াম পালন করে রমাদ্বানের শেষ রাত্রিতে তাঁদেরকে ক্ষমা করে দেওয়া হয়। লােকেরা জিজ্ঞেস করল, “ইয়া রাসূলুল্লাহ! এটা কি লাইলাতুল কদরের রাতে? রাসূলুল্লাহ  (ﷺ) উত্তরে বললেন, “না, নিশ্চয়ই শ্রমিককে তাঁর কাজ শেষে পারিশ্রমিক দেওয়া হয়।

ও আয-যুহুরী (রহ) বলেন, ঈদুল ফিতরের দিন, লােকেরা যখন ঈদের সলাত আদায় করতে ঈদগাহ ময়দানে যায়, তখন মহান আল্লাহ তাদের দিকে তাকিয়ে বলেন, “ওহ আমার বান্দারা! নিশ্চয়ই তােমরা আমার জন্য সিয়াম পালন করেছ, আমার জন্য সলাতে দাঁড়িয়েছ, যাও বাড়ি ফিরে যাও, তােমাদের গুনাহগুলাে মাফ করে দেওয়া হয়েছে।

যে ব্যক্তি রােজা রাখে এবং আল্লাহর সকল ফরজ হুকুম আহকাম মেনে চলে তারাই একমাত্র আল্লাহর প্রকৃত বান্দাদের অন্তর্ভূক্ত। আর যারা এসব ফরজ বিষয়ে অবহেলা ও শৈথিল্য প্রদর্শন করে, এবং আল্লাহর হক পরিপূর্ণভাবে আদায় করে না, ধ্বংস তাদের জন্য অনিবার্য হয়ে যায়। যদি কেউ খামখেয়ালিপনায় দুনিয়াবী কার্যকলাপে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে, তাহলে তাঁর জন্য অপেক্ষা করছে ভয়াবহ আযাব।

সালাফগণ তাদের কর্মগুলােকে পরিশুদ্ধ করার পিছনে মেহনত করতেন, কিভাবে আমলে বিশুদ্ধতা আনা যায় তাঁর পিছনে শ্রম দিতেন। এরপর উনারা তাদের আমলগুলাে কবুলের ব্যাপারে ফিকির জারি করতেন। এত আমল করার পরেও ভয় পেতেন, উনাদের আমল কবুল হবে কিনা। উনারা তাে সেই সকল সােনা মানুষ যাদের অন্তরে আল্লাহর ভয় বিরাজ করত . এই জন্য যে, উনাদের ওপর আরােপিত হুকুম-আহকাম পালনে নিজেরা কতটুকু সচেষ্ট থাকতে পেরেছেন। আলী ইবন আবি তালিব (রাঃ) বলতেন, “তােমার আমল কবুল হবে কি না তাঁর ব্যাপারে চিন্তিত না হয়ে, বরং আমল কিভাবে সম্পন্ন করবে তার পিছনে মনোেযােগ দাও। তােমরা কি আল্লাহর এই বাণী শুনােনি?

আল্লাহ মুত্তাকীদের পক্ষ থেকেই তাে গ্রহণ করেন।”  [আল মায়েদা, আয়াতঃ২৭]

ফুদ্বালা (রহ) বলেন, “আমি যদি জানতে পারি যে, আমার সরিষা দানা পরিমাণ কোন আমল আল্লাহ তায়ালা কবুল করেছেন, তাহলে তা আমার কাছে দুনিয়া এবং দুনিয়ার মধ্যে যা কিছু আছে, তার চাইতে অধিক প্রিয় হবে।

কেননা আল্লাহ্ রব্বল আলামিন ইরশাদ করেন, আল্লাহ তাে মুত্তাকীদের পক্ষ থেকেই গ্রহণ করেন।

মালিক বিন দিনার (রহ) বলতেন, “আমল সম্পাদন করার চাইতে, আমল কবুলের বিষয়টি কঠিন, এই ভয়টা যেন থাকে।

আতা আস-সুলামী (রহ) বলতেন, ‘আল্লাহভীরুদের ভয় এই যে, তাঁরা ভাবে, তাদের নেক আমলগুলাে হয়ত আন্তরিকতার সাথে আল্লাহর সামনে উপস্থাপন করতে পারেননি।

আব্দুল আযীয ইবনু আবী রুউয়াদ (রহ) বলেন, “আমি এমন অনেকজনের সাথে মিশেছি, যারা আমলের ব্যাপারে খুবই যত্মবান ছিলেন, তবুও আমল সম্পন্ন করার পর তাদের চোখেমুখে শুধু বিষন্নতার ছাপই দেখতে পেতাম, এই ভয়ে যে আল্লাহ তাদের আমল কবুল করবেন কি না?”

ঈদুল ফিতরের দিনে সালাফদের কার কারাে চোখেমুখে বিষন্নতার ছাপ ফুটে উঠত। তাঁদেরকে যখন বলা হত, আজকে তাে খুশি ও আনন্দের দিন। তাঁরা বলতেন, আপনি সত্যই বলেছেন, তবে আমি তাে আল্লাহরই দাস! আমার রব আমাকে যে আমলের আদেশ দিয়েছিলেন আমি জানিনা তিনি তা আমার তরফ থেকে কবুল করেছেন কি না?

ঈদুল ফিতরের দিন ওয়াহব (রহ) একদল লােককে হাসাহাসি করতে দেখে বললেন, যদি তাদের সিয়াম কবুল হয়ে থাকে, তাহলে জেনে রেখাে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ভাষা এরকম নয়, আর যদি কবুল না হয়ে থাকে, তাহলে ভীতিগ্রস্তদের অবস্থা এরকম হতে পারে না।

হাসান আল বসরী (রহ) বলতেন, “নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা রমাদ্বানকে তাঁর সৃষ্টিকূলের জন্য উপার্জনের মাধ্যম বানিয়ে দিয়েছেন। এ মাসে তাঁরা আল্লাহর ও হুকুম আহকাম মেনে তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য প্রতিযােগিতাইয় লিপ্ত হয়। কেউ কেউ এই প্রতিযােগিতা শেষে বিজয়ীর মুকুট পরিধান করে, কেউ কেউ পিছনে পড়ে রয়। সেদিনের দৃশ্য কতই না সুন্দর! যেদিন নেককারদের দেখা যাবে হাসিখুশি খেলতামাশায় আর বদকারদের দেখা যাবে পরাজিত ভুলষ্ঠিত অবস্থায়।

হযরত আলী (রাঃ) রমাদ্বানের শেষ দিনে সবাইকে ডেকে ডেকে বলতেন, “কোথায় সেই বিজয়ী, তাঁকে ডাকো অভিনন্দন জানাই। কোথায় সেই বিজেতা আসসা তাঁকে শান্তনা দেই। হে বিজয়ী! আমরা তােমাকে অভিনন্দন জানাই! ওহে বিজেতা! আল্লাহ তােমার দুঃখ-দুর্দশা লাঘব করে দিন!”

বরকতময় এই রমাদ্বান মাস। এই মাসে আল্লাহর ক্ষমা পাওয়ার উপায়ান্তর অনেক।

  • রােজাদারদের ইফতার করাননা।
  • আল্লাহর কোন বান্দার দুঃখ তাড়ানাে।
  • অধিক পরিমাণে আল্লাহকে স্মরণ। হাদিসে এসেছে, “যে ব্যক্তি রমাদ্বানে আল্লাহকে স্মরণ করবে, তাঁর গুনাহর খাতা মাফ করে দেওয়া হবে, আর যে তাঁকে ডাকবে সে হতাশাগ্রস্থ হবে না।
  • ক্ষমা প্রার্থণা করা।
  • রােজা রাখার সময় (সাহরী) ও রােজা ভাঙ্গার সময় (ইফতার) সময় বান্দার দুআ আল্লাহর দরবারে কবুল হয়। আবু হুরাইরা (রাঃ) বলেন, প্রত্যেক ব্যক্তিকে ক্ষমা করে দেওয়া হবে শুধুমাত্র যারা প্রত্যাখ্যান করবে তাঁরা ব্যতীত। আশেপাশে থাকা লােকসকল তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, ওহ আবু হুরাইরা! কারা প্রত্যাখ্যান করবে? তিনি বললেন, যারা আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইবেনা তাঁরা ব্যতীত।”
  • ফেরেস্তারা সিয়াম পালনকারীর জন্য ক্ষমা প্রার্থণা করেন, যতক্ষণ না সে সিয়াম ভঙ্গ করে।

রমাদ্বান মাসজুড়ে এত এত ক্ষমা অর্জনের উপায় থাকতেও, যে ব্যক্তি এই সূবর্ণ সুযােগ হেলায়ফেলায় কাটিয়ে দিবে, তাঁর চাইতে অভাগা এই দুনিয়ায় আর কেউ থাকতে পারে না। এ ধরণের লােকদের ধ্বংসের ব্যাপারে নবীজি (ﷺ) তিনবার ‘আমীন’ বলে জিব্রীল (আঃ) এর সাথে গলা মিলিয়েছিলেন।

কাতাদাহ (রহ) বলতেন, “যে ব্যক্তি রমাদ্বান মাসে তাঁর গুনাহ মাফ করিয়ে নিতে পারল না, তাহলে রমাদ্বানের বাইরে অন্য কোন সময়ে তাঁর গুনাহ মাফ করিয়ে নিতে পারবে না।

অর্থাৎ, যদি কেউ রমাদ্বানের মত এমন সুবর্ণ সুযােগ ছেড়ে দেয়, তাহলে বাকী মাসগুলােতেও সে সুযােগ সন্ধানী হবে না, হেলায়ফেলায় কাটিয়ে দিবে। এ ব্যাপারে একটি হাদিস আছে, যেখানে বলা আছে, “যে ব্যক্তি রমাদ্বানে ক্ষমা হাসিল করতে পারলাে না, তাহলে কবে সে তা হাসিল করবে?”

কাজেই, এ মাসে যদি কেউ ক্ষমা না পেয়ে থাকে, তাহলে কবে ক্ষমা পাবে? লাইতুল কদরের মত হাজার মাসের চাইতে উত্তম এমন রাতে যদি কেউ ক্ষমা পায়, তাহলে সে কবে পাবে? রমাদ্বান মাসে যদি কেউ নিজেকে পরিশুদ্ধ করতে না পারে, তাহলে কবে করবে? অবহেলা আর অবজ্ঞার অসুখ থেকে কখন সে নিজেকে সুস্থ করে তুলবে?

পর্ব- ১ | পর্ব- ২

উৎসঃ সালাফদের সিয়ামপৃষ্ঠা: ১০২ – ১০৬

আমরা কিভাবে ইসলাম মানবো ?

74

 লেখক: শরীফ আবু হায়াত অপু

আমরা যারা কোন ফর্ম পূরণের সময় ধর্মের ঘরে “ইসলাম” লিখি তারা স্কুলে পড়াশোনার সময় বিষয় হিসেবে ইসলামিয়াত নামে একটি নির্বিষ বিষয় পড়তাম। নির্বিষতার মাহাত্ম্য – SSC তে এ বিষয়ের মাত্র ১০টা প্রশ্ন পড়েই A+ বা লেটার পাওয়া যায়, আগের ক্লাসগুলোর কথা আর নাই বা বললাম। আসলে, দুঃখজনক হলেও সত্য  যে আমাদের অনেকেরই বাবা-মা ছোটবেলা থেকে বুঝিয়েছেন যা পড়লে রেজাল্ট ভাল হবে তাই হল কাজের পড়াশোনা আর বাকিটা অকাজের।

১০ পৃষ্ঠা পড়লে যেখানে চলে, কোন পাগল বাকি ৯০ পৃষ্ঠা পড়বে? আর জানার জন্য পড়ার তো প্রশ্নই উঠে না। ফলে ইসলামিয়াতের আবরণ ভেদ করে কখনো আমাদের মনের মধ্যে ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা প্রবেশ করতে পারেনি। তো এহেন গুণধরেরা যখন কোন এক মানসিক দুর্বলতার মুহূর্তে বাপদাদার ধর্ম ইসলাম মানার চেষ্টা করে তখন প্রথম বাঁধাটা আসে জানার ক্ষেত্রে। শূণ্য জ্ঞানের পাত্র নিয়ে তখন আমরা বই/ওয়েবসাইট হাতড়াই। এর ফলাফল বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যা হয় তা হল, অল্প বিদ্যা ভয়ংকরী। কিছু ভাসা ভাসা পড়াশোনা করে আমাদের এই ধারণা জন্মে যায় যে আমরা ইসলাম সম্পর্কে অনেক জানি-বুঝি।

আর আমাদের দেশের ফতোয়া দেয়া কাঠমোল্লা, মিলাদজীবি হুজুর আর মুরিদচোষা পীরদের আধিক্যে আমাদের একটা বিরাট ক্ষতি হয়ে গিয়েছে – তা হল আমরা পুরো আলিমজাতির উপর একটা বিরূপ ধারণা পোষণ করে চলি। এই জন্য ইসলাম সম্পর্কে জানতে গিয়ে আমরা মনে করি ইসলাম বুঝার জন্য অন্য কারো দরকার নাই, আমরা যা বুঝি তাই চূড়ান্ত।

কিন্তু আসলে কি এভাবে ইসলাম চলে? না। চলে না। তবে জেনে নেই কিভাবে ইসলাম শিখা এবং মানা উচিত।

ইসলাম শিক্ষাটা একটা সিলসিলার মত ব্যাপার, রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) যা বুঝেছেন, তাঁকে দেখে সাহাবিরা যা বুঝেছেন, তাবেয়িরা যা বুঝেছেন সেটাই কিন্তু ইসলাম। রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর উপর ২৩ বছর ধরে কোরআন নাযিল করা হল যাতে তিনি কোরআনের আদেশ নিষেধ নিজের জীবনে প্রতিফলন করে দেখান। আবার তিনি যা বুঝলেন এবং প্রচার করলেন তাই কিন্তু সাহাবিদের জীবনে প্রতিফলিত হল। তাই কোরআন তাফসির এর মূলনীতি বর্ণনা করতে গিয়ে ইবনে কাসির তার আল তাফসির আল কোরআন আল আজিম – এর ভূমিকায় লিখলেন :

ক্বুরানের ব্যখ্যা হবে নিম্নোক্ত ধারাবাহিকতায়, একটা না পেলে তবেই এর পরেরটায় যাওয়া যাবে:

১) ক্বুরানের ব্যখ্যা কোরআন দ্বারা।
২) ক্বুরানের ব্যখ্যা রসুলুল্লাহ (সাঃ) এর বাণী/আদেশ/নিষেধ দ্বারা।
৩) ক্বুরানের ব্যখ্যা রসুলুল্লাহ (সাঃ)এর সাহাবিদের দ্বারা।
৪) ক্বুরানের ব্যখ্যা রসুলুল্লাহ (সাঃ)এর সাহাবিদের তাবেয়িদের দ্বারা।
৫) ক্বুরানের ব্যখ্যা রসুলুল্লাহ (সাঃ)এর তাবেয়িদের তাবেয়িনদের দ্বারা।
৬) ক্বুরানের ব্যখ্যা ক্বুরানের সাতটি ক্বিরাতের দ্বারা।
৭) আরবি ভাষার জ্ঞান দ্বারা।

যিনি শুধু কোরআন পড়লেন (তাও মূল আরবি না, শুধু অনুবাদ) কিন্তু বাকিগুলো সম্পর্কে জ্ঞান রাখলেন না, তিনি যখন কোরআন পড়তে গিয়ে কোন কিছু না বুঝবেন তখন তার সেই “নলেজ গ্যাপ” এর জন্য নিজের মত করে (বেশিভাগ ক্ষেত্রেই শয়তানের মত করে) তার একটা ব্যাখ্যা দাড়া করিয়ে নিবেন। এর উদাহরণ আমাদেরই অনেক ভাই যাদের ধারণা শুধুমাত্র কোরআন মানাটাই আমাদের জন্য যথেষ্ট। তাদের বক্তব্য, যেহেতু আল্লাহ কোরআন সংরক্ষণ করবেন বলেছেন সেহেতু কোরআন সংরক্ষিত আছে। যেহেতু হাদিস সরাসরি আল্লাহর বাণী নয় তাই তা বিকৃত হয়ে গেছে এবং এগুলো মানা যাবে না। যদিও বা মানতে হয় তবে চিন্তা ভাবনা করে বিবেক বুদ্ধি খাটিয়ে সেগুলো মানা যেতে পারে। এখানে মূল সমস্যা হল খন্ডিত জ্ঞান। কেউ যদি কোন হাদিসের ভাষ্য বা Text জানেন কিন্তু তার ব্যাখ্যা না জানেন তবে তিনি ব্যাখ্যা না করতে পেরে ধারণা করবেন যেহেতু এটা হাদিস তাই এতে ভুল আছে।

আবার ব্যাপারটি এরকমও হতে পারে যে, কোন একটি বিষয় সম্পর্কে কেউ যদি একটি হাদিস জানেন এবং সেটা থেকে নিজে নিজে কোন সিদ্ধান্তে আসেন তবে সেটা বিভ্রান্তিকর হতে পারে।

যেমন অপ্রাপ্তবয়ষ্ক শিশুসন্তানেরা আখিরাতে কি পরিণতি লাভ করবে?

প্রথম হাদিসঃ অপ্রাপ্তবয়ষ্কদের রসুলুল্লাহ(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মিরাজের সময় ইব্রাহিম (আলাইহিস সালাম) এর সাথে জান্নাতে একটি গাছের কাছে থাকতে দেখেছিলেন।

দ্বিতীয় হাদিসঃ খাদিজা (রাঃ) রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কে তাঁর জাহিলিয়াতের সময়কার মৃত সন্তানদের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করায় তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছিলেন যে তাঁরা জাহান্নামী।

যারা প্রথমটি জানেন তারা অপ্রাপ্তবয়ষ্করা কি পরিণতি লাভ করবে – এর উত্তর দিবেন জান্নাত, যারা দ্বিতীয়টি জানেন তাঁরা বলবেন জাহান্নাম। যিনি প্রথম হাদিসটি জানেন তিনি ইসলামের খন্ডিত জ্ঞানের অধিকারী। যিনি শুধু দ্বিতীয় হাদিসটি পড়লেন তিনি বিবেক দিয়ে বিশ্লেষণ করে বলবেন এটা আবার কেমন বিচার? যে শিশু কোন পাপ করেনি সে কেন আগুনে পুড়বে? যারা দুইটাই জানেন তাদের মনে শয়তান বিভ্রান্তি ঢুকায়ে বলবে দেখেছ রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর কথা স্ববিরোধী, সুতরাং হাদিস মানার দরকার নাই।

তৃতীয় হাদিসঃ আনাস(রাঃ) বলেন, রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন কিয়ামাতের দিন অপ্রাপ্তবয়ষ্ক, পাগল এবং যারা দুই নবীর মাঝখানে এসেছে (আহ্লুল ফাতরাহ) তারা পরীক্ষিত হবেন। আল্লাহর পক্ষ থেকে একজন দূত এসে তাদের আল্লাহর নির্দেশে আগুনে ঝাঁপ দিতে বলবেন – যারা এই আদেশ মানবে তাঁরা জান্নাতে যাবে, যারা অগ্রাহ্য করবে তারা জাহান্নামী।

যিনি তৃতীয় হাদিসটিও জানেন তিনি কিন্তু প্রশ্নটির একটি সুন্দর ও গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা দিতে পারবেন। ইসলাম টোটালারিয়ান ভিউ সাপোর্ট করে, ফ্র্যাগমেন্টেড ভিউ না। যেমন একজন মানুষ একটি জানালা দিয়ে একটি রাস্তার কিছু অংশ দেখল যেখানে শুধু কাপড়ের দোকান আছে। এখন সে যদি দাবি করে ঐ রাস্তায় শুধু কাপড়ের দোকান আছে তা ঠিক কিন্তু সম্পুর্ণ ঠিক না। সে যদি ছাদে দাঁড়িয়ে ঐ রাস্তাটি দেখে তবে সে দেখতে পেত কাপড়ের দোকান ছাড়াও আরো অনেক কিছুই ঐ রাস্তায় আছে। জানালার দৃশ্যটি ফ্র্যাগমেন্টেড ভিউ কিন্তু ছাদের দৃশ্য টোটালারিয়ান ভিউ। এমনটি শুধু ইসলাম নয় অনেক অন্য ক্ষেত্রেও একই ভাবে কাজ করে। আমরা জিনোমিক্স নিয়ে পড়াশোনা করতে গিয়ে দেখেছি আগে যেখানে একটা জিন-এর কাজ নিয়ে গবেষণা হত; এখন হয় পুরো কোষের সব জিন নিয়ে। কারণ ঐ জিনের কাজ পুরো কোষের পরিপ্রেক্ষিতে প্রায়ই বদলে যায়। ঠিক তেমনি অনেক আয়াত বা হাদিস অন্যান্য সব আয়াত ও হাদিসের সাহায্যে পুরো অর্থ নেয়, একাকি ভিন্ন অর্থ নেয়। পুরো অর্থ মানে রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ও তাঁর সাহাবিরা যে অর্থে নিয়েছিলেন এবং জীবনে আমল করেছিলেন সেই অর্থ।

বড় আলিমের সুবিধাটা হল এখানে যে তিনি একটি বিষয় সম্পর্কে সব আয়াত এবং তার সম্পর্কিত হাদিসগুলো জানেন তাই তিনি একটা আয়াত বা একটি বিষয় ব্যাখ্যার সময় আমাদের থেকে ভাল ব্যাখ্যা করতে পারেন। তিনি যদি না জেনেও থাকেন তবে জানার চেষ্টা করে তবেই ব্যাখ্যা করবেন তার আগে করবেন না। আমি যদি সম্পূর্ণ জ্ঞান ছাড়াই আয়াতের অন্তর্নিহিত মানে বুঝতে যাই বা কোন বিষয় ব্যাখ্যা করতে যাই তাহলে সমস্যা হবে। আমার জ্ঞানের অভাবে আমি ভুল ব্যখ্যা করব, কিন্তু শয়তান আমাকে বুঝাবে যে ঐ অশিক্ষিত আলিমের থেকে আমিই ভাল জানি, বুঝি এবং আমার ভুল ব্যাখ্যা নিয়ে আমি তর্ক করব এবং ভুল পথে চলে যাব (নাউযুবিল্লাহ)।

কোন বিষয়ের কোন ব্যাখ্যা বড় কোন আলিম করেছেন, অন্য আলিমরা তাদের এই ব্যাখ্যাকে ঠিক বলেছেন তাদের পরিপূর্ণ জ্ঞানের পরিপ্রেক্ষিতে, তারপরেই আমাদের উচিত সেটা মেনে নেয়া ও প্রচার করা। যে কেউ ইসলাম নিয়ে সিস্টেমেটিকালি পড়াশোনা করুক, এরপর কোরআন-হাদিসের ব্যাখ্যা করুক, সেই ব্যাখ্যা বড় আলিমরা মেনে নিক, আল্লাহর কসম ঐটা মেনে নিতে আমার কোন আপত্তি নাই। কেউ একজন সারাজীবন ফ্লুইড মেকানিক্স পড়ল, পড়াল, রিটায়ার করে যখন দেখল আর কোন কাজ নাই, তখন ইসলামি ফাউন্ডেশন বা আব্দুল্লাহ ইউসুফ আলির অনুবাদ পড়ে আমাকে বুঝাবে যে হাদিস দরকার নাই, কোরআনেই সব আছে তাহলে আমি এই লোকের ধারেকাছে নাই। ইসলাম পুরাটা না বুঝে খন্ডিত বুঝ নিয়ে অনেক মানুষ নিজে বিভ্রান্ত হয়, অন্যদের বিভ্রান্ত করে ও সমস্ত মুসলিমদের বিপদে ফেলে।

আমরা অন্তত ইসলামের ক্ষেত্রে নিজেদেরকে অতি গুরুত্ব না দিয়ে বড়মাপের আলিমদের মতামতটা জেনে নিব, তারপরে সেটা নিয়ে কথা বলব। তাদের মধ্যে মতের ভেদাভেদ থাকলে আমরা উভয় মত সম্পর্কে পড়ব, চিন্তা করব তারপর যেটা পছন্দ হবে (জীবনযাত্রার সুবিধার্থে না, ইসলাম মানার ক্ষেত্রে যেটা বেশি তাকওয়াপূর্ণ, ও দলিল নির্ভর) সেটা মেনে নিব। যার মত মেনে নিলাম না তাকে হেয় করব না বরং সম্মান করব। আমরা মনে রাখব আলিমরাই রসুলদের উত্তরাধিকারী। সবচেয়ে ভাল হয় আমরা নিজেরা নিয়মানুযায়ী পড়াশোনা করে আলিম হয়ে যাই। ইসলামিক অনলাইন ইউনিভার্সিটি (http://www.islamiconlineuniversity.com) তে অনলাইনে পড়াশোনা করা যায় এমনকি সার্টিফিকেট পর্যন্ত নেয়া যায়। যারা জানার উদ্দেশ্যে জানতে চান তারা আরববিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চশিক্ষিত আলিম যারা বর্তমানে আমাদের দেশে অবস্থান করছেন তাদের কাছে ফর্মাল ক্লাসের আয়োজন করতে পারেন, এতে নিজের শিক্ষা হল, আরো মানুষ দ্বীন শিখতে পারল।

“ইসলাম একটা সিম্পল, সহজ ধর্ম” – এ কথা বলে যার যা করতে ভাল লাগে সব ইসলামের মধ্যে ঢুকাবে, এটা খুব বড় ধরণের অন্যায়। আমার নিজের কাছে যে ইসলাম মানতে ভাল লাগে তা মানলে আর আল্লাহর ইসলামের দরকার কি ছিল? আমরা ইসলাম মানি আল্লাহকে খুশি করে পুরষ্কার পেতে, তাঁর শাস্তি থেকে বাঁচতে। এই উদ্দেশ্য সফল করতে আল্লাহ আমাদের জন্য যেই ইসলাম পছন্দ করেছেন ঠিক সেটাই মেনে চলতে হবে।

আল্লাহ আমাদের আপন আত্মার ঔদ্ধত্য থেকে রক্ষা করুন, তাঁর আদেশ ঠিক মত জেনে তা মেনে নেয়ার তৌফিক দিন।

আমিন

বই – রামাদান নির্বাচিত ফাতাওয়া – ১ – ফ্রী ডাউনলোড

প্রকাশনায়: Ath-Thabāt Library

আলহামদুলিল্লাহ্‌ জনপ্রিয় ওয়েবসাইট Islam-QA.com এর রামাদান সম্পর্কিত ১১২টি ফাতাওা বাংলায় বই আকারে প্রকাশ করা হয়েছে।

PDF ফাইল ওপেন করার জন্য ফ্রি Software/Application

Android – ezPDF Reader  |  PlayStore | Adobe Reader – PlayStore

Windows 7/8/10 – Adobe Reader

রামাদান নির্বাচিত ফাতাওয়া – ১ – QA Server
রামাদান নির্বাচিত ফাতাওয়া – ১ – QA Server

বইটি ভালো লাগলে অবশ্যই একটি Hard Copy সংগ্রহ করে অথবা লেখক বা প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানকে সৌজন্য মূল্য প্রদান করে সহযোগিতা করুন।

রামাদান বিষয়ক সকল ফাইল – প্রবন্ধ, বই, অডিও/ভিডিও লেকচার ডাউনলোড করতে চাইলে এই লিঙ্ক এ ক্লিক করুন – রামাদান বিষয়ক সকল ফাইল – প্রবন্ধ, বই, অডিও/ভিডিও লেকচার

বই – রোযার সত্তরটি মাসয়ালা – মাসায়েল – ফ্রী ডাউনলোড

108

বই: রোযার সত্তরটি মাসয়ালা – মাসায়েল

প্রণয়নে: শায়খ মুহাম্মাদ সলেহ আল-মুনাজ্জেদ

ভাষান্তরে: সরদার মুহাম্মাদ জিয়াউল হক

সংক্ষিপ্ত বর্ণনা: সিয়াম বা রোযা প্রসঙ্গে জ্ঞাতব্য অনেকগুলো জরুরী মাসয়ালা – মাসায়েল, কুরআন – হাদীস ও যুগশ্রেষ্ঠ আলেমগণের ফতওয়ার উপর ভিত্তি করে সৌদী আরবের বিশিষ্ট আলেম সম্মানিত শায়খ মুহাম্মাদ সলেহ আল-মুনাজ্জেদ “সাবাউনা মাসয়া্লা ফিস্ সিয়াম” বইটি আরবি ভাষায় প্রণয়ন করেছেন । এবং এর বাংলা অনুবাদ “রোযার সত্তরটি মাসয়ালা – মাসায়েল” করেছেন – সরদার মুহাম্মাদ জিয়াউল হক।

PDF ফাইল ওপেন করার জন্য ফ্রি Software/Application

Android – ezPDF Reader  |  PlayStore | Adobe Reader – PlayStore

Windows 7/8/10 – Adobe Reader

বই – রোযার সত্তরটি মাসয়ালা – মাসায়েল QA
বই – রোযার সত্তরটি মাসয়ালা – মাসায়েল QA

বইটি ভালো লাগলে অবশ্যই একটি Hard Copy সংগ্রহ করে অথবা লেখক বা প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানকে সৌজন্য মূল্য প্রদান করে সহযোগিতা করুন।

রামাদান বিষয়ক সকল ফাইল – প্রবন্ধ, বই, অডিও/ভিডিও লেকচার ডাউনলোড করতে চাইলে এই লিঙ্ক এ ক্লিক করুন – রামাদান বিষয়ক সকল ফাইল – প্রবন্ধ, বই, অডিও/ভিডিও লেকচার

বই – স্বাগত তোমায় আলোর ভুবনে – ফ্রী ডাউনলোড

বই: স্বাগত তোমায় আলোর ভুবনে

লেখক: আবদুল মালিক আল কাসিম

অনুবাদক ও সম্পাদক: আমীমুল ইহসান

প্রকাশনায়: রুহামা পাবলিকেশন

বিষয়: আত্মশুদ্ধি ও অনুপ্রেরণা, ইসলামী সাহিত্য

পৃষ্ঠা সংখ্যা: ১৮৪

সংক্ষিপ্ত বর্ণনা: ইসলামি ঘরানায় বর্তমানে ছোটগল্প বেশ জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। তাই অনেক লেখকই দাওয়াহর জন্য এটিকেই বেছে নিচ্ছেন। ছোট গল্প যেহেতু দশ থেকে পঞ্চাশ মিনিট দৈর্ঘ্য বিশিষ্ট হয়, তাই পাঠকরা সাধারণত বিরক্ত হয় না। তাছাড়া গল্পে গল্পে পাঠকের বোধবিশ্বাসে সহজেই রেখাপাত করা সম্ভব হয়। যাক, ছোটগল্প নিয়ে একদিন আলাদা আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ।

‘স্বাগত তোমায় আলোর ভুবনে’ এর গল্পগুলো পুরোপুরি রবিবাবুদের ছোটগল্পের সংজ্ঞায় পড়ে না। এগুলো অনেকটা বিভূতিভূষণ ও বনফুলের ছোটগল্পগুলোর মতো। গল্পকে রোমাঞ্চকর কোনো পরিণতি দেয়ার চেয়ে গল্পের মূল মেসেজটা পাঠকের হৃদয়ে চারিয়ে দেয়ার চিন্তাই এখানে লেখককে তাড়িত করেছে।

শাইখ আব্দুল মালিক আল কাসিমের রচনা যারা পড়েন তাদের অজানা নয় যে, তার প্রায় সব রচনার সারনির্যাস হলো দাওয়াহ ও আত্মশুদ্ধি। আশির দশকে লেখা ‘আজ-জামানুল কাদিম’গল্প গ্রন্থটি তার রচনাবলির মধ্যে সর্বাধিক জনপ্রিয়। তার দায়িসুলভ প্রতিভার পূর্ণ স্ফূরণ ঘটেছে এই গল্পগুলোতে। মৃত্যু, কবর, তাওবা, সাদাকা, দাওয়াহ, সদাচার, তিলাওয়াত, মুহাসাবা, হিজাব ইত্যাদির মতো মুমিনের জীবনঘনিষ্ঠ বিষয়গুলোকে উপজীব্য করে তিনি গল্পগুলো নির্মাণ করেছেন।

গ্রন্থটি রচনা করতে গিয়ে মনে হয় তিনি মেয়েদের প্রতি বিশেষভাবে লক্ষ রেখেছেন। অধিকাংশ গল্পেই তিনি মেয়েদের বিভিন্ন দ্বীনি বিষয়গুলোকে দক্ষতার সঙ্গে উপস্থাপন করেছেন। নারীদের পর্দা, দাওয়াত ও ইবাদতসহ দাম্পত্য জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অনেকগুলো বিশুদ্ধ ভাবনা উঠে এসেছে গল্পে গল্পে। তাই আমি বলব, বইটি যতটা না যুবকদের তার চেয়েও বেশি মেয়েদের।

গল্পগুলো আশির দশকে আরবের তৎকালনি সমাজজীবনের প্রেক্ষাপটে লেখা। বইটি পড়তে গিয়ে পাঠক সেই সময়ের কিছুটা আভাস পাবেন। তখন বর্তমান যুগের মতো প্রযুক্তি এতটা বিস্তার লাভ করেনি। দাওয়াতের উপকরণ হিসেবে তিনি বারবার বলেছেন বয়ানের ক্যাসেটের কথা। তবে অনুবাদ করার সময় আমরা সময়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষার্থে গল্পের আবহটাকে কিছুটা যুগোপযোগী করার চেষ্টা করেছি। যেমন সময় অপচয় করা প্রসঙ্গে আমরা ইন্টারনেটের কথা বলেছি, ইউটিউবের কথা বলেছি। বুঝতেই পারছেন আশির দশকে এসবের নাম-গন্ধও ছিল না।

আজ-জামানুল কাদিম-এ তিন খণ্ডে মোট ছত্রিশটি গল্প আছে। কিছু গল্প সাইজে বেশ ছোট হওয়ার কারণে এবং কিছু গল্পের মেসেজ আমাদের উদ্দিষ্ট পাঠকদের জন্য কম গুরুত্বপূর্ণ মনে হওয়ায় বাদ পড়েছে। প্রতি খণ্ড থেকে নয়টি করে মোট সাতাশটি গল্প আমরা মলাটবদ্ধ করেছি।

Android – ezPDF Reader  |  PlayStore | Adobe Reader – PlayStore

Windows 7/8/10 – Adobe Reader

বই – স্বাগত তোমায় আলোর ভুবনে – QA
বই – স্বাগত তোমায় আলোর ভুবনে – QA

বইটি ভালো লাগলে অবশ্যই একটি Hard Copy সংগ্রহ করে অথবা লেখক বা প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানকে সৌজন্য মূল্য প্রদান করে সহযোগিতা করুন।

আমরা চোখ থাকতেও অন্ধ হয়ে থাকি

অনুবাদ: আবদ্‌ আল-আহাদ  | প্রকাশনায়: কুরআনের আলো ওয়েবসাইট

ঘটনাটি রাশেদ নামের এক ব্যক্তির। তিনি যেমনটি বলছিলেন…

আমার স্ত্রী যখন প্রথম সন্তানের মা হলো, তখন আমার বয়স তিরিশের বেশি হবে না। আজও আমার সেই রাতটার কথা মনে আছে।প্রতিদিনের অভ্যাস মতো সেদিনও সারারাত বন্ধুদের সাথে বাড়ির বাইরে ছিলাম। সারাটা রাত কেটেছিল যতসব নিরর্থক আর অসার কথাবার্তা, পরনিন্দা, পরচর্চা এবং লোকজনকে নিয়ে ঠাট্টা তামাশা আর মজা করে। সবাইকে হাসানোর কাজটা মুলত আমিই করছিলাম। আমি অন্যদের নিয়ে ঠাট্টা মশকরা করছিলাম আর তাই শুনে বন্ধুরা সব হেসেই খোশ হচ্ছিল।

মনে আছে, সেই রাতে আমি ওদের অনেক হাসিয়ে ছিলাম। মানুষের কণ্ঠস্বর, অঙ্গভঙ্গি ইত্যাদি খুব ভাল নকল করতে পারি আমি । যাকে নিয়ে ঠাট্টা মশকরা করি ওর মত কণ্ঠ করে কথা বলতে থাকি। ওর হেনস্তা না হওয়া পর্যন্ত আর ছাড়াছাড়ি নেই। আমার ঠাট্টা মশকরার ছোবল থেকে রেহাই পায় না কেউই, এমনকি আমার বন্ধুরাও না। এর থেকে বাঁচার জন্য কেউ কেউ আমাকে এড়িয়ে চলতে শুরু করেছিল। আমার মনে আছে, সেদিন রাতে বাজারে ভিক্ষা করতে দেখা এক অন্ধ ফকিরকে নিয়েও মশকরা করেছিলাম আমি। তারচেয়েও খারাপ কাজটি করেছিলাম আমার নিজের পা’টা ওনার সামনে বাড়িয়ে দিয়ে আর তাতে বেচারা হুমড়ি খেয়ে পড়ে গিয়েছিলেন। কী করবেন বুঝতে না পেরে অন্ধদৃষ্টি নিয়ে বেচারি চারপাশে শুধু মুখ ফেরাচ্ছিলেন।

আমি যথারীতি দেরি করে বাড়ি ফিরে দেখলাম আমার স্ত্রী আমার বাড়ি ফেরার প্রতীক্ষায় প্রহর গুনছে। ওর অবস্থা তখন ভয়ানক।আমাকে কাঁপাকাঁপা গলায় বলল, “রাশেদ… কোথায় ছিলে তুমি?”“চাঁদের দেশে গিয়েছিলাম বুঝি?” ব্যঙ্গোক্তি করে বললাম, “কোথায় থাকব আবার, বন্ধুদের সাথে ছিলাম।”ওকে খুবই অবসন্ন দেখাচ্ছিল। চোখের দু’ফোটা অশ্রু গোপন করে ও বলল, “রাশেদ, আমি আর পারছিনা। মনে হয় খুব শীঘ্রই আমাদের সন্তান আসছে।” এবার দু’ফোটা অশ্রু ওর গণ্ডদেশ বেয়ে গড়িয়ে পড়ল নিঃশব্দে।মনে হলো আমি আমার স্ত্রীকে অবহেলা করেছি।

আমার উচিৎ ছিল আমার স্ত্রীর সেবা-শশ্রুষা করা। রাতের পর রাত বাইরে কাটিয়ে দেওয়া আমার মোটেই উচিৎ হয়নি, বিশেষ করে যখন ওর গর্ভের নবম মাস চলছিল। আমি তাড়াতাড়ি করে ওকে হাসপাতালে নিয়ে গেলাম; ও ডেলিভারি রুমে চলে গেল। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ব্যাথায় আর যন্ত্রণায় কাতর হয়ে থাকল।আমি ডাক্তারের কাছে গেলাম। তিনি মানব জীবনে দুনিয়াবি নানান পরীক্ষা আর পার্থিব দুঃখকষ্ট নিয়ে কথা বলতে লাগলেন। বললেন, আল্লাহ্‌ আমাদের জন্য যা কিছু নির্ধারণ করেছেন তা নিয়েই আমাদের সন্তুষ্ট এবং পরিতৃপ্ত থাকা উচিৎ।এরপর বললেন, “আপনার ছেলের চোখে গুরুতর রকমের বিকলাঙ্গতা রয়েছে এবং মনে হচ্ছে ওর দৃষ্টিশক্তি নেই।”অনেক চেষ্টায় অশ্রু সংবরণ করতে করতে মস্তকটা আমার অবনত হয়ে পড়ল… মনে পড়ল বাজারের ঐ অন্ধ ফকিরটার কথা যাকে হুমড়ি খেয়ে ফেলে দিয়ে অন্যদের ফুর্তির খোরাক যোগাচ্ছিলাম।

সুবহানআল্লাহ্‌ ! আপনি তা-ই পাবেন, যা আপনি অন্যকে দিয়েছেন! কিছুক্ষণ নির্বাক হয়ে ভাবতে থাকলাম… বুঝতে পারছিলাম না কী বলব। মনে পড়ল আমার স্ত্রী আর সন্তানের কথা। ডাক্তারকে তার সহানুভূতির জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে ছুটে গেলাম ওদের দেখবার জন্য। আমার স্ত্রী কিন্তু মোটেই দুঃখিত নয়। ও আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে নির্ধারিত সিদ্ধান্তে  বিশ্বাসী…  আর তাতেই সন্তুষ্ট। কতবার ও আমাকে বলত মানুষকে নিয়ে ঠাট্টা তামাশা না করার জন্য! সে বলতেই থাকত, “পরের নিন্দা করো না…” যাইহোক, আমরা হাসপাতাল থেকে চলে এলাম; সালেম’ও এলো আমাদের সাথে।

বাস্তবে, আমি আমার সন্তানের প্রতি খুব বেশি মনযোগ দিতাম না। এমন ভাব করতাম যেন, ও বাড়িতে নেই। যখন ও জোরে জোরে কাঁদত, তখন আমি ওখান থেকে চলে গিয়ে শোয়ার ঘরে ঘুমাতাম। আমার স্ত্রী ওর অনেক যত্ন করত, ওকে অনেক ভালোবাসতো। আর আমার ব্যাপারে বললে, আমি ওকে অপছন্দ করতাম না, তবে ভালোবাসতেও পারতাম না।সালেম আস্তে আস্তে বড় হতে লাগল। ও হামাগুড়ি দিতে শিখল; তবে ওর হামাগুড়ি দেওয়াটা ছিল অদ্ভুত ধরনের। বয়স যখন প্রায় একবছর, তখন ও হাঁটতে চেষ্টা করতে লাগল; তখনই ওর পঙ্গুত্ব আমাদের কাছে ধরা পড়ল। এবার ওকে আমার কাছে আরো বড় ধরনের বোঝা মনে হতে লাগল।

সালেমের পর আমাদের উমার এবং খালেদ নামে আরও দুই সন্তানের জন্ম হয়েছে। কয়েক বছর চলে গেল, সালেম বড় হয়ে উঠল; ওর ভাইয়েরাও বড় হয়ে উঠল। আমার বাড়িতে থাকতে ভালো লাগত না, আমি সবসময় বাড়ির বাইরে বন্ধুদের সাথে থাকতাম… বাস্তবে, আমি ছিলাম তাদের (বন্ধুদের) হাতে একটা খেলনা [দরকার লাগলেই ওরা আমাকে ফুর্তির জন্য ব্যবহার করত]।আমার সংশোধনের ব্যাপারে আমার স্ত্রী কখনই হাল ছেড়ে দেয়নি। ও সবসময়ই আমার হেদায়াতের জন্য দো’আ করত। আমার লাগামহীন বেপরোয়া আচরণে ও কখনোই রাগ করত না। তবে সালেমের প্রতি আমার অবহেলা কিংবা ওর অন্য ভাইদের প্রতি আমার বেখেয়ালী ভাব দেখলে ও খুব মন খারাপ করত। সালেম বড় হয়ে উঠল। সাথে সাথে আমার দুঃশ্চিন্তাও বাড়লো। আমার স্ত্রী ওকে প্রতিবন্ধীদের বিশেষ কোনো স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিতে বলল; তবে কথাটি আমার কাছে খুব বেশি গুরুত্ব পেল না।

কীভাবে যে বছরগুলো কেটে গেল টেরই পেলাম না। আমার প্রতিটা দিনই কাটত একই ভাবে। খাওয়া, ঘুমানো, কাজ করা আর বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেওয়া। একদিন শুক্রবারে ঘুম থেকে উঠলাম বেলা ১১ টায়। ওই দিন আগেই ওঠা হলো। একটা দাওয়াত ছিল; তাই কাপড়-চোপড় পড়ে, গায়ে খুশবু লাগিয়ে বের হচ্ছিলাম। কেবল শোবার ঘরটা পেরিয়েছি.. অমনি সালেমের অবস্থা দেখে থমকে দাঁড়ালাম — ও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে!! শিশু অবস্থার পর এই প্রথম ওকে কাঁদতে দেখলাম। বিশটা বছর পেরিয়ে গেছে, আমি ওর দিকে নজর দিইনি। এবারও পাশ কাটিয়ে যেতে চাইলাম, পারলাম না…ঘর থেকে শুনতে পাচ্ছিলাম যখন ওর মাকে ও ডাকছিল। ওর দিকে ফিরে আরেকটু কাছে গেলাম।“সালেম! কাঁদছ কেন?” আমি জিজ্ঞাস করলাম।

আমার কণ্ঠ শুনে ওর কান্না থেমে গেল। আমি ওর খুব কাছাকাছি আছি টের পেয়ে ছোট্ট দু’খানা হাত দিয়ে চারপাশ হাতড়াতে লাগল। কী হয়েছে ওর? বুঝতে পারলাম ও আমার কাছ থেকে দূরে সরে যাওয়ার চেষ্টা করছে! যেন বলছে, “এতোদিনে তোমার সময় হয়েছে আমাকে খেয়াল করার? বিগত দশ বছর কোথায় ছিলে?” ও সরে যেতে থাকল। ওর পেছন পেছন আমি ওর ঘর পর্যন্ত গেলাম। প্রথমে বলতে চায়নি ও কেন কাঁদছিল। আমি একটু নরম হওয়ার চেষ্টা করলাম… সালেম বলতে লাগল কেন ও কাঁদছিল। আমি শুনছিলাম আর আমার ভেতর কাঁপছিল।

আপনারা কি জানেন, ও কেন কাঁদছিল?! ওর ভাই উমার — যে ওকে মসজিদে নিয়ে যায় — তখনও বাড়ি ফেরেনি। আজ জুম’আর দিন; সালেমর ভয়, ও প্রথম কাতারে হয়তো জায়গা পাবে না। ও উমার’কে ডেকেছে… ওর মাকেও ডেকেছে… কারও কোনো সাড়া নেই — এজন্যই সে কাঁদছে। ওর পাথর চোখ থেকে ঝরে পড়া অশ্রুর দিকে তাকিয়ে রইলাম। ওর পরের কথাগুলো আমার আর প্রাণে সইলো না।

মুখের উপর হাত রেখে ওকে থামালাম আর জিজ্ঞেস করলাম, “সালেম, তুমি কি এ জন্যই কাঁদছ?”ও বলল, “হ্যাঁ।”আমি বন্ধুদের কথা ভুলে গেলাম, পার্টির কথাও আর মনে থাকল না।আমি ওকে বললাম, “দুঃখ পেয়ো না, সালেম। তুমি কি জানো, আজ তোমাকে কে মসজিদে নিয়ে যাবে?” “নিশ্চয় উমার”, সে বলল, “…কিন্তু ও তো এখনও আসেনি।” “না”, আমি বললাম, “আজ আমিই তোমাকে নিয়ে যাব।”

সালেম হতভম্ভ হয়ে গেল… ওর বিশ্বাস হচ্ছিল না। ও ভাবল, আমি ওর সাথে ঠাট্টা করছি। চোখে পানি এসে গেল; আবার কাঁদতে লাগল ও। নিজ হাত দিয়ে চোখের পানি ফোঁটা মুছে দিয়ে ওর হাত ধরলাম। চাইলাম গাড়িতে করেই ওকে মসজিদে নিয়ে যাব। কিন্তু ও রাজি হলো না। বলল, “মসজিদ তো কাছেই… আমি হেঁটে যেতে চাই।” হ্যাঁ, আল্লাহ্‌র কসম, ও আমাকে একথাই বলল। মনে পড়ে না কবে শেষবারের মতো মসজিদে প্রবেশ করেছিলাম। তবে জীবন থেকে অবহেলায় হারিয়ে দেওয়া বিগত বছরগুলোর কথা পড়তেই মনের ভেতর ভয় আর অনুতাপের উদয় হলো। মসজিদ মুসল্লিতে ভরা। তারপরও আমি সালেমর জন্য প্রথম কাতারে একটু জায়গা খুঁজে নিলাম। একসাথেই জুম ‘আর খুৎবা শুনলাম; ও আমার পাশেই সালাত আদায় করল। সত্যি বলতে, আমিই ওর পাশে সালাত আদায় করলাম, ও আমার পাশে নয়।

সালাত সমাপ্ত হলে সালেম আমার কাছে একখানা কোরআন চাইল। আমি তো অবাক! ভাবলাম ও কী করে পড়বে, ও তো দেখতে পায় না। বলতে গেলে ওর কথায় কানই দিলাম না। কিন্তু কষ্ট পেতে পারে এই ভয়ে তাকে একখানা কুর’আন ধরিয়ে দিলাম। ও আমাকে সূরা আল-কাহ্ফ খুলে দিতে বলল। আমি পাতা উল্টাতে লাগলাম। খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত সূচীপত্র দেখতে থাকলাম। ও কুর’আন খানা আমার কাছ থেকে নিয়ে ওর সামনে রেখে চোখ বন্ধ করেই সূরাটি তেলাওয়াত করতে শুরু করল… সুবহানাল্লাহ! গোটা সূরা’টাই ওর মুখস্ত।

নিজের কথা ভেবে খুবই লজ্জিত হলাম। আমিও একখানা কুর’আন তুলে নিলাম…বুঝতে পারলাম সারা শরীর আমার কাঁপছে… পড়া শুরু করলাম… পড়তেই থাকলাম। আল্লাহ্‌র কাছে ক্ষমা ভিক্ষা চাইলাম। তাঁর কাছে প্রার্থনা করলাম, “ইয়া আল্লাহ্‌ ! আমাকে সহজ সরল পথ দেখাও।” আর সইতে পারলাম না… ছোট বাচ্চার মতো কেঁদে ফেললাম। মসজিদে তখনও অনেক লোক সুন্নাত আদায় করছেন। তাদের উপস্থিতি আমাকে একটু বিব্রত করল, আমি অশ্রু সংবরণ করলাম। আমার কান্না তখন চাপা দীর্ঘশ্বাসে রূপ নিয়েছে। শুধু টের পেলাম, একখানা কচি হাত আমার মুখখানা ছুঁতে চাইছে আর আমার ভেজা চোখ দু’টো মুছে দিচ্ছে। হ্যাঁ, ও আমার সালেম! আমি ওকে বুকে টেনে নিলাম… ওর দিকে তাকিয়ে নিজেকে বললাম… অন্ধ তো আমিই, অন্ধ তুমি না। আমি অন্ধ না হলে কি আর ওসব পথভ্রষ্টদের পেছনে ছুটে বেড়াই, যারা আমাকে জাহান্নামের আগুনের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে?

সালাত শেষ করে আমরা বাড়ি ফিরলাম। আমার স্ত্রী সালেমের জন্য অত্যন্ত চিন্তায় পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু ওর দুঃশ্চিন্তা অশ্রু (আনন্দের) হয়ে ঝরল যখন দেখল আমিও সালেমের সাথে জুম’আর সালাত আদায় করেছি।সেদিনের পর থেকে আমি আর কখনো মসজিদে জামা’আতের সাথে সালাত বাদ দিইনি। আমি আমার খারাপ বন্ধুদের ত্যাগ করেছি। বন্ধু করেছি মসজিদের ওই সৎনিষ্ঠ লোকগুলোকে। তাদের সাথে আমিও পেয়েছি ঈমানের অমৃত স্বাদ। কী আমাকে আমার জীবন সম্পর্কে ভুলিয়ে রেখেছিল তাও তাদের থেকে জেনেছি, শিখেছি। বিত্‌র সালাতের পরে যে দীনি আলোচনা হতো আমি তাও কখনো আর বাদ দিতাম না। মাসে পুরো কুর’আন কয়েকবার করে পড়ে শেষ করতে থাকলাম। মানুষের কুৎসা রটিয়ে আর ঠাট্টা তামাশা করে নিজের যে জিহ্বা টাকে কলুষিত করেছিলাম, তা এখন সদায় আল্লাহ্‌র স্মরণে সিক্ত রাখলাম যাতে আল্লাহ্‌ আমাকে মাফ করে দেন।

একদিন আমার কিছু দ্বীনি, ধার্মিক বন্ধুরা মিলে দূরে এক জায়গায় দা’ওয়াতের কাজে যাওয়ার মনস্থির করল। তাদের সাথে যাওয়ার ব্যাপারে আমার একটু অনাগ্রহ ছিল। আমি ইস্তেখারাহ সালাত আদায় করলাম, আমার স্ত্রীর সাথেও পরামর্শ করলাম। ভেবেছিলাম ও নিষেধ করবে যেতে… কিন্তু ঘটল তার উল্টোটা! কারন এতোদিন পাপের কারনে অনেক জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছি, অথচ ভুলেও ওকে একবার জিজ্ঞেস করিনি। আজ যখন ওকে জিজ্ঞেস করলাম, ও ভীষণ আনন্দিত হলো, এমনকি আমাকে উৎসাহিতও করল। আমি সালেমের কাছে গেলাম, বললাম আমি সফরে যাচ্ছি। শুনে ওর পাথর চোখদুটো ছলছল করে উঠল, আর কচি বাহুতে আমাকে জড়িয়ে নিলো…

বাড়ির বাইরে থাকলাম প্রায় সাড়ে তিন মাস। এই সময়টাতে যখনই সুযোগ পেয়েছি আমি আমার স্ত্রী আর সন্তানদের সাথে ফোনে কথা বলেছি। ওদের জন্য আমার খুব খারাপ লাগত… কি খারাপই না লাগত সালেমের জন্য!! ওর কণ্ঠটা শোনার ভীষণ ইচ্ছা জাগত… শুধু ওর সাথেই কথা হয়নি সফরের ঐ সময়টায়। ফোন করলেই শুনতাম হয় স্কুলে নয়তো মসজিদে আছে। যতবারই বলতাম ওর কথা আমার ভীষণ মনে পড়ে, ওর জন্য আমার মন খারাপ করে, ততবারই আমার স্ত্রী খুশিতে হাসত। কিন্তু শেষবার ও হাসেনি। ওর কণ্ঠস্বরটা কেমন যেন আলাদা ছিল শেষবার। ওকে বললাম, “সালেমকে আমার সালাম দিও”, ও শুধু বলল, “ইনশাআল্লাহ্‌,” তারপর চুপ হয়ে গেল।

অবশেষে বাড়ি ফিরলাম। দরজায় করাঘাত করে দাঁড়িয়ে আছি সালেম এসে আমার দরজাটা খুলে দেবে এই আশায়। কিন্তু আশ্চর্য হলাম আমার প্রায় চার বছরের ছেলে খালেদকে দেখে। ওকে কোলে তুলে নিতেই ও নালিশের সুরে বলে উঠল, “বাবা! বাবা!”। বাড়িতে ঢুকতেই কেন জানি না, ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। অভিশপ্ত শয়তান থেকে আল্লাহ্‌র কাছে আশ্রয় চাইলাম…আমার স্ত্রীর কাছে গেলাম… ওর চেহারাটা কেমন যেন লাগছে। যেন কিছুই হয়নি এমন একটা ভান করছে ও। ভালো করে তাকিয়ে বললাম, “কি হয়েছে তোমার?” ও বলল, “কিছু নাহ।” হঠাৎ সালেমের কথা জিজ্ঞেস করলাম। বললাম, “সালেম কোথায়?” ওর মাথাটা নিচু হয়ে গেল; কোন উত্তর দিলনা ও। ও কাঁদছে…“সালেম! কোথায় আমার সালেম?” আমি চিৎকার করে উঠলাম।ঠিক তখনই আমার ছোট ছেলে খালেদ ওর শিশু সুলভ ভাষায় বলে উঠল,“বাবা… থালেম জান্নাতে তলে গেতে… আল্লাহ্‌র কাথে…” (সালেম জান্নাতে চলে গেছে… আল্লাহ্‌র কাছে…)

আমার স্ত্রী আর সইতে পারল না। ও কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ার আগেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। পরে জানলাম, আমি আসার দুই সপ্তাহ আগে সালেমের জ্বর হয়েছিল। আমার স্ত্রী ওকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল। জ্বর আস্তে আস্তে ভয়ানক রূপ ধারন করল…অবশেষে জ্বর ছেড়ে গেল… সাথে আমার সালেমের প্রাণ পাখিটাও…

আর তাই, যদি দুনিয়া সমান বিপদ আসে আপনার উপর, যদি তা বইবার সাধ্য না থাকে, তো আল্লাহ্‌কে ডাকুন, “ইয়া আল্লাহ্‌!” যদি পথ হারিয়ে ফেলেন কিংবা যদি পথ সংকীর্ণ হয়ে যায়, যদি পাল ছিঁড়ে যায়, যদি আশার প্রদীপ নিভে যায়, তো আল্লাহ্‌কে ডাকুন, “ইয়া আল্লাহ্‌!।”আল্লাহ্‌ চেয়েছিলেন সন্তানের মৃত্যুর আগেই পিতাকে সন্তানের মাধ্যমে হেদায়াত দান করতে। আল্লাহ্‌ রাব্বুল ‘আলামীন কতই না দয়ালু! “অনেক মহান কর্ম নিয়্যতের কারনে তুচ্ছ হয়ে যায়, আবার অনেক নগণ্য কর্ম নিয়্যত গুণে মহান হয়ে ওঠে”  [আবদুল্লাহ ইবন মুবারাক]

বই – সালাফদের সিয়াম – ফ্রী ডাউনলোড

বই: সালাফদের সিয়াম

লেখক: সাঈদ ইবনে আলী আল কাহতানী, উম্মে আব্দ মুনীব

সম্পাদনা ও সংযোজন: রাজিব হাসান

ভাষান্তর: মুহিবুল্লাহ খন্দকার

প্রকাশনায়: আযান প্রকাশনী

পৃষ্ঠা সংখ্যা: 112

সংক্ষিপ্ত বর্ণনা: “সালাফদের সিয়াম” বইটিতে মূলত: সাহাবীগণ (রাদিয়াল্লাহু আনহুম ওয়া আজমাঈন), তাবেঈ ও তাবে-তাবেঈন (রাহিমাহুমুল্লাহ) কীভাবে সিয়াম পালন করতেন, কীভাবে রমাদ্বানের রজনীগুলো অতিবাহিত করতেন, কুরআনের সাথে কীভাবে সম্পর্ক স্থাপন করতেন, সাহরী ও ইফতার কীভাবে করতেন, ইতিকাফের দিনগুলো কীভাবে কাটাতেন, লাইলাতুল ক্বদর কীভাবে তালাশ করতেন এগুলো নিয়ে সবিস্তারে আলোচনা করা হয়েছে৷ আমরা আশা করছি এই বইটির মাধ্যমে রমাদ্বান মাসকে উত্তমরুপে কাজে লাগানোর একটা নির্দেশনা পাওয়া যাবে এই বইটি থেকে।

PDF ফাইল ওপেন করার জন্য ফ্রি Software/Application

Android – ezPDF Reader  |  PlayStore | Adobe Reader – PlayStore

Windows 7/8/10 – Adobe Reader

বই – সালাফদের সিয়াম – QA Server
বই – সালাফদের সিয়াম – QA Server

বইটি ভালো লাগলে অবশ্যই একটি Hard Copy সংগ্রহ করে অথবা লেখক বা প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানকে সৌজন্য মূল্য প্রদান করে সহযোগিতা করুন।

রামাদান বিষয়ক সকল ফাইল – প্রবন্ধ, বই, অডিও/ভিডিও লেকচার ডাউনলোড করতে চাইলে এই লিঙ্ক এ ক্লিক করুন – রামাদান বিষয়ক সকল ফাইল – প্রবন্ধ, বই, অডিও/ভিডিও লেকচার

আশাবাদী হওয়া [ অল্পতুষ্টির মাত্রা বৃদ্ধি করুন ]

hope

লেখক: ড. খালিদ আবু শাদি | অনুবাদক: হাসান মাসরুর

১. আজকের আলোচ্য বিষয়ের ফায়দা

  • আশা কল্যাণ লাভের কারণ।
  • কাজ ও সফলতার ব্যাপারে মানুষ অনুপ্ৰাণিত হয়।
  • যেকোনো দুর্যোগে পজেটিভ দৃষ্টিভঙ্গি ও স্থিরতা পাওয়া যায়; যদিও আপনি তখন কঠিন মুসিবত ও মানসিক চাপে থাকেন।
  • নিরাশা ও ব্যর্থতার পর্দা ভেঙে যায়।
  • শারীরিক ও মানসিকভাবে প্রতিরোধ প্রস্তুতি গ্রহণের ব্যাপারে উদ্যম তৈরি হয়।
  • আল্লাহ তাআলার ব্যাপারে ভালো ধারণা তৈরি হয়।
  • কঠিন বিষয়গুলোর মোকাবিলা ও উপযুক্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যায়।
  • আশাবাদী হওয়ার ক্ষেত্রে নবিজি (সা:)-এর আনুগত্য করা যায়।
  • ইচ্ছাকে শক্তিশালী করে লক্ষ্যে পৌঁছা যায়।
  • আশাবাদীর কাছ থেকে তার খুশি ও আনন্দ তার পরিবার ও সাথি-সঙ্গীদের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে অন্য মুসলিমকে আনন্দিত করার সাওয়াবও সে অর্জন করতে পারে।

২. কুরআনের আলো

কুরআনে এমন অনেক আয়াত বর্ণিত হয়েছে, যেখানে মানুষকে আশাবাদী করে তোলা হয়েছে। তাদের মাঝে আশার আলো ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে এবং হতাশা ও নিরাশাকে সমূলে উৎপাটন করা হয়েছে। তার কিছু আয়াত উল্লেখ করা হলো:

  • ক্ষমার ব্যাপারে আশাবাদী হওয়া: বলুন, হে আমার বান্দাগণ, যারা নিজেদের ওপর জুলুম করেছ, তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয় আল্লাহ সমস্ত গুনাহ মাফ করেন। তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।” [সুরা আজ-জুমার, ৩৯ : ৫৩]
  • সাহায্যের ব্যাপারে আশাবাদী হওয়া: “আর তোমরা নিরাশ হয়ো না এবং দুঃখ করো না। যদি তোমরা মুমিন হও, তবে তোমরাই বিজয়ী হবে।” [সুরা আলি ইমরান, ৩ : ১৩৯]
  • প্রতিদানের ব্যাপারে আশাবাদী হওয়া: “যখন তারা বিপদে পতিত হয়, তখন বলে, “নিশ্চয় আমরা আল্লাহর জন্য এবং আমরা তাঁরই সান্নিধ্যে ফিরে যাব।” [সুরা আল-বাকারা, ২: ১৫৬]

তারা সে সমস্ত লোক, যাদের প্রতি আল্লাহর অফুরন্ত অনুগ্রহ ও রহমত রয়েছে এবং এসব লোকই হিদায়াতপ্রাপ্ত।” [সুরা আল-বাকারা, ২ : ১৫৭]

  • অন্ধকারের পেছনে আলো এবং বিপদ আগমনের পর তা চলে যাওয়ার আশাবাদী হওয়া: “বিষয়টিকে তোমরা তোমাদের জন্য অকল্যাণকর মনে করো না; বরং এটি তোমাদের জন্য কল্যাণকর।[সুরা আন-নুর, ২৪ : ১১]
  • ব্যাপক আশাবাদী হওয়া: বলুন, “আল্লাহর দয়া ও মেহেরবানিতে। সুতরাং এরই প্রতি তোমাদের সন্তুষ্ট থাকা উচিত।” [সুরা ইউনুস, ১০ : ৫৮]

৩. রাসুল (সা:) আমাদের আদর্শ

> নবিজি (সা:) শুভলক্ষণ দেখে বিস্মিত হতেন এবং কুলক্ষণ অপছন্দ করতেন। হালিমি (রা:) বলেন, এই দু’য়ের মাঝে পার্থক্য হলো, কুলক্ষণ বলা হয় আল্লাহর ব্যাপারে ধারণা করার মতো বাহ্যিক কোনো কারণ ছাড়াই মন্দ ধারণা করা। আর শুভলক্ষণ হলো, আল্লাহর ব্যাপারে ভালো ধারণা করা এবং এর মাধ্যমে নিজের মাঝে নতুন আশা জাগিয়ে তোলা। আর সাধারণভাবেই এটি একটি প্রশংসনীয় বিষয়।

অশুভ লক্ষণ বলতে কোনো বিষয়কে অশুভ মনে করা। আরবরা জাহিলি যুগে সর্বপ্রথম যে পাখিটি দেখত, তা যদি ডান দিক দিয়ে উড়ে যেত, তাহলে সফর শুভ ও নিরাপদ মনে করত। আর যদি তা বাম দিক দিয়ে উড়ে যেত, তাহলে তা অশুভ মনে করত এবং সফর থেকে ফিরে আসত। নবিজি (সা:) এটি নিষেধ করলেন। এ কারণেই ইকরামা বর্ণনা করেন, ‘আমরা ইবনে আব্বাস (রা:)-এর কাছে বসা ছিলাম। এমন সময় একটি পাখি আওয়াজ করতে করতে উড়ে গেল। তখন এক লোক বলে উঠল, “কল্যাণকর হোক!” ইবনে আব্বাস (রা:) বললেন, “এর মাঝে কল্যাণ ও অকল্যাণের কিছু নেই।”

> ইয়াহইয়া বিন সাইদ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: ‘রাসুল (সা:) একটি দুধেল উষ্ট্রীর দিকে ইশারা করে বললেন, ‘এই উষ্ট্রীর দুধ কে দোহন করবে?’ তখন এক ব্যক্তি দাঁড়ালে রাসুল (সা:) তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার নাম কী?’ লোকটি বলল, ‘মুররা।’ অতঃপর রাসুল (সা:) তাকে বললেন, ‘তুমি বসো।’ (তিনি লোকটির নাম অপছন্দ করলেন। কারণ, মুররা শব্দের অর্থ হলো, তিক্ত)।

এরপর রাসুল (সা:) আবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘এই উষ্ট্রীর দুধ কে দোহন করবে? তখন (অপর) এক ব্যক্তি দাঁড়ালে রাসুল (সা:) তাকে জিজ্ঞেস করলেন,‘তোমার নাম কী?’ লোকটি বলল, ‘হারব।’ রাসুল (সা:) বললেন, ‘তুমি বসো।’ আবার বললেন, ‘এই উষ্ট্রীর দুধ কে দোহন করবে?’ তখন আরেক ব্যক্তি দাঁড়ালে রাসুল (সা:) তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার নাম কী?’ লোকটি বলল, ‘ইয়াইশ।’ রাসুল (সা:) তাকে বললেন, যাও, দুধ দোহন করো।‘ [মুয়াত্তা মালিক: ২৪]

> জাবির বিন আব্দুল্লাহ (রা:) থেকে বর্ণিত হাদিসে এসেছে — ‘রাসুল (সা:) যখন উম্মে সায়িব বা উম্মে মুসাইয়িবের কাছে গেলেন, তখন তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে উম্মে সায়িব বা উম্মে মুসাইয়িব, তোমার কী হয়েছে, তুমি কাতরাচ্ছ কেন?’ তিনি বললেন, ‘ভীষণ জ্বর, একে আল্লাহ বর্ধিত না করুন।’ তখন তিনি বললেন, ‘তুমি জ্বরকে গালমন্দ করো না। কেননা, জ্বর আদম-সন্তানের পাপরাশি মোচন করে দেয়, যেভাবে হাপর লোহার মরীচিকা দূর করে।‘ [সহিহু মুসলিম: ২৫৭৫]

> রাসুল (সা:) যখন কোনো প্রয়োজনে (বের হওয়ার) ইচ্ছা করতেন, তখন (কারও মুখে) এ কথা শুনতে পছন্দ করতেন, ‘হে সফলকাম, হে সঠিক পথের পথিক, হে বরকতময়!’ তেমনিভাবে তিনি অসুস্থ ব্যক্তিকে ‘হে সুস্থ শুনাতে চাইতেন। এতে তার মাঝে প্রশস্ততা তৈরি হতো। অথবা তিনি ভ্রষ্টতার অনুসন্ধানকারীকে ‘হে সঠিক পথপ্রাপ্ত শুনাতে চাইতেন। এতে সে আত্মতৃপ্তি অনুভব করত।

> রাসুল (সা:) আশাবাদী হওয়ার শিক্ষা দিয়েছেন। এ কারণেই তিনি মানুষের মাঝে সবচেয়ে প্রফুল্ল ছিলেন। তাঁর রব তাঁকে ভ্রুকুটি করতে নিষেধ করেছেন। তিনি আমাদেরকে শিক্ষা দিয়েছেন, ‘তিন দিনের বেশি শোক প্রকাশ নেই।’ এতে এই ইঙ্গিত রয়েছে যে, সব সময় পেরেশানিতে ডুবে থাকা যাবে না; বরং ভবিষ্যতের ব্যাপারে আশাবাদী হতে হবে।

৪. অমূল্য বাণী

> ইমাম মাওরিদি (রা:) তার কিতাব ‘আদাবুদ দুনিয়া ওয়াদ দ্বীন’-এ উল্লেখ করেছেন, ‘জেনে রেখো, অশুভ ধারণা থেকে কেউ মুক্ত নয়। বিশেষ করে ওই ব্যক্তি, ভাগ্য যার ইচ্ছাশক্তির বিপরীত এবং কুদরতি ফয়সালা যার প্রয়োজনের প্রতিবন্ধক। সে আশাবাদী হয়; কিন্তু নিরাশাই তার ওপর প্রবল হয়ে থাকে। সে আশা করে; কিন্তু ভয় তার অধিক নিকটবর্তী সুতরাং কুদরতি ফয়সালা যখন তার জন্য প্রতিবন্ধক হয় এবং প্রত্যাশা যখন সফলতার মুখ দেখে না, তখন সে নিজের ব্যর্থতার ওজরকে অশুভ লক্ষণ মনে করে এবং আল্লাহর ফয়সালা ও ইচ্ছার ব্যাপারটিতে উদাসীন হয়ে যায়।

সুতরাং সে যখন অশুভ লক্ষণ মনে করে, তখন আর সামনে পা বাড়ায় না এবং সফলতার ব্যাপারে আশা ছেড়ে দেয়। সে মনে করে তার ধারণাই সঠিক হবে এবং তার কঠিন পরিস্থিতি আজীবন থাকবে। এরপর তার জন্য এটিই স্বাভাবিক রীতিতে পরিণত হয়। তাই তার কোনো চেষ্টাই সফলতা লাভ করে না এবং কোনো ইচ্ছাই পূর্ণতা অর্জন করে না ৷ কিন্তু কুদরতি তাকদির যাকে সাহায্য করে এবং কুদরতি ফয়সালা যার অনুকূলে, সে সামনে বাড়ার ব্যাপারে কম মন্দ ধারণা করে। ভবিষ্যতের ব্যাপারে সে বিশ্বাসী হয় এবং সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল হয়। ভয় তার জন্য প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে না। কোনো দুর্বলতা তাকে ধরে রাখে না ৷ কারণ, সফলতা সামনে বাড়ার মাঝে এবং ব্যর্থতা পিছু হটার মাঝে।

> জনৈক নেককার লোক বলেন, ‘সিদ্ধান্তের জন্য সবচেয়ে ক্ষতিকর এবং চেষ্টাকে নস্যাৎ করে দেওয়ার সবচেয়ে বড় মাধ্যম হলো, কুলক্ষণে বিশ্বাস করা। যারা মনে করে, গরুর ডাক বা কাকের আওয়াজ তার জন্য নির্ধারিত ফয়সালা বা তাকদির পরিবর্তন করে দেবে, সে মূলত অজ্ঞ।

> ইবনে সিনা বলেন, ‘রোগের অর্ধেক হলো ধারণা। আর ধারণা থেকে বেঁচে স্থির থাকা হলো, ওষুধের অর্ধেক। ধৈর্য হলো সুস্থতার প্রথম পর্ব।

৫. বিস্ময়কর একটি কাহিনি

পারস্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধের কাহিনি। নুমান বিন মুকরিন (রা:) যখন পারস্য-সম্রাটের সামনে জিজিয়া অথবা ইসলাম গ্রহণ অথবা কিতালের সুরতগুলো উপস্থাপন করলেন, তখন সে বলেছিল, ‘যদি দূতদের হত্যা করা নিষিদ্ধ না হতো, তাহলে আমি তোমাদের হত্যা করে দিতাম। তোমরা উঠে চলে যাও। আমার কাছে তোমরা নিজেদের কোনো আশাই পূরণ করতে পারবে না। আর তোমাদের নেতাকে বলে দিয়ো, “আমি তোমাদের বিরুদ্ধে রুস্তমকে পাঠাচ্ছি। সে যেন তাকে ও তোমাদেরকে এক সাথে কাদিসিয়ার গর্তে দাফন করে দেয় ।” এরপর সে আদেশ করলে এক টুকরি মাটি নিয়ে আসা হলো।

সে নিজের লোকদের বলল, ‘টুকরিটি তাদের সবচেয়ে সম্মানিত মানুষের মাথায় উঠিয়ে দাও এবং তাকে সকল মানুষের চোখের সামনে দিয়ে নিয়ে যাও। সে যেন আমাদের দেশের রাজধানীর ফটক দিয়ে বের হয়।’ লোকেরা প্রতিনিধি-দলকে জিজ্ঞেস করল, ‘তোমাদের মাঝে সর্বোত্তম লোক কে?’ তখন আসিম বিন উমর তাদের দিকে এগিয়ে গিয়ে বললেন, ‘আমি।’ তারা টুকরিটি তাঁর মাথায় উঠিয়ে দিল। এরপর তিনি মাদায়িন থেকে বের হয়ে আসলেন এবং নিজের উটনীর পৃষ্ঠে তা উঠিয়ে নিলেন। তিনি সাদ বিন আবি ওয়াক্কাস (রা:) -এর জন্য এটি বহন করে নিয়ে এলেন এবং তাঁকে বিজয়ের সুসংবাদ দিলেন।

তিনি মাটি গ্রহণে আশাবাদী হয়েছেন এবং আল্লাহর ব্যাপারে সুধারণা করেছেন। তিনি মনে করেছেন যে, আল্লাহ তাআলা অচিরেই সে অঞ্চলটি তাঁদের দান করবেন। আর এমনটিই হয়েছে। কাদিসিয়্যার ঐতিহাসিক যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে এবং কিসরার হাজার হাজার সৈনিক দিয়ে তার গর্তগুলো পূর্ণতা লাভ করেছে ।

৬. রমাদানে আশাবাদী হওয়া

রমাদান আশার আলো ছড়িয়ে দেয়। এটি হলো পাপাচারে সীমালঙ্ঘনকারীর জন্য ক্ষমার মাস এবং ইসলামের বড় বড় যুদ্ধগুলোতে বিজয়ের মাস। সব ধরনের কল্যাণের মাস হলো রমাদান মাস ।

৭. আশার সূর্য ডুবে গেছে

অশুভ লক্ষণ ছড়িয়ে পড়ছে: কিছু নির্দিষ্ট লোক থেকে অশুভ লক্ষণের ধারণা ছড়িয়ে পড়ছে। নির্ধারিত কিছু নম্বর, নির্ধারিত কিছু স্বপ্ন বা দর্শন থেকে এবং নির্ধারিত কিছু স্থান থেকে অশুভ ধারণা ছড়িয়ে পড়ছে। যা মানুষের চলার পথে মন্দ প্রভাব সৃষ্টি করে এবং তার সফলতাকে বাধাগ্রস্ত করে ৷ এ কারণেই কোনো এক পুণ্যবান ব্যক্তি বলেছেন, ‘আমি ওই জিনিসের ভয় করছি, যার মাধ্যমে আমাকে পরীক্ষা করা হবে।’

এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে উত্তম বাণী হলো, ইবনুল কাইয়িম (রা:)-এর কথা: ‘জেনে রেখো, যে কোনো জিনিসকে অশুভ মনে করে এবং তাকে ভয় করে, সে এর মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং যে তার কোনো পরোয়া করে না এবং এদিকে ফিরেও তাকায় না, তার কোনো ক্ষতিই হবে না ৷’

৮. দুআ

  • হে আল্লাহ, আমার আশপাশের লোকদের মাঝে আশার আলো ছড়িয়ে দিতে আমাকে সাহায্য করুন এবং আমাকে কল্যাণের চাবি এবং অকল্যাণের তালা বানিয়ে দিন!
  • হে আল্লাহ, আমাদেরকে আমাদের সাধ্যের বাইরে কোনো জিনিস চাপিয়ে দেবেন না।
  • হে আল্লাহ, আমাকে এমন দৃষ্টিশক্তি দান করুন, যেন প্রতিটি পরীক্ষার পেছনে আমি প্রতিদান দেখতে পারি এবং প্রত্যেক বিপদের পেছনে অনুদান দেখতে পারি। আর প্রত্যেক দুরবস্থার মাঝে যেন আনন্দ ও প্রশস্ততা দেখতে পারি।

৯. স্বার্থপর হবেন না

  • কথাগুলো আপনার মসজিদের মুসল্লি ও আপনার সহপাঠী-সহকর্মীদের মাঝে আলোচনা করুন।
  • এই বইটি নিজে পাঠ করে অন্যদেরকেও পড়তে দিন; যেন তারা এর থেকে উপকৃত হতে পারে।
  • মসজিদের ইমামকেও বইটি হাদিয়া দিতে পারেন; যেন তিনি জুমআর খুতবা বা তারাবিহ-পরবর্তী আলোচনায় এর থেকে ফায়দা গ্রহণ করতে পারেন।

১০. যথেষ্ট কথা হয়েছে, এখন আমল দেখার বিষয়

  • প্রতিটি পরীক্ষার ক্ষেত্রে খুব দ্রুতই প্রশস্ততা আসবে এবং প্রতিদানের মিষ্টতা অতি কাছে, এ ব্যাপারে আমরা আশা রাখব।
  • আমার সামনে যে সকল প্রতিবন্ধকতা আসবে, তার সামনে মাথা নত করব না।
  • আমার আশপাশে যারা আছে, তাদের মাঝে আশার আলো ও সুধারণা ছড়িয়ে দেবো।
  • আমি যে অবস্থারই সম্মুখীন হব, আল্লাহর কাছে প্রতিদানের আশা রাখব।

উৎস: রমাদান-আত্মশুদ্ধির বিপ্লব, পৃষ্ঠা: ৫৫ – ৬৩

সাধারণ ভুল যেগুলো রমজানের সময় আমরা করে থাকি

. রামাদানকে একটি প্রথাগত অনুষ্ঠান মনে করাঃ

আমাদের অনেকের কাছে রামাদান তাঁর আধ্যাত্মিকতা হারিয়ে ইবাদাতের বদলে একটি প্রথাগত অনুষ্ঠানের রূপ লাভ করেছে। আমরা সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ‘zombie’র মত উপোস থাকি শুধুমাত্র আমাদের আশেপাশের সবাই রোজা রাখে বলে। আমরা ভুলে যাই যে এই সময়টা আমাদের অন্তর ও আত্মাকে সকল প্রকার খারাপ কাজ থেকে পরিশুদ্ধ করার জন্য আমরা দু’আ করতে ভুলে যাই, ভুলে যাই আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতে এবং জাহান্নামের আগুন থেকে আমাদেরকে মুক্তি দান করতে। নিশ্চিতভাবে আমরা পানাহার থেকে বিরত থাকি কিন্তু সেটা কেবল লৌকিকভাবেই!

যদিও আল্লাহর রাসূল (সা:) বলেছেনঃ “জিবরাঈল (আঃ) আমাকে বলেছেন, আল্লাহ্ ঐ ব্যক্তির নাক মাটিতে ঘষুন যার নিকট রামাদান আসল এবং তার গুনাহসমূহ মাফ হল না, এবং আমি বললাম, আমিন। তারপর তিনি বললেন, আল্লাহ ঐ ব্যক্তির নাকও মাটিতে ঘষুন যে জীবদ্দশায় তার পিতামাতার একজনকে অথবা উভয়কে বৃদ্ধ হতে দেখল এবং সে জান্নাতে প্রবেশ করার অধিকার রাখল না তাদের সেবা করার মাধ্যমে আর আমি বললাম, আমিন।

অতঃপর তিনি বললেন: আল্লাহ্ ঐ ব্যক্তির নাক মাটিতে ঘষুন যার উপস্থিতিতে যখন আপনার নাম উচ্চারণ করা হয় তখন সে আপনার প্রতি সালাম বর্ষণ করে না আর আমি বললাম, আমিন।” [তিরমিযী, আহমাদ, এবং অন্যান্য_আলবানী কর্তৃক সহীহকৃত]

২. পানাহারের ব্যাপারে অতিমাত্রায় চাপে থাকাঃ

আমাদের অনেকের ক্ষেত্রে, রামাদান মাসের পুরোটাই খাবার ঘিরে  আবর্তিত হয়। সালাত, কুরআন তিলাওয়াত ও অন্যান্য ইবাদাতের ব্যাপারে যত্নশীল হওয়া বদলে আমরা পুরোটা দিন কেবল পরিকল্পনা প্রণয়ন, রান্নাবান্না, কেনাকাটা এবং খাওয়া-দাওয়া নিয়ে চিন্তা করে কাটাই। আমাদের চিন্তা ভাবনার পুরোটা জুড়েই থাকে ‘খাওয়া-দাওয়া’।

যার দরূন আমরা উপোস থাকার মাসকে ভোজের মাসে পরিণত করেছি। ইফতারের সময়ে আমাদের টেবিলের অবস্থা দেখার মত! পুঞ্জীভূত নানাপদী খাবার, মিষ্টান্ন এবং পানীয়ে পরিপূর্ণ। পক্ষান্তরে, আমরা রামাদানের মুখ্য উদ্দেশ্য ভুলে যাচ্ছি, আর এভাবে আমাদের লোভ আর প্রবৃত্তির অনুসরণ বাড়তে থাকে সেগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করার শিক্ষালাভ করার বদলে। এটাও একধরনের অপচয় এবং সীমালঙ্ঘন।

“তোমরা খাও এবং পান করো, এবং কোনো অবস্থাতেই অপচয় করো না, আল্লাহ্ তাআলা কখনোই অপচয়কারীদের পছন্দ করেন না ।” [সূরা আ’রাফঃ৩১]

৩. সারা দিন রান্না করে কাটানোঃ

কতিপয় বোন(হয় স্বেচ্ছায় নতুবা স্বামীর চাপে) সারা দিন ও সারা রাত ধরে রান্নাবান্না করতে থাকেন, তার ফলে দিনের শেষে তারা এতটাই ক্লান্ত হয়ে পড়েন যে এশার সালাত পড়তে পারেন না, তাহাজ্জুদ কিংবা কুরআন তিলাওয়াত তো দূরে থাক! এই মাস হল মাগফিরাত এবং মুক্তিপ্রাপ্তির মাস। সুতরাং, চলুন আমরা চুলা বন্ধ করে নিজেদের ঈমানের প্রতি মনযোগী হই।

৪. মাত্রাতিরিক্ত খাওয়া-দাওয়াঃ

আমাদের কিছুসংখ্যক সেহরীর সময়ে নিজেদেরকে বিস্ফোরিত হওয়ার আগ পর্যন্ত ভরাক্রান্ত করে তুলি, কারণ আমরা মনে করি সারা দিন ক্ষুধার্ত অনুভব না করার এটাই একমাত্র পথ, আর কিছুসংখ্যক রয়েছেন যারা ইফতারের সময় এমনভাবে খান যাতে মনে হয় আগামীকাল বলে কিছুই নেই, সারাদিন না খাওয়ার অভাব একবারেই মিটিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন। যাহোক, এটা সম্পূর্ণরূপে সুন্নাহ্ বিরোধী কাজ।

পরিমিতিবোধ সব কিছুর চাবিকাঠি। রাসূল (সাঃ) বলেছেনঃ “আদম সন্তান তার উদর ব্যতীত আর কোনো পাত্রই এত খারাপভাবে পূর্ণ করে না, আদম সন্তানের পৃষ্ঠদেশ সোজা রাখার জন্য এক মুঠো খাবারই যথেষ্ট। যদি তোমাদেরকে উদর পূর্ণ করতেই হয়, এক তৃতীয়াংশ খাবার দ্বারা, এক তৃতীয়াংশ পানি দ্বারা আর অবশিষ্ট এক তৃতীয়াংশ বায়ু দ্বারা পূর্ণ করো।” [তিরমিযী, ইবনে মাজাহ্, আলবানী কর্তৃক সহীহ্কৃত]

অতিরিক্ত খাবার গ্রহণ একজন মানুষকে আবশ্যকীয় অনেক আমল এবং ইবাদাত হতে দূরে সরিয়ে নেয়, তাকে অলস করে তোলে এবং অন্তরকে বধির করে ফেলে।

ইমাম আহমদকে একবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিলঃ “উদরপূর্ণ অবস্থায় একজন মানুষ কি তার হৃদয়ে কোমলতা ও বিনয় অনুভব করে?” তিনি উত্তরে বলেছিলেনঃ “আমার মনে হয় না।”

৫. সারা দিন ঘুমিয়ে কাটানোঃ

রামাদান মাস হচ্ছে অত্যন্ত মূল্যবান সময়, এতটাই মূল্যবান যে মহান আল্লাহ্ পাক একে ‘আইয়্যামুম মাদুদাত’(একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক দিবস) হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। আমাদের অনুধাবন করার পূর্বেই এই মাগফিরাত ও মুক্তির মাস শেষ হয়ে যাবে। আমাদেরকে চেষ্টা করা উচিত এই পবিত্র মাসের প্রতিটি মূহুর্ত আল্লাহর ইবাদাতে কাটানোর, যাতে করে আমরা এই মাসের সর্বোচ্চ সওয়াব হাসিল করতে পারি। যাহোক, আমাদের কিছুসংখ্যক রামাদানের দিনগুলি ভিডিও গেমস্ খেলে অতিবাহিত করে, অথবা জঘন্যতম হল টিভি দেখা, ছবি দেখা এমনকি গান শোনা পর্যন্ত। সুবহানাল্লাহ্!!! আল্লাহকে মান্য করার চেষ্টা করা হয় তাঁকে অমান্য করার মাধ্যমে!

৬. রোজা রাখা অথচ খারাপ কাজ বর্জন না করাঃ

আমাদের কিছু সংখ্যক রোজা রাখে কিন্তু তারা মিথ্যাচার, অভিশাপপ্রদান, মারামারি, গীবত ইত্যাদি বর্জন করে না এবং কিছুসংখ্যক রোজা রাখার উদ্দেশ্য কেবলমাত্র পানাহার থেকে বিরত নয় বরং আল্লাহর প্রতি তাকওয়া(পরহেজগারী) অর্জন অনুধাবন না করে রোজা রাখে কিন্তু তারা প্রতারণা, চুরি, হারাম চুক্তি সম্পাদন, লটারির টিকেট ক্রয়, মদ বিক্রি, যিনা ইত্যাদিসহ যাবতীয় অননুমোদিত কর্মকান্ড বর্জন করে না। 

“হে মানুষ, তোমরা যারা ঈমান এনেছো! তোমাদের ওপর সাওম ফরজ করা হয়েছে যেমনটি করা হয়েছিলো তোমাদের পূর্বপুরূষদের ওপর যাতে করে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো।” [সূরা বাকারাঃ১৮৩]

রাসূল (সা:) বলেছেনঃ “যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা বলা ও এর ওপর আমল করা বর্জন করে না ও মূর্খতা পরিহার করে না, তার পানাহার হতে বিরত থেকে উপবাস করা আল্লাহর নিকট প্রয়োজন নেই।” [বুখারী]

৭. ধূমপানঃ

ধূমপান ইসলামে বর্জনীয় সেটা রামাদান মাসেই হোক বা এর বাইরে হোক, কারণ এটা “আল-খাবিছ্’(খারাপ কাজ) এর একটি। এবং এটা যাবতীয় ধূমপানের সামগ্রী অন্তভূর্ক্ত করে যেমনঃ সিগার, সিগারেট, পাইপ, শিশা, হুক্কা ইত্যাদি।

“তাদের জন্য যাবতীয় পাক জিনিসকে হালাল ও নাপাক জিনিসসমূহকে তাদের ওপর হারাম ঘোষণা করে” [সূরাআ’রাফঃ১৫৭]

এটা শুধু যে ধূমপায়ী তার জন্য ক্ষতিকর- তা নয়, বরং তার আশেপাশে যারা রয়েছে তাদের জন্যও ক্ষতিকর। এটা কারো অর্থ অপচয়ের জন্য একটি মাধ্যমও বটে।

রাসূল (সা:) বলেছেনঃ “কোনো ধরনের ক্ষতিসাধন করা যাবে না কিংবা ক্ষতিসাধন বিনিময়ও করা যাবে না।”
এই হাদীস বিশেষত রামাদানের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য এবং এটা সাওমকে বাতিল করে দেয়। [ফতওয়া-ইবনে উছাইমিন]

বিস্তারিত জানতে ভিডিওটি দেখুন

৮. ইচ্ছাকৃতভাবে সেহরী বাদ দেওয়াঃ

রাসূল (সা:) বলেছেনঃ “সেহরী খাও, কারণ এটার মধ্যে বরকত রয়েছে।” [বুখারী, মুসলিম]

এবং তিনি (সাঃ) বলেছেনঃ “আমাদের সাওম আর আহলে কিতাবদের সাওম পালনের মধ্যে প্রধান পার্থক্য হচ্ছে সেহরী গ্রহণ।” [মুসলিম]

৯. ইমসাক এর সময় সেহরী খাওয়া বন্ধ করে দেওয়াঃ

কিছু লোক রয়েছে যারা ফজরের ওয়াক্তের ১০-১৫ মিনিট পূর্বে ইমসাক পালনের জন্য সেহরী খাওয়া বন্ধ করে দেয়। শেখ ইবনে উছাইমিন বলেছেনঃ “এটা বিদ’আত ছাড়া আর কিছু নয় যার কোন ভিত্তি সুন্নাহে নেই। বরং সুন্নাহ হল তার উল্টোটা করা। আল্লাহ প্রত্যুষের আগ পর্যন্ত আমাদেরকে খেতে অনুমতি প্রদান করেছেনঃ “আর আহার কর ও পান কর যতক্ষণ না ফজরের সাদা রেখা কালো রেখা থেকে স্পষ্ট হয়।” [সূরা বাকারাঃ১৮৭]

রাসূল (সা:) বলেছেনঃ “তোমরা আহার কর ও পান কর যতক্ষণ না ইবনে উম্মে মাকতুম এর আযানের ধ্বনি শুনতে পাও, কারণ সে প্রত্যূষ না আসা পর্যন্ত আযান দেয় না।”
এই ইমসাক হচ্ছে কিছু সংখ্যক লোকের দ্বারা পালনকৃত আল্লাহর আদেশের অতিরিক্ত কাজ, তাই এটা ভুয়া। এটা ধর্মের নামে এক ধরনের উগ্রপন্থী আচরণ। আর রাসূল (সা:) বলেছেনঃ “যারা উগ্রপন্থা অবলম্বন করে তারা ধ্বংস হয়েছে, যারা উগ্রপন্থা অবলম্বন করে তারা ধ্বংস হয়েছে, যারা উগ্রপন্থা অবলম্বন করে তারা ধ্বংস হয়েছে।” [মুসলিম]

১০. সেহরী না খাওয়ায় সাওম পালন না করাঃ

আমাদের মধ্যে কিছুসংখ্যক রয়েছে যারা সাওম পালন করে না এই ভয়ে যে সেহরী খাওয়া হয় নি।যাহোক, এটা এক ধরনের স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য ভালোবাসা ও কাপুরূষতা। এ আর এমন কি ব্যাপার যে সামান্য কয়েক মুঠো খাবার খাওয়া বাদ হয়ে যায়? এমন না যে এর কারণে আমরা মারা যাব। আমাদের মনে রাখতে হবে যে আল্লাহর প্রতি আনুগত্য সবকিছুকেই ছাপিয়ে যায়।

১১. ইফতার এবং সেহরির নিয়ত করা

ইফতার এবং সেহরির সময় নিয়ত এর উদ্দ্যেশ্যে মুখ দিয়েদুআউচ্চারণ করা শরীয়ত সম্মত নয়। ইফতার এবং সেহরির যে সকল দুআ আমাদের দেশে প্রতি বছর ইসলামিক ক্যালেন্ডারগুলিতে প্রকাশিত হয় সেগুলো বিদআত। ইফতার অথবা সেহরির জন্য নির্দিষ্ট কোন দুআ সহিহ হাদিস এ নেই। এক্ষেত্রে শুধু মনে মনে নিয়ত করলেই ইনশাআল্লাহ হবে।

১২. রোযা ভাঙতে দেরি করাঃ

আমাদের অনেকেই ইফতারের সময় মাগরিবের আযান শেষ হওয়া পর্যন্ত বসে থাকেন, আযান শেষ হলে রোযা ভাঙেন। সূর্য অস্ত যাবার পর আযান দেওয়ার সাথে সাথে রোযা ভাঙা সুন্নাহ সম্মত। আনাস(রাঃ) বলেন,“রাসুলুল্লাহ(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এটাই করতেন। [মুসলিম]

১৩. ইফতার বেশি খেতে গিয়ে মাগরিবের নামায জামাআত ধরতে না পারাঃ

আমরা অনেকেই ইফতারিতে এত বেশি খাবার নিয়ে বসি যে সেগুলো শেষ করতে গিয়ে মাগরিবের জামাআত ধরতে পারিনা। এটা একেবারেই অনুচিত। রাসুল(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কয়েক টুকরা খেজুর মুখে দিয়ে ইফতার ভেঙে অতঃপর মাগরিবের নামাজ এর জন্য চলে যেতেন। নামাজ শেষ করে এসে আমরা ফিরে এসে ইচ্ছা করলে আরও কিছু খেতে পারি।

১৪. আমাদের দুআ কবুল হওয়ার সুযোগ ছেড়ে দেওয়াঃ

সিয়াম পালনকারী ব্যক্তির দুআ রোযা ভাঙার সময় আল্লাহর নিকট কবুল হয়ে থাকে। রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: “তিন ধরনের ব্যক্তির দুআ ফিরিয়ে দেওয়া হয়না- ১)একজন পিতার দুয়া, ২)রোযাদার ব্যক্তির দুয়া, ৩)মুসাফিরের নামাজ”। [বায়হাকি]

আমরা এই সময়ে দুআ না করে বরং খাবার পরিবেশন,কথাবার্তা ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ত থাকি। আমাদের চিন্তা করা উচিৎ কোনটা আমাদের দরকার- খাবার নাকি দুআ কবুল হওয়া ?
 

১৫. রোযা রাখা অথচ নামাজ না পরাঃ

সিয়াম পালনকারী কোন ব্যক্তি নামাজ না পরলে তার সিয়াম কবুল হয়না। রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)বলেছেন: “সালাত(নামাজ) হচ্ছে ঈমান এবং কুফর এর পার্থক্যকারী”। [মুসলিম]

আসলে শুধু সিয়াম নয়,সালাত(নামাজ) না পরলে কোন ইবাদতই কবুল হয়না।রাসুল(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)বলেন: “যে আসরের সালাত পরেনা, তার ভাল কাজসমূহ বাতিল হয়ে যায়।” [বুখারি]

১৬. রোযা রাখা অথচ হিজাব না পরা

মুসলিম নারীদের জন্য হিজাব না পরা কবীরা গুনাহ।

“ঈমানদার নারীদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে নত রাখে এবং তাদের যৌন অঙ্গের হেফাযত করে। তারা যেন যা সাধারণতঃ প্রকাশমান, তা ছাড়া তাদের সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে এবং তারা যেন তাদের মাথার ওড়না বক্ষ দেশে ফেলে রাখে এবং তারা যেন তাদের স্বামী, পিতা, শ্বশুর, পুত্র, স্বামীর পুত্র, ভ্রাতা, ভ্রাতুস্পুত্র, ভগ্নিপুত্র, স্ত্রীলোক অধিকারভুক্ত বাঁদী, যৌনকামনামুক্ত পুরুষ, ও বালক, যারা নারীদের গোপন অঙ্গ সম্পর্কে অজ্ঞ, তাদের ব্যতীত কারো আছে তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে, তারা যেন তাদের গোপন সাজ-সজ্জা প্রকাশ করার জন্য জোরে পদচারণা না করে। মুমিনগণ, তোমরা সবাই আল্লাহর সামনে তওবা কর, যাতে তোমরা সফলকাম হও।”  [আন-নুরঃ ৩১]

“হে নবী! আপনি আপনার পত্নীগণকে ও কন্যাগণকে এবং মুমিনদের স্ত্রীগণকে বলুন, তারা যেন তাদের চাদরের কিয়দংশ নিজেদের উপর টেনে নেয়। এতে তাদেরকে চেনা সহজ হবে। ফলে তাদেরকে উত্যক্ত করা হবে না। আল্লাহ ক্ষমাশীল পরম দয়ালু।” [আল-আহযাবঃ ৫৯]

সুতরাং রোযা রাখা অথচ হিজাব না পরা অবশ্যই সিয়াম পালনের পুরস্কার হতে দূরে সরিয়ে দেয় যদিও এটি সিয়াম ভঙ্গ করেনা।

১৭. পরীক্ষা কিংবা কর্মব্যস্ততার জন্য রোযা না রাখা

পরীক্ষা কিংবা কর্মব্যস্ততার কারণে রোযা না রাখা  শরীয়ত সম্মত নয়। সকালে পড়ালেখা করতে কষ্ট হলে রাতে করার সময় থাকে। আমাদের মনে রাখা উচিৎ যে পরীক্ষায় ভাল ফলাফল করার চেয়ে আল্লাহকে সন্তুষ্ট করাটাই আমাদের মূল লক্ষ্য।পড়ালেখা করার মধ্যে দিয়েও যদি আমরা সঠিকভাবে যদি আমরা রোযা রাখার মত ফরয কাজগুলো করার চেষ্টা করি, ইনশাআল্লাহ আল্লাহ আমাদের জন্য তা সহজ করে দিবেন এবং আমাদের সাহায্য করবেন।

আর যে আল্লাহকে ভয় করে, আল্লাহ তার জন্যে নিস্কৃতির পথ করে দেবেন।এবং তাকে তার ধারণাতীত জায়গা থেকে রিযিক দেবেন। যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর ভরসা করে তার জন্যে তিনিই যথেষ্ট। আল্লাহ তার কাজ পূর্ণ করবেন। আল্লাহ সবকিছুর জন্যে একটি পরিমাণ স্থির করে রেখেছেন। [আত-তালাকঃ ২-৩]

১৮. স্বাস্থ্য কমানোর উদ্দ্যেশ্যে রোযা রাখা

স্বাস্থ্য কমানোর জন্য রোযা রাখা উচিত নয়। এটি অন্যতম একটি বড় ভুল যা আমরা করে থাকি। সিয়াম পালন করার একমাত্র উদ্দ্যেশ্য হচ্ছে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। যদি স্বাস্থ্য কমানোর উদ্দ্যেশ্যে কেউ রোযা রাখে তাহলে তা শিরকের(ছোট শিরক বা শিরকুল আসগার) আকার ধারন করতে পারে।

১৯. তারাবীর নামাযের রাকাআত সংখ্যা নিয়ে মতবিরোধঃ

তারাবীর নামাযের কোন নির্দিষ্ট সংখ্যক রাকাআত নেই। আট এবং বিশ রাকাআত-এ দুটোই শরীয়ত সম্মত। শেখ ইবনে উথাইমিন বলেন,“এগারো কিংবা তেইশ রাকাআতের কোনটিকে নির্দিষ্ট করে অপরটি বাতিল করা অনুচিত।কারন বিষয়টি অনেক তাৎপর্যপূর্ণ,সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর।”

২০. নির্দিষ্টভাবে শুধু ২৭ রমযানের রাতকে লাইলাতুল ক্বাদর মনে করে ইবাদত করাঃ

আমরা অনেকেই কেবল ২৭ রমযান রাতে লাইলাতুল ক্বাদর পাওয়ার জন্য ইবাদত করে থাকি,কিন্তু অন্যান্য বিজোড় রাতগুলিকে প্রাধান্য দেইনা। অথচ রাসুল(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)বলেছেন,“রমযানের শেষ দশ রাত্রির বিজোড় রাতগুলিতে লাইলাতুল ক্বাদর তালাশ কর।”(বুখারি ও মুসলিম)

২১. ঈদের প্রস্তুতি নিতে গিয়ে রমযানের শেষাংশ অবহেলায় পালন করা

আমরা অনেকেই ঈদের প্রস্তুতি(নতুন কাপড় কেনা,খাবারের আয়োজন করা,মার্কেটে ঘোরাঘুরি করা)নিতে গিয়ে রমযানের শেষ দশ দিন অবহেলায় পালন করি(ঠিকমত ঈবাদত না করা এবং লাইলাতুল ক্বাদরের তালাশ না করা)। রাসুল(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)রমযানের শেষ দশ দিন আল্লাহর ইবাদতে খুব বেশি সময় নিমগ্ন থাকতেন,কেনাকাটি করায় ব্যস্ত থাকতেন না। রমযান শুরু হবার আগেই আমাদের কেনাকাটি শেষ করা উচিৎ।

 আয়শা (রা:)হতে বর্ণিত: “যখন রমযানের শেষ দশক শুরু হত রাসুল(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)লুঙ্গি শক্ত করে বাঁধতেন(অর্থাৎ ইবাদতে ব্যস্ত থাকতেন,স্ত্রীদের সাথে অন্তরঙ্গ হওয়া থেকে বিরত থাকতেন),রাত্রি জাগরণ করতেন এবং তাঁর পরিবারকে জাগিয়ে তুলতেন।” [বুখারী,মুসলিম]

২২. ইফতার পার্টির আয়োজন করা

যদিও অপরকে ইফতারি করানোতে সওয়াব আছে এবং এ কাজে উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে, তথাপি আমাদের অনেকেই মুখরোচক ইফতার পার্টির আয়োজন করে থাকেন,যেখানে হিজাববিহীন নারীদের আগমন থেকে শুরু করে অশ্লীল নাচ-গান, নারীপুরুষের অবাধ মেলামেশা,তারাবিহ এর নামাজ ছেঁড়ে দেওয়া- এ সবই হয়ে থাকে যেগুলো সম্পূর্ণভাবে ইসলামে নিষিদ্ধ।

রামাদান বিষয়ক সকল ফাইল – প্রবন্ধ, বই, অডিও/ভিডিও লেকচার ডাউনলোড করতে চাইলে এই লিঙ্ক এ ক্লিক করুন – রামাদান বিষয়ক সকল ফাইল – প্রবন্ধ, বই, অডিও/ভিডিও লেকচার

শরীরচর্চা [ আপনার অভ্যাস পরিবর্তন করুন ]

runing

লেখক: ড. খালিদ আবু শাদি | অনুবাদক: হাসান মাসরুর

১. আজকের আলোচ্য বিষয়ের ফায়দা

  • শক্তিশালী মুমিন দুর্বল মুমিনের চেয়ে আল্লাহর কাছে বেশি প্রিয় ও উত্তম।
  • হারানো যোগ্যতা ও সুস্থতা ফিরিয়ে আনা ৷
  • শারীরিক সুস্থতা অর্জন করা এবং স্থুলতাসহ নানা রকমের ব্যাধি থেকে মুক্তি লাভ করা।
  • সুস্থ শরীরের মাধ্যমে আল্লাহর ইবাদতে শক্তি অর্জনের নিয়ত থাকা।

২. কুরআনের আলো

আল্লাহ তাআলা বলেন: “তোমরা তাদের বিরুদ্ধে যতটা পারো শক্তি ও অশ্ববাহিনী প্রস্তুত রাখবে, যা দ্বারা আল্লাহর শত্রু ও তোমাদের শত্রুকে আতঙ্কিত রাখবে।” [সুরা আল-আনফাল, ৮: ৬০]

উকবা বিন আমির (রা:) এ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: ‘আমি রাসুল (সা:)-কে বলতে শুনেছি, তিনি মিম্বারে উঠে বললেন: “তোমরা তাদের বিরুদ্ধে যতটা পারো শক্তি অর্জন করো।’ নিশ্চয় শক্তি হলো নিক্ষেপণ; নিশ্চয় শক্তি হলো নিক্ষেপণ; নিশ্চয় শক্তি হলো নিক্ষেপণ।‘ [সহিহু মুসলিম: ১৯১৭]

৩. রাসুল (সা:)  আমাদের আদর্শ

রাসুল (সা:)-এর শারীরিক-বিন্যাস: কাজি ইয়াজ (রা:) তার আশ-শিফা গ্রন্থে রাসুল (সা:)-এর শারীরিক বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, ‘রাসুল ছিলেন উত্তম অবয়বের অধিকারী। তিনি বেশি লম্বাও ছিলেন না এবং একেবারে খাটোও ছিলেন না৷’

তাঁর চলার ধরন:

  • নবিজি (সা:)-এর চলার ধরন সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি এমনভাবে চলতেন, যেন কোনো উঁচু স্থান থেকে নিচে অবতরণ করছেন । এমনভাবে চলতেন, বোঝা যেত যে, তিনি অক্ষম কিংবা অলস নন। আবু হুরাইরা (রা:) বলেন: ‘আমি রাসুল -এর মতো দৃঢ় পদক্ষেপে দ্রুত চলতে কাউকে দেখিনি—যেন জমিনকে তাঁর জন্য গুটিয়ে দেওয়া হতো। তাঁর সাথে পথ চলতে আমাদের প্রাণান্তকর অবস্থা হতো, আর তিনি অনায়াসে চলে যেতেন।’ [সুনানুত তিরমিজি: ৩৬৪৮]
  • বদরের যুদ্ধে যাওয়ার পথে বাহন কম থাকায় পরিবর্তন করে করে সকলে বাহনে উঠতেন। নবিজি (সা:) আলি (রা:) ও আব্দুল্লাহ বিন রাওয়াহা (রা:)-এর জন্য একটি বাহন বরাদ্দ ছিল। তাঁদের দুজন হাঁটতেন আর একজন বাহনে চড়তেন। কিন্তু নবিজির সাথে থাকা দুজন খুব লজ্জা পাচ্ছিলেন যে, তাঁরা কীভাবে নবিজি (সা:)-এর সামনে বাহনে চড়ে যাবেন, আর তিনি হেঁটে হেঁটে গমন করবেন। কিন্তু নবিজি (সা:) নিজেই কেবল বাহনে চড়ে যাবেন এ বিষয়টি অস্বীকার করে বললেন: ‘তোমরা হাঁটার ক্ষেত্রে আমার চেয়ে বেশি সক্ষম নও এবং আমিও প্রতিদানের ক্ষেত্রে তোমাদের চেয়ে কম মুখাপেক্ষী নই।’
  • তিনি মক্কা থেকে তায়িফ পর্যন্ত পায়ে হেঁটে গিয়েছিলেন। কিন্তু সে সময় আজকের মতো এত পাকা ও প্রশস্ত রাস্তা ছিল না। সে সময় রাস্তাঘাট ছিল দুর্গম এবং পাহাড়-টিলায় পূর্ণ। অন্যভাবে বলা যায়, তিনি এই কঠিন রাস্তা অতিক্রম করে লক্ষ্যস্থলে পৌঁছেছেন।

৪. অমূল্য বাণী

আয়িশা (রা:) বলেন, ‘তোমরা ধার্মিকতা ও সাধনায় উমরের চেয়ে অগ্রগামী নও। তিনি যখন হাঁটতেন দ্রুত হাঁটতেন এবং যখন কথা বলতেন, তখন শুনিয়ে বলতেন এবং যখন প্রহার করতেন, তখন ব্যথিত করতেন।’

মূল্যবান ফায়দা

  • ব্রিটেনের এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে যে, ডাক-অফিসের যে সকল কর্মকর্তা হেঁটে হেঁটে দায়িত্ব পালন করে, তারা ওই সকল কর্মকর্তা থেকে অধিক সুস্থ, যারা তাদের অফিসে বসে কাজ করে থাকে।
  • বিশ্বে প্রতি বছর স্থূল দেহের কারণে গড় মৃতের সংখ্যা দুই মিলিয়ন ছয় লক্ষ মানুষ, যেখানে পারমাণবিক বোমায় আক্রান্ত সংখ্যা দুই লক্ষ ৬০ হাজারের চেয়ে কম।

৫. একটি চমৎকার কাহিনি

আবুল মুসবিহ আল-মিকরাই (রা:) বলেন, ‘একদা আমরা মালিক বিন আব্দুল্লাহ আল-খুসামি (রা:)-এর নেতৃত্বে রোমের কোনো একটি অঞ্চলে অভিযানের উদ্দেশে যাচ্ছিলাম। যখন মালিক বিন আব্দুল্লাহ জাবির বিন আব্দুল্লাহর কাছ দিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন জাবির (রা:) হেঁটে হেঁটে নিজের গাধাটিকে হাঁকিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন। মালিক (রা:) তাঁকে বললেন, “হে আবু আব্দুল্লাহ, আপনি বাহনে উঠুন, আল্লাহ তো আপনার জন্য বাহনের ব্যবস্থা করেছেন।” তখন জাবির (রা:) মালিক (রা:) কে বললেন, “আমি নিজের বাহন উপযোগী করে নেব। অন্যদের মুখাপেক্ষী হব না । আমি রাসুল (সা:)-কে বলতে শুনেছি: ‘যার দুই পা আল্লাহর পথে ধূলি ধূসরিত হবে, আল্লাহ তার জন্য জাহান্নাম হারাম করে দেবেন।‘ [সহিহুল বুখারি: ৯০৭]

জাবির (রা:) যখন যেতে যেতে এতটুকু দূরত্বে চলে গেলেন যে, তাঁর কাছে আওয়াজ পৌছানো যায়, তখন মালিক (রা:)  পুনরায় চিৎকার করে বললেন, “হে আবু আব্দুল্লাহ, আপনি বাহনে উঠুন, আল্লাহ তো আপনার জন্য বাহনের ব্যবস্থা করেছেন।” তখন জাবির (রা:) মালিক (রা:) কে বললেন, “আমি নিজের বাহন উপযোগী করে নেব। অন্যদের মুখাপেক্ষী হব না। আমি রাসুল (সা:) কে বলতে শুনেছি: ‘যার দুই পা আল্লাহর পথে ধূলি ধূসরিত হবে, আল্লাহ তার জন্য জাহান্নাম হারাম করে দেবেন।‘ [সহিহুল বুখারি: ৯০৭]

এই কথা শুনে একে একে বাহিনীর সকলে লাফিয়ে লাফিয়ে বাহনের ওপর থেকে নেমে পড়ল।’ বর্ণনাকারী বলেন, ‘ওই দিনের মতো এত অধিক মানুষ পায়ে হেঁটে যেতে আর দেখেনি।’

৬. রমাদানে শরীরচর্চা

আপনি প্রতিদিন পায়ে হেঁটে মসজিদে গমনের মাধ্যমে এক ঢিলে দুই পাখি শিকার করার মতো দুটি লাভ হবে। এক. আপনি মসজিদে পায়ে হেঁটে গমনের সাওয়াব অর্জন করবেন। দুই. শরীরচর্চার ফায়দা অর্জন হবে।

রাসুল (সা:) বলেন: আমি কি তোমাদেরকে এমন বিষয় জানিয়ে দেবো না, যার মাধ্যমে গুনাহসমূহ মিটে যাবে এবং মর্যাদাসমূহ বৃদ্ধি পাবে? (তা হলো) ‘কষ্ট সত্ত্বেও পূর্ণরূপে অজু করা, মসজিদের দিকে বেশি পরিমাণ কদম ফেলা, এক সালাতের পর অন্য সালাতের অপেক্ষা করা। আর এটিই হলো রিবাত, এটিই হলো রিবাত এবং এটিই হলো রিবাত।’ [সুনানুন নাসায়ি: ১৪৩, সুনানুত তিরমিজি: ৫১ ও ৫২]

বিশেষজ্ঞদের মতে, মানুষের জন্য পায়ে হাঁটার ব্যায়াম খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে যখন বয়স ৪০ পার হয়ে যায়, তখন তাদের জন্য এটি আরও জরুরি হয়ে পড়ে। পায়ে হাঁটার ফলে অনেক ব্যাধি থেকে বেঁচে থাকা যায়। বিশেষ করে, স্থূলতা, মাতলামি ও আত্মিক রোগ থেকে বাঁচা যায়। এই সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, ‘আত-তাফকির আল-ইবদায়ি’ কিতাবের লেখক টনি বুজান।

আমেরিকান গবেষকরা বিস্ময়কর ফলাফল বের করেছেন যে, হাঁটাচলার ফলে স্মৃতিশক্তি উদ্দীপ্ত হয় এবং মেধা ও চিন্তাশক্তি বৃদ্ধি পায়। বিশেষ করে যখন হাঁটাচলা হয় কোনো ফিকিরের সাথে।

অর্থাৎ আপনি হাঁটতে থাকবেন এবং সাথে সাথে আল্লাহ তাআলার সৃষ্টি ও তাঁর অফুরন্ত নিয়ামত নিয়ে চিন্তাভাবনা করবেন। আর এ ধরনের চিন্তাভাবনা মুমিন যখন মসজিদের দিকে রওয়ানা করে, তখনই বাস্তবায়িত হয়। বিশেষ করে ফজরের সালাতের সময় যখন মসজিদে গমন করে। এটি হলো এক ধরনের ফ্রি চিকিৎসা। সুতরাং আপনি বেশি বেশি মসজিদে গমন করুন এবং পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করুন; যেন আপনি পূর্ণ সুস্থ থাকতে পারেন।

৭. শরীরচর্চার সূর্য হারিয়ে গেছে

  • বর্তমানে মোটা ও স্থূলতার হার বেড়ে গেছে। মানুষ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ছে। যুবকরা বয়সের আগেই দুর্বল হয়ে পড়ছে। আপনি নিজের আশপাশের লোকদের দিকে তাকিয়ে দেখুন। স্থূল দেহের লোকদের হার কত? আপনি প্রতি দশজনের নয়জনকেই এমন পাবেন, যাদের ওজন যেমন থাকার দরকার ছিল, তা ছাড়িয়ে গেছে। এর ফলে হৃদয়ের ওপর চাপ পড়ে এবং শারীরিক দায়িত্বগুলো পালনে কষ্টের সম্মুখীন হতে হয় ৷ এতে আমাদের দুনিয়া ও আখিরাত উভয়টি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
  • পশ্চিমাবিশ্বে শরীরচর্চা তাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য এক অংশ। তারা প্রতিদিন সূর্যোদয়ের আগে কয়েক ঘণ্টা হাঁটাচলা করে। তারা ছোট- বড় সকলে মিলে এই ব্যায়াম করে থাকে। (এসব দিক থেকে) তারা আমাদেরকে ছাড়িয়ে গেছে, আর আমরা পশ্চাতে পড়ে আছি।

৮. দুআ

হে আল্লাহ, আমার শরীরকে আপনার আনুগত্যে, জবানকে আপনার জিকিরে, হৃদয়কে আপনার মহব্বতে শক্তিশালী করে দিন। আমি আপনার কাছে অলসদের মতো চলাফেরা এবং মুনাফিকদের মতো অলসতা থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি।

৯. স্বার্থপর হবেন না

  • কথাগুলো আপনার মসজিদের মুসল্লি ও আপনার সহপাঠী-সহকর্মীদের মাঝে আলোচনা করুন।
  • এই বইটি নিজে পাঠ করে অন্যদেরকেও পড়তে দিন; যেন তারা এর থেকে উপকৃত হতে পারে।
  • মসজিদের ইমামকেও বইটি হাদিয়া দিতে পারেন; যেন তিনি জুমআর খুতবা বা তারাবিহ-পরবর্তী আলোচনায় এর থেকে ফায়দা গ্রহণ করতে পারেন।

১০. যথেষ্ট কথা হয়েছে, এখন কাজ দেখার বিষয়

  • আমি মসজিদের দিকে বেশি বেশি কদম ফেলব এবং নিজের সাথে নিজের সন্তানদেরকেও নিয়ে যাব।
  • রোজা রেখে আমি পায়ে হেঁটে ব্যায়াম করব।
  • আমি নিজের দৈনন্দিন রুটিনের একটি অভ্যাস হিসেবে শরীরচর্চাকে গণনা করব। লিফট ব্যবহারের পরিবর্তে সিঁড়িতে ওঠানামা করব। কাছাকাছি কোথাও যেতে হলে গাড়ির পরিবর্তে পায়ে হেঁটে যাব।

উৎস: রমাদান-আত্মশুদ্ধির বিপ্লব, পৃষ্ঠা: ২১৪ – ২২১

সাবস্ক্রাইব করুন

2,018,267FansLike
1,685FollowersFollow
1,150FollowersFollow
6,143FollowersFollow
4,600SubscribersSubscribe